পরশু এগারোই সেপ্টেম্বর গিয়েছে। আমরা যারা সাত আর আটের দশকের পর (বা হয়তো তার আগেও যারা জন্মেছেন) জন্মেছি, তাঁদের অনেকের কাছেই এই দিনটার স্মৃতি মানে ২০০১ সালের সেই বুকে কাঁপ ধরানো ঘটনা। তখন সদ্য বাড়িতে টিভি এসেছে! কিন্তু এখনকার মতো চটজলদি ব্রেকিং নিউজ পাওয়া যেত না, টুইটার ট্রেন্ডও ছিল না, ফলে আমরা খবরটা জেনেছিলাম বেশ কয়েক ঘন্টা পর। সেই প্লেন উড়ে আসা আর তাসের পাতার মতো ধ্বসে পড়া দুটো বিল্ডিং...
এই সন্ত্রাসী আক্রমণ আর চারটে টেররিস্ট অ্যাটাক থেকে কীভাবে আলাদা তখন বুঝিনি, কিন্তু ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়ার দৃশ্যটা জীবনের মতো মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমরা কে কীভাবে প্রথম ৯/১১ এর সেই ফুটেজ দেখেছিলাম সেটা হয়তো আজ অনেকের স্পষ্টত মনে নেই, কিন্তু সাত সমুদ্দুর তেরো নদী দূরের সেই ঘটনা আমাদের সেই বয়সেও ভিতর থেকে নড়িয়ে দিয়েছিল, এই সত্যিটা অস্বীকার করার উপায়ও নেই।
এখন অবশ্য ৯/১১ নিয়ে আমরা গাদাগাদা সিনেমা ও সিরিজ দেখে ফেলেছি, নন-ফিকশন বইফইও পড়েছেন অনেকেই। এই ঘটনার পারিপার্শ্বিক ও পরিণাম নিয়ে অনেক কিছুই আজ জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও, একুশ বছর পরেও যে সত্যিটা সম্ভবত অনেকেই জানেন না, সেটা হল এই যে...এই ৯/১১ এর ঘটনার সূত্রপাত আসলে অন্য এক ৯/১১ এর ঘটনা দিয়ে। সে ঘটনা ঘটেছিল আরো আঠাশ বছর আগে....১৯৭৩ সালের এগারোই সেপ্টেম্বর। সেই দিনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাও ঠিক একইভাবে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল, বহু মানুষের মনে, তাদের জীবন বদলে গিয়েছিল বরাবরের মতো। সাল তারিখ আলাদা বটে, কিন্তু সার্ভাইভার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে গল্পটা এক। ঠিক কতটা এক, রজার বারবাকের এই ক'টা লাইন পড়লেই সেটা বোঝা যাবে।
On the morning of September 11, I watched aircraft flying overhead. Minutes later I heard explosions and saw fireballs of smoke fill the sky. As a result of these attacks thousands died, including two good friends.
ইতিহাসে ঢুকতে গেলে পাছে ফেসবুক পোস্ট এক লক্ষ শব্দের বই হয়ে যায়, তাই সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানানোর চেষ্টা করছি।
১৯৭০ সালে সালভাদর আইয়েন্দে নির্বাচনে জয়ী হয়ে চিলির রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা, কারণ আইয়েন্দে মোটামুটি বিত্তবান হলেও সোনার কাঠি মুখে নিয়ে জন্মাননি, সাধারণ সমাজকর্মী থেকে শুরু করে বামপন্থী রাজনীতির আইকন হয়ে উঠতে তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। পার্ফেক্ট নেতা তিনি ছিলেন না ঠিকই, দোষত্রুটিও ছিল কম নয়, তবে দেশের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর সততা ও 'ভিশন' জনতাকে আশার আলো দেখিয়েছিল।
মুশকিল হল আমেরিকার কাছে এই ঘটনা ছিল প্রায় চক্ষুশূলের সমান। তখন আমেরিকা আর রাশিয়ার মাঝে জোর স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তারপর ভিয়েতনামেও ঠিক তরজুত করতে পারছে না আমেরিকার সেনাবাহিনী। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রথম থেকেই ভয়ে ভয়ে ছিলেন চিলিকে নিয়ে। সালভাদর আইয়েন্দের মতো হিউম্যানিটারিয়ান নেতার হাতে সত্তা এলে চিলি ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বসবে, কয়েক বছর পর হয়তো কিউবা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মতো তারাও আমেরিকার বাড়া ভাতে ছাই দিতে প্রস্তুত থাকবে।
বলাবাহুল্য, এই ভয় ছিল অমূলক, কারণ আর যাই হোক, আইয়েন্দে সমসাময়িক বামপন্থী রাষ্ট্রনায়কদের মতো সশস্ত্র বিপ্লব করে নেতা হননি, নির্বাচনীয় গণতন্ত্রে তাঁর আস্থাও ছিল। চিলিতে সক্রিয় ডেমোক্রেসির দীর্ঘ লেগাসি আছে, ফলে সান টিয়াগো কোনোদিনই মস্কো হয়ে উঠত না। কিন্তু তখন আর ওইসব ভাবছে কে? রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পাশাপাশি সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিংগরও মনস্থির করে ফেলেছিলেন, আইয়েন্দেকে গদিতে থাকতে দেওয়া বিপজ্জনক।
ফলে দাবার চাল সাজানো হল নিঁখুতভাবে। সিআইএ কে কাজে লাগিয়ে আইয়েন্দের বিরোধী ও সেনাবাহিনীর জেনারেল অগাস্তো পিনোচের বিপ্লবী দলকে অস্ত্র ও অর্থের সাপ্লাই দেওয়াচলতে লাগল, পিনোচের কানে প্রয়োজনীয় ফুসমন্তরও দেওয়া হল পাশাপাশি। তিয়াত্তর সাল আসতে আসতে আইয়েন্দের বিরুদ্ধে মিলিটারি ক্যুপের সমস্ত পরিকল্পনা খাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। তবে গোটা ব্যাপারটাই করা হল অসম্ভব সতর্কতায়, (আমেরিকা অন্য দেশের অন্তরীণ মামলায় মাথা গলায় না সে তো সবাই জানে। হুঁ হুঁ বাবা)সিআইএ-এর নাম যাতে না জড়ায় সে নিয়ে প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন হেনরি কিসিংগর।
এইখানে বলে রাখা দরকার যে এই কিসিংগর বাবু মার্কিন রাজনীতির এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র৷ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ইনি পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন, লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে যুদ্ধ বাধানোর পেছনেও কিসিংগরের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল, আবার অন্যদিকে ইনিই ভিয়েতনাম যুদ্ধে সিজফায়ার করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, দরকারে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক বহাল করতেও পেছপা হননি। বিক্ষোভ ও বিতর্ককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে কিসিংগর এমন ভাবে সামনে এগিয়ে গিয়েছেন, যেন 'হাউস অফ কার্ডস'-এর ফ্র্যাঙ্ক আন্ডারউড। এমনকি তাঁকে নোবেল পিস প্রাইজও দেওয়া হয়েছিল। সে অন্য গল্প।
যাই হোক, আইয়েন্দেকে গদিচ্যুত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখকেই। চিলিয়ান মিলিটারির পক্ষ থেকে যখন আক্রমণ শুরু হয়, আইয়েন্দেকে পালাতে বলা হয়েছিল। তিনি পালাননি। এদিকে সাধারণ মানুষ এই কাণ্ড দেখে এমন বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল যে বলার নয়! দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে মিলিটারি ক্যুপ হলে সাধারণত জনতার একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকে, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছিল মিলিটারিরা জনতাকেও দোষী মনে করছে আইয়েন্দেকে ভোট দেওয়ার জন্য। মিলিটারির পক্ষ থেকে তাদের বন্ধক করে রাখা হয়েছিল নানা জায়গায়, বাচ্চাদেরও ছাড়া হয়নি। গোটা শহরে বোমাবাজি আর গুলিগোলা চলছে, লড়াকু প্লেন উড়ে যাচ্ছে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের উদ্দেশে, দেশের অন্যান্য জায়গাতেও প্রায় একই অবস্থা।
আইয়েন্দের সরকার এই ঝড় সামলাতে পারার মতো অবস্থায় ছিল না। সরকার পড়ে যায়, আর সালভাদর আইয়েন্দেকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই পিনোচে চিলির স্বৈরশাসক হয়ে বসেন। তাঁর নির্দেশে তাঁর বিরোধীদের কচুকাটা করা হয় সারা দেশ জুড়ে। পিনোচের এই স্বৈরাচার বজায় থেকেছে কয়েক দশক জুড়ে। হাজার হাজার লেখক, শিল্পী, সমাজকর্মী ও সাধারণ মানুষকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল এ সময়, তাঁদের মধ্যে জনপ্রিয় লেখিকা ইসাবেলে আইয়েন্দেও ছিলেন।
সিআইএ আর কিসিংগর অবশ্য খোশমেজাজে ছিলেন। তারা যা চেয়েছিলেন, তাই হয়েছে। এই দেশে আর বামপন্থীরা কব্জা করতে পারবে না, শত্রুতা করার লোকও পাওয়া যাবে না। বেচারা সিআইএ জানত না, তারা খাল কেটে কুমিরকে ডেকে এনেছেন। এই কুমির এইবার তাদেরকেই তেড়ে আসবে। অবশ্য এই কাজে সিআইএ-এর সুপ্রিমেসিকে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। খাল কেটে কুমির আনায় তারা বেস্ট।
জেনারেল পিনোচে কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু বিরোধীদের মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি, তা সে দেশে হোক অথবা বিদেশে। তাই বিরোধীদের দমন করার জন্য তিনি চিলিয়ান সিক্রেট পুলিশ এর গঠন করেছিলেন। এই সিক্রেট পুলিশ ছিল জার্মানির গেস্টাপোর মতোই, কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল আরো বিস্তৃত। চিলিয়ান সিক্রেট পুলিশের আভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক শুধু দেশ নয়, গোটা দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়াও ভাড়াটে গুণ্ডাদের নিয়ে বিভিন্ন গোপন সংগঠন তৈরি করেছিল তারা, যারা অর্থের বিনিময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অপারেশন চালাত। পরবর্তী কালে অন্যান্য দেশের মিলিটারি ডিক্টেটররাও এদের সাহায্য নিতে থাকে। (ওই অমুক দেশে অমুক রাজনেতা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, মার ব্যাটাকে! লেঠেলদের খবর দে দিকি! মোটামুটি এই অ্যাটিটিউড)
মজার কথা হল সিআইএ এই সিক্রেট অরগ্যানাইজেশনদের প্রথম থেকেই মদদ দিয়ে এসেছে, ডেথ স্কোয়াডদের টাকা দিয়ে পুষেছে, লাতিন আমেরিকার নানা দেশে অনৈতিক ভাবে গঠিন 'হুন্তা' সরকারের প্রতিও নিক্সন-কিসিংগর জুটি প্রথম থেকেই 'সফট' ছিল। খেলা ঘুরল তখন, যখন ১৯৭৬ সালের ২৬-এ সেপ্টেম্বর খোদ ওয়াশিংটনে হামলা করে বসল চিলি সিক্রেট পুলিশের ডেনা এজেন্টরা। হোয়াইট হাউস থেকে কয়েক ব্লক দূরে একটা গাড়িতে ভীষণ বিষ্ফোরণ হল, মারা গেলেন জনপ্রিয় নেতা ওরল্যান্দো লাতেলিয়ার আর রনি মফিট। এরা দুজনেই জেনারেল পিনোচের তীব্র আলোচক ছিলেন, আন্তর্জাতিক ফোরামে বেশ কয়েকবার পিনোচের কর্মপদ্ধতির গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়েছিলেন আগে। স্বভাবতই সন্দেহের তার ঘুরল চিলির দিকে।
আমেরিকার একটা ভালো দিক হল, যতই ডেমোক্রেটিক সিস্টেমে কোরাপশন থাক না কেন, ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্ক ব্যাপারটা অসম্ভব মজবুত। ইনভেস্টিগেশন একবার শুরু হলে রাজা মন্ত্রী কোটাল, সবার বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ে। এইবারও তার অন্যথা হল না। জানা গেল এই বিষ্ফোরণের পিছনে হাত আছে ইন্টারন্যাশনাল টেরারিস্ট অর্গ্যানাইজেশন অপারেশন কন্ডরের।
ইন্টারন্যাশনাল টেরারিস্ট অর্গ্যানাইজেশন?
সেটা আবার কী বস্তু?
পঞ্চাশ বছর আগের কথা, তখন এরকম সন্ত্রাসী সংগঠন সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানত না। তদন্ত এগোলে জানা গেল এই কন্ডর জ্যাঠারা আর কেউ নয়, পিনোচের চিলিয়ান সিক্রেট পুলিশের হাতে গড়ে ওঠা সেই নেটওয়ার্ক, যাদের পলিটিকাল অপোনেন্টদের খতম করার জন্য ব্যবহার করা হত। ক্রমে তারা স্বাধীন সংগঠন হয়ে চিলি থেকে বলিভিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা হয়ে গোটা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়াতেও পরিধি বিস্তার করেছে। আরো জানা গেল যে এদের সঙ্গে সিআইএ এর বেশ কিছু ট্রাঞ্জ্যাকশন হয়েছে আগে, সে সবের প্রমাণও আছে।
ব্যস! আর যায় কোথায়! সাপের নিশ্বাস ঘাড়ে পড়তেই সকলের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কিসিংগর নিজে অসম্ভব ধড়িবাজ ছিলেন, তিনি অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে বেঁচে গেলেন এ যাত্রায়। কিন্তু মুশকিলে পড়ে গেল হোয়াইট হাউস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেনেট কমিটির সামনে যা হোক করে মান ইজ্জত বাঁচানো হল বটে, কিন্তু সিআইএ-এর হাত থেকে ব্যাপারটার পুরো কন্ট্রোল সরিয়ে নেওয়া হল। সে নিয়ে খবরের কাগজে লাফালাফি চলল কয়েকদিন। এদিকে অপারেশন কন্ডরের রোগ এজেন্টরা সারা দুনিয়ায় গিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে নিজস্ব সংগঠন খুলে বসল। ক্রমে তাদের কথা সবাই ভুলেই গেল।
সময় কাটতে লাগল। আটের দশকের শেষের দিক। তখন আমেরিকা আফগানিস্তান নিয়ে পড়েছে। সোভিয়েতদের উৎখাত করতে লোকাল মিলিশিয়া আর মুজাহিদিনদের অস্ত্র আর ট্রেনিং দিয়ে পুষছে। উদ্দেশ্য সোভিয়েত সমর্থিত সরকারকে সরিয়ে একটা পাপেট গভার্নমেন্ট বসানো। ঠিক যে কাজটা তারা একসময় চিলিতে করেছিল। এইসময়েই এক ছোকরা এসে সে যুদ্ধে ঢুকে পড়ল, ভবিষ্যতে যাকে লোকে ওসামা বিন লাদেন বলে চিনবে। এই গোটা আশি আর নব্বইয়ে আমেরিকার প্রসাশনিক ব্যর্থতা আর সিআইএ এর বোকামি কীভাবে দুনিয়া জুড়ে ইসলামিক মিলিটেন্সিকে জন্ম দিয়েছিল সেটা আজ সবাই জানে, যেটা জানে না সেটা হল আল কায়দা যখন মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে প্রভাব বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে কয়েকজন মানুষ। আলাদা করে তাদের পরিচয় জানা যায়নি তখন, কিন্তু এরা প্রত্যেকেই সিআইএ আর আমেরিকার প্রভাবশালী নেতাদের সম্পর্কে ছিলেন, তারা ধীরে ধীরে অর্থ ও পলিটিকাল অ্যাসাসিনেশনের বিনিময়ে বিন লাদেনের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে থাকেন। ১৯৯৫ সালে যখন বুশ আর ক্লিন্টন পরস্পরকে দোষারোপ করছেন, তখন বিন লাদেন চুপিচুপি আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ার ইন্টেলিজেন্সকে বোকা বানানোর পরিকল্পনা করে চলেছেন। এর ছয় বছর পর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী আক্রমণ হয় আর গোটা দুনিয়ার স্বরূপই পাল্টে যায় বরাবরের মতো। একদিকে যুদ্ধ, সন্ত্রাস আর রাজনীতি চলতে থাকে, একদিকে আবছা হয়ে আসা সূত্রগুলো নিয়ে ইনভেস্টিগেশন চলতে থাকে সরকারি বেসরকারি মহলে।
২০০১ সালের ৯/১১ এর ঘটনার প্রায় বছর দশেক পর পোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়, আমেরিকায় আল কায়দার মাটি শক্ত করার কাজটা প্রধানত করা হয়েছিল অপারেশন কন্ডারের এজেন্টদের মাধ্যমেই। এদের মধ্যে অনেকেই আসলে পিনোচে সরকারের চিলিয়ান সিক্রেট পুলিশের সেই সমস্ত আধিকারিক, যারা গোপনে সিআইএ-এর সঙ্গে ষড় করে একের পর এক অপারেশন করেছে সে যুগে। নিকারাগুয়া থেকে মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে থেকে প্যারিস, সর্বত্র এদের কাজে লাগানো হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ওয়াশিংটনের সেই ঘটনার পর তারা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছিল, কিন্তু তলায় তলায় সক্রিয় ছিল ঠিকই। সন্ত্রাসী সংগঠনের পরিভাষা ততদিনে বদলে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে অস্ত্র ও অর্থের প্রয়োজনও। পুরোনো কন্ট্যাক্টকে কাজে লাগিয়ে অপারেশন কন্ডারের অনেকেই ততদিনে হাই এন্ড বিজনেসম্যান হয়ে উঠেছে, গোটা দুনিয়ায় রেজিম চেঞ্জের জন্য তাদের মদদ নেওয়া হয়, তাছাড়া নার্কোটিক্স, অস্ত্র আর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের বেআইনি ব্যবসাও তাদের হাতের মুঠোয়। ফলে বিন লাদেনকে বিশেষ কিছু করতেও হয়নি।
এই সংক্রান্ত ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস আগেও বেশ কয়েকবার সামনে এসেছিল, কিন্তু তখনও ৯/১১ এর ঘটনাটা হয়নি। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে উইকিলিকস সহ অন্যান্য হুইসলব্লোয়াররা সিআইএ আর হোয়াইট হাউস প্রসাশনের হাজার হাজার ডকুমেন্টস লিক করেছে, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ২০০১ সালের ৯/১১ এর ঘটনার ভিত তৈরি হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৯/১১ এর ঘটনা থেকেই। গার্ডিয়ান আর নিউইয়র্ক টাইমস বাদেও অনেক বিশ্বাসযোগ্য সংবাদপত্রে ইন ডেপথ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, বইও লেখা হয়েছে একাধিক।
ওই যে বলে, হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ। সরকার ও সংগঠন একই ভুল করে যায় বার বার, আর তার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। ১৯৭৩ সালের সেই ঘটনার ফলে চিলিতে যে রিপ্রেশন শুরু হয়েছিল, তাতে তিন হাজারের বেশি মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষ নিঁখোজ হয়েছেন, আর দেশছাড়া যে কত লক্ষ মানুষ হয়েছেন তার ঠিকঠাক তথ্য কারো কাছেই নেই। আর ৯/১১ এর সময় কতজন মারা গিয়েছেন সেটা তো সকলেই জানে। এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনার পরিণামস্বরূপ যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সে কথাও মনে রাখতে হবে। সত্যি বলতে ২০০১ সালে ৯/১১ এর পর যত যুদ্ধ হয়েছে, সবগুলোর তার কোথাও না কোথাও গিয়ে এই দুটো ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না, কারো কিছু আসেযায়ও না। আমরা একই ভুল বারবার করব বলে তৈরি হয়েই আছি।
যাই হোক, এ ব্যাপারে আরো বিশদে জানতে হলে এই বইটা পড়তে পারেন।
Chile 1973. The Other 9/11: The Downfall of Salvador Allende
David Francois
প্রকাশক- হেলিওন অ্যান্ড কোম্পানি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন