বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

দশমীর ছবি

 


আজ দশমী। আজকের দিনে একজন বাঙালি ঠিক কী ভাবে, সেটা অন্যদের পক্ষে বোঝা কিছুটা কঠিন। শুধুমাত্র একটা লেখা, একটা গান, একটা কবিতা বা একটা ছবি দিয়ে সেই ইমোশনটা বোঝানো অসম্ভব বললে খুব একটা ভুল হয় না। কিন্তু তাও, আমাদের চোখের সামনেই এমন একটা শিল্পকর্ম আছে, যা এই দিনটার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব, সংস্কৃতি, আমেজকে একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে এনেছে। শুধু তুলেই আনেনি, লক্ষ লক্ষ বাঙালির বুকে বিদ্যমান সেই আবহমান ভাবকে চিরকালের মতো জীবন্ত করে রেখেছে একটা অনবদ্য ছবিতে, যে ছবিটা মাঝেমধ্যে আমরা স্বপ্নেও দেখে থাকি। শুধু একটা ছবি। তাই দিয়েই যা বলার বলে দিয়েছেন শিল্পী। তবে আমি নয়, সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় চিত্রকর আর আর্ট ক্রিটিকরা এই কথা বলেছেন। একশো বছর আগে তো বটেই, সমসাময়িক কালেও কোনও একটা শিল্পকর্ম এভাবে বাঙালি সমাজের এই উৎসবের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি।

ছবিটা সম্ভবত প্রত্যেকেই দেখেছেন। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা এই ছবিটির নাম 'প্রতিমা বিসর্জন'। ছবিটা দুর্গাপুজো সিরিজের অন্যান্য ছবিদের সঙ্গে আঁকা হয়েছিল, সম্ভবত ১৯১৫ থেকে ১৯২০ সালের মাঝে কোনো একটা সময়। কিন্তু এই ছবির কিছু নিজস্বতা আছে, যা অন্যান্য ছবিতে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী সেই বিশেষত্ব, সেটা বলা আমার মতো আনাড়ির পক্ষে খুবই মুশকিল। সময়সাধ্যও বটে। কিন্তু যে ঘটনার ফলে ব্যাপারটা নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, সেটা বরং আগে জানাই।

২০১৭ সালে আমি লন্ডনে মাসখানেক সময় কাটিয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাস, বাইরে কনকনে হাওয়া চলছে, তাই খালি সময়ের বেশিরভাগটাই কাটত কোনো না কোনো মিউজিয়ামে। ব্রিটেনের ভালো ব্যাপার হল, পাবলিক মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারিগুলোয় টিকিট ফিকিট লাগে না, উপরন্তু বিনিপয়সায় দারুণ দারুণ আর্ট ওয়াক করা যায় কিংবা সেমিনার শোনার সুযোগ হয়। তা এত এত মিউজিয়ামের মধ্যে যে মিউজিয়ামটা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল, সেটা হল টেট মডার্ন। খুব স্বাভাবিকভাবেই মডার্ন আর্ট সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু এই একমাসে টেট মডার্নে আমি এতগুলো ওয়াক আর আর্ট অ্যাপ্রিশিয়েশনের ক্লাস করে ফেললাম যে যাদুঘরের লোকজনও আমাকে চিনে গিয়েছিল। যারা আমাদের ক্লাস নিত, তাঁরা প্রত্যেকেই আর্ট হিস্টোরিয়ান বা ফাইন আর্টসের শিক্ষক, অনেকে নিজেরাও ছিলেন খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী।

তা একদিন কথায় কথায় টেট মডার্নে এক বছর আগে আয়োজিত ভুপেন খাক্কার একজিবিশন এর কথা উঠল, সেখান থেকে কথা গড়াল ভারতীয় আর্ট এর ইতিহাসের দিকে। আমাদের যে ভদ্রলোক পড়াচ্ছিলেন, তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, "ভারতবর্ষের অনেক শিল্পীদের কাজই দেখেছি, অনেকের কাজ খুবই ভালো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু গগনেন্দ্রনাথ ট্যাগোরের মতো ভিসানারি আর্টিস্ট সম্ভবত আর একজনও আসেননি। আমাদের রিসার্চ কিউরেটর নাদা রাজা তো ওকে নিয়ে প্রায় একটা গবেষণা পত্রই লিখে ফেলেছে। তুমি যখন কলকাতায় যাও মাঝেমধ্যে, তুমি নিশ্চয়ই ওর পেইন্টিংগুলো দেখেছ? বিশেষ করে ১৯১৫ সালের পর যেগুলো এঁকেছিলেন?"

লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল প্রায়। ছবি দেখা তো দূর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই 'দক্ষিণের বারান্দা'-তে তাঁর সম্পর্কে দু একটা ঘটনার উল্লেখ আছে মনে হয়, আর ভারতীয় মডার্ন আর্টের সূত্রপাতও নাকি তাঁর হাত ধরে হয়েছিল... এইটুকুই আমার সম্বল ছিল। তবে আর্ট সম্পর্কিত আলোচনাতেও তাঁর লেখা নিয়ে বিশেষ শুনিনি। ইনিয়েবিনিয়ে সে কথা বলতেই ভদ্রলোক একেবারে উত্তেজিত হয়ে লাফাতে লাফাতে বললেন, "সে কী হে? হি ওয়াজ আ জিনিয়াস! কার্টুনিস্ট, স্যাটায়ারিস্ট, পেইন্টার! লোকটা কী করে গেছে জানো? রঙ আর তুলি দিয়ে গান রচনা করেছিল, আলো আঁধারির রিপ্রেজেন্টেশন দিয়ে সুরের কম্পোজিশন করেছিল, ক্যানভাসের ওপর রঙ দিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারত ট্যাগোর। দুর্গাপুজো নিয়ে ওর সিরিজটাও দেখোনি তুমি? ওয়েস্টার্ন কিউবিস্ট এক্সপ্রেশনের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির আবহমান মুল্যবোধকে এভাবে কেউ ব্লেন্ড করতে পারেনি হে! স্টেলা ক্রামরিখ, আমাদের একজন আমেরিকান বন্ধু, ভারতীয় আর্ট নিয়ে রিসার্চ করছে, ওই ছবিটা দেখে আমি ওকে কাঁদতে দেখেছি।"

আমি ব্যাজার মুখে জানালাম আমি এসব কিছুই জানি না। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের পত্তন করেছিলেন বলে শুনেছি, কিন্তু গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে খুব একটা হইচই নেই ভারতীয় বা বাঙালি সমাজে। ইংরেজদের থাকার সময়েও তিনি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে দিতেন তাদের মুখের ওপর, রাখঢাকও ছিল না। কেউ তাঁকে খুব একটা পছন্দও করত না। এক্ষেত্রে বড় বা ছোট ভাইয়ের প্রতিভা আর জনপ্রিয়তার আড়ালে তাঁর চলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

ভদ্রলোক হতাশ হয়ে বলেছিলেন, "এই বছরই তো তাঁর একশো পঞ্চাশতম জন্মদিন, সরকার তাঁর কাজ নিয়ে কোনো প্রদর্শনী করছে না?"

আমার জানা ছিল না সেটা। কিন্তু এই সূত্রে আলাপ গভীর হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে, পরে তিনি গগনেন্দ্রনাথের অনেক ছবিই দেখিয়েছিলেন আমাকে, বুঝিয়েছিলেন এক একটা তুলির মুভমেন্টের আড়ালে থাকা ম্যাজিক। তুলির আঁচড়ের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত সব গল্প। সে সব আর পুরোপুরি মনেও নেই।

গগনেন্দ্রনাথ সম্পর্কেও কিছু কিছু জানা হল পরে। ছবি আঁকার হাত প্রথম থেকে থাকলেও তিনি সে নিয়ে সিরিয়াস হন ছেলের মৃত্যুর পর। সম্ভবত ব্যাপারটা তাঁকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি রঙ তুলি ক্যানভাসের কাছে আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েরা এরকম কিছু হলে কলমের কাছেই ফিরে ফিরে যেত, কিন্তু গগনেন্দ্রনাথের কলম ছিল তুলি। তাঁর কাজকে মোটামুটি তিনটে সময়ে ভাগ করা হয়।

ফার্স্ট ফেজ (১৯০৫-১৯১১) সে সময়ে প্রধানত ল্যান্ডস্কেপই এঁকেছেন তিনি। এই দশকের শেষ দিকেই তাঁর ছেলের দেহাবসান হয়। গগনেন্দ্রনাথের শিল্পী জীবনের মোড়ও ঘুরে যায়।

সেকেন্ড ফেজ (১৯১১-১৯১৫) চৈতন্য সিরিজের অধিকাংশ ছবি এই সময়েই আঁকা।

বিচিত্র যুগ ( ১৯১১-১৯২১) এই সময়ে কিউবিজম সহ অন্যান্য আর্ট স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। অসামান্য সব ছবি এঁকেছেন এ সময়ে, সে ছবিতে উদ্ভাবনী ক্ষমতাও ছিল দেখার মতো।

লাস্ট ফেজ (১৯২৫-১৯৩০) শেষ জীবনে এই শিল্পী পোস্ট কিউবিস্ট ধারার ছবি এঁকেছেন বেশি, অন্যান্য ছবিও আছে অবশ্য। 'স্বর্ণপুরী', 'সাত ভাই চম্পা', 'সিটি ইন দ্য নাইট', 'হাউস অফ ডেড', 'বেড অফ অ্যারোজ' তাঁর বহু প্রশংসিত ছবিগুলোর কয়েকটা।

দুঃখের কথা হল, সরকারের পক্ষ থেকে গগনেন্দ্রনাথের ছবি সংরক্ষণ করার কোনো প্রচেষ্টা হয়েছে বলে মনে হয় না। শান্তিনিকেতন আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কিছু ছবি পড়ে আছে, অনেক ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে। একশো পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতেও তেমন কিছু করা হয়নি, একটা ভালো প্রদর্শনী অবধি হয়নি, তবে 'বসে আঁকো' প্রতিযোগিতা হয়েছিল তাঁর নামে। এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে শিল্প জগতের দীর্ঘশ্বাস উঠেছিল, দেশি বিদেশি আর্ট হিস্টোরিয়ান আর আর্ট ক্রিটিকরা প্রতিবাদও করেছিলেন। মনে আছে 'দ্য ওয়ায়্যার' একটা প্রতিবেদনও প্রকাশিত করেছিল এ নিয়ে। ওইটুকুই। লাভ হয়নি কিছুই। অন্যান্য অনেকের মতোই গগনেন্দ্রনাথের শিল্পী জীবনকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, ভাগ্যে ছিল বলে তাঁর কিছু ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল, রিপ্রোডাকশান হলেও তাতে যত্নের অভাব ছিল না। সব এক সে বড়কর এক।

কিন্তু নিঃসন্দেহে, প্রতিমা বিসর্জনের মতো মুগ্ধতার আবেশ আর কোনো ছবিতেই খুঁজে পাইনি। একটু খুঁটিয়ে দেখুন ছবিটাকে। সামনের দিকে দোতলা জানলায় দাঁড়ানো দুই স্ত্রীলোক, একজনের পরনে ফিরোজা, অন্যের পরনে লাল শাড়ি, এই দুজন আর্টের ইতিহাসে অমর হয়ে গিয়েছে। এরা আসলে শুধুই শোভাযাত্রার দর্শক মাত্র নয়, এদের কসমিক অবজার্ভার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুজো আসে, পুজো যায়, আর এই সাইকেলটা নীরবে দেখে চলে এক সেন্টিয়েন্ট এনটিটি। তারা কারা? তারা আসলে আমরাই। মুখ বদলে যায়, প্রজন্ম বদলে যায়, কিন্তু দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় বুকের ভেতরের সেই টনটনে ভাবটা একই থাকে।

এইবার শোভাযাত্রার সামনের দিকে চলুন। প্রতিমাকে ঘিরে রাখা সোনালি রঙের আলোকে আরো জৌলুশময় করে তুলেছে কয়েকটা মশাল। সেই মশালের শিখায় তুলির রক্তাভ বোল্ড মুভমেন্ট দেখে কী মনে হচ্ছে? শুধুই মশাল? না মশালটা অন্য কিছুর প্রতীক? অশুভের পরাজয় বা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন? বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে একটু পিছন দিকে খেয়াল করুন। সারি সারি কালো ছায়ার মধ্যে বোঝা যায় প্রায় সকলেই পুরুষ, কিন্তু মিছিলের মাঝে একজন লাল শাড়ি পরিহিতা মহিলাও উপস্থিত। ইনি কে? অবাক হতে হয়। অনেকের মতে ইনিই হলেন আসলে মা দুর্গা! প্রতিমায় নয়, মা থাকেন জনসাধারণের মধ্যেই। গুজব কিন্তু নয়। শিল্পীর ব্যাকগ্রাউন্ডটা ঠাকুরবাড়ির, একটু ভেবে দেখলেই সেটা বুঝবেন। ব্যতিক্রমী চিন্তা নয় কি?

গোটা ছবি জুড়ে একটা নীলচে আলো আর ধূসর পরিবেশ খেলা করছে, সামনের সোনালি আলোর আড়ালে যা শত শত মানুষের মনের ভাবকে প্রতিফলিত করছে। একই কারণে বিসর্জনে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ছায়ামূর্তির ন্যায় আঁকা হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি এ-ও দেখা যায় লাল সিঁদুর উড়ছে গলির মুখে! দ্য কন্ট্রাস্ট রিফেলেক্টস দ্য হোপ! ওই যে! আসছে বছর আবার হবে, হোক সিঁদুরখেলা! এরকম হাজারটা আর্টিস্টিক ডিটেল আছে এই ছবিতে, কিন্তু যে কথাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, ছবিটার যে সমস্ত জায়গায় কিছুই দেখার নেই, সেখানেও কিছু না কিছু আছে। গোটা ছবিটাই আসলে মনের ভিতর একটা অডিও ভিস্যুয়াল ইমোশন তৈরি করে, যা স্পেস আর টাইমের ঊর্ধ্বে গিয়ে একই রয়ে গেছে। এই 'পাসিং অফ টাইম' মেজাজ একটা ছবিতে তুলে ধরতে ওস্তাদ ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। সত্যি বলতে, এই আবহমান শৈল্পিকতাটাই এই ছবিটার সবচেয়ে বড় সম্পদ।

আজ, এই ছবিটার মাধ্যমেই সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালাম। সবাই ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন।

শুভ বিজয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন