বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

বেকশিনস্কির দুনিয়ায়

 


জার্নালের পাতা উল্টে দেখলাম, এগারো বছর আগে আজকের দিনে এম টিভি আনপ্লাগড-এ ইন্ডিয়ান ওশান আর রঞ্জিত বারোটের অসামান্য জুগলবন্দিতে 'মা রেওয়া' গানটা শুনে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ইউটিউবে সেই ভিডিওটা খুঁজে পেলাম না, কিন্তু মনে পড়ে গেল সে সময়ের এম টিভির কথা। এক একটা প্রোগ্রাম হত বটে! কোক স্টুডিওর প্রথম কয়েকটা সিজন, আনপ্লাগড, রুটস, সাউন্ড ট্রিপিং... সে সব এখন কোথায়? কয়েকদিনের মধ্যেই সব বন্ধ হয়ে স্প্লিটসভিলা মার্কা ছ্যাবলামি শুরু হয়েছিল, সেই নিয়েই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে! আজকাল অবশ্য গান জিনিসটাই অদৃশ্য হতে চলেছে মেনস্ট্রিম থেকে। শেষ কবে একটা গোটা ভালো অ্যালবাম শুনেছি মনে করলে সেই অমিত ত্রিবেদীর একটা না একটা কাজ মনে পড়ে! ইন্ডি ব্যান্ডরাও প্রচার পায় না। শান্তনু মৈত্র 'সঙস অফ দ্য রিভার' ডকুর জন্য কিছু অসামান্য গান কম্পোজ করেছেন, কোলাবরেট করেছেন মাটিবানি, মোহিত চওহান, তাবা চেকে, বম্বে জয়শ্রী, কৌশিকী চক্রবর্তী প্রভৃতির সঙ্গে, সে সব গান কেউ শুনছেও না। ট্রেন্ডিং মিউজিকের লিস্টে যে সমস্ত গান দেখি, ভয়ে দাঁতকপাটি লেগে যায়! অথচ বছর আটেক আগেও বাংলা হিন্দি ইন্ডি সিনে প্রচুর ভালো গান রিলিজ করত, প্রচারও পেত।
জীবনের একটা বড় সময়--যার সূত্রপাত প্রাক কৈশোরাবস্থাতেই হয়েছিল বলে আমার ধারণা-- আমি নিবিড়ভাবে গানবাজনা ফলো করেছি। প্রথম প্রেম অতি অবশ্যই হিন্দি সিনেমার গান (তার একটা প্রধান কারণ ছিল আমার বাবার রেডিও প্রীতি, ছায়াগীত আর আপকি ফরমাইশ আর সেই সব গানের কমেন্ট্রি শুনে আমার সে যুগের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সাতকাহন জানা হয়ে গিয়েছিল) আর পুরোনো নতুনের বিচারও ছিল না। হাজার খানেক গান আমার কন্ঠস্থ ছিল, এখনও আছে কিছু, আর খুব একটা বেসুরোও গাই না মনে হয়। যাই হোক, ধীরে ধীরে এই তালিকায় ঢুকে পড়ে অন্যান্য ঘরানার গীত সঙ্গীতও। ক্লাসিকাল ফ্লাসিকাল আমি খুব একটা বুঝতে পারি তা নয়, কিন্তু বেনারসে থাকাকালীন আমি ফি বছর সঙ্গীত ফেস্টিভ্যালে গিয়েছি, নেশাগ্রস্তের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনেছি। ধ্রুপদ খেয়াল ঠুমরি কীর্তন তো কিছুই নয়, একসময় আমি ছয় আট মাস হন্য হয়ে জ্যাজ আর ব্লুজ নিয়ে পড়েছিলাম। একেবারে জিমি রাশিং চার্লি পার্কার ডিউক এলিংটন গুলে খাচ্ছি তখন, ব্লুজ-র্যাগটাইম-স্পিরিচুয়ালস নিয়ে রিসার্চ পেপার নামিয়ে দিতে পারি ইচ্ছে করলে.. সন্দেহ নেই, বেনারস ছাড়া অন্য কোনো শহরে বড় হলে এসব পাগলামির জায়গা থাকত না। সে অন্য কথা, থাকগে! কথা হচ্ছিল গান নিয়ে।
প্রশ্ন হল, জীবনে গানের গুরুত্ব ঠিক কতটা? যারা চর্চা করে, শেখে, নিয়মিত পারফর্ম করে, তাদের কাছে অবশ্যই অনেকটা। কিন্তু এই বৃত্তের বাইরে থাকা লোকজনের জীবনে গানের গুরুত্ব আছে কি? থাকলে, কতটা? সাধারণ শ্রোতাদের কাছে গান শোনাটা ঠিক কতটা ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে উঠতে পারে? আসুন, একটা গল্প বলি। একজন মানুষের গল্প, যে ছিল শুধুই একজন শ্রোতা। গায়ক নয়, কম্পোজার নয়, কয়েকদিন বেহালা চর্চা করলেও সেটা ছিল নেহাতই শখের বশে। তো বলাই চলে, ভদ্রলোক ছিলেন শুধুমাত্র আমার আপনার মতো একজন শ্রোতা। কিন্তু দাঁড়ান, এর বাইরেও দুনিয়ার কাছে তার আরেকটা পরিচয় আছে। এই ভদ্রলোক একজন শিল্পীও বটে। তাঁর নাম Zdzisław Beksiński, বাংলায় (ভুল উচ্চারণ, জানি) জেজিসওয়া বেকশিনস্কি।
তা মিনিট কয়েকের জন্য গান থেকে শিল্পের দুনিয়া ঘুরে আসা যাক ঝট করে। আর্ট ওয়ার্ল্ডের খবর যারা মোটামুটি রাখেন, বেকশিনস্কির কথা তারা অবশ্যই জানবেন। এই পলিশ চিত্রশিল্পী শুধু ক্যানভাসেই তুলি চালাতেন না, ফোটোগ্রাফার আর ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবেও তাঁর নামডাক ছিল। কিন্তু যে জন্য তিনি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন, সেটা হল তাঁকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া একটা প্রবাদ। সেটা সত্যি না মিথ্যে কেউ জানে না, কিন্তু আর্ট ওয়ার্ল্ডে গুজব ছিল, লোকটা স্বপ্ন আঁকতে পারে! হি ক্যান পেইন্ট ড্রিমস! সে স্বপ্ন ইউটোপিক ফ্যান্টাসি হতে পারে, ডিস্পটোপিক এক্সপ্রেশন হতে পারে, মৃত্যু সংক্রান্ত আর্ট বা মেলানকোলিক ইন্টারপ্রিটেশন হতে পারে, কিন্তু মোদ্দা কথা, বেকশিনস্কি ছাড়া এ ধরনের ছবি কেউ চেষ্টা করেও আঁকতে পারেনি।
অনেকে মাসের পর মাস স্টুডিওতে বসে চেষ্টা করেছেন, লাভ হয়নি কিছুই। এদিকে বেকশিনস্কি বছরে পঞ্চাশ ষাট সত্তরটা ছবি এঁকে ফেলতেন অবলীলায়, যদিও আর্ট নিয়ে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। পোল্যান্ডের ছোট্ট শহর সানোকে জন্মেছিলেন, আর্কিটেকচার পড়তে পলিটেকনিকে গিয়েছিলেন, কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দিন কয়েক কাজও করেছেন। কাজ করেছেন বাস কোম্পানির ডিজাইনার হিসেবেও। কিন্তু পোষায়নি কিছুই। অবশেষে হার্ড প্যানেল তৈরি করে অয়েল কালার্স নিয়ে দিন কাটাতে শুরু করেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাটে, তাঁর খেয়ালই নেই কী আঁকছেন।
যখন খেয়াল হয়, বেকশিনস্কি ইউরোপের শিল্প জগতের চুড়োয় বসে আছেন। একের পর এক প্রদর্শনী, একের পর এক অনুষ্ঠান। ক্রিটিক তো বটেই, সাধারণ মানুষও তাঁর ছবি দেখে আহা উহু করছে। ফ্রান্স, ইস্টার্ন ইউরোপ থেকে জাপান হয়ে সমগ্র বিশ্বে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই পলিশ শিল্পী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খ্যাতি বেড়েছে, বেড়েছে ফ্যান ফলোয়িংও। তাঁর আঁকা ভঙ্গুর সব চরিত্র, তাদের বিকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বেদনাদায়ক অভিব্যক্তির ছবি নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে সারা দুনিয়ায়। একবার তাঁকে ফ্যানাটিক রিয়ালিজমের সেরা শিল্পী বলা হচ্ছে, তো একবার বলা হচ্ছে ডিসটোপিয়ান সুরিয়ালিজমের জনক। সে এক কাণ্ড! বেকশিনস্কি নিজেও প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলেন এসব দেখে। তাঁর আর্ট স্টাইল আর শৈল্পিক মনোভাব নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে সাংবাদিকরা, কিছুতেই তাদের সন্তুষ্ট করা যায় না। একবার একজন জিজ্ঞেস করেছে, "আজকাল আপনার ছবিগুলো আগের চেয়ে অন্য রকম হচ্ছে! হাউ ডু ইউ ফিল?"
বেকশিনস্কি শুধু বলেছিলেন, "আই ফিল... আই ফিল ফ্যান্টাস্টিক!"
আর যায় কোথায়, ক্রিটিকরা কয়েক মাসের মধ্যে ঘোষণা করে ফেলল, জেজিসওয়া বেকশিনস্কি স্টাইল বদল করেছেন, ১৯৬০ সালের পর এখন তাঁর শিল্পী জীবনে 'ফ্যান্টাস্টিক পিরিয়ড' চলছে। ল্যাও ঠেলা! ফ্যান্টাস্টিক পিরিয়ডের আর্টের দামও বেড়ে গেল হুহু করে, বেকশিনস্কিও আগামীতে তাই বলতে হল এই সময়ের ছবিগুলোকে। শিখলেন, কী করে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকতে হয়, কী করে হাসিমুখে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আওড়াতে হয়, কী করে হ্যান্ডল করতে হয় মিডিয়াকে?পরে জানা গিয়েছে, ব্যাপারটা আয়ত্ত করতে তাঁকে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয়েছিল।
যাই হোক, শেষ জীবনে ডিজিটাল ফোটোগ্রাফি আর কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকেছিলেন বেকশিনস্কি, এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন নানারকম। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না তাঁর। এমনিতেও তাঁর জীবন খুব একটা সুখের ছিল না, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে ঈর্ষা করত। বেকশিনস্কি ছিলেন বাড়াবাড়ি রকমের মুখচোরা, তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল অনেকটা তাঁর আঁকার মতোই অদ্ভুত। চেনাজানা মানুষের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করলেও পাবলিক ইভেন্ট বা শিল্পীদের সান্নিধ্যে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসত। বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পর থেকে কেউ পেইন্টিংয়ের অর্থ উদ্ধার করতে চাইলে তিনি রীতিমত অস্বস্তি বোধ করতেন, স্বপ্নের ব্যাখা বা সারিয়ালিজম নিয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, "I don't want to say or convey anything. I just paint what comes to my mind."
১৯৯৮ সালে তাঁর স্ত্রী জোশা মারা যায়, ১৯৯৯ সালের ক্রিসমাস ইভের দিন তাঁর একমাত্র ছেলে তোমেক, যে বেতার শিল্পী আর অনুবাদক হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, আত্মহত্যা করে। ছেলের মৃত্যুর পর নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছিলেন বেকশিনস্কি। এই ঘটনার ছয় বছর পর, ২০০৫ সালে বেস্কিন্সকিকে তাঁর ওয়ারশর ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সতেরো বার ছুরি মারা হয়েছিল তাঁকে। তদন্তে জানা যায়, কাজটা করেছে তাঁরই বাড়িওয়ালার ছেলে, সে ছেলের বয়স তখন আঠেরো পেরোয়নি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, এ কাজ সে কেন করেছে? উত্তরে সে জানায়, সে বেকশিনস্কির কাছ থেকে একশো ডলার চেয়েছিল, সে দেয়নি, তাই রাগ হয়েছিল তার। এমনিতেও বুড়ো মহাক্ষ্যাপা, কেউ তাকে পছন্দ করে না, ব্যাটা শুধু গান শোনে দিনরাত, সেইসব প্যানপ্যানানি শুনে সবাই বিরক্ত হয়। মাঝেমধ্যে পিং ফ্লয়েড চালায় বটে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই কী সব ফালতু গান শোনে, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না তার। তাই সে রেগেমেগে টাকা চাইতে গিয়েছিল বুড়োর কাছে। সে পাত্তা দেয়নি, একমনে গান শুনে যাচ্ছিল। সুতরাং... পুলিশ শোনে সবই। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়! বিশেষ কিছু করার ছিল না, কেস বন্ধ হয়ে যায়।
এই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। ম্যাগদেলেনা জেবাওউস্কা বলে এক বায়োগ্রাফার বেকশিনস্কিদের (মানে আর্টিস্ট বাবা ও রেডিও আর্টিস্ট ছেলে) জীবন ও শিল্প সত্তা নিয়ে বই (দ্য বেস্কিন্সকিস- ডাবল পোর্ট্রেট) লিখবে বলে রিসার্চ করছিল, এমন সময় বেকশিনস্কির নিজের লেখা নানান নোট, চিঠি, গল্পের খসড়া হাতে এসে পড়ে তাঁর। সেসব পড়ে ভ্রু কুঁচকে যায় জেবাওউস্কার। অবশেসিভ কম্পালশান ডিসঅর্ডার এর পেশেন্ট ছিলেন বেকশিনস্কি, ছেলে তোমেকও ডিপ্রেশন নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল, কিন্তু এছাড়া তেমন কোনো চাঞ্চল্যকর তথ্য আগে জানা যায়নি তাদের সম্পর্কে। কিন্তু এইবার যে সন্দেহ হচ্ছে, সেটা তো অসম্ভব!
দীর্ঘদিন ধরে নানা জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে জেবাওউস্কা, সাক্ষাৎকার নেয় অনেক আর্ট ডিলার আর বিশ্লেষকের। ক্রমে বেস্কিন্সকির জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে এমন একটা ধারণা দানা বাঁধতে থাকে, যা শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু, অল ক্লুজ লেড টু সেম বিলিফ। বিশ্বাস হোক না হোক, এটাই 'সম্ভবত' সত্যি ঘটনা। তোমেকের প্রসঙ্গ বাদ দিলে, এই ঘটনায় আছে শুধু দুজন। এক, বেকশিনস্কি নিজে। দুই, গান! অথবা বলা চলে, গানের প্রতি বেকশিনস্কির অনুরাগ।
ঘটনা হল, বেকশিনস্কির যে 'ইমোশনালিজম' নিয়ে দুনিয়া তোলপাড়, তাঁর যে ব্রাশ স্ট্রোক নিয়ে আজ গবেষণা হচ্ছে, সেটা শুধুই তাঁর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আসলে, বেকশিনস্কির এক 'সমস্যা' ছিল, যদি একে সমস্যা বলতে হয়! মানুষের সঙ্গে কথোপকথন হলে বা সম্পর্কে থাকলে ইমোশন ব্যাপারটা কীভাবে এক্সপ্রেস করতে হয়, সে কথা তিনি সারা জীবন ধরে বুঝতেই পারেননি। যা বুঝতে পেরেছিলেন, সে হল গান। সেই ছোটবেলায় যখন মা পিয়ানো শিখতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল, তখন থেকেই গান শোনার অভ্যেস তৈরি হয়। (পিয়ানো চর্চা বেশিদিন চলেনি, অসাবধানতায় বন্দুকের গুলি ফেটে দুই আঙুলের ডগা উড়ে গিয়েছিল বলে সে শিক্ষা আর দীর্ঘায়িত হয়নি)
কিন্তু আর চারজনের চেয়ে শ্রোতা হিসেবে আলাদা ছিলেন বেকশিনস্কি। গানের মাধ্যমে অপার্থিব এক জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি, যা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।
১৯৪১ সালে এক গুচ্ছ সোভিয়েত বায়নিল রেকর্ড হাতে আসে, বেকশিনস্কি সেগুলো নিয়ে অপেরা আর ক্লাসিকাল সঙ্গীতের মধ্যে ডুবে যান। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সাধারণত সেসব খুব একটা ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু বেকশিনস্কি সে গান শুনে এমন মোহিত হয়ে পড়লেন যে বলার নয়! ক্রমে তিনি বুঝলেন, গান শোনার সময়ে সেই গানের সঙ্গে সাযুজ্য রাখা রঙের নকশা তার চোখের সামনে ঘোরে। মানে, সত্যি সত্যিই তিনি গানের অন্তরীণ জগতটা দেখতে পান। এক একটা রেকর্ড বদলে দেন, রঙের নকশাও বদলে যায়। এমনটা আর কারো সঙ্গে হয়েছে বলে জানা নেই। কিশোর বেকশিনস্কির এই অভিজ্ঞতা বোঝার মতোও কেউ ছিল না, থাকার কথাও নয়, কিন্তু ছেলের মাথায় তখন ভূত চেপে গেছে। তখন তার বয়স তেরোও নয়। বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় যখন সবাই ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত, সে একটা লুকিয়ে রাখা রেডিওতে জার্মান স্টেশন ধরে Tannhäuse শুনছে। প্রসঙ্গত, রিচার্ড ওয়াগনার ১৮৪৫ সালে এই থ্রি স্টেট অপেরা কম্পোজ করেছিলেন, এর মধ্যেও দুই দুনিয়ার ঐতিহ্য আর বিশ্বাস নিয়ে একটা গানের লড়াই আছে, ইন্টারেস্টিং কিছু কাহিনি আছে এই অপেরার মঞ্চন নিয়েও। সে যাই হোক, এই অপেরার প্রতিটা গান চোখের সামনে উন্মোচিত হতে দেখল বেকশিনস্কি। এক একটা কম্পোজিশন যেন উড়ো মেঘের মধ্যে ভেসে আসছে চোখের সামনে, বিজাতীয় ভাষায় কথা বলছে তার সঙ্গে। সুর বদলে গেলে ছবিও বদলে যাচ্ছে, গলার স্কেল বা কথা বদলে গেলে বদলে রঙ ও নকশার ভাষা। এই গোটা ব্যাপারটা জীবন্ত হয়ে উঠছে বেকশিনস্কির চোখে ও মনে, কিন্তু সেটাকে 'এক্সপ্রেস' করতে পারছে না সে। কী করে বোঝাবে সে কী দেখছে? এ কি বাস্তব? না স্বপ্ন? ভাষা দিয়ে তো বোঝানো সম্ভব নয়, তাহলে কি রঙ? বাধ্য হয়ে একের পর এক ফর্ম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলল। ফোটোগ্রাফি, পেইন্টিং, ভাস্কর্য! এমনকি গল্পও লিখেছেন খান চল্লিশেক, সে সব তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। পড়ে বোঝা যায়, সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে বসবাস করতেন এই পলিশ শিল্পী।
এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
"When I paint while listening to pop music, I make movements with my torso, which hinders my work, seemingly senseless; nevertheless, turning off the sound system creates a feeling of lack of something, without which you cannot work. And that is why it does not matter what I paint – what is important is what I cannot express in words, but I hope I can express it in some of the best paintings. Some kind of indeterminate, but (…) existing exultation, which is most strongly present in post-Wagner’s music."
যতদিন গেছে, বয়স যত বেড়েছে, বেকশিনস্কি এই সুরের জগতের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। সারা সারা দিন গান শুনতেন, কখনও জ্যাজ, কখনও রক, কখনও বা ক্লাসিকাল। তুলি চলত ক্যানভাসে, সঙ্গে চলত গানও। কানে হেডফোন গুঁজে অন্য দুনিয়ায় ডুবে যেতেন তিনি। এই ছিল তাঁর শিল্পসাধনা, তার আঁকার প্রসেস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পোল্যান্ডে সাম্যবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, বেকশিনস্কি দিনরাত জ্যাজ শুনছেন। যখন তাঁর ফ্যান্টাস্টিক পিরিয়ড চলছে, রক অ্যান্ড পপ মিশে গিয়েছে ক্লাসিকাল ওয়েস্টার্ন আর অপেরার সঙ্গে। মাঝেমাঝে খেই হারিয়ে ফেলতেন তুলি হাতে নিয়ে, তখন দিনের পর দিন গান নিয়ে কেটে যেত। কিছুই বাকি রাখতেন না! হঠাৎই হাজার কয়েক গান শোনার পর একটা গান শুনেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে আসত, তুলি চলত সাবলীলভাবে।
গানের সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা চালাতেন বেকশিনস্কি। তাঁর এক্সপ্রেশনিজম, তাঁর সুরিয়ালিজম, তাঁর স্বপ্ন আঁকার ক্ষমতা, সবই ছিল এইটুকুর মধ্যে। গানের মধ্যে। ক্রমে গানের ভিতরের জগতে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিলেন, যে মানুষদের সমাজ আর ইমোশন বুঝতে কষ্ট হত। শিল্পীদের সঙ্গে দেখা হলে অস্বস্তি বোধ করতেন, বন্ধুদের মাঝে জোর করে হেসে এড়িয়ে যেতে চাইতেন সিরিয়াস কথাবার্তা, মনের ভাব এক্সপ্রেস করার ক্ষমতাই তাঁর ছিল না। ছেলে তোমেককে জীবনে একদিনও জড়িয়ে ধরেননি, আদর করে দেননি, কিন্তু তাঁর জন্যে রাখা গান শুনে ছবি এঁকে পাঠাতেন ছেলের কাছে, স্ত্রী জোশার কাছেও। ছবি না হলে চিঠি লিখতেন, বা ছোট্ট কোনো মূর্তি বানিয়ে উপহার দিতেন। কথা বলতেন না। তোমেক নিজেও সম্ভবত বাবার স্বভাব কিছুটা পেয়েছিল, তাই ছেলে আর বাবার ইকোয়েশনটা অদ্ভুত ছিল। দুজনেই দুজনকে বুঝত, কিন্তু সামনাসামনি কথা বলতে পারত না। আত্মহত্যার আগে বাবার উদ্দেশ্যে একগাদা চিঠি আর টেপ রেখে গিয়েছিল তোমেক, বেকশিনস্কি সেসব পড়ে নোট বানিয়ে রেখেছিলেন।
গান শোনা অবশ্য কোনোদিনই থামেনি তাঁর। সারা জীবন ধরে গান শুনে গেছেন। ক্লাসিকাল নিয়েই আগ্রহ ছিল বেশি। পাড়াপড়শিরা বিরক্ত হত, কিছু বলতে পারতেন না তিনি। কিন্তু গান ঠিকই চলত। গান না শুনলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত তাঁর। হাজার হাজার সিডি, রেকর্ডিং এর সরঞ্জাম রাখা থাকত হার্ড প্যানেল, তুলি আর ক্যামেরার পাশাপাশি। এক জায়গায় লিখেছেন, "I have had my hearing tested, to check if it’s still all right, but I have this need of music to literally smash and tear me apart. It somehow appears, that after fourteen hours of constant listening, only music allows me to paint without any break, standing up, as if there’s no exhaustion. It works better than coffee!"
জাগ্রত অবস্থায় বেকশিনস্কি গান শুনছেন না, সে ভাবাও যায় না। গোটা জীবন সারিয়ালিস্টিক স্বপ্নের ভিতর কাটিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সে কথা অনুধাবন করার কোনো উপায় ছিল না কারো কাছে। তাঁর আড্ডা মারার জায়গা ছিল Chopin, Liszt, Grieg, Dvorak, Bruckner, Shostakovic বা Górecki এর কম্পোজিশন, আমাদের পরিচিত সমাজ তাঁর কাছে ভিনগ্রহের শামিল ছিল। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া নোটে লেখা ছিল, তাঁর সব পেইন্টিং আর ভাস্কর্য যেন নষ্ট করে দেওয়া হয়। এগুলো শুধুই তার ফর্ম অফ এক্সপ্রেশন, যার মাধ্যমে তিনি সঙ্গীতকে বুঝতে চাইছিলেন। বলাবাহুল্য, সে কথা কেউ শোনেনি। বেকশিনস্কির সারাজীবনের কাজ সযত্নে রক্ষিত আছে সানোক ও অন্যান্য জায়গার মিউজিয়ামে।
একজন মানুষ, যে গান নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিল। কৈশোর, যৌবন, খ্যাতি থেকে শুরু করে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত গানই তাঁর একমাত্র সঙ্গী, সম্ভবত মৃত্যুর কারণও, অথচ তিনি না গায়ক, না সুরকার না অন্যকিছু। শুধুই একজন শ্রোতা, যিনি তাঁর শিল্পকে গানের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছিলেন। একজন মানুষের সঙ্গীতের গুরুত্ব ঠিক কতটা, সেটা বুঝতে হলে পোল্যান্ডের সানোক মিউজিয়ামে গিয়ে ঘুরে আসতে পারে যে কেউ। বেকশিনস্কির সমস্ত নোট আর কয়েক হাজার গানের সিডির পাশাপাশি মানুষটাকেও হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন