বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

সমীরা মুসা-- এক উজ্জ্বল নক্ষত্র


সকাল ন'টা। ভদ্রলোক হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। একটা জরুরি কনফারেন্সে যেতে হবে তাঁকে। গাড়ি আগেই বলা আছে, কিন্তু শেষ মুহুর্তে এমন দেরি হচ্ছে কেন বুঝতে পারছেন না তিনি! যাই হোক, দেরি হলেও ড্রাইভার এল। গাড়িতে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। ফাইল খুলে বের করলেন বক্তৃতার খসড়া। জরুরি পয়েন্টগুলো দেখে নিচ্ছেন। বহু বছরের পরিশ্রম আছে এই গবেষণার পেছনে। সাফল্য আজ হাতছানি দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য অনেক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতে হয়েছে তাঁকে, পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেকটা পথ। কিন্তু অতীতের কথা ভুলে যাওয়াই ভালো। যদি সব ঠিকঠাক হয়, তাহলে কয়েকমাসের মধ্যেই প্রোপোজাল অ্যাপ্রুভ হয়ে যাবে, কাজও শুরু হবে পুরোদমে। সাফল্য আর ব্যর্থতার দোলাচল থেকে বেরিয়ে এসে এইবার একটু স্বস্তিতে কাজ করতে পারবেন তিনি। দেশে ফিরে গিয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করবেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? পরিবারকেও একটু বেশি সময় দেওয়া যাবে এতদিনে।
ভদ্রলোকের ভাবনায় ছেদ পড়ল, কারণ গাড়ি আচমকা গাড়ি পথ ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় নেমে গিয়েছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে সামনের খাদের দিকে। আরে আরে! ব্রেক ফেল হয়ে গেল নাকি? আসন্ন দুর্ঘটনার আশংকায় বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল মুহুর্তে। এরইমধ্যে তিনি দেখলেন, গাড়ির চালক এক ধাক্কায় দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়ল। মরিয়া হয়ে তিনিও দরজা খুলতে গেলেন, কিন্তু দরজা লক। লাথি মারতে মারতেই তিনি দেখলেন গাড়িটা গড়াতে গড়াতে খাদে পড়তে শুরু করেছে। খুব বড়জোর পনেরো সেকেন্ড, তারই মধ্যে প্রায় চল্লিশ ফুট নিচে গিয়ে পড়ল গাড়িটা। ভয়ংকর বিষ্ফোরণ হল একটা। আগুন জ্বলতে শুরু করল গাড়িতে। ভদ্রলোকের নিথর দেহের চাপেই হয়তো শেষমেশ ভেঙে পড়া দরজাটা খুলে গেল, কিন্তু তখন আর তার প্রয়োজন নেই।
গল্প শেষ। কী হল, কেন হল, সেটা এইটুকু শুনে ইন্টারপ্রেট করা যাবে কি? সম্ভবত না। আচ্ছা, কয়েকটা ক্লু দেওয়া যাক!
১) ধরা যাক, এই ভদ্রলোক একজন সায়েন্টিস্ট। খুব নামকরা নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট। এবং তিনি সম্প্রতি এক যুগান্তকারী গবেষণায় সাফল্য পেয়েছেন!
কিছু বোঝা গেল? আমি বাজি রেখে বলতে পারি, অনেকের মনেই একটা হালকা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু এখনও ঠিক দানা বাঁধছে না ব্যাপারটা। আচ্ছা, আরেকটা ক্লু দেওয়া যাক।
২) ভদ্রলোক ইরানের বাসিন্দা। মানে, তাঁর মাতৃভূমি ইরান। কাজটা শেষ করে তিনি দেশে ফিরে গিয়ে থিতু হতে চেয়েছিলেন।
এই তো! সবাই হাত তুলেছেন এবার। সকলের মুখ উজ্জ্বল। একে একে আসুন! সবাই মিলে চেঁচালে বুঝতে পারব কী করে? হ্যাঁ, বলুন! আপনি বলুন। আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? মুখ তো চকচক করছে। আর এই দুই ভদ্রলোকের মুখেও তেরছা হাসি যে!
"মোসাদ! মোসাদ!"
"ইয়েস! ইরানের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট তো, ও মোসাদ ছাড়া কেউ নয়। এসব অ্যাসাসিনেশন ওদের কাছে ছেলেখেলা। মোসাদের মতো তুখোড় ইন্টেলিজেন্স সারা দুনিয়ায় নেই।"
"মোসাদ ছাড়া কে হবে? আমাদের দেশেও এমন একটা ইন্টেলিজেন্স দরকার।"
"ইরানের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টদের গুপ্তহত্যা করবে, এমন বুকের পাটা আর কারো কাছে নেই! ইজরায়েলের মতো দেশ হয় না। বাঘের বাচ্চা সব! ঘরে ঢুকে মেরে আসে।"
"মোসাদ! হাহাহা! ডেফিনিটলি মোসাদ! আই লাভ দেম। "
হ্যাঁ, বুঝেছি স্যার। মোসাদই বটে! ফুল মার্কস চান যদি, নিয়ে নিন। কিন্তু সত্যি বলতে স্যার, আপনাদের এই গেসওয়ার্ক যে সঠিক হবে, সেটা আমি গেস আগেই করে রেখেছিলাম। সন্দেহ নেই, মোসাদ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। কিন্তু কথা হল, আপনারা এ নিয়ে এত উত্তেজিত কেন? এই অপারেশন এর পিছনের কাহিনি কি আপনি জানেন? অবশ্যই জানেন না। কাজেই এই সিদ্ধান্তকে ঠিক বা ভুল প্রতিপন্ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পারসেপশনের ওপর নির্ভর করে মোসাদকে ছাড় দিলে হবে? ইরানের একজন প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক মারা গেল, সেটাও তো ঘটনা! কী বললেন? ভদ্রলোক সম্ভবত বোমা বানানোর প্ল্যান করছিলেন? ইরান আর আরব কান্ট্রিজের সন্ত্রাসী দলগুলোকে ঠেকিয়ে রাখতেই ওরা এ কাজ করে? কয়েক শতাব্দী ধরে ইহদিদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, মোসাদ তার জবাব দিচ্ছে? বদলা নিচ্ছে।
দুঃখিত স্যার! এগুলো শুধুই কথা! মানে কথার কথা! যুক্তি ফুক্তি নেই, প্রমাণ ফ্রমাণ ও পাবে না কেউ। কিছু কথা পঁচিশ পঞ্চাশ বছর আগে প্রাসঙ্গিক ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন আর নেই। হ্যাঁ, ইহুদিদের ওপর প্রচুর অত্যাচার হয়েছে, সে কথা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। ইজরায়েল আর আরবদের মধ্যে চিরকালীন দ্বন্দ আর সংগ্রামের ইতিহাসও কারো অজানা নেই। এ কথাও ঠিক যে ইজরায়েলকে বিশ্বশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে মোসাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না, যেভাবে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে সি আই এ-এর মাথা কাজ করে যায়, কিন্তু তাতে তাদের সব কাজটা ঠিক বলে চালানো যায় না। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ভক্ত হওয়া আর রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজা করা প্রায় একই। মোসাদ হোক বা র, জার্মান হোক বা জর্ডান, সমসাময়িক জিওপলিটিক্সে প্রত্যেকে পাওয়ার গেমসে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে। নীতিগতভাবে তাদের কারো কোনো আদর্শ তো নেইই, উল্টে এসব ইন্টেলিজেন্স এর অদূরদর্শিতা আর গোঁয়ার্তুমির মাশুল দিতে সার্বিকভাবে আমাদের অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছে। মুশকিল হল সরকার ও জনতার একাংশ চিরকালই সামরিক শক্তি আর গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িয়ে থাকা এজেন্টদের তোল্লাই দিয়ে থাকে, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজও অধিকাংশ এজেন্সিকে সেভাবে জবাবদিহি করতে হয় না। এর ফলে ভালো থ্রিলার আর ওয়েব সিরিজ হয় ঠিকই, কিন্তু ক্ষতি হয় মানব সমাজের। সিক্রেট ইন্টেলিজেন্সদের ভুলভাল অপারেশনের ফলে ইদানীংকালে যে ধরনের কোলাট্রল ড্যামেজ হয়েছে, সে সব সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে। মানবাধিকারের প্রশ্ন চুলোয় যাক; সে সব নিয়ে কিছু বললে আজকাল আবার বিশেষ বিশেষ বিশেষণে চিহ্নিত করার রেওয়াজ হয়েছে, কিন্তু শুধু গোদা প্রফিট লসের নিরিখে দেখতে গেলেও এই ধরনের আনরেস্ট্রিক্টেড আর আনরেগুলেটেড ইন্টেলিজেন্স অপারেশন যে পরিমাণ ড্যামেজ করেছে, তার কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। অনেক সময় সরকার আগে থেকে কিছুই জানে না, মাঝপথে গোলমাল হলে তারাও বেকায়দায় পড়ে যায় রীতিমতো। ইতিহাসে চোখ বুলোলে দেখা যাবে, ইজরায়েল সরকার মোসাদকে নিয়ে একেবারে নাজেহাল হয়ে আছে। না পারে ওগরাতে, না পারে গিলতে। নিরাপত্তার কথা ভাবলে মোসাদের কথাই মনে পড়ে অবশ্য, কিন্তু তাদের নিরংকুশ সত্তাকে সামাল দিতে জেরুসালেম প্রসাশনের প্রায় হিমশিম অবস্থা। সিনবেত কর্তার কথায় বিশ্বাস করতে হলে ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য একটা ব্লান্ডার ব্রিগেড তৈরি করতে হয়েছে, উল্টো দিকে মোসাদের লোকজন আবার সরকারকে দুষছে। তবে মোসাদকে একা দোষ দিলে চলবে না। কমবেশি একই অবস্থা সব দেশের সংগঠনের। কিন্তু দোষ করলেও স্বীকার করার চল নেই, তাই সরাসরি দোষারোপও করা যায় না।
ওপরের ঘটনার কথাই ধরা যাক। আরব বৈজ্ঞানিকদের রুখতে বা তাঁদের সরিয়ে শত্রুদেশকে আঘাত পৌঁছানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচুর অপারেশন করা হয়েছে, কিন্তু ফর্ম্যালি একটারও দায়িত্ব নেয়নি মোসাদ। কিন্তু আপনাদের মতো সারা দুনিয়ার লোকেরাই সন্দেহ করেছে, এই কাজগুলো কাদের? মাঝেমধ্যে অন্যান্য ইন্টেলিজেন্সরাও সময়ে অসময়ে প্রমাণ দিয়েছেন এহেন অ্যাসাসিনেশন অ্যাটেম্পটের, কিন্তু মোটের ওপর জবাবদিহি করতে হয়নি কাউকেই।
যাকগে! সত্যি বলতে এসব নিয়ে লেখা আসল উদ্দেশ্য ছিল না। আসল উদ্দেশ্য ছিল এমন এক বিজ্ঞানীর কথা জানানো, যিনি সম্ভবত প্রাণ দিয়েছেন শুধুমাত্র এইজন্য, কারণ তিনি বিশেষ এক দেশের নাগরিক ছিলেন। তাঁর সারাজীবনের শিক্ষা, পরিশ্রম, গবেষণা, স্বপ্ন সব মিথ্যা, বৈজ্ঞানিক ও মানুষ হিসেবে সমাজে তাঁর অবদানও সত্যি নয়, সত্যি শুধুমাত্র তাঁর পাসপোর্টে লেখা দেশের নাম। সে দেশ শত্রুদের।
মেয়েটির নাম সামীরা। সামীরা মুসা। ১৯১৭ সালে কায়রোয় জন্মেছিল সে। তখন দেশে ঘার্বিয়া সরকার, গোটা মিশরের সভ্যতা সংস্কৃতি একটা পুনর্জাগরণ এর মধ্যে দিয়ে চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অবস্থা কাহিল, সাধারণ মানুষ চেনা গণ্ডির বাইরে জীবনের মানে খুঁজছে। কয়েক বছর দমচাপা হয়ে থাকার পর আবার অভিযান শুরু হয়েছে একে একে।
মীরা যখন বাচ্চা মেয়ে, তখন আচমকা তুতানখামেনের কবর আবিষ্কৃত হয়। সেই নিয়ে পৃথিবী জুড়ে তুমুল উত্তেজনা, সারা দুনিয়ার আর্কিওলজিস্টরা কায়রোয় এসে ভিড় করছে। মমির অভিশাপ আর ফারাও রহস্য নিয়ে ট্যাবলয়েডের গরমাগরম খবর; আজ সিনেমা কাল ফ্যাশন শো পরশু নাটক চলছে, টুরিস্টের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। খবরের কাগজে সে সব ছবিও প্রকাশিত হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, আদ্যিকালের ধ্যানধারণা ছেড়ে মিশর এইবার আধুনিকা হতে চলেছে। রেনেসাঁস ইয়ার্স এর এই ধারণা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল নয় ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব একটা বদল মোটেও আসেনি। রাজনীতি বা সমাজ সংস্কার তো দূর, স্বাস্থ্য আর পড়াশুনা নিয়েও কারো মাথাব্যাথা নেই। আর মহিলাদের পরিস্থিতি তো বলার নয়। একজন মেয়ে স্কুলে গেলে হল, কুটকাচালি শুরু হয়ে যায়। ভোট দেওয়ার অধিকারও তাদের নেই। তবে পরিবর্তনের নিনাদও বাজছিল। ১৯১৯ আর ১৯২০ সালেই সাধারণ নির্বাচনে মহিলাদের অংশীদারিত্ব নিয়ে বিশাল আন্দোলন হয়, এমন আন্দোলন আগে কেউ দেখেনি। হুদা সারাওয়ি এই জন আন্দোলন এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অটোবায়োগ্রাফি Harem Years: The Memoirs of an Egyptian feminist পড়লে এই নিয়ে বিষদ জানা যাবে।
তা যাই হোক, সামীরার বাবা হাজি মুসা আলি বেশ ব্যতিক্রমী ও উদার মানসিকতার মানুষ ছিলেন। যতদূর জানা যায়, হুদা সারাওয়ির বক্তৃতা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছিল, মেয়েদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখাও তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি প্রথম থেকেই ভেবেছিলেন, মেয়েকে আর চারজনের মতো করে রাখবেন না। স্ত্রীকে জানিয়েই রেখেছিলেন সে কথা। মেয়েকে স্কুলে পড়াবেন, কলেজেও পাঠাবেন, মেয়ে আগ্রহী হলে তাকে সক্রিয় রাজনীতি করতেও উৎসাহ দেবেন। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু সে সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত পরিকল্পনাই একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, এক লহমার মধ্যে হাজি মুসা আলির পৃথিবী উজাড় হয়ে গেল। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী, সামীরার আম্মি।
কিছু করার ছিল না। প্রায় একশো বছর আগের কথা, মিশরের মতো দেশে কর্কটরোগ সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই ছিল না। হাজি মুসা আলি পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। এইবার ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি কী করবেন? সামীরার বয়স এতটাই কম যে ক্যান্সার তো দূর, মরে যাওয়া ব্যাপারটাই সে বোঝে না। সবাই তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু সামীরা বারবার মাকে খুঁজে বেড়ায়। হাজিসাহেবের কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে। তা একদিন হাজিসাহেব ধৈর্য হারিয়ে মেয়েকে ধমক দিলেন। কড়া গলায় জানিয়ে দিলেন, আম্মিকে 'ক্যান্সার' নামের এক রাক্ষস খেয়ে ফেলেছে। সে আর ফিরবে না। 'আর রাক্ষসটা? তাকে কেউ কিছু বলবে না? সিন্দবাদের মতো তাঁকে যুদ্ধে হারাবে না কেউ?' কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাচ্চা মেয়েটি প্রশ্ন করেছিল। হাজি মুসা আলি মুখ ঢেকে বলেছিলেন, ওই রাক্ষসের সঙ্গে কেউ যুদ্ধ করে না বেটি। ক্যান্সারকে কেউ হারাতে পারে না। হাজিসাহেব তখনও জানতেন না, অজান্তেই তিনি মেয়ের জীবনপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন সেইদিনই।
উদারমনস্ক বাবার সাহচর্য সামীরাকে অশিক্ষিত হয়ে থাকতে দেয়নি। শোক কাটিয়ে উঠে হাজি মুসা আলি কায়রোয় এসে থিতু হয়েছিলেন, মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে যে ঠিক কতটা বুদ্ধিমান, সে সম্পর্কে তাঁর নিজেরও কোনো ধারণা ছিল না। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি স্কুলে আসতে আসতে সামীরা স্কুলে প্রায় চাইল্ড প্রডিজির সম্মান পেয়ে গেল। অংক আর বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য আগ্রহ, এছাড়া আছে অদম্য উৎসাহ আর উদ্যম কল্পনাশক্তি। নিজেই ছুটোছুটি করে নানান বিষয়ে বই জোগাড় করে, সে সব পড়ে নোট বানায়, ষোল বছর বয়সে সে অ্যালজেব্রা নিয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলল।
হাজিসাহেবকে জানানো হল, তাঁর মেয়ের মধ্যে একটা সহজাত বৈজ্ঞানিক প্রতিভার খোঁজ পেয়েছেন অনেকেই, পরীক্ষার অসামান্য কৃতিত্ব তো কিছুই নয়। শুধু একটাই দোষ, সামীরা বড্ড বেশি পড়াশোনা করে। ওইটুকু মেয়ে, কাল বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, এখনই তো আনন্দ করার সময়! সারাক্ষণ গোমড়ামুখো হয়ে গাব্দাগোবদা বইয়ের পিছনে লুকিয়ে থাকতে আছে?
হাজিসাহেব কোনো প্রতিক্রিয়া জানালেন না, শুধু একদিন মিন্ট টি খাওয়ার সময়ে সামীরাকে আলগা করে বললেন, "সবসময় এত গোমড়া হয়ে থাকিস কেন? পড়াশোনা তো করবিই, কিন্তু অত চাপ নিস কেন? মনে হয় যুদ্ধ করছিস!"
সামীরা মৃদুহেসে বলেছিল, "কাউকে তো যুদ্ধটা শুরু করতেই হবে আব্বু!"
সামীরা কী বলতে চাইছেন, সেটা ধরতে কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়েছিলেন হাজিসাহেব। তারপর চমকে উঠেছিলেন ভীষণভাবে। রুদ্ধস্বরে তিনি বলেছিলেন, "অল দিস ইয়ার্স..."
সামীরা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে জানিয়েছিল, 'অলওয়েজ!"
জানি, এটা হ্যারি পটারের গল্প নয়। বাপ মেয়ে এইভাবে কথা বলেনি নিশ্চিত, কিন্তু ডাম্বেলডোর আর স্নেপের এই কথোপকথন দেওয়ার একমাত্র কারণ, ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানো। সেইদিন রাত্রে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর তার পড়ার ঘরে গিয়েছিলেন হাজিসাহেব। বিস্ফারিত চোখে দেখেছিলেন, বছরের পর বছর ধরে ক্যান্সার সম্পর্কিত নথিপত্র সংগ্রহ করছে সামীরা। মেডিকাল রিসার্চ, জার্নাল, কেস স্টাডি, ওসুধপত্র, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে দিস্তে দিস্তে কাগজ... কী নেই? এক একটা লেখা প্রায় পাঁচ ছয় বছর আগের, তখন সামিরার বয়স এগারো বারোর কাছাকাছি। হাজিসাহেব মেয়েকে কিছুই বলেননি সেদিন, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
অ্যাকাডেমিক ব্রিলিয়ান্স কিছু কিছু পথ সহজ করে দেয়। যে দেশে মেয়েদের শিক্ষা ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয় বলে ধরা হত, সেখানে সামীরা কায়রো ইউনিভার্সিটিতে একবারে চান্স পেলেন। তাও যে সে নয়, তাঁর সাব্জেক্ট ছিল রেডিওলজি। কেন এই মেয়ে সব ছেড়ে রেডিওলজি নিতে গেল, সেটা এইটুকু পড়ে যে কেউ বলে দেবেন। সামীরা জানত, ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রেডিওলজিই অন্যতম পন্থা হতে চলেছে। ফেলিক্স ব্লচ আর এডোয়ার্ড পার্সেলের মতো অনেকেই যে আমেরিকায় আর ইউরোপে এন এম আর বা নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স নিয়ে কাজ করছেন, সে কথাও সামীরা আগেই জেনেছিল।
কায়রো ইউনিভার্সিটিতে তখন আলি মুশার্ফা বলে এক ডিন এসেছিলেন। সামীরাকে প্রথমে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি, যদিও মেয়ে হয়ে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেশন পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সুবাদে অনেকেই সামীরাকে চিনে গিয়েছিল। মুশার্ফার টনক নড়ল, যখন তিনি সামীরাকে প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে দেখলেন! সদ্য ভর্তি হওয়ার একটা মেয়ে যে রেডিওলজির জটিলতম বিষয় নিয়ে এমন প্রশ্ন করতে পারে আর নিজে সে নিয়ে ব্যাখা দিতে পারেন, সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। পরবর্তী সময় মেন্টর হিসেবে আলি মুশার্ফা সামীরাকে বারবার সাহায্য করেছেন, বহুবার তাঁকে উদ্ধার করে এনেছেন আনুষাঙ্গিক ঝামেলা ঝঞ্জাট থেকে। সামীরা অবশ্য তাঁকে নালিশ করার কোনো সুযোগ দেননি। প্রথমে ব্যাচালার্স, তারপর মাস্টার্স, তার ওপর পড়াতে পড়াতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর হিসেবে ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা... ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত কোনো ইউনিভার্সিটিত সেকালে যা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল, বিশেষ করে একজন আরব মেয়ের পক্ষে। কিন্তু সামীরা কিছুতেই হার মানেননি। পিএইচডি করার সময় তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয় নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন নিয়ে গবেষণা করার জন্য। মাত্র দু বছরের মধ্যে সামীরা তাঁর থিসিস সাবমিট করে, এই বিষয়ের প্রেক্ষিতে যা প্রায় এক যুগান্তকারী ঘটনা।
আরেকটু বিশদে বলা যাক। আসলে বিদেশে কাটানো এই সময়টুকুকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিল সামীরা। এক্সটেন্সিভ রিসার্চ তো করেইছে, সঙ্গে গোটা দুনিয়ার ভৌতবিজ্ঞানী আর পরমাণু বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কোলাবরেট করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এনেছে। ভুলে গেলে চলবে না, সামীরা সে সময় শুধুই একজন ছাত্রী, সরকারের কমিশনড সায়েন্টিস্ট বা ইনভেন্টর নয়। কিন্তু তাও সামীরার কাজ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যে ব্যাপারটা সামীরাকে আর চারজনের থেকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটা হল তাঁর নিষ্ঠা৷ বাইশ তেইশ বছর বয়সী এই মেয়ের স্বপনে-শয়নে একটাই কথা ঘুরত, নিউক্লিয়ার রেডিয়েশনকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা খুঁজে বের করা, আর সেই চিকিৎসাকে সকলের নাগালে নিয়ে আসা। বিভিন্ন ধাতুর ওপর আয়োনাইজিং এক্স রে রেডিয়েশন করে ফ্র্যাগমেন্টেশন করার যে জটিল ফর্মুলা সামীরা আবিষ্কার করেছিল, তাতে আমেরিকা আর ইউরোপের বৈজ্ঞানিকরা জাস্ট হাঁ হয়ে গিয়েছিল। এ তো প্রায় অসাধ্যসাধন! এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি হবে তাই নয়, প্রয়োজনে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পরমাণু বোমাও তৈরি করা যায়। ভুলে গেলে চলবে না, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেক দেশই পরমাণু বোমা নিয়ে গবেষণা করছে, কিন্তু এহেন গবেষণা রীতিমতো ব্যয়সাধ্য। সামীরার পদ্ধতি কাজে লাগালে বরং কাজটা ভবিষ্যতে অনেক সহজে হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল, সামীরা তাঁর আবিষ্কারকে ওয়েপেনাইজ করতে প্রথম থেকেই নারাজ ছিল। ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সে সারা দুনিয়ার বৈজ্ঞানিকদের একটা ছাদের তলায় নিয়ে এল, গঠন করল Atomic Energy for Peace conference. তখন তাঁর বয়স তিরিশও হয়নি। সামীরার এই উদ্যোগে আমেরিকার বৈজ্ঞানিকরাও সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে আমেরিকা যে কাজ করেছে, তা যেন ভবিষ্যতে কখনও না হয়! নিউক্লিয়ার রিসার্চ হবে, কিন্তু তাঁর কাজ হবে মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা, বোমা তৈরি নয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সারা দুনিয়ার সরকার যখন সামীরাকে দলে টানার চেষ্টা করছে, মিশরের সরকার উদাসীন হয়ে বসেছিল। সামীরার কোনো রিসার্চকে ডকুমেন্টও করা হয়নি ইজিপ্টে। বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, কায়রো প্রশাসন তাঁকে ইজিপ্টের পরমাণু বোমা কমিটির পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু সামীরা মোটেও রাজি হননি। ইউরোপ আমেরিকার স্বাধীন ইনভেন্টারদের সঙ্গে তখন তিনি দিনরাত কাজ করছেন। আমেরিকার সরকার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ফুল স্কলারশিপ দিতে রাজি হয়েছে, নানান রাজ্যের নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটিতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে প্রয়োজনে, কারণ না দিলে চলছিল না। ক্যান্সার রিসার্চের দুনিয়ায় তখন সামীরা প্রায় বিস্ময় বালিকা। পঁচিশ বছর বয়সে তাঁকে বলা হচ্ছে, দ্য মাদার অফ নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন।
সামীরার জেদ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় সবাই। ছোটোখাটো এই মেয়েটা এত উদ্যম পায় কোত্থেকে? অবিরাম, অবিচল ভাবে সে কাজ করে যায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তাঁকে ক্যান্সারের প্রতিরোধ করতেই হবে, হারাতেই হবে সেই দৈত্যকে। আর সে কাজটা দ্রুত করতে হবে তাঁকে। একের পর এক যুগান্তকারী গবেষণা, নতুন আবিষ্কার, জটিল ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে মেডিকাল সায়েন্সে হাতেকলমে পরীক্ষা করা... এই করেই কাটছিল। ইতিমধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৯৫২ সাল। মিশরের কিছু প্রতিনিধি এসে আমেরিকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁকে ইজিপ্টে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান আন্তরিক ভাবে। এত বছরে এই প্রথম। (সন্দেহ নেই, সামীরার কাছে নিউক্লিয়ার গবেষণা সম্পর্কিত কিছু তথ্যও হয়তো জানতে চেয়েছিলেন তারা) ইচ্ছে না থাকলেও নিমরাজি হন সামীরা। বহুদিন দেশে যাননি, মাতৃভূমির জন্য মাঝেমধ্যে মন খারাপ তো করেই। না হয় একবার ঘুরে আসবেন এই সূত্রেই, ছোটোখাটো কিছু পরামর্শ দেবেন বিজ্ঞানীদের। তিনি বুঝতেও পারেননি, এই একটা সিদ্ধান্তের কী পরিণাম হতে পারে?
এরপর যা ঘটেছিল সেটা খুব সুখকর নয়। ১৯৫৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটা নিউক্লিয়ার রিসার্চ ফ্যাসিলিটি থেকে আমন্ত্রণ আসে। সামীরা যখন একটা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন, বহুদিনের একটা গবেষণা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বেশ খোশমেজাজে গাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। মাঝপথে কী হয়, তার একটা আবছা কষ্টকল্পিত ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি এই পোস্টের প্রথমেই। শুধু ভদ্রলোক নয়, আসলে ছিলেন ভদ্রমহিলা। ইরান নয়, ইজিপ্টের সায়েন্টিস্ট। ওইটুকুই অন্তর। দুর্ঘটনায় গাড়ি পড়ে যায় খাদে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা যান সামীরা। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স ছিল তাঁর।
পুলিশি তদন্তে কিছুই জানা যায়নি। ড্রাইভারের লাশ পাওয়া যায়নি, খুব সম্ভবত সে আগেই নেমে পালিয়েছে। গোলমাল বুঝে হোমল্যান্ড সিকিওরিটি আর এফবিআই কাজে নামে। দেখা যায়, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তাঁকে কোনো চিঠিই পাঠানো হয়নি। পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। চালক কে, গাড়ি কার, কমিউনিকেশন কোত্থেকে হয়েছিল... কোনো কিছুই ট্রেস করা যাচ্ছে না। বোঝাই যায়, ইট ওয়াজ আ প্ল্যান্ড অ্যাসাসিনেশন। একদম নিঁখুত প্ল্যান। কিন্তু কে? কে করতে পারে এ কাজ? কেউই মুখে কিছু বলে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সি আই এ-এর একাধিক আধিকারিক জানায়, এমন পারফেক্ট মার্ডার কারা করতে পারে? যারা আগেও করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব নিউক্লিয়ার সায়েন্সটিস্টদের নিয়ে যারা সর্বক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
মোসাদ!
কন্সপিরেসি থিওরিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। কিন্তু এইরকমের ঘটনা বারবার হলে ভ্রুকুঞ্চিত হয় বইকি। গত পঞ্চাশ বছরে কমবেশি একই ভাবে একশোজনেরও বেশি বৈজ্ঞানিক মারা গিয়েছেন। ১৯৮০ সালে ইরান আর মিশরের ভৌতবিজ্ঞানী ইহায়া আল মেশাদের সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে মৃত্যু হয়। ১৯৮৭ সালে মিশরীয় মাইক্রোওয়েভ সায়েন্টিস্ট সাইদ বাদির রহস্যময় ভাবে মারা যান। ২০১৫ সালে আবু বাকার রামাদানকেও মৃত্যুবরণ করতে হয় একইভাবে। তবে শুধু ইজিপশিয়ান বা আরব নয়, এই লিস্টে ইউরোপিয়ান, এশিয়ান, ভারতীয় সবাই আছে। ভুলে গেলে চলবে না, রাজনৈতিক ভাবে ভারতের সঙ্গে অনেক আরব দেশের সম্পর্ক বেশ ভালো। এর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পঞ্চাশের গোড়া থেকেই মিশর শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার রকেট রিসার্চ প্রোগ্রাম তৈরি করার চেষ্টা করছে। সে সময় জার্মানির কিছু বৈজ্ঞানিক তাদের সাহায্যও করছিল। ১৯৬২ সালে জানা যায় তারা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে, নতুন কিছু টেস্ট মিসাইল পরীক্ষা করতে চলেছে মিশর। মোসাদ কথাটা জানতে পেরেই লাফঝাঁপ করতে শুরু করে, অথচ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা ঝুঁকি সম্পর্কিত কোনো প্রমাণ ছিল না। ( আমি বলছি না, এটা ইজারায়েল সিক্রেট সার্ভিসের একজনের রেকর্ডেড স্টেটমেন্ট) সহসা কে যেন বলে, মিশরকে যারা সাহায্য করছে, সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে কয়েকজন নাকি নাজি পার্টির সমর্থক ছিল। ব্যস! আর যায় কোথায়! ফটাফট Operation Damocles এক্সেকিউট করা হয়, কয়েকমাসের মধ্যেই কয়েকজন জার্মান বৈজ্ঞানিকের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। বাকিরা ভয় পেয়ে কেটে পড়ে। মিশর এর রিসার্চ ডুবে যায়, ফলও হয় মারাত্মক। রাগের বশে একের পর এক বেপোরোয়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। ফলে ইজরায়েল নিজেও জড়িয়ে পড়ে নানা ঝামেলায়। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন খাপ্পা হয়ে মোসাদ চিফ ইসের হেরালের কাছে ত্যাগপত্র চেয়ে বসেন। তিনি মহা বিরক্ত হয়ে জানান, এই মহা ত্যাঁদড় এজেন্সির অদূরদর্শিতা আর অবাধ্যতার খামিয়াজা দিতে হবে ইজরায়েলের সাধারণ মানুষকে। ইন্টেলিজেন্স মানে শুধু গোপন অপারেশন এক্সেকিউট করাই নয়, দেশ ও দুনিয়ার পলিটিকাল স্টেবলিটি বজায় রাখাও তাদের এসওপির মধ্যে পড়ে। সত্যি মিথ্যা বিচার করা আমার কাজ নয়, আমি শুধু তথ্য জানালাম। সব পাবলিক ডোমেনে আছে।
অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু সামীরা মুসার আকস্মিক মৃত্যু নিশ্চিতভাবে সমগ্র মানবজাতির কাছে একটা বড় ক্ষতি। যদি সত্যিই মোসাদের হাত থেকে থাকে এই কাজে, তাহলে এর চেয়ে বেশি আনফরচুনেট আর কিছুই হয় না।
সামীরার করা গবেষণার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা চিকিৎসা পদ্ধতি আজ ক্যান্সার ট্রিটমেন্টে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি বিশ্বসেরা ক্যান্সার স্পেশালিস্টদের বেশ কয়েকজন বলেছেন, সামীরা আর কুড়ি বছরও বেঁচে থাকলে ক্যান্সার রিসার্চ আজ অন্য জায়গায় পৌঁছে যেত। বিজ্ঞানের প্রত্যেকটা ফিল্ডে এক একটা সময় এক একজন মহারথী এসেছেন, যাদের হাত ধরে বিজ্ঞান গবেষণা অন্য লেভেলে গিয়ে পৌঁছেছে। সামীরাও তেমন একজন ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁর যুদ্ধটা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। সময়ের আগেই তিনি এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
সামীরা শুধু একজন। ইরান, মিশর ও সমগ্র আরব দুনিয়ায় এমন ব্যক্তিত্বের অভাব নেই। সম্প্রতি ইরানে যা হচ্ছে, তারপর অনেককে বলতে শুনলাম শুধু পথে নেমে চেঁচালেই বিপ্লব হয় না। বিপ্লব করতে হয় ইজরায়েলের মতো করে, মোসাদের মতো করে। রাস্তায় নেমে স্লোগানবাজি নয়, 'তেরি কেহ কে লুংগা' অ্যাটিটিউডে। মানবজাতির ইতিহাসে এরা সত্যি কোনো কাজ করেছে কি? শুনে সত্যিই দুঃখ হল। আজ্ঞে হ্যাঁ, আরব মহিলাদের অবদান কিছু কম নয়। শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই যত গবেষণা হয়েছে, সে ফিরিস্তি দিলে দিন কাবার হয়ে যাবে। সে কথা থাক। আপাতত, এই বইটা পড়লে আশা করি খানিকটা বেসিক জানা যাবে। পডকাস্টটাও শুনতে পারেন।


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন