ইবোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তুরস্কে গিয়ে। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, ছোট ছোট করে কাটা চুল। প্রথম দেখায় তাকে বেশ ভারিক্কি চালের মাস্টারমশাই বলে মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু সে ইম্প্রেশন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জাদু কি ঝাপ্পি আর দাড়িগালে এক গাল কোমল হাসি সে ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছিল অচিরেই।
কাপাদোশিয়ায় অবস্থিত শহর নেভাশিয়েরে ইবোর আস্তানা। তার বাড়ির সামনে এক চিলতে খালি জমি পেয়ে সেখানে সবজি চাষ করে ইবো। তার ঘরটা অবশ্য খুব গোছানো নয়, সর্বক্ষণ বন্ধুরা এসে ঘাঁটি গাড়ে, বেশ একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেলের মতো আমেজ জড়িয়ে ছিল একতলা বাড়িটিকে। কিন্তু তাই বলে আন্তরিকতার অভাব ছিল না কোনো। ইবো আমাদের জন্য দুর্দান্ত টার্কিশ কফি করে এনেছিল, চটি ফটফটিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কিনে এনেছিল কুকিজ। ইতিমধ্যে আমি চোখ বোলাচ্ছিলাম তার ঘরে। সোফা আর টেবিলে ইতিউতি ছড়ানো টার্কিশ ভাষার বই, চা কফির সরঞ্জাম, গিটার, সিগার আর তামাকের কৌটো, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হ্যান্ডবুক, গানের সিডি... এরই মধ্যে উঁকি মারছিল একটা ডায়েরি। তাতে কলম দিয়ে ফার্সি ভাষায় লেখা নোট। ইবোর আবার ফার্সি শেখার দরকার পড়ল কেন, সে কথা নিজেই জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম, তার আগে ইবো নিজেই আসল কথাটা জানিয়ে দিল।
"টার্কিতে আছি বটে, কিন্তু আসলে আমি ইরানের ছেলে বুঝলে! আমার মাদারল্যান্ড ইরান, যদিও আর আমার সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।"
এ আবার কী রহস্য?
ধীরে ধীরে ব্যাপারটা জানা গিয়েছিল। বছর পনেরো আগের কথা। ইবো ইরানে থাকাকালীন সক্রিয়ভাবে পলিটিকাল অ্যাকটিভিজ মুভমেন্টে জড়িয়ে ছিল। তার মতো অনেক ছেলেমেয়ে, যারা তেহরান, ইস্ফাহান বা সিরাজের মতো শহরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, তারা দেশের দুর্নীতিগ্রস্র সরকারের চাপিয়ে দেওয়া মধ্যযুগীন আইন ও একতরফা জুডিশিয়াল সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ক্রমে ছাত্ররা ডিগ্রি পেয়ে কর্মজীবনে ঢুকেছে কিন্তু তাই বলে বিপ্লব থেমে থাকেনি। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফুল টাইম জার্নালিস্ট বা অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে গিয়েছে আগামীতে, অনেকে আবার চাকরি বা ব্যবসার পাশাপাশি সক্রিয় থেকেছে। একসময় ছাত্র আন্দোলন বলে দাগিয়ে দেওয়া এই নেশন ওয়াইড প্রটেস্টের বৃহত্তর স্বরূপ চাক্ষুষ করা গিয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। ইবোও এই আন্দোলনের কর্মী ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির পাশাপাশি একাধিক ভাষায় দক্ষতা ছিল বলে সে খুব তাড়াতাড়ি ব্লগার আর অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে এগিয়ে আসে। দক্ষতার পুরস্কারও পায় অবশ্য। প্রথমে বারকয়েক হুমকি, তারপর ভুয়ো কেসে সোজা জেল। একেরবার জরিমানা দিয়ে জেল থেকে বেরোয়, একটা বা দুটো প্রতিবেদন লিখতেই আরেকটা কেসে মামলা করা হয় তার নামে। পাশপাশি বাবা মা পরিবারকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার হুমকি তো আছেই। দ্য প্রাইজ ফর দ্য প্রোটেস্ট।
ইরানের এই আন্দোলন চলছে প্রায় তিরিশ বছর ধরে, ২০০০ সালের পর থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী নাম লিখিয়েছে এই বিপ্লবে। তাই বলে ওয়ার্ল্ড মিডিয়া যে এদের নিয়ে খুব লেখালিখি করেছে তা মোটেও নয়। ইরান ও তুরস্কের মতো অনেক দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড রেভোলিউশান চলে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নজিরও কম নয়। অথচ সরকারের কোনো হেলদোল নেই, সমাজ ব্যবস্থা যেন উল্টে পেছন দিকে হাঁটছে। হিটলারও লজ্জা পেয়ে যাবে। সরকার এর বিরোধিতা করেছ কি মরেছ! হাজার হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছে, কয়েজ লক্ষ ছেলেমেয়ে জেলে পচছে। সবাই জানে, ট্রায়ালে পৌঁছানোর আগেই অনেকে প্রাণ হারাবে। আর মামলা যদি শেষমেশ হয়ও, তাহলেও বিচার ব্যবস্থার কথা তো সকলেই জানাই।
ইবোর ভাগ্য ভালো ছিল, পেশাসূত্রে টাকাপয়সা কিছু জমেছিল বলে সময় থাকতে একটা ঠিকঠাক উকিল পেয়েছিল সে। ২০১১ সালেই সে উকিল জানিয়ে দেয়, "তোমার প্রাণ সংশয়ের সম্ভাবনা আছে। বাঁচতে চাইলে আজকেই দেশ ছেড়ে পালাও। ডকুমেন্ট আমি রেডি করে রেখেছি। এখানে থাকলে নিজে তো মরবেই, বাড়ির লোকও প্রাণ হারাবে বেঘোরে। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা চলে না।" মাত্র তিন ঘণ্টার নোটিসে, ইবো এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। জন্মভূমিকে চিরকালের জন্য বিদায় জানিয়ে তুরস্কে এসে থিতু হয়। এরপর দশ বছর কেটে গেছে। বাড়ি আর ফেরা হয়নি ইবোর। সে জানে, ইরান গেলেই মারা পড়বে। নতুন দেশে, নতুন ভাষা শিখে আবার প্রথম থেকে শুরু করেছে ইবো। একটু একটু করে একাত্ম হয়েছে তুরস্কের বাইরে নির্বাসনে থাকা ইরানি বিপ্লবীদের সঙ্গে, তুরস্কের আন্ডারগ্রাউন্ড রেবেল মুভমেন্টের খবরও আছে তার কাছে। সে হেলিন বোলাকের গানের ভক্ত, আমিও গ্রুপ ইয়োরামের গান শুনি জেনে ইবোর সে কি উচ্ছ্বাস! কথায় কথায় সে বলেছিল, "ইরানে হিজাব বাধ্যতামূলক, এই মেডিয়েভাল আইন শেষ করার জন্য আমরা কতই না আন্দোলন করেছি, আর এদিকে সরকার ব্যাপারটাকে ইরানের কালচার বলে চালাচ্ছে। যত ঢং! হিজাব পরা তো শুধু নয়, আসল হল তোমার স্বাধীনতা হরণ করা। তুমি দেখো, একদিন ইরানের মেয়েরাই এদের মজা দেখাবে।"
সেদিন আমিও জানতাম না, ইবোও জানত না, এক বছরের আগেই এ কথা ফলে যাবে। গোটা ইরান জুড়ে মেয়েরা পথে নেমে আসবে, শত চেষ্টা করেও সরকার তাদের মুখ বন্ধ করাতে পারবে না। বাইশ বছরের মাশা ইমানি হিজাব পরেনি বলে ইরানের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে, পিটিয়ে খুন করেছে, এই ঘটনাটা টিপিং পয়েন্ট ছিল ইরানের ছেলেমেয়েদের কাছে। আজ, এই মুহুর্তে যা চলছে, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে। সূদুর কুর্দিস্তান থেকে খাস তেহরান পর্যন্ত হাজার হাজার মেয়ে, যারা এতদিন সযত্নে বিপদ ও বিতর্ক এড়িয়ে চলেছে, তারাও আজ বন্দুকের সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এরই মধ্যে দেখলাম, কয়েকজন আবার ব্যাপারটা কার্দিশ কন্সপিরেসি আর ইজরায়েল পরিচালিত বলে চালানোর চেষ্টা করছে, সত্যিকারের মুসলমানরা নাকি সরকারকে সমর্থনই করছে। শুনে আমার এইসা হাসি পেল। ইবো হলে পাক্কা বিষম খেত হাসতে হাসতে। তার চেয়েও অবাক কথা হল, ইরানের সরকারের অনেকে এখনও মাশা ইমানির ঘটনাটাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জোর পেড নিউজ চালানো হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও একগাদা গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হিজাব পরা নাকি মেয়েদের কর্তব্য। এবং, আইনও বটে। ইচ্ছে না থাকলেও আইনের কথা শোনাই উচিত। এই আইন শুধু পৃথিবীর নয়, জন্নত আর দোজখেরও। মেয়েদের ধর্ম হল, আব্রুর জন্য, মান সম্মান রক্ষার জন্য জান দিয়ে দেওয়া, দরকার পড়লে জান নিয়ে নেওয়া। এটা শুনেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আইন! বছর আটেক একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল আবার। ইরানেরই ঘটনা। তবে কিনা, আমাদের স্মৃতিশক্তি বড়ই কম! সো, লেটস রিওয়াইন্ড আ বিট।
মেয়েটার নাম ছিল রেহানা জাব্বারি। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রথম থেকে। উনিশ বছর বয়সে সে যখন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে শুরু করে, বাড়ির লোকের বুক ফুলে উঠেছিল গর্বে। কেউ জানত না, তাদের আদরের মেয়ের কপালে কী লেখা আছে?
পেশায় দ্রুত নাম করছিল রেহানা। ইতিমধ্যে এক ঘরোয়া গেট টুগেদারে তার সঙ্গে নিজে এসে আলাপ করেন এক সরকারি আধিকারিক, তার নাম মুর্তাজা সারবন্দি। এই সারবন্দি ইরানের গুপ্তচর বিভাগে কাজ করতেন, সরকারি মহলে তার চেনাজানা কম ছিল না। সে রেহানাকে জানায়, অফিসের ভোল পাল্টাতে হবে। একজন ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার দরকার। রেহানার কাজ সে দেখেছে, কিন্তু কাজ শুরু করার আগে দপ্তর দেখে নিতে হবে রেহানাকে। তার ইনপুট শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন মুর্তাজা। রেহানা রাজি হয়ে যায়।
নির্দিষ্ট দিনে মুর্তাজার অফিসে গিয়েছিল উনিশ বছরের রেহানা। তখন সে জানত না, মুর্তাজার মনে কী আছে? তাকে একা ডেকে মুর্তাজা তার ওপর চড়াও হন, রেপ করতে চান। রেহানা আব্রু বাঁচাতে ছুটোছুটি শুরু করে। কিন্তু মুর্তাজা তখন ক্ষুদ্ধার্ত বাঘের মতো তাকে আক্রমণ করছেন। ওদিকে দরজা বন্ধ। এমন সময় রেহানার মনে পড়ে তার কাছে থাকা জেবি ছুরিটার কথা। মাঝেমধ্যে দেওয়ারের প্লাস্টার ছেঁচে দেখতে হয় বলে ছুরিটা সম্প্রতি কিনেছিল সে, সেটা হাতে বের করে নেয়। মুর্তাজা তার ওপর ঝাঁপাতেই সে ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করে। মুর্তাজা আর্তনাদ করে বসে পড়েন, ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্তপাত হতে থাকে। রেহানা কোনোরকমে দরজা খুলে পালায়। পরে জানা যায়, মুর্তাজা অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে মারা গিয়েছেন।
তা, ইরানের সরকারের মুখপাত্র তো বলেছেন, আব্রু বাঁচাতে প্রাণ দিলে বা নিলে জন্নত পাওয়া যায়! সে কথা নিশ্চয়ই মনে ছিল তখন? সবাই উনিশ বছরের মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিল নিশ্চয়ই! আইনও তাঁকে সাহায্য করেছিল দিব্যি।
আজ্ঞে না, তেমনটা মোটেও হয়নি। রেহানাকে গ্রেপ্তার করা হয় পরের দিনই। তার ওপর হত্যার মামলা চালানো হয়, পাশাপাশি চলে অকথ্য অত্যাচার। জেলে রেহানাকে যে পরিমাণ মেন্টাল ও শারীরিক টর্চার সহ্য করতে হয়েছিল, সে কথা তার বাবা পরে জানিয়েছিলেন। বারবার তাকে জোর করা হয় অপরাধ স্বীকার করার জন্য, কিন্তু মেয়েটা ছিল এক নম্বরের জেদি। সে মাথা নোয়ায়নি। একেকবার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে, তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে আগের মতো। শুধু মামলার কারণে অবশ্য তার ওপর অত্যাচার করা হয়নি, পুলিশ ও সরকারের রাগ ছিল অন্য। কেন সে পড়াশোনা করেছে? কেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হয়েছে? কেন সে চাকরি করতে গিয়েছে? বিদেশি গান আর সিনেমা নিয়েও তার এত আদ্যিখ্যতা কেন? তাকে দোষী বলে প্রমাণ করতে গোটা দেশ জুড়ে ফেক নিউজ আর প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে, কিন্তু তাও রেহানার সমব্যাথীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে দিনদিন।
সচরাচর এই ধরনের কেসে মানবাধিকার কমিশন আইনকেই সাপোর্ট করে। ইরানে তো বটেই। কিন্তু রেহানার মামলাটা এতটাই স্পষ্ট আর সরকারের মনোভাব এতটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল যে সারা দুনিয়া থেকে সমর্থন জানানো হয়েছিল তাকে। ই ইইউ, ইউ এন আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইরানের সরকারের কাছে আর্জি করেছিল, ইসলামিক সংগঠনরাও নিন্দা করেছিলেন ইরানের। দেশ বিদেশের আইনজীবীরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই 'ফ্লড ইনভেস্টিগেশন'- এর পয়েন্টগুলো, প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে আত্মরক্ষার্থে কাউকে আঘাত করা কোনোমতেই অপরাধের শ্রেণীভুক্ত নয়। কোনো লাভ হয়নি।
সাত বছর জেলে রেখে নির্যাতন করার পর আদালত রেহানার ফাঁসির হুকুম দেয়। ২৫ অক্টোবর ২০১৪, সারা দুনিয়ার হিউমান রাইটস কমিশন, সরকার, ঊমেন রাইটস আর সাধারণ মানুষের অনুরোধকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তাঁকে তেহরানের গোহরদাস্ত জেলের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। ফাঁসির আগে তার শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়ার মতো সময়ও কারো কাছে ছিল না।
রেহানা জেনে গিয়েছিল, তার নিয়তি কী? ফাঁসির একদিন আগে বন্ধুকে দিয়ে মায়ের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল সে৷ সেই চিঠির কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি।
ডিয়ার মা,
এই দুনিয়াটা আমাকে উনিশ বছর বাঁচার সুযোগ দিয়েছিল। আমার মনে হয়, সেই রাতে, সেই ভয়ংকর রাতেই আসলে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। আমার দেহটা শহরের কোনো অঞ্চলে ডাম্প করে দেওয়া হত, পরে একদিন পুলিশ বডি আইডেন্টিফিকেশন এর জন্য তোমাকে নিয়ে আসত সেখানে। তোমাকে জানানো হত, খুন করার আগে আমাকে রেপও করা হয়েছিল। কিন্তু আমার খুনি কোনোদিন ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের কাছে না আছে তার মতো টাকা, না আছে বাহুবল। এরপর দিন কাটত যেমন কাটে। কয়েক বছর দুঃখ আর লজ্জা নিয়ে তুমি বেঁচে থাকতে, তারপর মরে যেতে তুমি। সব ঠিকঠাক থাকত। কিন্তু কে জানে কোন অভিশাপ ছিল আমার ওপর, এমনটা তো কিছুই হল না।
তুমিই আমাকে বলেছিলে যে মানুষকে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করতে হয়। আমাকে যখন আদালত হত্যাকারীনী বলে কনভিক্ট করছিল, আমি চোখের জল ফেলিনি, প্রাণভিক্ষা চাইনি। চাইনি, কারণ আমি আইনের ওপর ভরসা করেছিলাম। চোখ বুজে ভরসা করেছিলাম।
তুমি জানো মা, সারাজীবনে আমি একটা মশাও মারিনি। আরশোলা মারতে বললেও আমি পারতাম না, বড়জোর তাদের সুঁড় ধরে ঘরের বাইরে ফেলে আসতাম। আর এখন কিনা আমাকে বলা হচ্ছে, আমি প্ল্যান করে একজন মানুষকে খুন করেছি। যারা এই আদালত থেকে ন্যায় পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিল, তাদের সেই ভরসার তারিফ করতেই হয়। তুমি আর এসবের জন্য কেঁদো না মা। একদিন আগেই পুলিশের একজন বয়স্ক অফিসার আমাকে নখ বড় রাখার জন্য যথেচ্চ ভাবে মারধোর করে গেছেন। কেন আমার নখগুলো এত সুন্দর? তবে এ তো রোজকার কথা। কখনও সুন্দর নখ, কখনও সুন্দর মুখশ্রী, কখনও বা সুন্দর হাতের লেখা... এমনকি ভাবনাচিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির সৌন্দর্য এর জন্যও আমাকে মার খেতে হয়েছে। আমার মিষ্টি গলাটাও ওদের বড় সুন্দর মনে হয়, তাই সেটাও বরদাস্ত করতে পারে না...
মা, আমার ভাবনাচিন্তা আজকাল অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তোমাকে একটা চিঠিতে সব কিছু লিখে জানানো সম্ভবও নয়। খুব সম্ভবত তোমাকে না জানিয়েই আমাকে মেরে ফেলা হবে, তখন তুমি এই চিঠিটা পাবে। আমার বন্ধুর কাছে আমি অনেকগুলো চিঠি দিয়ে দিয়েছি তোমার নামে। জেনো, এইটুকুই আমার চিহ্ন।
আর একটা কথা মা। সম্ভবত মৃত্যুর আগে আমার শেষ কথা।
আমি মাটির তলায় শুয়ে শুয়ে পচতে চাই না। আমার চোখ দুটো আর অল্পবয়সী হ্রদয়কে একটু একটু করে ঝুরঝুরে মাটিতে বদলাতে দিতে আমি নারাজ। তোমাকে অনুরোধ জানালাম, মৃত্যুর পর আমার চোখ, হার্ট, কিডন, হাড় সহ শরীরের যে অংশও কারো কাজে লাগে, তাকে উপহার ভেবে দিয়ে দিও। কিন্তু তাকে আমার নাম জানিও না। আমি চাই না, সে আমার জন্য প্রার্থনা করুক।
তোমার মেয়ে
রেহানা
আট বছর আগের ঘটনা। একজন মেয়ে আব্রু বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিল, তাকে সাত বছর জেলে রেখে ফাঁসি দেওয়া হল। আট বছর পরের ঘটনা। সেই দেশেই আবার একজন মেয়েকে বে আব্রু বলে খুন করা হল, সে নাকি আব্রুর মানে বোঝে না।এরপর আরো পঞ্চাশজন প্রাণ হারিয়েছে। দ্য মিডিয়া ইজ সেম, দ্য প্রোপাগাণ্ডা ইজ ইভেন বেটার। আমরাও দু এক মাস এই নিয়ে লাফালাফি করে ভুলে যাব। ভুলবে না শুধু তারা, যারা আজ এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।
হ্যাঁ, চট করে কিছুই বদলাবে না, দেশের সরকার বা আইনও একই থাকবে, কিন্তু প্রাণের সঞ্চার ঘটবে নতুন প্রজন্মের বুকে। কিশোর কিশোরী দু চোখ খুলে দেখবে, সবাই ভয় পায়নি। সবাই ভয় পায় না। এক একজন ঘুরে দাঁড়ায় ঠিকই। তারা আগেও ছিল, এখনও আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
(২০১৪ সালের এই ঘটনার পরেই আমি মিথ্যামেব জয়তের প্রথম খসড়াটা লিখেছিলাম। তখন গোটা গল্পটা শুধু একজন মেয়েকে নিয়েই ছিল। রেহানা। গল্প বদলে গেছে, পরিসর বদলে গেছে, চরিত্রও বদলে গেছে, শুধু রেহানা রয়ে গেছে নিজের জায়গায়।
নোবেলবিজয়ী ইতালিয়ান সাহিত্যিক দারিও ফো রেহানাকে এই পোর্টেটেটা ডেডিকেট করেছিলেন।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন