বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

সঙ্গীত জগতের কিসসা



এক হয় গল্প। এক হয় গল্পের ভেতর গল্প। সেই গল্পের ভেতরেও আবার গল্প থাকতে পারে। কিন্তু সেরার সেরা হল গল্পের ব্ল্যাকহোল। স্পেস টাইমের ঊর্ধ্বে অবস্থিত একটা কিসসাদানি, যার অন্তরালে অসংখ্য গল্পের জমায়েত, মাধ্যাকর্ষণ এর টানের মতোই আবহমান কাল ধরে সে সব গল্প এসে সমাহিত হচ্ছে এই সুরগহ্বরে। হ্যাঁ, কৃষ্ণগহ্বর না বলে সুরগহ্বর বলাই যথাযথ, কারণ এ কিসসাগুলো সব সুরের দুনিয়ার। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস সত্যি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলেরই সমান। যুগের পর যুগ কেটে গেলেও তাঁর শক্তিক্ষয় হয়নি। এই সুরগহ্বরের সিংগুল্যারিটিতে এমন সব বিচিত্র আখ্যান, এমন সব অমীমাংসিত রহস্য রয়ে গিয়েছে, যার সমাধান এখনও হয়নি। অসংখ্য চরিত্র, তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইন আর অদ্ভুত জীবন, তাঁদের ব্যক্তিগত ও সঙ্গীত জীবনের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা এমন সব সূত্র, যা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক দ্রুত কমে আসছে। তেমনই কিছু সূত্র কয়েকদিন আগে চোখে পড়ল। ধীরে ধীরে সূত্রগুলো জুড়ে একটা গল্পের আকার নিল। গল্প অবশ্য সম্পূর্ণ হয়নি, কারণ এই ছোট্ট গল্পটির মধ্যে একটি বৃহৎ গল্পের বীজ লুকিয়ে ছিল। লুকিয়ে আছে। যাই হোক!
১৯৩৭ সালে। ভারতবিখ্যাত এক শিল্পী তার সঙ্গীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে চলেছেন পন্ডিচেরিতে। ক্যায়রানা ঘরানার শ্রেষ্ঠতম গায়ক, বিলম্বিত লয়ের সম্রাট-- যার গলা শুনে শ্রোতারা সত্যি সত্যিই ‘ট্রান্স’-এ চলে যেত, সম্মোহিত হয়ে বসে থাকত সারা রাত, অশ্রুসজল চোখে তাঁর গায়েকি শুনত, মুগ্ধ হয়ে তাঁর সারঙ্গী আর বীণা বাজানো শুনত-- সেই ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ চলেছেন এই গাড়িতে। কিন্তু গন্তব্যে আসার আগেই ঘটে গেল অঘটন। চিঙ্গলেপুট স্টেশন আসতে না আসতেই বুকে ব্যাথা উঠল ওস্তাদের। সে এমন ব্যাথা যে চোখ উল্টে গেল, কপালে রগ ফুলে উঠল, ফেনা বেরোতে লাগল মুখ থেকে। সবাই হায় হায় করে উঠল। ওস্তাদজি! ওস্তাদজি! ওস্তাদজি তখন ঘর্মাক্ত দেহে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে শুয়ে পড়েছেন, তাঁর যন্ত্রণাসিক্ত মুখের পেশীগুলো হয়ে উঠেছে লাল। ধরাধরি করে তাঁকে নামানো হল সিঙ্গারপেরুমোলকল্লি স্টেশনে। খাঁসাহেব তখনও কথা বলতে পারছেন না। ইঙ্গিতে বললেন, জল আনো।
সবাই ছুটে গেল। জল এনে মুখের সামনে ধরল এক স্যাঙাত। ওস্তাদজি সে জল মুখে ঠেকালেন না, অতিকষ্টে উঠে বসলেন বুকে হাত দিয়ে। জল ভর্তি লোটা হাতে নিয়ে হাত পা ধুলেন, নমাজের কলমা পড়লেন মনে মনে। নমাজ শেষ করে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, তারপর স্টেশনশুদ্ধ লোককে অবাক করে দিয়ে শুরু করলেন গান। যন্ত্রণায় ভুরু কুঁচকে উঠছে, স্বর কেঁপে যাচ্ছে। খাঁসাহেবের একটা হাত বুকের ওপর রাখা, চোখ থেকে জল পড়ছে ক্রমাগত! দু একজন তাঁকে থামাতে গেল, কিন্তু ওস্তাদের শিষ্যরা আটকে দিল সবাইকে। তাদেরও চোখে জল! যা বোঝার তারা বুঝে গেছে! ক্রমে স্বর স্পষ্ট হল, সুর নিঁখুত হল, আলাপের তীক্ষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল স্টেশন চত্ত্বর জুড়ে। রাগ দরবারি! ওস্তাদজি রাগ দরবারি গাইছেন। লোকজন হতভম্ব হয়ে শুনল, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ চোখ বন্ধ করে গাইছেন। গাইছেন তো গাইছেনই, আর কোনও কিছুতেই তাঁর মন নেই। আসন্ন মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে কয়েক ঘণ্টা সেই সঙ্গীত আসর চলল, তারপর ইহজগত থেকে বিদায় নিলেন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ।
স্বাধীনতার আগের কথা। তাই মিরজে ওস্তাদজির বাড়িতে খবর যেতে একদিন সময় লাগল। বানুবাঈ বেগম পাথরের মতো মুখ করে সব শুনলেন। অনেক আগের এক স্মৃতি মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি কথা দিয়েছেন! কিন্তু আগে, ওস্তাদজিকে শান্তিতে তাঁর প্রিয় মিরজের মাটিতে শোয়াতে হবে। উঠলেন বানুবাঈ। তাঁর কথামতো খবর পৌঁছে দেওয়া হল ওস্তাদজির আত্মীয় স্বজনদের কাছে, বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও। নির্দিষ্ট দিনে কবর দেওয়া হবে তাঁকে। কিন্তু সঙ্গীত রত্ন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ... তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী মানে তো গোটা মহকুমা, গোটা রাজ্য, গোটা মুলুক! কে এমন আছে যে তাঁর বন্দিশ শুনে চোখের জল ফেলেনি? ধারওয়াড় এর লোকজনদের কাছে তাঁর গান ছিল ঈশ্বরের আরাধনা, তাঁর সারেঙ্গি ছিল প্রেমের ঝরণার শামিল। এত যুগ ধরে উত্তর ভারত আর দক্ষিণ ভারতের কার্নাটিক সঙ্গীতের ধারা সমান্তরাল নদীর মতো বয়ে যেত, খাঁসাহেব দুই নদীর মাঝে সেতুনির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু কী করে? কী করে এই অসাধ্যসাধন হয়েছিল?
১৮৮০ সালের আগে ধারওয়াড় প্রায় ঘুমন্ত নগরী ছিল, লোকজন শান্তিতে জীবন যাপন করত, গানবাজনা নাটক নিয়ে চর্চা করত। কিন্তু সঙ্গীত পরম্পরার দিক থেকে দেখতে গেলে উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের চল ছিল না, বরং কর্ণাটিক মিউজিক মায়েস্ট্রোদের পুণ্যতীর্থ ছিল এই জমি। এমন সময় একটা ছোট্ট বদল এল, তুঙ্গভঙ্গা নদীর উত্তর প্রান্ত মানে কর্নাটকার কিছু অংশ আর মহারাষ্ট্রকে সঙ্গে করে ব্রিটিশরা বম্বে প্রেসিডেন্সির পত্তন করল। মারাঠা মানুষ এর শ্রেষ্ঠত্ব আর ন্যাশনালিজম এর বড়ি গিলিয়ে করা রাজনীতির অভাব সেকালেও ছিল না, কিন্তু এই অঞ্চলের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষকে ওই দিয়ে বিশেষ কব্জা করা গেল না। উত্তর কর্নাটকা আর মারাঠা সংস্কৃতির মিলন ঘটল আর কারওয়ার, ধারওয়াড়, বেলগাঁও, বিজাপুরের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে এই মিশ্র সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে পড়ল। কিন্তু আবদুল করিম খাঁ তখন কোথায়? কী করছেন? সেটা দেখতে গেলে একটু পিছনে যেতে হবে?
আমার বিশ্বাস, দুনিয়ার সব কিছুই মূলে আছে প্রেম। (এবং অপ্রেম! বিচ্ছেদও বলা যায়) এমনিতেও ভারতীয় সঙ্গীতের মূলে এমন সব অসামান্য প্রেম কাহিনির ভূমিকা আছে যে সে নিয়ে এক একটা ক্লাসিক সিনেমা বা উপন্যাস দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। সে সব ভুলিয়ে দিয়ে আজকাল আমরা মার মার কাট কাট করছি। যাকগে!
তা আবদুল করিম ছিলেন মুজাফফরপুরের ক্যায়রানা গ্রামের ছেলে, যেখানে থেকে ক্যায়রানা ঘরানার সূত্রপাত। তাঁর ওয়ালিদ মানে বাবা ছিলেন ওস্তাদ কালে খাঁ, কাকা ওস্তাদ আব্দুল্লা খাঁ আর ননহে খাঁ। সবাই গান বাজনায় এক একজন সুরমা। তা ছোটবেলা থেকেই সেতার, তবলা, সারেঙ্গি, সেতারের শিক্ষা নিয়েছিলেন, গলা সাধতেও শিখেছিলেন। গান গাইতে গাইতে ঘোরে চলে যেতেন সেই বয়সেই, ফলে প্রধানত কী নিয়ে এগোবেন ভাবতে হয়নি বিশেষ। তালিম চলল দীর্ঘদিন। কৈশোর পেরিয়ে ভাই আবদুল হকের সঙ্গে চলে এলেন বরোদা, সে তখন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারদের আখড়া। মুম্বাইয়ে এখন যেমন লোকে কিসমত ফেরাতে যায়, সেকালে গায়ক আর বাজিয়েরা গিয়ে উপস্থিত হত বরোদায়। গুণের কদর বুঝতে কেউ ভুল করে না সে শহরে, ফলে দুই ভাই তুরন্ত দরবারে মোতায়েন হল সঙ্গীতকার হিসেবে। বেতন ভালো, লোকজন সম্মান করে, আর রাজপরিবারের বদান্যতায় হাত উপুড় মাঝেমধ্যেই হয়। আর হাত উপুড় মানে যে পর্বত, সে তো সবাই জানে। লাইফ সেটলড। সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু! কিন্তু... ইয়ে জালিম ইশক! কিসি কো ভি আগোশ মে লে লেতা হ্যায়!
রাজমাতার ভাই ছিলেন মরাঠা গোমন্তক সর্দার মারুতি রাও মানে। তার মেয়ে তারাবাঈয়ের গানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয় ওস্তাদজিকে। তা কী হল কেউ জানল না, কিন্তু গান শেখাতে শেখাতে তারাবাঈ আর আবদুল করিম একে অপরের প্রেমে পড়লেন, আর পড়লেন তো এমন ভাবে পড়লেন সোজা বিয়ে করার কথা ভেবে বসলেন একেবারে। জানাজানি হতে তো কুরুক্ষেত্র শুরু হয়ে গেল! সে যুগে ইন্টার কাস্ট... থুড়ি ইন্টার রিলিজিয়ান ম্যারেজ, তাও কিনা গোঁড়া মারাঠা পরিবারে! কিন্তু বাপ যেমন জেদি ছিল, মেয়ে ছিল তার চেয়েও বেশি জেদি। ইয়ে ইশক নেহি আসান, এক আগ ক দরিয়া হ্যায় অউর ডুব কে জানা হ্যায়... ফিলোসফিটা আত্মস্থ করেছিল মিয়াবিবি। ফলে তারা কিছুতেই দমল না। সেকালে অনার কিলিং হত না, কিন্তু দুজনকেই বরোদা থেকে বিতাড়িত করা হল। ছাড় পেলেন না ওস্তাদজির ভাইও। তা আবদুল করিম খাঁ বম্বেতে গিয়ে থিতু হলেন। সে ১৯০২ সালের কথা।
আগামী দশ বছর ধরে মহারাষ্ট্র কর্নাটকা কোঙ্কণ ঘুরতে ঘুরতে ওস্তাদ আবদুল করিম ক্রমে ভিন্ন ধারার সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতেন। শিষ্যদের তালিম দেওয়ার জন্য পুনেতে আর্য সঙ্গীত বিদ্যালয় খুলেছিলেন, সেখানে কর্ণাটিক আর ক্যায়রানা ঘরানা মিশিয়ে নতুন এক ধরনের শৈলী তৈরি করে ফেললেন তিনি। ক্রমে সেই গান এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে মিশ্র সঙ্গীতের আলাপ শোনাতে ডাক পড়তে লাগল ওস্তাদ আর তাঁর শিষ্যদের। খুড়তুতো ভাই ওস্তাদ ওয়াহিদ খাঁ কে সঙ্গে নিয়েও সব সামলাতে পারেন না তিনি। গোটা বম্বে প্রেসিডেন্সিতে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করছেন তিনি, যেতে হচ্ছে বাইরেও। ওস্তাদ আবদুল করিমের এক অসামান্য গুণ ছিল। কঠিন কথাটা সহজ করে ছাত্র ছাত্রীদের বোঝাতেন, শ্রোতাদের সামনেও অনায়াসে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের গায়েকির রহস্য উন্মোচন করতেন, ফলে দুই ঘরানার গায়েকি নিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহ বাড়তে লাগল। কর্নাটকি সঙ্গীতের ভক্তরা উত্তর ভারতীয় গান শুনতে চায়, উত্তর ভারতীয় শ্রোতারা কর্নাটকি সঙ্গীতের ফরমায়েশ করে। পনেরো বিশ বছরের মধ্যে গোটা দেশ জুড়ে আবদুল করিম খাঁ সাহেবের নাম ছড়িয়ে পড়ল।
এইবার কাহানি মে টুইস্ট। এই বিশ বছর তারাবাঈ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন, তাদের পাঁচ পাঁচটা সন্তান হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের ঘরকন্নার পর তারবাঈ ১৯২২ সালে ঠিক করলেন, সম্পর্ক বিচ্ছেদ করবেন। একশো বছর আগের কথা! ব্যাপারটা খুব সহজ ছিল না, বিশেষ করে এত বছর সংসার করার পর। খাঁ সাহেব স্ত্রীকে ভালোবাসতেন, ধার্মিক গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না, তেমন কোনও বদভ্যাসও তাঁর ছিল না। ফলে তারাবাঈ এই সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন সেটা কেউ জানে না। অনেকের ধারণা, ওস্তাদজির কাছে গান শিখতে আসা এক মেয়েই এর কারণ। তার নাম সরস্বতীবাই মিরজকর, ১৯২০ সালে যখন তিনি ওস্তাদজির কাছে আসেন, তাঁর বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর। দেখতে এমন্ কিছু সুন্দর ছিল না, কিন্তু গানের গলা ছিল অসামান্য।
সে যাই হোক, এর দু বছরের মধ্যেই ওস্তাদজির ঘর ভেঙে যায়, পাঁচ সন্তান ( আব্দুররহমান, কৃষ্ণা, চম্পা, গুলাব আর সাকিনা) কে নিয়ে তারাবাঈ আলাদা হয়ে যান, এবং সিদ্ধান্ত নেন ছেলেমেয়েদের নাম বদলে ফেলবেন। তাদের নতুন নাম হয় সুরেশ বাবু মানে, হীরাবাই বড়োদকর, কৃষ্ণা রাও মানে, কমলা বাই বড়োদকর আর সরস্বতী রাণে। পরবর্তী জীবনে এরা সঙ্গীত দুনিয়ার এক একজন লিজেন্ড হয়ে উঠেছিলেন। প্লে ব্যাক সিঙ্গিংয়ের দুনিয়ায় সরস্বতী রাণে অদ্বিতীয় ছিলেন, হীরাবাই বড়োদকরকে তো সরোজিনী নায়ডু আদর করে 'গান কোকিলা' বলে ডাকতেন। সে অন্য গল্প।
যাই হোক, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ তাঁর কিশোরী ছাত্রী সরস্বতীবাই মিরজকরকে বিয়ে করে নেন এরপর, তাঁর নাম হয় বানুবাঈ লতকর। বম্বে-পুনে ছুটোছুটি করে আর পারছিলেন না বলে মিরজেই পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু এই সম্পর্কে আগের মতো ‘প্যাশন’ ছিল না, স্ত্রী সন্তানকে হারিয়ে খাঁ সাহেব খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন। সবসময় বসে বসে কী ভাবতেন, রাতে জেগে গান করতেন! এই অবসাদ তাঁর গলাতেও ফুটে উঠেছিল, আর সে কারণে তাঁর গায়েকি আরও গভীর, আরও অন্তর্ভেদী, আরও দার্শনিক হয়ে উঠেছিল।
এই বদলে যাওয়া গানের গলা তাঁকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল পরবর্তী পনেরো বছরে, সে কথা এখানে বর্ণনা করা অসম্ভব। এইটুকু বলা যায়, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ না থাকলে আমজনতার অনেকেই ক্লাসিকাল সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হতে পারত না। সেকালে অনুষ্ঠানে সামনে বসে গান শোনাই রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এরপর এল গ্রামফোনের যুগ। ৭৮ আরপিএম-এ রেকর্ড, তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিটের এক একটা রেকর্ডিং ধরা থাকত তাতে। কিন্তু জনপ্রিয় গায়করা সে শুনে নাক কুঁচকেছিলেন। সেটা বোঝাই যায়। এক একটা বন্দিশ যেখানে ঘন্টার পর ঘণ্টা চলে, শ্রোতারা সারা রাত বসে থাকে এক একটা রাগ শোনার জন্য, সেখানে সাড়ে তিন মিনিট সে জিনিস রেকর্ড হবে কী করে? কিন্তু সঙ্গীতকে সাধারণ শ্রোতাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব বুঝেছিলেন কেউ কেউ। ফলে তিন মিনিট শ্রোতাদের রাগদর্শন করোনোর দায়িত্ব (এবং চ্যালেঞ্জ) মাথা পেতে নিয়েছিলেন দুজন শিল্পী। (পরবর্তীতে ওস্তাদ বিলায়ত খাঁ, আমির খাঁ আর পন্ডিত রবিশংকরের মধ্যেও এই গুণটা দেখতে পাওয়া গিয়েছে) প্রথম হলেন, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ। দ্বিতীয় হলেন, রেকর্ডিং জগতের প্রথম তারকা গউহর জান। তাঁর জীবনের গল্পও কিছুটা খাঁ সাহেবের মতোই ছিল। আর্মেনিয়ান ইহুদি হয়ে জন্মেছিলেন, বাবা মায়ের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হওয়ার পর নাম বদল করা হয়েছিল, বদলে গিয়েছিল গোটা জীবনটাই। কিন্তু সে অন্য গল্প।
যে কথাটা বলার, সেটা হল সরস্বতীবাই মিরজকর ওরফে বানুবাঈ খাঁ সাহেবের এই একাকীত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। (সম্ভবত) তাঁর জন্যই যে ওস্তাদজির ঘর ভেঙেছে, সে জন্য মনে মনে নিজেকে দোষী ঠাউরাতেন তিনি। তাই, অনেক বলা সত্ত্বেও সারা জীবনে একটা গানও রেকর্ড করেননি বানুবাঈ। শোনা যায় খাঁ সাহেব তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, আমার মৃত্যুর পর অন্তত একটা গানের রেকর্ড বের কোরো। বানুবাঈ কথা দিয়েছিলেন, করবেন। ১৯৩৭ সালে, খাঁ সাহেবের মৃত্যুর পর, বানুবাঈয়ের প্রথম রেকর্ড বাজারে আসে। এরপর অবশ্য তিনি সঙ্গীতের দুনিয়া থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি মারা যেতে তাঁকে ওস্তাদজির পাশেই কবর দেওয়া হয়েছিল।
এই গল্পের কোনও শেষ নেই। ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ-এর প্রধান শিষ্য সওয়াই গন্ধর্ব, কেসরবাই কেরকরদের লিগেসি আজও জীবিত। খাঁ সাহেবের মাধ্যমে জয়পুর আতরউলি ক্যায়রানা ঘরানার গল্প গিয়ে মিশে গিয়েছে ধারওয়াড়-কোলহাপুর-মিরজ-এ! নর্থ ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল আর কর্নাটিক মিউজিকের এই যৌথ সংস্কৃতি আর ইতিহাসের মাঝে এমন অজস্র চরিত্র আর বাঁক বদলের ঘটনা আছে, যা নিয়ে কেউ বিস্তারিত লেখেনি। এই মিশ্র সংস্কৃতির সঙ্গীত ধারা থেকে উঠে এসেছেন গাঙ্গুবাই হাঙগল, বাসবরাজ রাজগুরু, ভীমসেন যোশী, হীরাবাই বড়োদকর, এমনকি বেগম আখতার আর মোহম্মদ রফিও। গল্পের ধারা এখনও চলছে, পরেও চলবে... কিন্তু কে আর লিখে রাখবে এইসব কাহিনি? খুব দ্রুত আবছা হয়ে আসছে এই ইতিহাস, হয়তো পরের প্রজন্মের কেউ এই গল্পগুলো জানতেও পারবে না। না বলাই থেকে যাবে কত কত গল্প!
মনে পড়ে গেল একটা শের! গালিব বলেছিলেন, ভিনদেশ থেকে এক পরদেশী এসেছে, তাঁর ঝুলি ভর্তি গল্প! কিন্তু কেউ ওর জবান বুঝতে পারছে না যে! কাউকে ডেকে নিয়ে এস তোমরা! গল্পগুলো যে হারিয়ে যাচ্ছে!
बया उरीद गर ईं जा बुवद ज़बाँदाने
ग़रीबे-शहर सुख़नहा-ए-गुफ़्तनी दारद

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন