বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

বিয়াট্রিস উডের প্রেমে পড়ার ফলে...

 


সেনসেশনাল! কথাটা বহুদিন ধরে মিডিয়া হাউস বা সংবাদপত্র দপ্তরের বিজনেস লিংগোতে ঢুকে গেছে। আজকাল তো শুনি মাস কম করে আসা নতুন জয়েনিদের প্রথমেই টার্গেট ধরিয়ে দেওয়া হয়। বছরে এতগুলো 'এস' মানে সেনসেশনাল রেটিং চাই। আমার এক বন্ধুকে তার বস ওরিয়েন্টেশনের সময়েই বলে দিয়েছিল, "ব্রো! ফাক দ্য রুলবুক। টি আর পি মাংতা। মোদ্দা কথা, নিউজকে সেনসেশনালাইজ করা না শিখতে পারলে এ লাইনে কেরিয়ার করার কথা ভেবো না বাপু।"
তা 'সেনসেশনাল' ব্যাপারটা কী 'ব্রো'? অক্সফোর্ড ডিকশনারি তো বলছে, "something or someone causing great surprise, excitement, or interest." কেমব্রিজের মতও প্রায় তাই... "Very good, interesting or unusual." মুশকিল হল, কোনটা যে কার কাছে ইন্টারেস্টিং, সেটা নিয়ে কিছু বলা নেই। আলিয়া ভাটের নতুন লুক যদি বৃহত্তর সমাজের কাছে ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়, তাহলে আর যুক্তি দেওয়া চলে না। (এটা ওই থ্রি ইডিয়টের ম্যাডির ডায়ালগ হয়ে গেল, অব তু আর্গুমেন্ট মে মা কি সাড়ি ঘুসেড়েগা তো হম কেয়া বোল সকতে হ্যায়?) তারা দয়া করে বাকি পোস্টটা পড়বেন না।
আর আনইউজুয়াল বা অস্বাভাবিক বলতে কি শুধু গনেশের দুধ খাওয়া আর অমুক গ্রামে অমুক ছেলের লেজ গজিয়েছেই বোঝানো হয়? অনেকে হয়তো মাথা নেড়ে বলবেন, ওইসব কিছু নয়, সেনসেশনাল হল শুধুমাত্র দুটো জিনিস। লাভ অ্যান্ড পলিটিক্স। উদ্দাম প্রেম আর রাজনীতির অস্তিত্ব থাকলেই একজন ব্যক্তির পাবলিক লাইফ 'সেনসেশনাল' হয়ে যায়। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে বলতে হয়, ইতিহাসে যে সমস্ত সুপার সেনসেশনাল মানুষদের আগমন হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন। সেই সমস্ত অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যারা জীবনকে একশো শতাংশ উপভোগ করেছেন, উদ্দাম প্রেম ও রাজনীতি করেছেন, তাঁদের নাম সমাজ মনেও রাখেনি। এই মুহুর্তে পাঁচ পাতার লিস্ট দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না, কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে একটা জিনিস কমন মনে হয়, এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিকপাল ছিলেন। চুটিয়ে প্রেম ও রাজনীতি যেমন করেছেন, কাজ করতেও পেছপা হননি। কেউ একের পর এক মাস্টারপিস লিখেছেন, কেউ অসামান্য সব ছবি এঁকেছেন, কেউ আবার বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে সাফল্য পেয়েছেন... নেশা ও পেশা দুই ক্ষেত্রেই এদের 'আনইউজুয়াল' চয়েস দেখে আগ্রহ ও কৌতূহল হওয়াই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেনসেশনাল ব্যক্তিদের সূচিতে আজ এরা ব্রাত্য। যাকগে! আমি বরং একজন শিল্পীর কথা জানিয়ে যাই এ সূত্রে। যদি 'মোস্ট সেনশেসনাল পার্সনস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' লিস্ট তৈরি করা হয়, আমার মতে অন্তত তিনি প্রথম সারিতেই থাকবেন।
বিয়াট্রিস উড। গত শতাব্দীর এই মহীয়সী মহিলা সম্পর্কে বলতে বলে বিশেষণ কম পড়ে যাবে। খুব ছোট্ট করে তাঁর পরিচয় দিতে হলে বলা যায় তিনি একজন শিল্পী। কারণ, শিল্প বা আর্ট জিনিসটায় সব কিছুই সমাহিত থাকে। শিল্পী শুনে খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছেন না হয়তো! তাহলে আরেকটা কথা জানিয়ে দিই প্রথমেই। টাইট্যানিক সিনেমার রোজ এর কথা মনে আছে তো? কেট উইনস্লেট যে ভূমিকায় অভিনয় করে গোটা দুনিয়ার হার্টথ্রব হয়ে উঠেছিলেন! রোজের চরিত্রের অনেকটাই বিয়াট্রিস উডের বাস্তব জীবন থেকে তুলে এনেছিলেন জেমস ক্যামেরুন। স্ক্রিপ্ট লেখার সময়েই কাকতালীয় ভাবে বিয়াট্রিসের কথা জানতে পারেন, দেখাও হয় দুজনের। ক্যামেরুন সাহেব বিয়াট্রিসের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়েছিলেন, রোজের চরিত্র তাঁর মাথায় এসে গিয়েছিল তখনই। বিয়াট্রিস সম্পর্কে একটা কথা বলা হয়, "হাউ ক্যান ইউ নট লাভ হার?" এটাই রোজের চরিত্রের প্রথম শর্ত হিসেবে ভেবে রেখেছিলেন পরিচালক ক্যামেরুন। পর্দায় রোজ হয়ে যে আসবে, এভরিওয়ান মাস্ট ফল ইন লাভ উইথ হার!
যাই হোক, বিয়াট্রিসের জীবনে ফেরা যাক। সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মালেও বড় হয়ে উঠেছিলেন নিউইয়র্কের ইস্ট এন্ডে, টাকাপয়সার অভাব কোনোদিনই ছিল না। কিন্তু বিয়াট্রিসের মা বাবা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তাদের বাড়িতে একজন রেবেল জন্মেছে। ক্রমে মেয়ে বড় হল। বিয়াট্রিসের অসামান্য রূপ আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তো ছিলই, তার উপস্থিত বুদ্ধি আর হিউমার দেখে আপ স্টেট সিটিজেনরা ফিদা হয়ে যেত বললে ভুল হবে না। কিন্তু ওপর ওপর যতই 'ফ্লার্ট' করুক না কেন, আসলে বিয়াট্রিসের চোখ আর মন ছিল শিল্পীর। মেধা ও স্মৃতিশক্তি মানুষ হয়তো জন্মগতভাবে পেয়ে থাকে, কিন্তু দেখার চোখ আর মন গড়ে তুলতে হয় আস্তে আস্তে। সে ক্ষমতা বিয়াট্রিস প্রথম থেকেই আয়ত্ত করেছিল।
কিশোরী বয়সেই বিয়াট্রিস বুঝতে পারে, হাই ক্লাস সোসাইটির মেকি হাসি আর আচার অনুষ্ঠান তার জন্য নয়, এখানে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। একমাত্র শিল্প ও শিল্পীদের সান্নিধ্যে থাকলেই সে ভালো থাকবে। সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি দেরি করেনি সে।
মেয়ে 'আর্ট' নিয়ে কেরিয়ার করতে চায় শুনে তো উড দম্পতির আক্কেল গুড়ুম। বিংশ শতাব্দীর শুরু৷ আমেরিকার রুচিশীল সমাজে শিল্প নিয়ে আগ্রহ থাকলেও শিল্পীদের তারা খুব ভালো নজরে দেখত না। (ওই যা হয় আর কি! ভারতবর্ষে এই সেদিন অব্দি এরকম মনোভাবই ছিল। সিনেমা দেখতেও অনেকেই ভালোবাসে, ছেলেমেয়ে অভিনয় করবে শুনলেই মাথায় বাজ পড়ে।) তবে বিয়াট্রিস যাকে বলে পাক্কা খিলাড়ি, সে ঠিক ভালো ভালো কথা বলে বাড়ির লোককে পটিয়ে নিল, আঁকার স্কুলে ভর্তি হয়ে তালিম নিতেও শুরু করল। কিন্তু খুব বেশিদিন নয়, কারণ ততদিনে বিয়াট্রিস ফরাসি সাহিত্যের প্রেমে পড়েছে। ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য তখন মন আঁকুপাঁকু করছে তার। প্যারিসের শিল্পী পাড়া, শিল্প সাহিত্যের ক্রীড়াভূমি, বোহেমিয়ান বিপ্লবের তীর্থস্থান... সেখানে না গেলে চলে? আবার বাড়িতে নেগোশিয়েশন চলল। ভাগ্য ভালো, আমেরিকার সম্ভ্রান্ত ঘরে ফরাসি শেখার চল ছিল, ফলে কেস হ্যান্ডল করা খুব জটিল হয়নি বুদ্ধিমতী মিস উডের কাছে। কয়েক মাস পর দেখা গেল তিনি প্যারিসের জুলিয়ান অ্যাকাডেমিতে আঁকা শিখছেন।
কিন্তু শুধু আঁকা শেখাই বিয়াট্রিসের লক্ষ্য ছিল না কোনোকাল। সে নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দিতে চেয়েছিল শিল্পজগতে, সব ধরনের আর্ট ফর্মের সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছিল যতটা সম্ভব। ফলে অভিনয় শিক্ষা আর রেডিও ড্রামাও শিখতে শুরু করল বিয়াট্রিস। পাশাপাশি স্টেজ অ্যাক্টিংও করছে সে, লিখছে দিনযাপনের ছোট ছোট কথা। সত্যি বলতে বিয়াট্রিসের কাছে সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি ছিল, সেটা হল অভিজ্ঞতা লাভ করা... অফ অল কাইন্ড। বিয়াট্রিস ছিল যাকে বলা যায় 'বাগি বোহেমিয়ান'। অত নিয়ম মেনে কাজ করলে যে শিল্পী হিসেবে কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না, এই কথাটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। লার্নিং কামস ফ্রম দ্য লাইফ। কিছু শিখতে হলে জীবনে এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে, নতুন মানুষ, নতুন ভাবনা, নতুন সমাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে হবে, উজাড় করে দিতে হবে। অবিরাম নতুন কাজ সম্পর্কে ভাবতে হবে, সঙ্গে জীবনকে চুটিয়ে উপভোগও করতে হবে। নতুন মানুষ, নতুন কাজ, নতুন সমাহ, নতুন প্রেম... প্রেমের ব্যাপারে মেয়ে কোনোদিন আপস করেনি। বারবার সে প্রেমে পড়েছে, সে একেবারে কয়ামত সে কয়ামত তক লেভেলের প্রেম। তার প্রেমিকের তালিকা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে, কে নেই তাতে? কিন্তু বিয়াট্রিস একজন প্রেমিককেও বিয়ে করেননি। দু দু'বার বিয়ে করেছেন ঠিকই, সে প্রয়োজন ছিল বলে, পুরোটাই আইনি কারণে, তাদের সঙ্গে প্রেম তো দূর, কোনো সম্পর্কই পাতাননি। এই নিয়ে তাঁর রাখঢাকও নেই। বিয়াট্রিস সে দিক থেকে শুধু বাগি বোহেমিয়ান নয়, বাগি বালিয়াও।
যাই হোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ফিরতে হয়েছিল বিয়াট্রিসকে, কিন্তু অভিনয় আর শিল্পচর্চায় ছেদ পড়ল না। কিন্তু বিয়াট্রিসের জীবনের মোড় ঘুরল ১৯১৬ সালে, যখন ফরাসি শিল্পী মার্সেল দুশাম্প আর সাহিত্যিক হেনরি পিয়ারে রোচের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। দুশাম্প শুধু নামকরা আঁকিয়েই ছিলেন না, ভাস্কর্য শিল্প আর দাবা খেলাতেও তাঁর প্রতিদ্বন্দী বিশেষ কেউ ছিল না। অন্যদিকে রোচে মুভিং আর্ট ফর্ম নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, পরবর্তীতে ফিল্ম ফ্র্যাটারনিটির তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। এই তিন মূর্তি একসঙ্গে আসতেই আকাশে বাজি ছুটল, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দৃশ্যমান হল ছায়াপথে। মানে আর কিছুই নয়, মাঝে মধ্যে ঠিকঠাক কোলাবোরেশান হলে দুনিয়ায় নতুন কিছুর সৃজন হয়। সুব্রত মিত্রকে না পেলে সত্যজিত রায়ের প্রথম সিনেমা ঠিক কেমন দাঁড়াত কে জানে? প্যারিসে মমার্তের ঠেক না থাকলে ইম্প্রেসানিস্ট আন্দোলন হত না, কফি হাউস এর আড্ডা না থাকলে লিটল ম্যাগাজিন এর বাড়বাড়ন্ত কতটা হত বলা মুশকিল।
উড-রোচে-শাম্প যেন দৈবের বশেই জুটি বেঁধেছিলেন। আর্ট ফর্ম নিয়ে একের পর এক উদ্ভাবনী চিন্তা করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়িতও করেছেন একে একে। 'দাদাইজম' কে নতুন রূপে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্বও এই তিন মূর্তির। 'দ্য ব্লাইন্ড ম্যান' আর 'রংরঙ' বলে দুটো ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন তাঁরা, সেখানে প্রচলিত শিল্প মাধ্যমের ঊর্ধ্বে থাকা আর্ট ফর্ম নিয়ে আলোচনা করা হত। শিল্প শুধু মনের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ... আ ওয়ে অফ এক্সপ্রেশন, তার কোনো নির্দিষ্ট 'ফর্ম' বা নিয়ম থাকতে পারে না, এ কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত এই তিনজন। একের পর এক প্রদর্শনী, কন্সার্ট, নাটক করতে করতে বিয়াট্রিসের সঙ্গে শিল্পজগতের পরিচয় হয়। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে নিতে নিতেই এই ট্রায়ো আভান্ত গার্ড(avant-garde) শিল্পীদের নিয়ে একটা বিপ্লব শুরু করে দেয়, সেই বিপ্লবের ফলে আগামীতে অসংখ্য শক্তিশালী শিল্পীর আগমন হয়েছে। এরই মাঝে বিয়াট্রিস নিজেকে খুঁজে যাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে দুশাম্প এর সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়েছে, আবার রোচেও তাঁকে পছন্দ করত বলে অনেকের ধারণা। এই ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে নিউইয়র্কের গলিঘুঁজিতে আলোচনা বড় কম হত না। (সেই নিয়ে রোচে পরবর্তী কালে Jules et Jim বলে এক উপন্যাসও লিখেছেন, ত্রঁফো সেই উপন্যাস অবলম্বনে একটা ফাটাফাটি সিনেমাও পরিচালনা করেছেন, ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমা মুভমেন্টে যার গুরুত্ব অপরীসীম।) কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও বিয়াট্রিস কোথাও না কোথাও নিজেকে খুঁজছিলেন। তিনি যে কাজেই হাত দেন তাতেই সোনা ফলান, সাফল্য পান, কিন্তু আসলে তিনি কী করতে চান? কী করলে তিনি নিজে শান্তিতে থাকতে পারবেন?এই সময়েই বিয়াট্রিসের পরিচয় প্লাস্টিক আর্ট ফর্মের সঙ্গে।
প্লাস্টিক আর্ট নিয়ে বাংলায় বিশেষ লেখালিখি চোখে পড়েনি। প্লাস্টিক আর্ট বলতে শুধু প্লাস্টিক নয়, যে কোনো সিন্থেটিক উপাদানকেই বোঝানো হয়, যাদের মোল্ড বা মডিফাই করে ভাস্কর্য বা সিরামিক তৈরি করা যায়। এমনিতে ভিসুয়াল আর্ট ফর্মের শাখা হলেও প্লাস্টিক আর্টের ভিতর অনেক শাখা আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম ও 'শাটল' হল সিরামিকস। সিরামিক আর্ট বলতে যারা শুধুই পটারি বা চিনেমাটির বাসন ডিজাইন করা বোঝে, তাদের উদ্দেশ্যে জানাই ব্যাপারটা আরো অনেক বিস্তারিত এবং জটিল। খুব ওপর ওপর বললে সিরামিকসকে ভাগ করা যায় স্টুডিও পটারি, টাইলস, ফিগারিনস, টেরাকোটা আর টেবলওয়্যারে। এর প্রত্যেকের নিজস্ব এবং আঞ্চলিক ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, ধারা আছে। সিরামিক আর্টের নিজস্ব জগত আছে, নিজস্ব সত্তা আছে, কদরদান আছে বড় কম নয়। কয়েক বছর আগে সিরামিক আর্টের একটা ভাস বা ফুলদানি তিনশো তিরিশ কোটি টাকায় নিলাম হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই আর্ট ফর্মের প্রতি শিল্পীদের মনোভাব। এক একটা ছোট্ট চিনামাটির টাইল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা বছরের পর বছর কাজ করে যায়, কেউ কেউ অর্ধেক জীবনে একটা বা দুটো ফিগারিন তৈরি করে। এত সূক্ষ, এত জটিল সে কাজ যে জনসাধারণের কাছে ব্যাপারটা অনেক সময় ধরা পড়ে না। আর সেটাই ইউ এস পি। সিরামিক আর্ট হল নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে কথোপকথন চালানো, এক একটা সূক্ষ্ম আঁচড়ের মাধ্যমে নিজের ইমোশনকে প্লাস্টিক ফর্মের ওপর ফুটিয়ে তোলা। সারা জীবন ধরে, নিঃশব্দে এই কাজ, এই সাধনা চলতে থাকে। জনপ্রিয়তা, দেখনদারি বা প্রচারের ইচ্ছে থাকলে এই কাজ করা যায় না।
বিয়াট্রিস অবশ্য দোনামোনা করেননি। প্রথমে আংশিক ভাবে হলেও পরে তিনি পুরোপুরি সিরামিক আর্টের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফিগারিন আর পটারি তৈরি করতে করতে তিনি পরবর্তী তিরিশ বছরে একটা নিজস্ব স্টাইল গড়ে তুলেছেন, নাম দিয়েছেন sophisticated primitives...ক্রমে সিরামিকের দুনিয়ায় লোকে তাঁকে চিনেছে, স্বতন্ত্র ঘরানা হিসেবে বিয়াট্রিসের স্টাইল অনুসরণ করেছে অনেকেই। কিন্তু বিয়াট্রিস নিজে সে সব নিয়ে মাথা ঘামাননি। এক মনে কাজ করে গেছেন, পাশাপাশি উপভোগ করেছেন জীবন। আর দাদাইজম নিয়ে কাজ তো ছিলই, লোকে নাম দিয়েছিল 'মামা অফ দাদা'। দুশাম্প আর রোচে হলেন পাপা। সেই নাম শুনে খিলখিলিয়ে হাসতেন বিয়াট্রিস। নব্বই বছর বয়সে পৌঁছে তিনি চোখ টিপে বলেছিলেন, “I am not the Mama of Dada. I was on the sidelines, in love with two of the men. All these people are dead, and here I am getting the publicity.”
গান নাচ বাজনা শিল্প সাহিত্য ইতিহাস রাজনীতি... সব ক্ষেত্রেই তুখোড় জ্ঞান ছিল তাঁর। রূপে গুণে তো বটেই, কথা বলতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। মিষ্টি গলায় কথা বলতে বলতে আচমকা এমন হিউমারের ফোড়ন দিতেন যে লোকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত, তারপর আবারও মুগ্ধ হয়ে শুনত তাঁর কথা। রাজনৈতিক হোক বা ব্যক্তিগত জীবন, সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পরোয়া করেননি কোনোদিন, তাই বিতর্ক তাঁর সঙ্গেই চলত। সে সব গা করতেন না বিয়াট্রিস, যদিও পেজ থ্রি সেনসেশান হিসেবে তাঁর নাম উঠে গিয়েছিল সম্পাদকদের খাতায়। 'ট্রু লাভ' নিয়ে ভীষণ ইমোশনাল ছিলেন, কিন্তু পলিগ্যামিকে প্রশ্রয় দিতেন না। বয়সকালেও এত সুন্দর আছেন কী করে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিতেন, "I owe it all to art books, chocolate and young men."
এরই মধ্যে ভদ্রমহিলা সারা দুনিয়ায় ঘুরেছেন, দীর্ঘ সময়ে এসে থেকেছেন ভারতেও। সে সব অভিজ্ঞতা শুনলে হাসতে হাসতে পেটে ব্যাথা হয়ে যায়। বিহারের এক নেতার রান্নাঘরে ঢুকে তাঁকে চমকে দিয়েছিলেন, খিল্লি করতে ভালোবাসতেন বিজু পাটনায়েকের সঙ্গে। ভারতবর্ষে থাকাকালীন এখানকার শিল্পের প্রেমে পড়েছিলেন যেমন, প্রেমে পড়েছিলেন এক ভারতীয় বৈজ্ঞানিকেরও। তার নাম জানা যায়নি, কিন্তু এনি বেসেন্ট, জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তি, রুক্কিণী দেবী আরুন্দুলে বা কমলা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্যের কথা কারো অজানা নেই। থিওসাফিকাল সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন সারাজীবনের জন্য। টেরাকোটা থেকে আদিবাসী হস্তশিল্প, সব কিছুর প্রতিই গভীর অনুরাগ ছিল বিয়াট্রিসের, কিন্তু যে জিনিসটার প্রেমে পড়েছিলেন সত্যি সত্যি, সেটা হল সিল্কের সাড়ি। এরপর সারা জীবন সাড়ি ছাড়া কিছুই পরেননি, ক্যালিফোর্নিয়ার ওজাইতে অবস্থিত তাঁর স্টুডিওতেও তাঁকে সাড়ি পরেই দেখা যেত। সবাই দেখে বলত, আ প্রিন্সেস লাইক হার উইল নেভার বর্ন এগেন। বিয়াট্রিস সত্যিকারের রাজকন্য।"
নব্বই পেরোনোর পর লেখিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বিয়াট্রিস উড। পঁচাশি বছর ধরে জার্নাল লিখেছেন, নিজের হাতে আঁকা হাজার হাজার ইলাস্ট্রেশনও ছিলই। প্রথম প্রকাশিত বই এমন হুড়োহুড়ি তোলে যে সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার নিতে চলে আসে। একজন বলেছিল, "শিল্পী না হলে লেখিকা হলে তো পাঠকদের লাভ হত! সব সিক্রেট অ্যাফেয়ারের কথা জানিয়ে দিতে পারতেন লিখে লিখে। এত রাজাগজার সঙ্গে প্রেম করলেন, আমাদের ভাগ্যে তো কিছুই জোটে না।"
সে শুনে বুড়ির কী হাসি! হাসতে হাসতেই বললেন, "ফ্লার্ট করাটাও মন দিয়ে শিখতে হয় বাছা! পরিশ্রম করো, হবে।"
রাজকন্যা আবার হাসতে শুরু করে। সাংবাদিক নাছোড়বান্দা। জিজ্ঞেস করে, "শিল্পীরা নাকি গম্ভীর হয়। আনমনা হয়ে কী সব ভাবে খালি! আপনি এত বড় শিল্পী হয়ে সারাক্ষণ হাসছেন! এত হাসি আসে কোত্থেকে?"
বিয়াট্রিস সাংবাদিকের থুতনি নেড়ে বলেন, "When the ball that was my heart was broken,... laughter fell out. "
বিয়াট্রিস মারা গিয়েছেন একশো পাঁচ বছর বয়সে। সম্পত্তির বেশিরভাগটাই অ্যানি বেসেন্টের হ্যাপি ভ্যালি স্কুল আর সোসাইটিকে দিয়ে গেছেন, শেষ জীবনে ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ি ছেড়ে ওখানেই চলে গিয়েছিলেন। শেষ দিন অব্দি কাজ করে গিয়েছেন, অসুস্থ অবস্থাতেও ডাক্টার আর নার্সদের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতেন। টাইট্যানিক রিলিজ করার সময় পরিচালক জেমস ক্যামেরুন দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাঁকে চোখ মেরে বলেছিলেন, "ছবি আমিও খারাপ আঁকি না। রোজের ছবির জায়গায় জ্যাকের ছবি হলে ছবিটা আরো ভালো হত। রোজ আঁকত, জ্যাক শুয়ে থাকত নেকলেস পরে। কেমন হত বলো?"
বেচারি ক্যামেরুন? তিনি আর কী বলবেন? শুধু নিঃশব্দে হেসেছিলেন। তাদের আর দেখা হয়নি। আফটারলাইফ বলে কিছু একটা আছে বলে বিশ্বাস ছিল বিয়াট্রিসের, সেখানেই পাড়ি দিয়েছিলেন। এখানে সবাই ভুলে গিয়েছে, কিন্তু অন্য কোনো দুনিয়ায় হয়তো সাংবাদিকরা আজও তাঁকে নিয়ে সেনশেসনাল স্টোরি লিখে চলেছেন।
আজ হঠাৎ করেই বিয়াট্রিসের কথা মনে পড়ল।একটা প্যান্ডেলে কিছু সিরামিক আর্টের কাজ দেখলাম, হয়তো সেখান থেকেই। পুজোর প্রথম দিনে সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। সবাই আনন্দে থাকবেন। প্রার্থনা করি, যেন বিয়াট্রিসের মতো চিরদিন হাসিখুশি থাকতে পারেন। হ্যাপি পুজো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন