বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২

অলীক আলেখ

 


জীবনে কোনোকিছুই খুব ভালো করে শিখতে পারিনি, কিন্তু হাত মকশো করা হয়েছে অনেক জায়গাতেই। পাহাড়ে ওঠা হোক বা ষাঁড়ের পিঠে ওঠা, বাদাম বিক্রি হোক বা সফটওয়্যার বিক্রি, সিনেমা হোক বা নাটক... অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হব বলে একেবারে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি। এই করতে গিয়ে সেবার ঢুকেছিলাম অভিনয়ে। স্টেজ অ্যাক্টিং সম্পর্কে আমার মাইনাস লেভেলের জ্ঞান, বিদ্যার ব ও নেই, তাই পেত্থম পেত্থম বেশ মুখ হাঁড়ি করে সব গিলেছি। যদিও অ্যামেচার থিয়েটার ছিল, তাও স্টেজ ব্লকিং, সাবটেক্সট, আলো নেওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা দিব্যি গলাঃধকরণ করেছি। সে গল্প অন্য একদিন বলব। আপাতত এই ছবিটা মেমোরিতে উঠে এল বলে যে কথাটা মনে পড়ছে, সেটা হল এই নাটকটা করার অভিজ্ঞতা। সে কী অভিজ্ঞতা! ওরে বাপ রে বাপ!
অস্কার ওয়াইল্ডের 'দ্য ইম্পর্ট্যান্স অফ বিইং আর্নেস্ট' সর্বকালের সেরা ক্লাসিক বলে গণ্য করা হয়। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে প্রায় প্রত্যেক উইকেন্ডে একটা না একটা শো থাকেই, কোভিডের সময়টুকু ছাড়া সে নিয়মের অন্যথা হয়নি। এই কমেডি নিয়ে অবশ্য নাক কুঁচকানো লোকের অভাব নেই। 'ফার্স' বা লো কমেডি বলে অনেকেই ওয়াইল্ডকে হেয় করেছিলেন এককালে, আবার উইটি ডায়ালগ আর ভিক্টোরিয়ান লাইফস্টাইলকে একেবারে হুবহু মঞ্চে তুলে আনার জন্য তিনি তারিফও পেয়েছেন কম নয়। তা আমাদের পরিচালক অমিতাভদা এই নাটকটার একটা বাংলা ভার্সান লিখে ফেললেন। সেই বাংলাটা হিন্দিতে অনুবাদ করার দায়িত্ব দেওয়া হল আমায়। বাংলা টু হিন্দি অনুবাদ ইজ নট আ বিগ গেম, নামিয়েও ফেললাম। এইবার ঠিক হল, নাটকটা করা হবে হিন্দিতে।
এখন ভেবে দেখি, ভবিষ্যৎ জানার উপায় থাকলে আমি প্রথম দিনই দৌড় মারতাম। কিন্তু আমি ওই যে বলে জাত আর্টিস্ট, ঘটে আর গ্যাঁটে কিছু না থাকলেও শিল্প সাধনা করার অদম্য বাসনা, তাই দুগগা বলে ঢুকে পড়েছিলাম সেই নাটকের রিহার্সালে। হিন্দিটা ঠিকঠাক জানা আছে বলে বড়কা একটা রোল বাগিয়েছি, বেশ উড়ু উড়ু ভাব এসেছে মনে।
কিন্তু দু চার সপ্তাহ যেতে না যেতেই বোঝা গেল, এ ফিল্ড থেকে নামটা বরাবরের জন্য কাটা গেল রে ভাই! ভাবতাম, চান্স পেলে একদম ইন্টেন্স রোল করব, এ তো কমেডি! ট্রিভিয়াল কমেডি ফর সিরিয়াস পিপল! কিছুই হচ্ছে না। একে তো অভিনয় লবডঙ্কা, তারপর নাটকের হিন্দি ভার্সান আমার মোটেও পোষাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে তো আর পালানো যায় না। তাই রিহার্সাল চলতে লাগল (সে মুগলে আজম এর জন্যও এত রিহার্সাল হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে আমার) আর আমিও বলদার মতো সেই পার্ট মুখস্থ করে চালিয়ে যেতে লাগলাম। এদিকে আমার মন সর্বক্ষণ বিদ্রোহ করছে। কোথায় ওয়াইল্ডের লেখা সংলাপ আর কোথায় তার বাংলা অনুবাদ থেকে পাওয়া হিন্দি অনুবাদ। (ঈয়াপ! অনুবাদ। বাংলা চরিত্র করে দিলেই তো অ্যাডাপ্টেশন হয় না, আর নাটক অনুবাদ করলে খিচুড়ি আর অ্যাপল পাই মিশিয়ে যে জিনিসটা হয়, সেটাকে হয় নাটক বলা যায় না, নয় আক্ষরিক অর্থেই 'নাটক' বলতে হয়।) অ্যাক্টিং কেরিয়ার এর প্রথমেই এরকম ক্রিয়েটিভ কনফ্লিক্ট হলে যে কী অবস্থা হয় বলুন দিকি?
খুব ছোট্ট উদাহরণ। এই ধরুন মূল ইংরেজিতে সংলাপ...
Jack: ... That, my dear Algy, is the whole truth pure and simple.
ALGERNON.
The truth is rarely pure and never simple. Modern life would be very tedious if it were either, and modern literature a complete impossibility!
JACK.
That wouldn’t be at all a bad thing.
ALGERNON.
Literary criticism is not your forte, my dear fellow. Don’t try it. You should leave that to people who haven’t been at a University. They do it so well in the daily papers. What you really are is a Bunburyist. I was quite right in saying you were a Bunburyist. You are one of the most advanced Bunburyists I know
এইবার এই ইমোশনটা যদি বাংলা বা হিন্দিতে অনুবাদ করাও হয়, Bunburyist কথাটার হিউমার জিন্দেগিতে আসবে না। যদি বা লেখায় আসে, মঞ্চে সেটা একেবারেই ফুটবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। ফলে ব্যাপারটা দাঁড় করাতে গেলে পুরো ব্যাপারটার সেটিংই পালটে ফেলা দরকার। সে আর হওয়ার নয়! সে যাই হোক, অ্যামেচার গ্রুপে অত ভাবলে চলে না। আর আমিই বা কোন হনু যে আমার কথা সবাইকে বোঝাতে যাব বা বোঝাতে পারব? ফলে হিন্দিতে (অনেকেই বাংলা উচ্চারণেই হিন্দি বলছিলেন, সেটা শুনতে মন্দও লাগছিল না) ব্যাপারটার টেক্সচারই বদলে গেল।
সে যাই হোক, এই বিপুল কাস্ট নিয়ে সেই অসমসাহসী নাটক অবশেষে মঞ্চে নেমেওছিল। আর খুব আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলাম, লোকে বেশ এনজয়ও করছে। আমার এক অসম্ভব প্রিয় বন্ধু(দরকারে ঠোঁটকাটা হয়ে সত্যি বলতে তার বাধে না), তখনকার রুমমেট আর নাটকপাগল (অভিনেতা) ছেলেটিও যখন ভালো ভালো কথা বলতে লাগল, আমি যারাপনাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কেয়া হো গেয়া ভই?
সেই নাটকের একটা স্টিল। সহ অভিনেতাদের (ধুস, সব বন্ধু! কে কার চেয়ে বেশি ছ্যাবলা বলা মুশকিল) কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ। সপ্তর্ষি, যার সঙ্গে সিন করতে আমি প্রথম থেকেই কম্ফোর্টেবল ছিলাম, ফ্লোতে পড়ে মাঝেমধ্যে ক্যারেক্টর ফ্যারেক্টার ভুলে নিজের ম্যানারিজম ঢুকিয়ে দিতাম এবং প্রথম শো তেই ডায়ালগ ভুলে কেলেংকারি হওয়ায় ব্যাটা যেভাবে উদ্ধার করেছিল আমাকে, শ্রীময়ী, কৃষাণু, ঈন্দ্রাণী, 'গবা'দা, তনুশ্রীকেও। অতি অবশ্যই আমাদের পরিচালক অমিতাভদাকে। আর বিশেষ করে ঊর্মি বলে এই মাঝেমধ্যে রেগে যাওয়া মেয়েটাকে, যে অ্যাট লিস্ট আমার ওপর রেগে যায়নি কখনও। নাহলে সিন ঝুলিয়ে একাক্কার করতাম।
নাটক চলাকালীন একটা গোটা গান গাইতে হত একটা সিনে। একেবারে বুকে হাত রেখে বলতে পারি, ওই সাড়ে তিন থেকে চার মিনিটের পিসটাই মঞ্চে আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। ছোটবেলা থেকে গানটা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, অসংখ্য প্রিয় গানের একটা বলা যায়। ওটার জন্যই মুখিয়ে থাকতাম। শেষ মেশ যে নাটক ছেড়ে পালাইনি, তাও ওই গানটার জন্যই। এই সেই গান গাওয়ার সিন

1 টি মন্তব্য:

  1. পরেরবার দেখা হলে গান শুনতে শুনতে ভাঁড়ে চা খাবো।
    ইয়ে কোন গানটা বললে না তো?
    -প্রদীপ্ত

    উত্তরমুছুন