শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬

নদীর জলে একটা নৌকো।অন্ধকার হয়ত হয়েছিল।আপেলগুলো মিষ্টি ছিল।রেডিওতে ব্যাটারি কমে এসেছিলো।হাওয়া চলছিল না সেদিন।আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম।তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে।

নদীর জলে একটা নৌকো।ভোর হচ্ছিলো।সূর্যের আলো তখন তোমার চোখে এসে লাগেনি।ফ্লাস্কে করে আনা চা কাপে ঢেলে নিয়েছিলাম।ধোঁয়া উঠছিলো চায়ের কাপ থেকে।আমি তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম।তুমি কথা বলছিলে নদীকে দেখে। 

নদীর জলে একটা স্টিমার।স্টিমারের ভোঁ এর শব্দে তোমার কথা শুনতে পাইনি।তোমার চুলগুলো উড়ছিল প্রচন্ড হাওয়ায়।বাদামওয়ালা ছেলেটা কানের কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করছিলো।আমি নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।নদী কথা বলেনি। 

নদীর জলে একটা কার্গো জাহাজ।পাশে দাঁড়িয়েছিল অন্য মালবাহী জাহাজগুলো।সরু হয়ে আসা জলের ওপর চলছিল স্টিমারের দল। তুমি আর সেখানে আসতে চাওনি।তোমার ভালো লাগতো না।রোদ বেড়েছিল।নদীর কালো জাল আমার দুঃস্বপ্ন ছিল কি?কেউ কথা বলেনি। 

আমি বসে ছিলাম নদীর ধারে। শুকিয়ে যাওয়া নদী।জল নেই।ভোর হয়,রোদ বাড়ে,বিকেল হয়,রাত আসে।তোমাকে আসতে দেখি না।নদী চলে গেছে তোমার মত।আকাশ মুখ ফিরিয়ে থাকে।আমার চোখে ছলকে পড়া কয়েক মুহূর্ত ভবিষ্যৎ।আর কোনোদিন কথা  হবে  না। 



শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

দাসত্বের হাজার বছর আর তাড়া করে না আমায়।পিছন থেকে আওয়াজ দেয় না ধেয়ে আসা আগুন আর রক্তপাতের উল্লাস।নির্বাসনের আগত সমাপ্তির কথা ভাবতেও আর ইচ্ছে করে না।নতুন নাম নেওয়া হয়নি,আর নেবও না।আর্থিক স্বচ্ছলতা আর আদর্শের নিশ্চয়তা ছাড়াও বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছি।কলেজে পড়ার সময় যে গানের কলি শিখে ভুলে গেছিলাম,গিটার চলে গেছিলো আলমারির আড়ালে,সেই গানের লাইন আওড়ালে আর গিটারের বোল তুললে যে পয়সা ফেলে এদেশে সে আমার জানা ছিল না। পালিয়ে আসার মাসুল চুকিয়েছিলাম লেখাপড়ার নিস্পত্তি করে।কিন্তু জ্ঞানবৃদ্ধির সুযোগ জুটে গেছে বিনিপয়সাতেই।খালি পরীক্ষার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে গেছি।টিমটিমে আলোর নীচে দিয়ে কানা গলি দিয়ে হেঁটে আসি,অসুখ করা পুরোনো বাড়ির আহ্লাদী ছোট ঘরটায়।চে বিদায় নিয়েছে,বিদায় নিয়েছে মাও,কি করে যেন টেবিলে এসে জায়গা দখল করেছে,ভয় ভয় পাওয়া মুখে একটা ট্রাম্পেট।কালশিটের রং যদি বা না যায়,মিছিল এর উৎসাহ আর বিপ্লবের উন্মাদনা চলে গেছে প্রয়োজনে,অবিশ্বাসে আর সময়ের আহ্বানে।নতূন করে ভেবেছি,কোথায় ভুল ছিল?আদর্শে ভুল ছিল না,ভুল ছিল না বিশ্বাসে।খালি একটাই অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা।নিজের বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার,যারা শুনতে চায় না,তাদের জোর করে শোনাবার।যারা বুঝতে চায় না,তাদের কানের সামনে চিৎকার করার।মানুষ বদলায়নি,শাসন বদলায়নি,আমরাই বদলে গেছি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।পল সেজান নিজের দৃষ্টিকোণ চাপিয়ে দেননি কোনোদিন,ফেলিনি জোর করে কারোকে সিনেমা দেখায়নি,ডিলান নিজের জন্যেই গান লিখেছে।কিন্তু সেই শিল্পে পৃথিবীর চেহারা পাল্টেছে,মানুষের মন পাল্টেছে।আমরা গান শুনতে চাই,বক্তৃতা নয়।গান শুনিয়ে বিপ্লব হয়েছে বলে আমাদের জানা ছিল না।এস্তোনিয়ার সিংগিং রেভোল্যুশন এর কথা জানতাম না।দাসত্বের হাজার বছর তাড়া করে না আর তাই,গিটারে আমার বিপ্লব। বন্দুক দেখলে ঘেন্না হয় না,করুণা হয়।আমার বিপ্লব চলবে,নানা দেশে,নানা ভাষায়,গান গাইবো,গান শোনাবো।যদি একজনের চোখেও জল আসে এই গান শুনে,তাকে কেউ বাঁধতে পারবে না। সে স্বাধীন  ...চিরকালের জন্যে। 

শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬

১)
"খুন্দন ব্রিজ খুন্দন ব্রিজ" চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলো।খুন্দন ব্রিজ। আরে,এখানেই তো নামার কথা। জীপের মধ্যে জানলার ধারে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে!হুড়মুড় করে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে নেমে পড়লাম।জীপের আর কোনো যাত্রী নামেনি এখানে।বিচ্ছিরি হর্ন বাজাতে বাজাতে জীপটা ঘোরানো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।চারপাশে নজর ফিরিয়ে দেখলাম,অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়।চারপাশে দোকান বাজার বলতে যা ছিল,এই ঘনঘোর বৃষ্টির মরশুমে সবই বন্ধ প্রায়।গায়ে গরম কম্বল মতন জিনিস চাপিয়ে সামনের চায়ের দোকানে যারা মাফলারের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে,তাদের কারোরই চোখে আমাকে দেখে কৌতূহলের উদ্রেক হলো না।রাস্তার পাশে একটা জীপ স্টার্ট করা অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে গর্জন করছে,কিন্তু ড্রাইভারের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।এর মধ্যে আবার টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে রেইনসুট বের করে মাথায় গলালাম।ঝামেলা যখন পাকিয়েই ফেলেছি এত তাড়াতাড়ি হার মানলে চলবে না।রুকস্যাক এর বেল্ট কোমরে কসে এগোলাম চায়ের দোকানের দিকে।দোকানের এক পাশে একটা চালার ঘরে উনুন বসেছে,ত্রিপল দিয়ে ভালোভাবে ঢাকা বলে জল পড়ছে না।জনাকয়েক যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,তাদের কাউকেই শহরের লোক মনে হলো না।একটু কথা বার্তা চালানো দরকার।দোকানির কাছে মুখ বাড়িয়ে এক কাপ গরম চা বলে দিলাম,তারপর একগাল হেসে বললাম,"বারিশ ওয়ারিশ রুকেগা কি নাহি?ই সময় য়েহি হাল রেহতা হ্যায় ক্যা ভাইয়া ?"কয়েকজন এর চোয়াল নড়ল,বাকিরা বোধহয় বুঝলোই না এক বর্ণ। আমি আবার চেষ্টা চালালাম,"সরজি।থাচি জানা হ্যায়।কুচ গাড়ি-উড়ি মিলেগা?"কেউ উত্তর দিলো না।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার একই কথা বললাম।এবার উত্তর এলো পাশের লোকটার কাছ থেকে।"অভি সব বন্ধ হ্যায়। রস্তা টুট গায়ে পহাড় গির কে,কুচ ভি নাহি মিলেগা। "শুনে মাথায় বাজ পড়লো। গোদের ওপর বিষফোঁড়া।বেজায় রাগ হলো বৃষ্টির ওপর।বৃষ্টির চোটে ল্যান্ডস্লাইড হয়ে রাস্তা ভেঙে যাওয়া এখানে রোজকার ব্যাপার এই মরশুমে।কিন্তু কোনো না কোনো উপায় তো থাকবেই,রাস্তা ভাঙা হলে কি আর লোকজন চলা ফেরা করবে না ?একটু ভুজুং ভাজুং দিয়ে যদি কোনোরকম পথ বের করা যায়,দেখেছি পাহাড়ে জঙ্গলে সব জিনিসেরই একটা অল্টারনেট খুঁজে রাখা হয়।কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,"অরে নাহি সারজি ,বহুত জরুরি হ্যায়।আপ কোই জুগাড় বাতাও।"বলেই দোকানি কে বলে ওর জন্য আরেকটা চা বলে দিলাম।লোকটি নির্বিকার চিত্তে নতুন আনা চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললো,"আগার জানা হি হ্যায় তো পায়দল জাইয়ে।এক রাস্তা হ্যায় পায়দল জানে কে ওয়াস্তে,৩-৪ ঘন্টা লাগ্ যায়েগা।"দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটার পাশে গিয়ে বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম।
2)
সহজের কথা
অতীন্দ্রিয়বাদ অথবা transcendentalism যাদের রক্তে,তাদের কোনো কথা বোঝানোর চেষ্টা করেই লাভ হয়না।যা হয়েছে,যা হচ্ছে,যা সবই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের existence এর জন্যে,এমনকি আমাকে না বলে হুট্ করে তির্থান থেকে পালিয়ে আসাতেও যে অনুসূয়ার কাছে transcendentalism তাতে কোনো সন্দেহ আমার নেই।এমন বান্ধবী পেলে যে বেশিরভাগ ছেলেদের প্রেম করার নেশা দুদিনেই ছুটে যেত,সেই সম্পর্কেও আমার বিশ্বাস অটল।এমন বোহেমিয়ান আর পাগল মেয়েও যে থাকতে পারে,না দেখলে বিশ্বাস করবে কেউ?তাও বিলেত আমেরিকায় নয়,হিপি পান্ক দের আখাড়ায় নয়,মধ্যবিত্ত বাঙালীর বাড়িতে।অনুকে প্রথম দেখি কলেজ সোসাইটির রিক্রিয়েশন ক্লাব এ।শর্টস আর পুলওভার পরে বই হাতে বসেছিল মাঝের দিকে,মঞ্চের দিকে একবার ও দৃষ্টি দেয়নি।গভীর মনোযোগে পড়ছিল হাতের বইটা।সামনের সারিতে বসা শাড়িপড়া মহিলাদের ভ্রুকুটি তাকে একবারের জন্যেও অস্থির করেনি।সুন্দরী মনে হয়নি ওকে,কিন্তু চোখ আটকে গেছিল কিসের টানে কে জানে!তার বেমানান পোশাক আর সাবলীল ভঙ্গি আমাকে শান্ত থাকতে দেয়নি সেদিন।পরের চার বছর।কি করে যে আমাদের সম্পর্কটা তৈরী হয়েছিল আমিও ঠিক জানি না,হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলাম আমার কোলে মাথা রেখে অনু,অনুসূয়া  শুয়ে আছে ময়দানে।চুল এলোমেলো,মুখ শান্ত,চোখ দুটো উজ্জ্বল।যেমন থাকে আজও।
অনুর পছন্দ-অপছন্দ,চিরকাল অন্য ঘরানারই ছিল।প্রথম প্রথম অবাক হলেও আস্তে আস্তে আমি বোধহয় তার মতনই হয়ে গেছিলাম খানিকটা।তার পছন্দের কান্ট্রি মিউসিক,ঢোলা ফ্যাশন এর ভক্তি,পাহাড় জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার নেশা হুট হাট করে,একটু একটু করে আমাকেও গ্রাস করেছিল।আমি যে অনুর সাথে দেখা হওয়ার আগে খুব বাধ্য ছেলে ছিলাম তা নয়,কিন্তু পৃথিবীটাকে অন্য রকম করে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেউ করেনি আমাকে।ধীরে ধীরে আমিও মেতে উঠলাম ওর সঙ্গে,ওর অবান্তর ফিলোসফিতে,impractical জীবনদর্শনে আর অতিন্দ্রিযবাদের চরিত্রায়নে।কিন্তু একটা তফাৎ রইলো,থাকবে।অনু হলো স্বভাবপাগল,তার পাগলামি আমার সঙ্গের তোয়াক্কা করে না,সে অন্ধের মতো সে নিজের মনের কথা শোনে।আমি স্বভাবপাগল নই,আমার পাগলামির আনন্দ অনুর সঙ্গেই,ওকে ছাড়া নয়।এই সমস্যাটা অবশ্যই আমার নিজস্ব কেননা অনু প্রথম থেকেই ওর স্বভাব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছে বেশ কয়েকবার।সাবধান করতে চেয়েছে আমাকে,বুঝিয়েছে যে তার গতিপথ গতানুগতিক নয়,সকলের মত সে life সেগমেন্টেশন এ বিশ্বাস করে না,কিন্তু প্রতিবারই আমি জোর করে তার কথাগুলো উড়িয়ে দিতে চেয়েছি।অনুর সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে আসাটা যে নিরামিষ বাঙালি ছুটির আমেজে হবে না,সেটা না বুঝেই জোর করে ওর সঙ্গে এসেছি এইবার।আগে কোনোবারই যদিও হাজার বলা সত্বেও সে আমাকে সঙ্গে নেয়নি,এইবার একরকম ভাবে ঝুলেই পড়েছিলাম।কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছি,দাল মে কুছ কালা হ্যায়।মানালির নাম করে বাড়ি থেকে বেরোলেও সেখানকার মত টুরিস্ট স্পট যে অনুর জন্যে না,তা বুঝতে আমাকে বেশি বেগ পেতে হলো না।সে খুঁজে খুঁজে বের করে অজানা সব জায়গা আর হুট করে পাড়ি জমায় কোনো রকম প্ল্যান ফ্ল্যান না করে।যদিও আমিও কোনকালেই ননীর পুতুল ছিলাম না কিন্তু অনুর মত stamina আমার নেই,সে রীতিমত ন্যাশনাল লেভেলের এথেলিট,তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে গত এক সপ্তাহে।কিন্তু এমন চরকি ঘোরান ঘুরেছি যে এই অঞ্চলের মানচিত্র প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।মানালিত়ে না গিয়ে অনু প্রথমেই গিয়ে উঠলো,কসোলএ।কুল্লু থেকে পূর্বদিকে পার্বতী নদীর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দু ঘন্টা গিয়ে পৌছতে হয় এই ছোট্ট জায়গাটায়,লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে।সেখানেও না থেমে অনু চলে গেল তোশ এ।ভারসেনি গ্রাম থেকে প্রায় চার ঘন্টা ট্রেক করে তোশ পৌছে আমরা আস্তানা গাড়লাম জমদগ্নি ঋষির মন্দিরে বাইরে কাঠ দিয়ে বানানো ছোট লগ কেবিনে।
 ৬টা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার,তিন দিন কেটে গেল সেখানে।অনু বই পড়ল,ট্রেক করলো,আকাশ দেখল,গাঁজা খেল।বসে রইলো ঘন্টার পর ঘন্টা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে,পাহাড় দেখল দু চোখ ভরে,আর আমি ওকে দেখলাম।কি নিশ্চিন্ত!কি নির্বিকার!পাহাড়ের মধ্যের ছোট সেই গ্রামে রাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ে থাকলাম অনুর মুখের দিকে,প্রতিদিন
..তোশ থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মালানার উদ্দেশ্যে,যেখানে নাকি আজও আলেকজেন্ডারএর বংশধরেরা থাকে,ভারতীয় কোনো নিয়ম সেখানে না চললেও মালানা বিখ্যাত সারা পৃথিবীতে এখানে চাষ করা আফিমের জন্যে,যার নাম ডাক ছড়ানো মালানা ক্রিম বলে।
 মালানা থেকে নাগর হয়ে তির্থান ভ্যালি।অনু ক্রমে ক্রমে আরো অজানার দিকে,আরো আদিমতার দিকে চলছে,তির্থান এ টুরিস্ট বলতে দু তিন জন বিদেশী bagpackers.লোকেদের কাছে এ জায়গা অচেনাই রয়ে গেছে internet এর যুগে এসেও,যদিও বেশি লোক আসা যে ভালো নয় এসব জায়গার জন্যে,আমিও বুঝতে পারি।মান্ডি,লার্জি,গুসায়নি হয়ে তিরাথান পৌঁছতে হয়,পুরো এলাকাটাই গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক এর অংশ।


একটা সরকারী ছোট বাংলো ছাড়া কথাও কিছু নেই,শুধু তির্থান নদীর স্রোতের শব্দ,পাখির ডাক,সূর্য ওঠা ও নামার অনুভূতি..ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি যত আমরা মানুষজন থেকে দুরে সরছি অনু আরো চুপচাপ,আরো শান্ত হয়ে যাচ্ছে।আমার সাথে কথা আর বলছে না বললেই চলে,কোনো মানুষের চিহ্ন দেখলেই নদীর পার দিয়ে হেঁটে গা ঢাকা দিচ্ছে বড় বড় পাথরের আড়ালে,এমনকি আমার দিকে চোখ পড়লেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইচ্ছাকৃত ভাবে।দিন কাটছে ওর ডায়রির(অথবা বই)এর পাতায় কি সব লিখে,আর সামনের দিকে চেয়ে থেকে।এরকম জায়গায় আমাদের মত শহুরে লোকেদের ভাববিহ্বল হওয়া স্বাভাবিক,কিন্তু অনু যেন নিজের থেকেও পালিয়ে গিয়ে মিশে যেতে চাইছে বনে পাহাড়ে,নদীর জলের রেণুতে,আকাশের মেঘ হয়ে থেকে যেতে চাইছে এখানেই...তার খামখেয়ালী স্বভাব আমার অজানা নয়,এও অজানা নয় যে প্রকৃতির কোলে এলে ওর কিছুই মাথায় থাকে না,কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি হবে বলে ভাবিনি।এই নিয়ে আজ তিনদিন হলো তির্থানে।কাঠের আগুনের ওপর ঝলসানো তির্থান নদীতে ধরা ট্রাউট দিয়ে ডিনার করলাম আমরা।আগুনের কমলা আলোয় অনুকে দেখে কোনো রকম চিন্তা করতে ইচ্ছে হলো না,তার মুখে হাসি...গুন গুন করে গাইছে তার প্রিয় গান..ধীরে ধীরে উঠে সে এগিয়ে এলো আমার দিকে।আমার পাশে এসে বসলো..সামনের আগুন ছাড়িয়ে তির্থান নদী পর্যন্ত গানের সুর ভেসে যেতে লাগলো...

ঘুম ভেঙ্গে গেল।পাশ ফিরতেই অনুর গিটারের তারে আঙ্গুল লেগে ঝন ঝন করে উঠলো,অনু ঘরে নেই।গিটারের গায়ে লাগানো স্টিকনোট কালকের গান গেয়ে চলেছে.."Country roads, take me home..to the place I belong....থাচি"
৩)
দু সপ্তাহ আগে জিগ্গেস করলে আমি থাচি আর রাঁচির ভৌগোলিক পার্থক্য বুঝতে হিমশিম খেতাম,কিন্তু সেই বলে না খিদে পেলে বাঘে ঘাস খায়।অনুর সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে নিজের তাগিদেই সব জেনে নিতে হয়েছে,সে কবে কোন দিকে বেরিয়ে পড়বে না বললে জানার উপায় নেই।বেগতিক দেখে বাধ্য ভূগোলের ছাত্রর মতো ম্যাপ গিলে খেয়েছি,লোকেদের জিগ্গেস করে রেখেছি পথঘাট।যদিও এখনো অনেক ভুল বজল হয় কিন্তু এইটুকু জানি যে চণ্ডিগড় থেকে মানালি যাওয়ার রাস্তাতে,সুন্দারনগর,মনডি আর তারপর কুল্লু পড়ে।কুল্লু থেকে detour নিলে পূর্বদিকে নাগর,কাসোল,মানিকরণ,আর মনডি থেকে পূর্বদিকে ঘুরলে পড়ে জালোরী পাস,তির্থান,থাচি ইত্যাদি ছোট ছোট জায়গা।


পারতপক্ষে এদিকে লোকে কম আসে,কিন্তু গাইড বুক দেখতে দেখতে আশেপাশের নামগুলো মুখস্থ হয়ে গেছিল।ভাগ্যিস হয়েছিল,না হলে আজকে আমার দশা পাগলের মত হত।সকালবেলায় অনুর লেখা পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম,সে একাই থাচির দিকে এগিয়ে গেছে।আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল না কেন,সে কথাও আন্দাজ করেছি।যতদুর মনে হয় আমার সঙ্গ তাকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে পারছিল না,আমার তাকে চোখে চোখে রাখা,খাবার এগিয়ে দেওয়া তার হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় বাধা দিচ্ছিল।তড়াঙ করে উঠে,ব্যাগ গুছিয়ে বেরোতে না বেরোতেই তুমুল জোরে বৃষ্টি নামে।বহু কষ্টে একটা ল্যাড়ঝ্যারে বাস যদিও বা পেলাম,খুন্দন ব্রিজে নেমে এই কান্ড।শেষমেষ হেঁটেই এগোলাম থাচির দিকে,বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এখন।জোরে পা চালাচ্ছি,এখন ভালয় ভালয় অনুর দেখা পেলে হয়।না হয় একটু রেগেই যাবে আমাকে দেখে,কিন্তু ভয় হচ্ছে থাচি থেকে যদি সে এগিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে খোঁজা আমার পক্ষে অসম্ভব।থাচি থেকে বেশ কয়েকটা ট্রেক আরম্ভ হয়,এদিকটায় ঘন জঙ্গল আর পাহাড় কোনো জনবসতি নেই।এরকম সময় এই বৃষ্টির মধ্যে না জেনে শুনে কোন পথে যাব অনুকে খুঁজতে?

4)
অনুর কথা

হয়তো অনেক আগেই আসা উচিৎ ছিল।আসা হয়নি,কিন্তু একদিক থেকে দেখলে ভালোই হয়েছে। বাবা মায়ের হাত যে যদি ছোটবেলায় এখানে আসতাম,আজ এখানে দাঁড়িয়ে যা অনুভব করছি তা কি করতে পারতাম তখন?হয়তো পারতাম,হয়তো পারতাম না।সম্ভাবনার অঙ্কের নিয়ম এখনো আবিষ্কৃত হয়নি বলেই পৃথিবীটা আজও খানিকটা অকৃত্তিম,খানিকটা পবিত্র রয়ে গেছে।মানুষ বড় ছটপটে,কোনো সুন্দর জিনিসকে নিজের মতো থাকতে দেয় না।সব কিছুর ওপর তার নির্বিশেষ অধিকার চাই।যতক্ষণ না কাটাছেঁড়া করছে ততক্ষন শান্তি নেই।শিল্প হোক অথবা প্রকৃতি,অথবা মানুষ নিজে,সকলকে নিয়ে অবিরাম চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকে।কখনো ল্যাবে,কখনো ড্রয়িং রুমে আবার কখনো জটলায়।কোনো ভালো জিনিস কি শুধুই নিজের মতো করে স্মৃতির কোনে রেখে দেওয়া যায় না?নিজের মত থাকতে দেওয়া যায় না কোনো দৃশ্য কে?কোনো অনুভূতিকে?কবিতা লিখে লোককে না দেখলে কি তার গুরুত্ব কমে যায়?আমার কাছে অন্তত না।সকলকে নিজের মতো থাকতে দিলেই তারা সবচেয়ে খুশি থাকতে পারে,মহৎ থাকতে পারে। থাচিতে এসে আরেকবার সেটা বুঝতে পারছি।

সহজের জন্য যে একটু খারাপ লাগছে না তা নয়।কিন্তু ওকে না নিয়ে এসে কোনো উপায় ছিল না।সে যে আমার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে এই কয়েক বছরে,হিমাচলে ওকে না নিয়ে এলে বুঝতে পারতাম না কোনোদিনও।কোনো রকম প্রশ্ন না করেই সে আমার সঙ্গে চলছে প্রথম দিন থেকে।কোনো ভাবেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারিনি যে ওকে ভালোবাসলেও ওর সঙ্গে থাকতে পারবো না আমি কোনোদিন।কারো  সঙ্গে থাকলেই তার জীবনের নিজস্ব ভাব,অনুভূতি,পছন্দ অপছন্দ একটু হলেও বদলাতে থাকে।সেটা আমি পারবো না। নিজের অজান্তেই আমি ওর জীবনে দখল দিয়ে চলেছি চার বছরের বেশি।আমার কোনো রকম বোঝাপড়া করতে হয়নি কোনোদিন ওকে ভালোবেসে।কোনো রকম কম্প্রোমাইস করিনি নিজের পছন্দ অথবা সিদ্ধান্তে। কিন্তু সহজ যেন একটু একটু আমার মতোই হয়ে যাচ্ছে। যদিও সেটা খারাপ কিছু নয়,তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার সে কি করবে,কি পছন্দ করবে কি করবে না ,কার সাথে থাকবে কার সাথে থাকবে না...কিন্তু তার সঙ্গ কোথাও না কোথাও আমাকেও তার ওপর নির্ভর করে তুলছে।সে আমার সঙ্গে থাকলে আমার মনে কি ভাব আসবে,আর এক থাকলে আমার কি মনে হবে সেটা নিশ্চিতভাবে এক নয়।তোষ অথবা তীর্থান,পাহাড় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন খেয়াল হয়েছে,মনে হয়েছে অনেকক্ষণ  সহজকে দেখলাম না তো?সে তো খাবার অথবা চা নিয়ে এলো না রোজকার মত?কোথায় গেলো সে?কিন্তু একা থাকলে কি আমি এরকমই ভাবতাম?নিশ্চয়ই না।সহজ আমাকে চোখে চোখে রাখতে গিয়ে হয়তো অনুভব করতে পারছে না এখানকার সৌন্দর্য,যেখানে একা থাকলে সে অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতে পারতো অনায়াসে।কিন্তু আমি তো জানি,ওকে নিয়ে না আসলেও সে নিজেই চলে আসবে এখানে।আমাকে খুঁজতে।কে জানে,যদি আমার থেকেও বেশি কিছুর সন্ধান পেয়ে যায় এখানে এসে?


ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিলো।তুষারপাতও শুরু হয়ে গেছে। ক্যাম্পের ভিতর বসে গরম কফিতে চুমুক দিলাম।আগস্টের এই সময় এখানে লোকজন আরও কম আসে।বৃষ্টির সময় ক্যাম্পে থাকা মোটেই কাম্য নয়।গাওঁ বীর জলপ্রপাতের ট্রেক করতে সময় লাগে তিন গুন্ পথ ঘাট যাও ভেঙে,ট্রেইলরুট গুলো হারিয়ে যায়,বৃষ্টির সময় নানা রকম ইনফেকশন আর পোকামাকড়ের উপদ্রবও বেড়ে যায় গভীর জঙ্গলে।কিন্তু তা সত্ত্বেও এইসময় থাকি যেন সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে।সারাবছর সবুজ হয়ে থাকা ঘাসের মরশুমে ফোটে হাজার হাজার ফুল।বনেও লেগে যায় ফুলের মেলা।ভেজা জঙ্গলের গভীর বোনের মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায় নানা রকমের পাখির ডাক।বিথুনারায়ণ মন্দিরের কাছে থাচি ফরেস্টের গায়ে লেগে থাকা লগ কেবিন গুলো এক দাঁড়িয়ে থাকা ঝম ঝম করে হওয়া বৃষ্টিতে।পাঞ্জাই গ্রামের দিক থেকে ছিটকে চলে আসা ছোট ছোট ভেড়া গুলো কচি পায়ে হেঁটে বেড়ায় সামনের মাঠের ওপর। থাচি পাঞ্জাই যমজ গ্রাম। হাতে গোনা কয়েক বাড়ি লোক,সবুজের বিস্তার আর নিস্তব্ধতার আকাশ নিয়ে থাকি যেন লুকিযে থাকে সারাবছর এই ব্যস্ত কুলু-মানালি রুটের একপাশে।প্রিয় কবি রাল্ফ বলদ এমারসন এর বলা কথাগুলো বার বার ঘুরে যাচ্ছে মনের জানলা দিয়ে  ....“Do not follow where the path may lead. Go instead where there is no path and leave a trail."সময়ের থেকেও দামি যে কিছু হতে পায়ে জীবনে এখানে এলে কেউ কেউ অনুভব করতে পারবে। এক একটা কফির চুমুকে যেন কেটে যায় কত কত বছর,এতই শান্ত আর নির্জন থাচির আকাশ।

I sit idle and think about pen and paper, what should I pen?
My thoughts?
Imagination?
reality of life? beauty of nature?
Happy or sad creature?
All of a sudden, strike with the reminiscence,
Travel to my sense of life,
Its a long story of a better and bitter!
Both the taste are so differ, love the learn of hither and thither,
Went to childhood to drunkard boot!
Both speaks the real truth,
Is there any crude, which can beat the rawness of these brute(cruel its not so cruel, it is just one real of brute) ?
I look at Almighty!
I dont know where is he?
Right there in my heart of temple/part of these physical dead!
I am not afraid to accuse him,
Because it is in me, not in that unknown cult!
Boom! Life goes boom!
Boom! I go boom!
All I have is my past time,
My last time: not faded in my memories of thousands,
I have all the times.
Desert to ocean; ocean to desert, story goes,
Oh my gosh!
Thirst is in both the toaste,
I cream, I didt screen my scream, I let go with the nightmare of my dream.

কেটে গেল জীবন।কফির কাপ থেকে ধোঁয়া তখনও উঠছে।সামনের ছেলেটার হতভম্ব হাতে একটু হেসে আমার বইটা ধরিয়ে দিলাম।

5)
বইটা হাতে নিলাম। প্রথম পাতা খুলতেই দেখতে পেলাম অনু হাতের লেখা কয়েক লাইন  ..........




রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬

কুট্টুসের কাণ্ড


 

(গল্পের প্রথম অংশটা আমার লেখাপরেরটা লিখেছেন মৌসুমী ঘোষতার ব্লগ-এর ঠিকানা হলো http://sagorbalaka.blogspot.in/ স্পিরিন্ট গল্প যাকে বলে, মানে ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ স্টাইলে হুড়মুড় করে দশ মিনিটে একটা গল্প নামানোর চেষ্টা গল্প অবশ্য শেষ হয়নি, পরের অংশটা আপনাদের লিখতে হবে)

 

১) সকাল সাতটা বাজতেই পোষা টিয়াপাখিটা ডেকে ওঠেকুটকি পাখির নাম দিয়েছে কুট্টুস টিনটিনের খুব ভক্ত বলেই মনে হয় কুট্টুস আর কুটকির বদমায়েশির চোটে বাড়ির লোকেরা হয়রান সাত বছর বয়স হলে কী হবে, সারাদিন কুটকি বাড়ি মাথায় তুলে নাচানাচি করছে আর সমানে ওর সাথে তাল রেখে চেঁচিয়ে যাচ্ছে কুট্টুসকুট্টুসকে নিয়ে এসেছিল ছোটমামাছোটমামার আবার শখের চিড়িয়াখানা আছে একটা, যদিও সেখানে পাখিই বেশি দিশি-বিদেশি ময়না, টিয়া, কাকাতুয়ার ডাকে ছোটমামার বাড়িটা সরগরম হয়ে থাকে সারাদিনএছাড়াও আছে কয়েকটা গুঁটলু-পুঁটলু খরগোশ, পাঁচটা বেড়াল আর একটা ছাগল ছাগল পোষার কথা আবার কেউ ভাবে নাকি? কিন্তু ছোটমামার ব্যাপারই আলাদা ছাগলটাকে দেখে নাকি তার ছোটবেলার বন্ধু ল্যাংচাকে মনে পড়ে গেছিলছাগল বাবাজির নামও রাখা হয়েছে ল্যাংচা কী আশ্চর্য, ল্যাংচা আবার ল্যাংচার দারুণ ভক্ত মাঝে মধ্যেই ছোটমামা নিজে হাতে করে এনে ল্যাংচাকে ল্যাংচা খাওয়ান এ নিয়ে প্রথম দিকে বিস্তর হাসাহাসি হলেও পরে সকলের কাছেই ল্যাংচা আপনজন হয়ে উঠেছে সাদা রঙের ছাগল বড় একটা দেখা যায় না,তার ওপর ল্যাংচার মাথায় একটা কালো টিপ আছে যেন কেউ কাজল পরিয়ে দিয়েছে!

 

যাই হোক, কথা হচ্ছিল কুট্টুস আর কুটকির কুটকির স্কুল ছুটি পড়ে গেছে এখন ওর দুরন্তপনা আরও বেড়েছে তাই সকাল থেকে দুরন্তপনায় নাকাল করে তুলছে সবাইকে, কুট্টুসকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে এ ঘর সে ঘর আর গুচ্ছের লঙ্কা খাইয়ে চলেছে কুট্টুসকে কুট্টুসটাও হয়েছে মহাপাজি, সকাল হতেই চেঁচাতে থাকে ‘ভোর হোলো দোর খোল’ বলে ছোলা আর লঙ্কা ছাড়া কিছুই ওর মুখে রুচছে না আজকাল আবার এর মাঝে একদিন রবিবারে সকাল সকাল এসে হাজির হলেন ছোটমামা পরনে জোব্বা আর কাঁধে ঝোলাব্যাগ ছোটমামাকে দেখেই মা নালিশ করতে বসলো কুট্টুস আর কুটকির, ওরা বড় ন্যাওটা কিনা ছোটমামার!

ছোটমামা হাত তুলে বললেন, “দিদি, দাঁড়াও দাঁড়াও আগে একটু বসেনি কী গরম পড়েছে! তার ওপর বেচারা ল্যাংচার সর্দি হয়েছে ঠান্ডা গরম হয়ে!” এই বলে তিনি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেনব্যাগ থেকে একটা শালপাতার ঠোঙ্গা বের করে বললেন, “দিদি, জিলিপি এনেছি নিয়ে এসো তো একটু সবার জন্য!” ততক্ষণে কুটকি, বাবা আর দিদিও চলে এসেছে ছোটমামাকে দেখেই দিদি বলে উঠলো, “ছোটমামা, তোমার কুট্টুসকে নিয়ে যাও গো, সঙ্গে কুটকিটাকেও নিয়ে যাও দু’জনে সারাদিন বাড়ি মাথায় করে নাচছে” বলে দিদি লম্বা ভেংচি কাটল কুটকিকে কুটকিও মুখ ভেঙ্গাতে দেরি করল করলো না

ছোটমামা হাত তুলে বললেন, “ওরে বাবা দাঁড়া দাঁড়া তোদের নিয়ে আর পারি না” মা ততক্ষনে সকলের জন্যে খাবার সাজিয়ে এনেছে জিলিপিতে একটা লম্বা কামড় দিয়ে ছোটমামা বললো, “কী রে কুটকি? বদমায়েশি করছিস বুঝি?”

কুটকি মাথা নেড়ে বললো, “না ছোটমামা দিদি মিছিমিছি মিথ্যে নালিশ করে খালি আমি আর কুট্টুস তো খেলা করছিলাম একটুও দুষ্টুমি করিনি

ছোটমামা বললেন, “তাই তো? তাহলে কী করা যায়? খেলা তো বন্ধ করা উচিৎ নয় গরমের ছুটি চলছে

বাবা বললো, “গরমও যা পড়েছে এবার, কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে এলে হতো কিন্তু আমার আবার ছুটি পাওয়া মুশকিল এই বছরে

ছোটমামা আস্ত একটা জিলিপি মুখে পুরে বলল, “তাহলেই দেখো! গরমে কুটকি বাড়িতে বসে করবেই বা কী? সেই জন্যেই বাড়ি মাথায় করছে ওকে দোষ দেওয়া যাবে না তাহলে বরং...সবচেয়ে ভালো সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসা যাক! জামাইবাবু না হয় নাই গেল! কুটকি আর ছুটকি তো যেতেই পারে আমি যাবো না হয় সঙ্গে! দিদির কী মত?”

মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল, বাবাকে ছেড়ে গেলে বাড়িতে কাউকে থাকতে হবে সারাদিন, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারও আছে বিশদ আলোচনার পর সবাই একমত হল যখন, কুটকি-ছুটকি মানে কুটকি আর দিদিই যাবে ছোটমামার সঙ্গে, গোল বাধল জায়গা নিয়ে বাবা বলছে দীঘা, মায়ের ইচ্ছে রাঁচি কুটকি সুন্দরবন যাবে বলে লাফাচ্ছে আর দিদি বলছে দার্জিলিং অতএব হট্টগোল! এর মধ্যে একবার ছোটমামা চেঁচিয়ে বলল, ব্যাস! আমি যা বলবো সেটাও ফাইনাল আরে বাবা আমি তো সঙ্গে যাবো না কী!

“আমরা যাবো হাফলং

বাবা বলল, হাফলং তো অনেক দূর তুই একা এদের সামলে এতদূর যেতে পারবি?”

ছোটমামা মুচকি হেসে বললো, একা কই? কুট্টুসও যাবে আমাদের সঙ্গে!”

 

২) কুটকির আনন্দ আর ধরে রাখে কে? একেই মা-বাবা এ যাত্রায় সাথে নেই, তাই “ওদিকে যেও না, সবসময় দিদির হাত ধরে থাকবে, সব জিনিস দেখেই খাব খাব করবে না”...এসব জ্ঞান দিয়ে বিরক্ত করার মানুষজন নেই তার সঙ্গে যোগ হল কুট্টুস-এর সহযাত্রা ছোটমামা ঘোষণা না করা পর্যন্ত কুটকির মাথায় কুট্টুস এর যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠেনি যেন পাখিটা ওরই সম্পত্তি যেখানে! ও যাবে, মানে সঙ্গে কুট্টুস তো যাবেই ভাগ্য ভালো, মা বাবাও এই নিয়ে আর বিশেষ আপত্তি করল না

ছোটমামা খেয়ালে মানুষ হলে কী হবে, প্ল্যান যখন করেছেন সেইমত কাজ গুছিয়ে রাখছেন প্রথমেই ট্রেন-এর টিকিট কেটে নিয়ে হাজির কামাখ্যা এক্সপ্রেস পরশু সকাল সাড়ে দশটায় হাওড়া থেকে ওদের ট্রেন ছাড়ার কথা বেড়াতে যাওয়ার খাবার পেয়ে কুটকির সব বন্ধুরা একে একে হাজির তাদের মনে একটু চাপা দুঃখ ও বটে ভাবল, আমাদের যে কেন এমন একটা মামা জোটেনি কপালে?” মামা সবার সঙ্গে মিশলেন হইহই করে সবাই মিলে মামাকে দিয়ে প্রমিস করালো যে, পরেরবার গরমের ছুটিতে শুধু কুটকি ছুটকি নয়, ওদের সক্কলকে সাথে করে পাড়ি দিতে হবে এর মধ্যে কুটকি আর কুট্টুস-এর গানে সারা বাড়ি মাতোয়ারা মা-বাবা-দিদি নাজেহাল তো বটেই, পাশের বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত পর্দা সরিয়ে রমা, মানে কুটকি-ছুটকির মাকে না জিজ্ঞাসা করে পারল না, আরে, মেয়েটার হলটা কী? আর পাখিটাই বা বাড়ি মাথায় করছে কেন!”

কিছুই না, যত ছুটির গান এদ্দিন পর্যন্ত শিখেছে কুটকি, সেগুলোই জোরে জোরে ওগরাতে লেগেছে,আর কি! ‘আমাদের ছুটি ছুটি, চল নেব লুটি, ওই আনন্দঝর্না’ আবার কখনো ‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি’ এমনি যা মনে আসছে ছুটির আমেজের গান পাখিটা কি এই অবস্থায় চুপ করে থাকবে বলে মনে হয়? কুটকিকে গাইতে দেখে সেও শুরু করেছে তার যা কাজ, নকল করা এই দুইয়ের রাগ-রাগিনী নিয়ে ঘোষালবাড়ি সরগরম

রমা একটা বাক্সে দুই বোনের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখলেন কিছু হালকা গরমের জামা দিলেন, দরকারে যদি লাগে ট্রেনে শীত করে রাতে শোয়ার সময় সে খেয়ালও আছে বাবা এসে বললেন, যাক, আর চিন্তা নেই কালকের ছুটিটা কোনক্রমে মঞ্জুর করিয়েছি মামাভাগ্নিদের ট্রেনে তুলে দিতে পারব অন্তত!” আর মামাকে কয়েকশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেন খরচাপাতিও তো হয়েছে কিছুটা, হবেও

পরদিন যাত্রার ক্ষণ উপস্থিত যে যার মতন ব্যস্ত এখন মা নাডুর কৌটো বাক্সে গুঁজে দিতে ছাড়ছে না, বাবা গেছে মোড়ের মাথায় রিক্সা ডাকতে ততক্ষণে সব গুছিয়ে ফাইনাল করে রাখতে গেছে বাবা কুটকির তখনও একটা ডায়রি পেন ঢোকানো হয়নি ব্যাগে ওমা তাইতো! মনে পড়তেই চট করে কাজ সেরে নিল সে ছুটকির সাজ যে শেষ হয় না এখনও ক্লিপ লাগানো বাকি চুলে ওদিকে প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ বাড়ির বাইরে, মানে রিক্সা আগত

তল্পিতল্পা বিশেষ কিছু নেই মামার একটা ব্যাগ আর ছোট সুটকেস দু বোনের একটা পুঁচকে বাক্স রমা নিজেই আস্তে আস্তে বাইরে বের করছিল হঠাৎ দেখা গেল ছোটমামা একটা কী খুঁজছে এঘর ওঘর করে নিশ্চয়ই হাতঘড়িটা গুম করেছে বাড়িতে জিগ্গেস করতে মামা বললেন যে চুল আঁচরানোর আগে এই ট্রেনের টিকিট তা বের করে টেবিলের ওপর রেখেছিলেন, তারপর আর খুঁজে পাচ্ছেন না পাঞ্জাবির পকেটে রাখবেন বলে বাইরে রাখলেন তো মাল উধাও ভেবেচিন্তে কিছুই কুল করতে পারছে না মা তো ব্যস্তসমস্ত হয়ে চারবার দেখছে বাবা ওদিকে বাইরে থেকে হাঁক ডাক দিতে শুরু করেছে,বাড়ি থেকে কেউ বেরোচ্ছে না দেখে এই ড্রয়ার ওই ড্রয়ার হাতড়াতে হাতড়াতে মা আনমনেই একবার কুটকিকে জিগ্গেস করল, টিকিটটা দেখেছিলিস কোথাও?”

কুটকির উৎসাহে এখনো একটুও ভাঁটা পড়েনি চেঁচিয়ে বলল, কই না তো!” তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, কুট্টুস-এর মুখে একটা সাদা কাগজ যেন দেখেছিলাম তারপর তো সে ছাদে চলে গেছে এখানে তো দেখছি না

পাশের ঘর থেকে মামা শুনতে পেয়েছে ভাগ্নির কথা বাবাও আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে উঠোনে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিল মেয়ের কথা শুনে তো মাথায় হাত ব্যাস! তারপর আর দেখে কে? ছাদের সিঁড়িতে বাড়ির সবাই লাইন দিয়েছে, আর ঘোষালবাড়ির সদর থেকেও শোনা যাচ্ছে বাড়ির ভেতরর গোলমাল, কুট্টুস! এই কুট্টুস! কুট্টুসসোনা, কুট্টুস রে, কুট্টুস...”

বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১৬

1)​ট্রিগার টিপতেই যেন বিস্ফোরণ হলো হাতে।দুই হাত সামনের দিকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল অমিত কিন্তু তা সত্ত্বেও যেন বুলেটের প্রতিক্রিয়াতে বুক অব্দি এসে লাগলো সেই আগুনের উত্তাপ,লোহার বলের মত। কোনমতে হাত সোজা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো অমিত।সামনের লোকটা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে।
2)
হাতড়ে হাতড়ে সুজল সামনের দিকে এগোতে চেষ্টা করছিল।চাপ চাপ অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।এত ঘন এই অন্ধকার যেন মনে হচ্ছে কেউ চোখে কালো ফেট্টি বেঁধে দিয়েছে অথচ কিছুক্ষণ আগেই আলোয় আলোকিত হয়েছিল চারিধারে।লোকজন আসছিল যাচ্ছিল রোজকার মত।হঠাৎ করে হলো সেই দুর্ঘটনা।
3)বাগচিবাবুর বুকের রোগ আছে।ডাক্তারের বারণ আছে বেশি চলাফেরা করার।কিন্তু সবসময় সে কথা মানলে কি চলে!বাইশ বছর সিকিউরিটি সার্ভিস এ কাজ করেছেন উনি।ভয় পাওয়ার লোক নন।প্রাক্তন সিকিউরিটি চিফ হিসেবে সিস্টেম রেভলিউসান করা আজ তারই কর্তব্য।যে কোনো কনফিডেনশিয়াল অপারেশনএর দিন তিনি ব্যাঙ্কে যাবেনই।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।রেডিয়েশন ব্যাজ হাতে নিয়ে এগোচ্ছেন করিডোর দিয়ে,অন্য হাতে ডসিমিটার এমন সময় CCTV তে দেখা গেল কালো মুখোশ পরা কয়েকজন লোক ঢুকে এসেছে ক্যাম্পাসে?মোবাইল বের করে কয়েকটা নম্বর টিপতে লাগলেন তিনি।

4)লাল বাতিটা দেখতে পেয়েই সচকিত হয়ে উঠলো শমিত।অ্যালার্ম।কীবোর্ড এ খটখট করে হাত চলতে লাগলো তার।সিকিউরিটি কোডের প্রোগ্রাম চেঞ্জ করতে তার লাগবে তিরিশ সেকেন্ড।.কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি?

5)অমিতের দলে আরো একজন ছেলে আছে।সকলেই আর্মড।চার লেভেল সিকিউরিটি ভেদ করতে কোনরকম অসুবিধেই হয়নি তাদের।দরকারের সব জিনিসই ছিল তাদের কাছে।বলাই আছে এই ডাকাতির উদ্দেশ্য টাকা নয়,অন্যকিছু।সে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ম্যানেজার এর বুকে বন্দুক ঠেকালো।সিকিউরিটি ভল্টের কোড জানতে তার ঠিক আঠ সেকেন্ড লাগল,যদিও দেরী না করার পুরস্কার হিসেবে ম্যানেজার মাথায় বন্দুকের বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে আছে এখন।ম্যানেজার এর ডেস্কের তলায় হাত নিয়ে গিয়ে একটা বিশেষ বোতাম টিপে দিল সে।

6)সুজলের কাছে তিন মিনিট আছে।শমিতএর কাছ থেকে আপডেট পেয়েই সে ছুটে গেছে ব্যাঙ্ক এরিয়ার মধ্যে।এই ব্যাঙ্কে সাধারণ লোক আসতে পারে না,ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর টেস্টিং স্টেশন এর ক্যাম্পাসের এই ব্যাঙ্ক খালি NNRTS এর এমপ্লয়ী আর তাদের পরিবারের জন্যে,তাও প্রচুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে।আজ সকালেই খবর পেয়েছে সুজল,ডিফেন্স মিনিস্ট্রি ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন এর কয়েকটা ফাইল রাখা হয়েছে ব্যাঙ্কে,মাত্র দুদিনের জন্যে। দিল্লির চেয়ে এখানে রাখা নিরাপদ মনে করেছেন আর্মি পার্সোনালরা।মিডিয়া খবর পাবে না।নিউক্লিয়ার টেস্টিং এর সময় এরকম বেশ কয়েকবার হয়।কিন্তু এরকম বিপর্যয় কোনদিন ঘটেনি।

7)১৫ সেকেন্ডএর মধ্যেই চারিদিকের সিকিউরিটি সিস্টেম রিসেট হয়ে গেল।সিকিউরিটি সিস্টেম এর কোড লক হওয়ায় আগেকার কোনো এক্সেস ই কাজ করবে না,যদিও সিকিউরিটি ফোর্স আসতে সময় লাগবে এতে কিন্তু অনুপ্রবেশকারীরা বাইরে বেরোতে পারবে না কোনভাবেই।কাজ শেষ করে শমিত দৌড়ে গেল সি ব্লকএর দিকে।

8)প্ল্যান ঠিকমতন এগোচ্ছে।অমিতের ব্যাগ থেকে বেরোলো ফুলস্কেপ কাগজ,এনিগ্মা সিফার ট্রান্সমিটার,শুহিল ট্রান্সমিট ক্রিপ্টোগ্রাফার,আরও নানাবিধ জিনিস।প্রয়োজন মত সরঞ্জাম তুলে অমিতরা এগোলো ভল্টের দিকে।সিকিউরিটি কোড লেখা আছে হাতে ধরে রাখা এনিগ্মা সিফার এর স্ক্রিন এ। দরজা খুলে গেল। জিপিএস সেট করাই আছে। দ্রুত তারা এগিয়ে গেল।নির্দিষ্ট সিস্টেম এ স্টোরড তথ্য ট্রান্সমিট করতে হবে প্রিপ্রোগরাম্যান্ড ডিভাইস আইডি তে। কাজ শেষ করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

9)Air condition duct দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সুজল।যতদুর জানতে পেরেছে বাগচিবাবুর কাছ থেকে,অনুপ্রবেশকারীরা ডাটা ব্লো অপারেশন প্লান করেছে।নিউক্লিয়ার প্রজেক্টস এর যাবতীয় তথ্য শত্রুদের পাচার করাই একমাত্র উদ্দেশ্য,কিন্তু ওরা এত সিকিউরিটি ক্রস করে ভিতরে ঢুকলো কি করে?নিশ্চই কেউ সাহায্য করেছে।সামনেই চার নম্বর duct,এখানেই মনে হয় আছে সন্ত্রাস্কারীরা।হঠাৎ দুম করে সব আলো নিবে গেল।সুজল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মেন পাওয়ার সোর্স অফ না করলে তো অন্ধকার হওয়ার কথা নয়,এখানে অটোমেটিক ব্যাকআপ সিস্টেম আছে।
হাতড়ে হাতড়ে সুজল সামনের দিকে এগোতে চেষ্টা করছিল।চাপ চাপ অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।এত ঘন এই অন্ধকার যেন মনে হচ্ছে কেউ চোখে কালো ফেট্টি বেঁধে দিয়েছে অথচ কিছুক্ষণ আগেই আলোয় আলোকিত হয়েছিল চারিধারে।

10)খুব সাবধানে duct খুলে নেমে এলো সুজল।হাতে অটোমেটিক পিস্তল।বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে আছে সে।আস্তে আস্তে এগোচ্ছে সে। এমন সময় যেন মাটি ফুঁড়ে একটা লোক সামনে এসে দাঁড়ালো।ট্রিগার টিপতে গিয়েও সামলে নিল সে। বাগচিবাবু।তিনি আঙ্গুল মুখে রেখে তাকে চুপ করতে বললেন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে।  

"হোল্ড ইট"চকিতে মাথা তুলল অমিত।সামনে একজন বুড়ো লোক,তার পিছনে একজন কমান্ডো।এক মুহুর্তের মধ্যে ট্রিগার টিপলো সে।পর পর তিনবার। ট্রিগার টিপতেই যেন বিস্ফোরণ হলো হাতে।দুই হাত সামনের দিকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল অমিত কিন্তু তা সত্ত্বেও যেন বুলেটের প্রতিক্রিয়াতে বুক অব্দি এসে লাগলো সেই আগুনের উত্তাপ,লোহার বলের মত।হাত সোজা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো অমিত ।সামনের লোকটা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে।মাটিতে পড়ে থাকা দেহ দুটিই নিথর,কিন্তু এরা মরেনি।তার সঙ্গীর হাতে ধরা tranquilizer sedative দিয়ে এদের ডার্ট মারা হয়েছে,যা মাত্র কয়েক সেকেন্ড  এর মধ্যেই লোককে বেহুঁশ করে দিতে পারে,কিন্তু ইচ্ছে করেই তার সঙ্গে গুলি চালিয়েছিল অমিত,যাতে এই কয়েক সেকেন্ড এরা সামলানোর সুযোগ না পাক। সামনের লোকটির সামনে উবু হয়ে বসলো অমিত।দুমিনিট।বাকি কাজটা শেষ করলো।।সিকিউরিটি,রেডিয়েশন সিস্টেম অকেজো। দ্রুত বেরিয়ে গেল তারা।

11)হসপিটালে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে শমিত।এতক্ষণে ভিসিটিং আওয়ার্স হলো।সামনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো সে। সামনে শুয়ে আছেন বাগ্চিবাবু।তাকে দেখে হাসলেন।নিশ্চিন্ত কন্ঠে বললেন,"আমার ফোনটা পেয়েছিলে তো?"শমিত বলল,"পেয়েছি।কাজ হয়ে গেছে। স্পাই স্টিক দিয়ে deleted ডাটাগুলো বের করতে সময় লেগেছে ৪২ সেকেন্ড" বাগচিবাবু হাসলেন। শমিত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।NNRTS এ ইন্টারপ্রেটার হিসেবে চাকরি যখন পেয়েছিল,শমিত বেশ গর্ব বোধ করেছিল।দেশের জন্যে কাজ,এত বড় একটা প্রজেক্টের অংশ।কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল,সে আসলে NNRTS  এর এমপ্লয়ী নয়,তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে RAW  এর দিক থেকে। ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স RAW এর রিক্রুটমেন্ট এ কখনই তাদের নাম লেখা থাকে না,বরং ফিল্ড এক্সেকিউটিভ,কোডার,সিকিউরিটি অফিসার হিসেবেই তাদের চাকরি হয় কিন্তু পরে তারা জানতে পারে যে তারা ইন্টেলিজেন্স এর মেম্বার।করাপশন আর রাজনৈতিকদের যোগসাজশে দেশের বহু গোপনীয় তথ্য চলে যায় শত্রুপক্ষ দের কাছে,defense,স্পেস,টেলিকম সব সেক্টর এই এরকম হয় আকছার। তাই RAW দেশের সরকারী আমলাদের মধ্যে ডাবল এজেন্ট নিযুক্ত করে।এরা সরকারী চাকরি করে ঠিকই কিন্তু দরকার পড়লে বেআইনি ভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষার্তে এগিয়ে আসে।বাগচিবাবু RAW এর ডাবল এজেন্ট ছিলেন,তারপর আসে শমিত।শমিত বাগচিবাবুর মারফত জানতে পারে,রাজনৈতিক যোগসাজশে নিউক্লিয়ার ডিফেন্সের প্রচুর তথ্য বেচে দেওয়া হবে শত্রুপক্ষ কে,এই কাজে খোদ NNRTS আর সরকারের হাত আছে।মিডিয়া আর পলিটিকাল সত্তার বিনিময়ে এরকম সওদা আকছার চলে ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স এ। তাই RAW এর তরফ থেকে তাদের আগেই সরিয়ে নিতে হবে জরুরি ডাটা।গোপনে প্ল্যান হয়।বাগচিবাবু,শমিত এর সঙ্গে যোগ দেয় অমিত ও তার বন্ধু।অমিতদের পাঠানো হয়েছিল RAW এর দিক থেকে।সিকিউরিটি ক্র্যাক করার সবরকম ব্যবস্থা করে দেন বাগচিবাবু।সিকিউরিটি চিফ থাকাকালীন তিনি সিস্টেমের সব ফাঁকফোকর জানতেন।কিন্তু সিকিউরিটি সিস্টেম এর ভল্ট এর কোড জানা কোনমতেই সম্ভব নয়।প্রতি ১০ মিনিট অন্তরে কোড বদলে যায়,কোড জানা থাকলেও রেটিনা স্ক্যান করেই ভিতরে ঢুকতে যাবে।একমাত্র উপায় যদি সিকিউরিটি algorithm রিসেট করা যায়।কিন্তু সিসটেম রিসেট করলে দরজা খুলে গেলেও বেরিয়ে আসার সময় রেটিনা স্ক্যান না করে কোনো উপায় থাকবে না।

ভেবেচিন্তে বাগচিবাবু একটা উপায় বার করলেন।ঝুঁকি থাকলেও এছাড়া কোনো উপায় নেই।পনের মিনিটে অপারেশন শেষ না করতে পারলে প্রোগ্রাম reactivate হয়ে পুরো পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে।তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমের করিডোর এ।CCTV তে অমিতদের দেখেই তিনি ফোন করলেন,সুজলকে।চিফ সিকিউরিটি।কমান্ডো।সুজল ফোন তুলতেই তিনি বললেন,"সুজল,intruders.আমাদের কাছে বেশি সময় নেই।ফোর্স ডাকতে গেলে দেরী হয়ে যাবে।আমি দেখেছি ওরা দুজন মাত্র।তুমি সহজেই হ্যান্ডেল করতে পারবে।ওরা সিকিউরিটি ভল্টের দিকে এগোচ্ছে। "সুজল বলল,"কিন্তু ওরা ভিতরে ঢুকবে কি করে স্যার?কোডের এক্সেস তো থাকার কথা নয় ওদের কাছে। "বাগচিবাবু বললেন,"সে সব ভাবার সময় নেই এখন সুজল।হয়ত ভিতর থেকে কেউ সাহায্য করেছে।এতগুলো সিকিউরিটি লেভেল ক্রস করা সম্ভব ছিল না তাহলে"
সুজল বলল,"আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি। duct দিয়ে যেতে হবে".
"সুজল,সময় কিন্তু বেশি নেই,খুব বেশি হলে আঠ মিনিট "
"ভাববেন না"সুজল ফোন  দেয়।ফোন রেখে হাতঘড়ি দেখেন বাগচিবাবু।এতক্ষণে অমিতের পাঠানো সিগনাল পেয়ে গেছে শমিত।আজ আগে থেকেই অর রাতের ডিউটি ফিক্স করা হয়েছিল।সিস্টেম reset করতে শমিতের একমিনিট ও লাগবে না।দ্রুত পায়ে তিনি এগিয়ে গেলেন মেন বিল্ডিং এ।সুজল নিশ্চই এতক্ষণে duct দিয়ে এগিয়ে গেছে ভল্টের দিকে।সিকিউরিটি এরিয়া  থেকে ব্যাঙ্কের ভল্ট এরিয়া কমপক্ষে ২০ মিনিটের রাস্তা। আর তারপর সোজা রাস্তা নয়,তাকে যেতে হবে ducts এর টানেল দিয়ে।তার মত কমান্ডোর পক্ষেই  এরকম করে দুরত্ব অতিক্রম করে পৌছনো সম্ভব সেখানে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কিন্তু সুজল কে ইনক্লুড করার উদ্দেশ্য অন্য।জোর পায়ে তিনি এগিয়ে গেলেন পাওয়ার রুমে।পকেট থেকে বার করলেন  অত্যাধুনিক এক যন্ত্র। এর নাম পিন্চার। যে কোনো ট্রান্সফরমার কে কিছুক্ষণের জন্য বিকল করে  দিতে পারে। মুহুর্তের মধ্যে সারা ক্যাম্পাস অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু সিকিউরিটি ব্যাকআপ এর বিদ্যূত এই ট্রান্সফরমার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভল্ট এরিয়াতে পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগলেন শমিতের জন্যে। অমিতেরা ততক্ষণে position  নিয়েছে।সিস্টেম রিসেট হওয়ায় ভিতরে ঢুকতে কোনরকম অসুবিধে  হয়নি,ডাটা ক্র্যাক করাও প্রায় শেষ কিন্তু আসল কাজ এখনো বাকি।ততক্ষণে সুজল এসে গেছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে অমিতদের দিকে  গেলেন তিনি। "হোল্ড ইট"চকিতে মাথা তুলল অমিত।সামনে একজন বুড়ো লোক,তার পিছনে একজন কমান্ডো।এক মুহুর্তের মধ্যে ট্রিগার টিপলো সে।

12)কাজ শেষ।অমিত cryptic কোডে ডাটা ট্রান্সফার করে দিয়েছে বাগচিবাবুর আইফোনে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভাবতেই হয় তাই সব ডাটা সে নিপুণ ভাবে ডিলিট করে দিল।ডাটা derive করার কাজ শমিতের। এখান থেকে বেরোনোর সময় হাতে কিছু থাকা চলবে না। বিপ করে একটা আওয়াজ অমিত রা বুঝলো সিস্টেম reactivate হয়ে গেছে।সুজলের দেহটা টেনে নিয়ে গিয়ে দরজার কাছে পৌছল অমিত,শেষ কাজ।রেটিনা স্ক্যান এর সামনে সুজলের চোখ রাখতেই accepted হয়ে খুত করে দরজা খুলে গেল। বাইরে বেরোনোর সময় সুজলের পায়ে লেগে থাকা গুলিটা দেখল সে।রক্ত বেরোচ্ছে ,কিন্তু কোনো ক্ষতি হবে না। নিজের অজান্তেই দেশের জন্যে একটা ভালো কাজ করেছে সে।

13)বাগচিবাবুর আইফোনের deleted ডাটা revive করতে পারল শমিত স্পাই স্টিক দিয়ে।এই যন্ত্রের সাহায্যে deleted ডাটা সহজেই রিস্টোর করা যায় যদি সেই ডাটা IOS এ থাকে। কালই পাঠিয়ে দিয়েছে যাবতীয় তথ্য RAW তে।ব্যাঙ্কের ভল্টে এখন যে ডাটা আছে,সেটার কোডিং বিস্তর চেঞ্জ করে দিয়েছে অমিত।বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও আসলে সেই ডাটা ইনকমপ্লিট।কোনভাবেই কেউ সেটা কাজে লাগাতে পারবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগলো শমিত।কখনো কখনো মনে হয় ও কি ঠিক করছে?দেশের ভালো ভেবে যা করছে তাতে কি দেশে ভালো হচ্ছে আদৌ?RAW তাকে ভুল উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে না তার কি নিশ্চয়তা আছে.?কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে যায় Robert Brault এর বলা একটা কথা।
"Never act until you have clearly answered the question: "What happens if I do nothing?"

মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬

ভেবেছিলাম ডানা মেলে উড়ে যাব স্বাধীনভাবে,কিন্তু আবিষ্কার করলাম স্বাধীনতা একটি প্রকল্পিত ধারণা মাত্র।কেউ স্বাধীন হতে পারে না,পাখিরাও আকাশের অদৃশ্য় শিকলে বন্দী সারাজীবনের মত।যতই ছাড়ানোর চেষ্টা কর,তত চেপে বসে প্রত্যয়ের গভীরে। এই বন্দিদশা আর কিছুই নয়,নিজেকে  চিনতে না পারার ইতিহাস।বিশৃঙ্খলা কে সঙ্গী করে পরিপূর্ণতা পাওয়ার অবুঝ প্রচেষ্টা।নিজের স্বরূপ অস্বীকার করার হঠকারিতা।বিশ্বাস থাক অথবা না থাক,ডানা ছড়ানোর জন্যে প্রশস্ত আকাশ খুঁজি,যেখানে আর কেউ নেই আমায় ভয় দেখানোর,আমার জায়গা নেওয়ার।পরিবর্তন যে জীবনে সবচেয়ে স্থিতিশীল,এই সহজ সত্যের উপর যদি বিশ্বাস থাকত,স্বাধীন হতে বাধা ছিল না কোনো।স্বাধীন যারা,তারা এগিয়ে গেছে নিজের কাছে অসঙ্গত থেকেও।এই স্বীকোরোক্তি বেদনা দেয়,কিন্তু নিজস্বতার সম্মান অক্ষুণ রাখে,সে যতই বেমানান হোক না কেন।বৃষ্টি কিন্তু আজও হয়।তফাৎ শুধু এই,তারা উপলব্ধি করে,আমি সম্বেদন করি...বৃষ্টির জল বিশ্বাস কে ভেজায় না,মুক্ত করে.....
যদি নৌকাডুবি না হত,হয়ত অনেকদিন বেঁচে থাকত ভালবাসার রসদ,গাছে ফুল ফুটত স্বকীয় বিস্মৃতির।জীবন চলত,নৌকোরই মত।ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে।কয়েককলি পিছুটান সঙ্গে থাকত,বাকিগুলো ভেসে যেত বেহতা জীবনের হিল্লোলে।কয়েকফোঁটা বৃষ্টির উষ্ণতায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ত গাল বেয়ে,আর থেমেথাকা দৃষ্টি কখনো জ্যোৎস্না মেলে দেখত পূর্ণিমা রাতের আয়না।যদি  নৌকাডুবি  না হত,বিপ্লবের শিকড় ছড়িয়ে যেত অজানা নিশ্বাসে  আর জোয়ারে বয়ে আসত স্নিগ্ধ মননের পুজোর ফুল।চিঠির আদলে হয়ত ধরা পড়ত আরো একটি কবিতা,অথবা দেখা যেত আরেকফালি আকাশ,কারো চোখে।নৌকাডুবি হয়নি  .....একচিলতে না থাকা জঙ্গল শুধু স্বপ্ন ভাঙ্গার ছবি....আর নিয়তির লেখা শুধু প্রাণের গল্পই বলে।বেহতা জীবন আর নৌকার দাঁড়ে হাল ধরে বসে কাটে অনন্তকাল।মাঝে মাঝে ভাবি  ....যদি নৌকাডুবি হত....

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

যোগাযোগ এর পুরনো সূত্রগুলি রয়ে গেছে ডায়রির পাতায়,পুরনো ল্যান্ডফোনের পাশে রাখা থাকে যেটা গত দশ বছর ধরে।সেইদিন,যেইদিন মোবাইল এসেছিল বাড়িতে,যোগাযোগ কথাটায় একটা বিশেষণ যোগ করতে।ইনস্ট্যান্ট ফোন করতে,নাম্বার সেভ করতে,এসএমএস করতে।তারপর থেকে যোগাযোগের সুবিধে বেড়ে চলেছে,নিত্যনতুন পন্থায় যোগ হচ্ছে দুরত্ব কম করার উপায়,কিন্তু এত সত্ত্বেও ব্যবধান বেড়ে চলেছে দিনদিন। দিনদুপুরে মোবাইলের নাম করে নিজেকে চার্জ দিই,ডাটাকেবিলে গুঁজে রাখি চিন্তার সকেট।মাথার চারিপাশে কিলবিল করে নম্বর,হাতে বাঁধা আইসির যোগাবিয়োগের ফর্মুলা,প্রতি মুহুর্তে বদলে যায় ডেটার কবলে থাকা স্মৃতিচারণের প্রণালী,আরো নির্ভুল ক্যালকুলেশনএ।সম্পর্কের কোনো মিসিং লিংক থাকে না স্টোরেজএ ,প্রতিটা নম্বর জায়গা বদল করে গতিশীল ভাবনার আবেগ মেপে।কিন্তু ব্যবধান কমে না,রাজ্যের নোটিফিকেশনএর বন্যায় বয়ে চলে যায় পুরনো সম্পর্কের নামগুলো।স্টোরেজএ জমতে থাকা নামের পাশের ছবিগুলো শুধু হিসেবরক্ষা করে চলে তালাবন্ধ স্মৃতি কুঠুরির,যদি কোনদিন কেউ বাঁকা ঠোঁটে ঠুকরে লাল রক্ত বের করে,সেই আশায়...

শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬

ঘন হয়ে আসা ঢেউএর  গায়ে দিগন্ত বিস্তৃত জলছবি।মেঘের ছায়ায় সন্ধ্যে রঙের ক্ষণস্থায়ী রূপে সমুদ্রকে মনে হয় সুরিয়াল ক্যানভাসের মতো।পেরেসা বীচ আর ফিরার খোয়ার রাস্তায় এসে পড়েছে শেষ বিকেলের আবেশ।স্যানটোরিনি শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত টাভের্না ক্যাফে তে বসে অপেক্ষা করছি সীর্সার জন্যে।এখানে চারদিকে টাভের্না ক্যাফের ছড়াছড়ি,গ্রিক ডিশ সার্ভ করা এই ছোট বড় ক্যফে স্যানটোরিনি শহরের অন্যতম আকর্ষণ,প্রতিটা ক্যাফে থেকেই প্রায় দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্র।ক্লিফ এরিয়ার টাভের্নাগুলো তে তো জায়গা পাওয়াই যায় না,শুধু সমুদ্র আর আকাশ দেখেই যে কিভাবে সারা-সারা দিন কেটে যেতে পারে অনায়াসে,স্যানটোরিনি এলে বুঝতে পারা যায়।মেডিটেরেনিয়ানের তীরে গ্রীসের এই দ্বীপে নোঙ্গর করে থাকে প্রচুর জাহাজ,বেশিরভাগ অবশ্য ক্রুজ শিপ।বহু বিছর আগে ভূমিকম্প হয়ে আগের ভূভাগ বিভাজিত হয়ে জেগে ওঠে ১০০০ ফিট উঁচু এই দ্বীপের প্রাচীর আর তার চারপাশে গভীর জলের লেগুন।সামনে ধপধপে সাদা বাড়িঘরের  পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে রঙচঙে পোশাক পরা টুরিস্টদের দল,টাভের্না তে বাজতে শুরু করেছে এখানকার প্রিয় বৌজৌকি অর্কেস্ট্রা।আকাশের রং গাড় লাল হয়ে যেন গলানো লাভা ঢেলে দিয়েছে সমুদ্রের বুকে,দিগন্তের কোনায় উঁকি দিচ্ছে অজানা আকৃতির মেঘবলাকার সারি।একটা একটা করে আলো জ্বলছে স্যানটোরিনি শহরে।কিছুক্ষণেই রাস্তাঘাট ঝলমলে হয়ে উঠবে,আর অন্ধকার গ্রাস করবে আকাশকে।শুধু জেগে থাকা তারাদের দল প্রতিশ্রুতি দেবে,কাল ফিরে আসার।হঠাৎআমার নাম শুনে বুঝলাম,সীর্সা এসে গেছে।এগিয়ে গিয়ে দেখি সাদা স্কার্ট এর ওপর গোলাপী টপ পরে দাঁড়িয়ে আছে সীর্সা ক্যাফের সামনে।আমায় দেখে ঠোঁটের কোন দিয়ে হাসল। 

"তাহলে সত্যিই ফিরলে?"
"কেন?তোমার মনে কি সন্দেহ ছিল?"
"তোমার মনে কি সন্দেহ ছিল না?"
"সন্দেহ ফেরা নিয়ে ছিল না সীর্সা,ফেরার সময় নিয়ে ছিল।ভাবতাম বেঁচে থাকতে ফিরব না মৃত্যুর পর?"
"ঝড়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছ তুমি?"
"ঝড়?না ঢেউ?"
"ঝড়।বৌজোকিতে "কাতিয়েইগা" বাজছে।কাতিয়েইগা মানে ঝড় জান তো?"
"তোমাদের স্বাধীনতার সুর।"
"স্বাধীনতা নয়,মুক্তি।মুক্তির সুর।তোমার জন্যে।"
"কেউ কি মুক্ত হতে পারে?চিরকালের জন্যে?"
"মনকে আটকায় কার সাধ্য?"
"কিন্তু বছর যে পেরিয়ে গেছে!"
"জীবন কি পেরিয়ে গেছে!"
"তুমি আছ তো?থাকবে তো?আমার জন্যে?"
"আমি তো ছিলাম না কোনদিন,আমি যে সীর্সা।সীর্সারা কারো জন্যে থাকে না,তুমি তো জান।"
"হ্যাঁ।সীর্সা মানেই তো লিবার্টি।"
"কিন্তু তুমি তো আছ।তোমার জন্যে।"
"আমি কি সত্যি ফিরতে পেরেছি?জীবনের জন্যে?"
"তুমি আসলে যাওইনি কোনদিন,যারা চলে যায় তারা কোনদিনই ফেরে না।ফেরে তারাই যারা আসলে যেতেই পারেনি"

বৌজৌকি বাজতে থাকলো।তারারা জ্বলছে।ঢেউয়ের ওপর ভাসছে জাহাজ।রাত নামছে।ভেসে আসছে গান।স্যানটোরিনি বেঁচে আছে আজও,যেমন বেঁচে ছিল ৪০ বছর আগে,যখন দেখা হয়েছিল সীর্সার সঙ্গে প্রথমবার এরকম এক রাতে।স্যানটোরিনি বেঁচে রইলো।বেঁচে রইলাম আমরা।মুক্তি কি একেই বলে?

শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

রেডিওটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল।থেমে গেল গান।নবগুলো ঘুরিয়ে,ব্যাটারি পাল্টে,ঝাঁকুনি দিয়েও কোনরকম হরকত করানো গেল না আটত্রিশ বছর বয়সী এই তুখোড় যন্ত্রকে দিয়ে।কিন্তু সাধারণ এই বিকলতা মেনে নেওয়া অতটা সোজা হলো না রেডিওর মালিকের জন্যে।সে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।একে একে বেরোল স্ক্রুড্রাইভার,হাতুড়ি,তারের কৌটো।চলতে লাগলো ঠুকঠাক,যদি অসময়ের ঘুম ভাঙ্গে তিরিশ বছরের পুরনো সঙ্গীর।নাকের ওপর চশমাটা সোজা করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই চলল।সামনে জ্বালানো মোমবাতিতে ধরা পড়ল তার শুকনো চোখের ওপর পাকা চুলের ছায়া।রিসিভার ডায়ালে স্টেশন ঘোরাতে ঘোরাতে দৃশ্যেপট সরে যেতে লাগলো স্টেশন এরই মত।শব্দরেখায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো বছর বারোর দুটি ছেলে হাতে একটা অন্য রেডিও নিয়ে,সামনে দিয়ে চলে গেল সাইকেলে ঘুরতে থাকা রেডিওর ঘোষনা।দুটো স্পিকারে ভেসে উঠলো সদ্যবিবাহিত দম্পতির ছবি,সে ছবি পাল্টে গেল।কিশোর ছেলেদের দল পা ঝুলিয়ে বসলো ওপরের হ্যান্ডেলে।সম্মোহনী ঘড়ির কাঁটায় যৌবনের এর ছবি বার্ধক্যে পরিণত হলো,কিন্তু তাদের কোলের ওপরের রেডিও একই রয়ে গেল।আজও এক,কিন্তু এবার সে ছুটি চায়।কথা বলতে আর ইচ্ছা করে না,পুরনো সঙ্গীর কাছ থেকে সে বিদায় নেবে।কিন্তু যা প্রত্যাশিত,তার প্রত্যাশা কি কেউ করে?ঠুকঠাক,ঠং ঠং হয়েই চলল।

একসময় আলো জ্বলে উঠলো।বেজে উঠলো গান।কিন্তু ইজিচেয়ার শুন্য রয়ে গেল চিরকালের মত।

সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

ছায়াপথ একাই বেঁচে থাকে


ছায়াপথ একাই বেঁচে থাকে কখনো কোনও কথা না বলে, হয়তো তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত কোনওদিন গ্রহান্তরের পথিকের, কিন্তু সে যে আজ নিরুদ্দেশ জীবনচক্রের গোলকধাঁধায়করুণ তার কাহিনি, কথার ওপর সাজানো কথা দিয়ে জীবন চলেযেন ভেঙ্গে পড়া কয়েকটি আয়নার স্বীকোরক্তিসে নিজের চেহারা আর দেখে না ভুলেওপুরনো রেকর্ড করা গলার স্বর চাপা রয়ে গেছে গতানুগতিকতার হর্নেশুধু মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি হয়সে ছাতা না খুলেই রাস্তা দিয়ে হাঁটেভিজতে থাকেভিজতে ভিজতে ধুয়ে যায় তার স্বরূপ, কয়েক মুহুর্তের জন্যেউদাস চোখে তাকিয়ে সে তখন কথার কিনারা খোঁজেআকস্মিকতার খোলচে পরা অতীতের রং চোখের সামনে উঁকি মারেসেই রঙ উধাও, ইন্দ্রধনুষ দেখা দেয় আজ সাদায় কালোয়কথা বাড়ালেই কথা বাড়েমনকে বোঝায় এই বলে যে, সে একলাই ছিলছায়াপথেরই মতোবৃষ্টি তখন থেমেছেপথিকের হাতে ধরা ছাতার বাঁট দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে অভিমান। 

সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬

সবুজ ঘন জঙ্গল।মাথার ওপর গাছের শাখাপ্রশাখায় একসুরে ডেকে চলেছে দোয়েল,ময়ূর,বউ কথা কও,আরও কত নাম না জানা পাখি।মাটির রং খয়েরি সবুজ,মনে হয় খানিক আগেই হয়ে গেছে একপশলা বৃষ্টি।কচি সবুজ পাতাগুলো থেকে এখনো জল চুইয়ে পড়ছে।টুপ,টুপ,টুপ টুপ.....নাকে ভেসে আসছে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ।চোখ বুজলে শুনতে পাওয়া যায় ঝিঁঝিঁর শব্দ।আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।চোখের পলক বন্ধ হলো।বৃষ্টিভেজা বন উবে গেল মুহুর্তে।সাদা মার্বেলের ঘরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। 
কল্পনাকলের মেশিন থেকে বেরিয়ে এসে চশমা খুলে চোখ মুছলাম।সার্কিট গুলো বদলাতে হবে।সবুজের ছোঁয়া চোখে লেগে আছে বলেই হয়ত...অভ্যেস ছেড়ে গেছে আজ ৫০০ বছর।ছেলেবেলার নেশা ,সবুজ দেখার।তখন আমি মানুষ ছিলাম।  

রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৬

বালিশের একপ্রান্ত ছিঁড়ে তুলো বেরিয়ে এসেছে।মেহগনি কাঠের চেয়ারটেবিল গুলো ধুলোয় জর্জরিত।প্যালাস্তারা খসে পড়েছে চারিদিকে।দরজার বাইরে লাগানো কলিং বেল টা বোবা,কোনো ওষুধই তাকে ঠিক করে তুলতে পারবে না।আগেকার সাজানো ঝাড়লন্ঠন গুলো এখনো আছে ক্ষতবিক্ষত ভাবে,জানলার ভাঙ্গা কপাট দিয়ে হাওয়া এসে দুলিয়ে দেয় মাঝে মাঝে তাদের।ওয়ালক্লক এর কাঁটাগুলো নুয়ে পড়েছে,যেন জিগ্গেস করছে অবশিষ্ট সময় তার জীবনের।এই ঘরে কোনদিন সুরের চর্চা হত।রোমান্টিক ইরার কম্পোসারদের নিয়ে চলত মাতামাতি।বাক থেকে শুরু করে বেঠোফেন অব্দি কেউই বাদ যায়নি।রোমান্টিক সুরের স্বপ্নের ওপর কাঠামো করে ভবিষ্যতের সিঁড়ি তৈরী করার ইচ্ছে ছিল তার।কিন্তু সেই সিঁড়ি কোনদিনই তৈরী হয়নি।হয়ত গোড়াতেই গলদ ছিল।রোমান্টিসিস্ম এর খোয়াব,খোয়াবই রয়ে গেছে।
কিন্তু আজও বিরাজ করে ঘরের ঠিক মাঝামাঝি রাখা একটা পিয়ানো।তার সামনে রাখা রকচেয়ারে বসে থাকা একই ব্যক্তি।তার হাতে একটানা বেজে চলেছে পিয়ানোর কীবোর্ড।ব্যক্তির মুখে জলন্ত পাইপ,পরনে  আদ্যিকালের একটা  ডিনার স্যুট। চোয়াল ঝুলে পড়েছে,চামড়া আলগা হয়ে এসেছে।পাগলের মত অবিরত বাজিয়ে চলেছে সে।একসময় সে পিয়ানোর ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ল।পাইপটা পড়ে গেল মেঝেতে।ব্যক্তিটি মারা গেছে। 

টেক আ বো,মিস্টার স্ট্রেঞ্জর।ইউ হ্যাভ ক্রিয়েটেড ওয়ান।মৃত্যুর চেয়ে রোমান্টিক আর কি বা আছে?
চোখ যখন বিদ্রোহ করে,কোনোরকম লোভ দেখিয়েই তাকে সামলানো যায় না।বাইরে যখন সন্ধ্য হয় হয়,পাখির দল ফিরে চলে নিজের বাসায়,হঠাৎ করে সামনে রাখা কম্পিউটার এর মনিটরটা আয়না হয়ে যায়,দেখতে পাওয়া যায় নিজের বিধবস্ত চেহারা,আর কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের আউটলাইন।এমন সময় কম্পিউটার,কীবোর্ড,আর টেবিলের যাবতীয় জিনিসপত্র উড়ে চলে যায় ওপরের দিকে।উষ্ণতার নিশ্বাসে গরম হয়ে বেলুনের মত উঠে যায় আরো,আরো ওপরে।মুখ ফিরিয়ে দেখি,প্রতিটা টেবিল তখন হয়ে গেছে এক একটা গাছ,যার পাতাগুলোতে লেগেছে সন্ধ্যের গোধুলি।কোথা থেকে দুটো অদৃশ্য হাত এসে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে যান্ত্রিক আবর্জনাকে,কাঁচের দেয়াল তখন পরিণত হয়েছে মেঘের সমুদ্রে।সারি সারি নৌকো চলে আসে আমার সামনে পিছনে,মাঝির জায়গায় দাঁড় বইছে সবুজ এক একটি গাছ।চশমা তুলতে গিয়ে দেখি,চশমা ডানা লাগিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে টিয়াপাখিদের দলের সঙ্গে।কফির কাপ থেকে ভেসে আসে সোঁদা গন্ধ।অফিসের স্কাইলাইট থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙ্গীন প্রজাপতি।হুহু হাওয়া বয়ে যায়।আমি চোখ বন্ধ করি।কল্পনার উড়ানে শিকল না হয় নাই পরালাম কিছুক্ষণ।কয়েক মুহূর্ত চোখের পলক বন্ধই থাকুক।কিছুক্ষণ বরং বৃষ্টিতে ভিজে নেওয়া যাক...

সম্পর্ক জিনিসটা বড় অদ্ভুত।নিজের পরিচয় জেনেও যে অপরিচিত হয়ে থাকে বাইরের লোকের সামনে।ইতস্তত করে পৃথিবীর তেরছা চোখের সামনে।সম্পর্কের নাম যে একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট,সে বিষয়ে সম্পর্ক বোধহয় নিজেও সচেতন থাকে না,যতদিন না তীরের পর তীর এসে বিঁধতে শুরু করে তার অভ্যেসের সংজ্ঞায়।নামহীন যে আবেগপ্রবণতা নিয়ে হেসেখেলে কাটিয়েছে এতদিন,তার উপস্তিতি ভুলে সম্পর্ক তখন হাত দেয় নিজের নামের তরজমায়।খুঁজে বেড়ায় অনুসঙ্গতার বিবরণ,এদিক সেদিক পাগলের মতো।নতুন যুক্তির দলিল থেকে শুরু করে প্রাচীন পুঁথির রহস্য,কেউ যদি তাকে সাহায্য করতে পারে,লজ্জানিবারণ করতে।জাদুঘরে থাকা প্রাগৈতিহাসিক মমিগুলো তখন মুচকি হাসে।কয়েকজন অবশ্য সহানুভূতির চোখে তাকায়।সেই একই ভুলের ধারাবাহিকতা চলে যুগের পর যুগ।নিরন্তর সন্ধানের মাঝে,সম্পর্কের পিছনে আসতে থাকা অনুভূতি একসময় জীবন্ত ফসিলে পরিণত হয়।
....অথচ প্রজাপতি হতে পারতাম।বদলে যেতে পারতাম ভৈরবী মুহুর্তে ফুটে ওঠা অন্য কোনো ফুলে,ভোমরা অথবা মৌমাছি হওয়াতেও কোনো বাধা ছিল না।কিন্তু কিছুই হওয়া হলো না,তাই শেষমেষ মানুষই হলাম।অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রথমে নিজেকে,তারপর তাকে দেখলাম চোখের কোন দিয়ে,গায়ের রং নীল,ঠিক আমারই মতো,শুভ্রটানে সুসজ্জিত দেহের সুবাসে আমার পুরনো জীবনের স্মৃতি।সময় আসবে।পুনরাবৃত্তি হোক একই ঘটনার।অপেক্ষা করতে হবে ১২ বছর.....মানবজীবন রইলো,কিন্তু গাছ আর ফুলের মায়া আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখল।শুয়ে রইলাম পাতাঝরা গাছের নিচে,বাগান যখন ঘুমিয়ে রইল,তখন ঘুমের সুতোয় টান দেওয়ার অভ্যেস টা একই রয়ে গেল।স্বপ্নে দেখলাম হাতে পায়ে পল্লবিত পুষ্পের কলি,শিরাগুলো আঙ্গুল দিয়ে বেরিয়ে মাটিতে গিয়ে মিলিত হয়েছে।ঘুম হয়না।রাতবিরেতে ওঠে জানলা খুলে গাছ পাতাদের ফিসফিসানি অনুভব করি।চায়ের পটে ফেলে দেওয়া গোলাপের পাঁপড়ি আর আয়নার চারিপাশে বাঁধিয়ে রাখা লতাপাতার নকশা ডাক দিয়ে যায়।সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকি আকুল দৃষ্টিতে।বৃষ্টি এলো।ভিজলাম।সেও ভিজছে নিশ্চয়ই,কিন্তু তাকে থাকতে হবে দৃষ্টির অন্তরালে।বড় কষ্ট,বড় সুদীর্ঘ এই প্রতীক্ষা।বছর কাটতে লাগল.....
আজ এসেছে সেই দিন।অবশেষে।রাতের তৃতীয় প্রহর।আমার চোখে ভিজে থাকা কৌতুহল,আর বেদনার সারি।অপেক্ষা শেষ হয়েছে,কিন্তু আকাঙ্ক্ষা কি এখনো একই আছে?সময়ের কাঁটায় জীবনের শাখাপ্রশাখা প্রসারিত হয় অজানার দিকে|ধীরে ধীরে সেই অপরিচিত কুলই হয়ে ওঠে আপন।কিন্তু মায়ার বন্ধন নিয়তিকে বাঁধতে পারে না।বাগানে এসে দাঁড়িয়েছি।আস্তে-আস্তে সে আবির্ভূত হলো,প্রথমে হাত পা প্রসারিত করে সহজ করলো নিজেকে,তারপর করুণ দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে ভোররাতের প্রথম অপরাজিতা,শেষ করে ১২ বছরের দীর্ঘমেয়াদী নির্বাসন।বিদায়  ...ডান হাত এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় আমি তার ডাঁটি ধরে মারলাম টান,প্রাণপণে। 
.....চোখ খুললাম।আমি ফিরে এসেছি।গায়ের নীলের ওপর সাদাটান গুলো একই ভাবে উজ্জ্বল।ওপরের দিকে চোখ তুললাম।সে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।চোখ বেয়ে নেমেছে জলের রেখা।আর কোনদিন তুমি ফুল ছিঁড়বে না।আমরা আজ থেকে বন্ধু হলাম.....

বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬

প্রশ্নের বাজারদর বেড়ে চলেছে দিনদিন।যত অযৌক্তিক যে প্রশ্নের ভিত,তার চাহিদা তত বেশি।রঙ্গীন মোড়কে থাকা অবান্তর প্রশ্নের বিক্রি করে কয়েকদিনে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে বিতর্কিত আলোচনার আয়োজকেরা। বাজার ছেয়ে গেছে তীক্ষ্ণতার প্রশ্নজালে।দাঁত বার করে তারা ভয় দেখিয়ে বেড়ায় অন্ধকার গলিগুলোয়,যেখানে নিভুনিভু বাড়ি চালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে যুক্তি,উত্তর আর ব্যর্থ শ্রোতাদের দল।এদের গলার জোর কম,আদর্শের জোরে বেঁচে রয়েছে আজও।কিন্তু প্রশ্নের সওদাগরেরা পিছন থেকে আক্রমণ করলেও দিনের আলোয় এই দলের সম্মুখীন হতে চায় না,সযত্নে এড়িয়ে চলে তাদের।কানাঘুসো শোনা যায়,উত্তরের গলিতে শ্রোতাদের দলের কাছে লুকোনো আছে গোপন একটা অস্ত্র।কোনো হাতিয়ার তাকে রোধ করতে পারে না।নানা দলের লোক এই অস্ত্রের ওপর অধিকার দাবি করে কিন্তু জোর করে ছিনিয়ে নিলেও এই অস্ত্রপ্রয়োগ করতে পারে না সকলে। যুদ্ধের একতরফা রণভেরীর মাঝে একা জেগে থাকে,রাতের পর রাত মাথার কাছে এসে দাঁড়ায় সঙ্গী হয়ে,স্বপ্ন দেখায় ভবিষ্যতের। শত্রু দলের লোকেরা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছে,অস্ত্রটির নাম বিশ্বাস।
চোখের তারাদের প্রতিটা দিন কাটে একভাবে।একঘেয়ে দৃশ্যের ঘেরাজালে।প্লেটে রাখা টোস্ট আর টেবিলে সাজানো কম্পিউটার।রাস্তার কোলাহল আর ইউটুবের ভিডিও।ছুটির জন্যে পাঠানো দরখাস্ত মঞ্জুর করে না ওপরওয়ালা।তার কোনো ছুটি নেই,নেই কোনো মুখবদলের উপহার।কখনো কখনো সে রেগে মেগে নাকের বদলে নরুণ আর বাস্তবের বদলে কল্পনার ছবি পাঠিয়ে দেয় ব্রেন এর দপ্তরে বসে থাকা নিউরনদের কাছে।কিন্তু সে ছবি অবশেষে চলে যায় জোড়াতালির কারখানায় রাখা পুরনো স্বপ্নঘরের চিলেকোঠায়।স্বপ্নের নিউরন দের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না,বড় আলসে তারা।বাস্তবের কোনো ছবি তাদের ডাটাবেস সাপোর্ট করে না।কিন্তু পুরনো কর্মচারী বলে পার পেয়ে যায় প্রত্যেকবার।পলকের চেয়ারে বসে থেকে তারাদের অপেক্ষা চলতে থাকে অন্যান্য ইন্দ্রিযদের অগোচরে।অবশেষে একদিন স্বপ্নঘরের ডাক পায় সে,ছুটি পাওয়া যায়নি কিন্তু ট্রান্সফার হয়ে গেছে স্ব্প্নজগত ডিপার্টমেন্ট এ।অপ্রত্যক্ষ ছবির প্রোগ্রামিং করতে হবে,কিন্তু কোনো রকম স্ট্রাকচার অথবা ফ্লোচার্ট ফলো করা চলবে না।আনন্দে আত্মহারা হয়ে সামনের দিকে তাকায় তারা।জ্বলজ্বল করে ওঠা নীল চোখের পলক বন্ধ থাকে সামনে।ঠোঁটের ভিজে আবরণ তখন অন্য ঠোঁটের আড়ালে। 

শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৬

১)আতরের দোকান করে যারা,তাদের দোকানের বাইরের পৃথিবীটা বড়ই বাসী মনে হয়।পুষ্পের সৌরভ পেলেও তা যেন মনে হয় জোলো, ভালো মিষ্টির সুবাস মনে ধরে না।সব কিছুই বড় অপরিশোধিত।আতরের দোকানটা যেন আরেক জগত,গন্ধের হাট বসেছে সেখানে।কোনোটা পারস্যের ফুলের আতর,কোনটা হিমালয়ের আয়ুর্বেদিক শিকড়এর গন্ধ।প্রতিটি ফুল নিজের ইতিহাস জানায়।বলতে চায় নিজের গল্প।কয়েকজন কারিগর বছরের পর বছরের ধরে এক্সপেরিমেন্ট করে নতুন সুগন্ধের আশায়।দক্ষ হাতে গন্ধ তৈরী করে ওস্তাদ তারা।কিন্তু যে গন্ধ তৈরী করা যায় না,সেই গন্ধ পেলে তারা হীনমন্যতায় ভোগে।মাথার চুল খামচে ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু  ... পারে না। 

২)পুরনো দেরাজের ভিতর একরকম গন্ধ থাকে।গন্ধটা খুব পরিচিত কিন্তু ঠাহর করা যায় না।কখনো মনে হয় গন্ধটা প্রাচীন আসবাবের,কখনো মনে হয় নতুন বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ।বেশ কয়েক বছর পর যখন দেরাজ খোলে,গন্ধটা ছড়িয়ে থাকে বইয়ে,ছোটবেলার ডায়রিতে,জমানো স্টিকারএর কৌটোয়,রঙিন পেনসিলে.একটুক্ষণ বসে থাকলে আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রতিযোগিরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে চেনানোর জন্য.লক্ষী পুজোর গন্ধ,সন্ধ্যেবেলায় হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার গন্ধ,মাদুরে বসে খেতে বসার সময় হারিকেনের সলতের গন্ধ,মরাঘাসের ওপর ভিজে ফুলের অপেক্ষার গন্ধ,আরো কত....রঙের ও নিজস্ব এক একটা গন্ধ থাকে,যেমন থাকে ইতিহাসের.স্মৃতির গন্ধ অবশ্য লুকিয়ে থাকে নুড়ি নুড়ি গল্পের পিছনে,আড়াল দিয়ে হাসে.কিন্তু বর্তমানের কোনো গন্ধ থাকে না,কেননা বর্তমানের কোনো গল্প থাকে না।গল্প বুনে ওঠে অতীতের তারে।তাই গল্পের গন্ধ তৈরী করা যায় না।