রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬

কুট্টুসের কাণ্ড


 

(গল্পের প্রথম অংশটা আমার লেখাপরেরটা লিখেছেন মৌসুমী ঘোষতার ব্লগ-এর ঠিকানা হলো http://sagorbalaka.blogspot.in/ স্পিরিন্ট গল্প যাকে বলে, মানে ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ স্টাইলে হুড়মুড় করে দশ মিনিটে একটা গল্প নামানোর চেষ্টা গল্প অবশ্য শেষ হয়নি, পরের অংশটা আপনাদের লিখতে হবে)

 

১) সকাল সাতটা বাজতেই পোষা টিয়াপাখিটা ডেকে ওঠেকুটকি পাখির নাম দিয়েছে কুট্টুস টিনটিনের খুব ভক্ত বলেই মনে হয় কুট্টুস আর কুটকির বদমায়েশির চোটে বাড়ির লোকেরা হয়রান সাত বছর বয়স হলে কী হবে, সারাদিন কুটকি বাড়ি মাথায় তুলে নাচানাচি করছে আর সমানে ওর সাথে তাল রেখে চেঁচিয়ে যাচ্ছে কুট্টুসকুট্টুসকে নিয়ে এসেছিল ছোটমামাছোটমামার আবার শখের চিড়িয়াখানা আছে একটা, যদিও সেখানে পাখিই বেশি দিশি-বিদেশি ময়না, টিয়া, কাকাতুয়ার ডাকে ছোটমামার বাড়িটা সরগরম হয়ে থাকে সারাদিনএছাড়াও আছে কয়েকটা গুঁটলু-পুঁটলু খরগোশ, পাঁচটা বেড়াল আর একটা ছাগল ছাগল পোষার কথা আবার কেউ ভাবে নাকি? কিন্তু ছোটমামার ব্যাপারই আলাদা ছাগলটাকে দেখে নাকি তার ছোটবেলার বন্ধু ল্যাংচাকে মনে পড়ে গেছিলছাগল বাবাজির নামও রাখা হয়েছে ল্যাংচা কী আশ্চর্য, ল্যাংচা আবার ল্যাংচার দারুণ ভক্ত মাঝে মধ্যেই ছোটমামা নিজে হাতে করে এনে ল্যাংচাকে ল্যাংচা খাওয়ান এ নিয়ে প্রথম দিকে বিস্তর হাসাহাসি হলেও পরে সকলের কাছেই ল্যাংচা আপনজন হয়ে উঠেছে সাদা রঙের ছাগল বড় একটা দেখা যায় না,তার ওপর ল্যাংচার মাথায় একটা কালো টিপ আছে যেন কেউ কাজল পরিয়ে দিয়েছে!

 

যাই হোক, কথা হচ্ছিল কুট্টুস আর কুটকির কুটকির স্কুল ছুটি পড়ে গেছে এখন ওর দুরন্তপনা আরও বেড়েছে তাই সকাল থেকে দুরন্তপনায় নাকাল করে তুলছে সবাইকে, কুট্টুসকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে এ ঘর সে ঘর আর গুচ্ছের লঙ্কা খাইয়ে চলেছে কুট্টুসকে কুট্টুসটাও হয়েছে মহাপাজি, সকাল হতেই চেঁচাতে থাকে ‘ভোর হোলো দোর খোল’ বলে ছোলা আর লঙ্কা ছাড়া কিছুই ওর মুখে রুচছে না আজকাল আবার এর মাঝে একদিন রবিবারে সকাল সকাল এসে হাজির হলেন ছোটমামা পরনে জোব্বা আর কাঁধে ঝোলাব্যাগ ছোটমামাকে দেখেই মা নালিশ করতে বসলো কুট্টুস আর কুটকির, ওরা বড় ন্যাওটা কিনা ছোটমামার!

ছোটমামা হাত তুলে বললেন, “দিদি, দাঁড়াও দাঁড়াও আগে একটু বসেনি কী গরম পড়েছে! তার ওপর বেচারা ল্যাংচার সর্দি হয়েছে ঠান্ডা গরম হয়ে!” এই বলে তিনি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেনব্যাগ থেকে একটা শালপাতার ঠোঙ্গা বের করে বললেন, “দিদি, জিলিপি এনেছি নিয়ে এসো তো একটু সবার জন্য!” ততক্ষণে কুটকি, বাবা আর দিদিও চলে এসেছে ছোটমামাকে দেখেই দিদি বলে উঠলো, “ছোটমামা, তোমার কুট্টুসকে নিয়ে যাও গো, সঙ্গে কুটকিটাকেও নিয়ে যাও দু’জনে সারাদিন বাড়ি মাথায় করে নাচছে” বলে দিদি লম্বা ভেংচি কাটল কুটকিকে কুটকিও মুখ ভেঙ্গাতে দেরি করল করলো না

ছোটমামা হাত তুলে বললেন, “ওরে বাবা দাঁড়া দাঁড়া তোদের নিয়ে আর পারি না” মা ততক্ষনে সকলের জন্যে খাবার সাজিয়ে এনেছে জিলিপিতে একটা লম্বা কামড় দিয়ে ছোটমামা বললো, “কী রে কুটকি? বদমায়েশি করছিস বুঝি?”

কুটকি মাথা নেড়ে বললো, “না ছোটমামা দিদি মিছিমিছি মিথ্যে নালিশ করে খালি আমি আর কুট্টুস তো খেলা করছিলাম একটুও দুষ্টুমি করিনি

ছোটমামা বললেন, “তাই তো? তাহলে কী করা যায়? খেলা তো বন্ধ করা উচিৎ নয় গরমের ছুটি চলছে

বাবা বললো, “গরমও যা পড়েছে এবার, কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে এলে হতো কিন্তু আমার আবার ছুটি পাওয়া মুশকিল এই বছরে

ছোটমামা আস্ত একটা জিলিপি মুখে পুরে বলল, “তাহলেই দেখো! গরমে কুটকি বাড়িতে বসে করবেই বা কী? সেই জন্যেই বাড়ি মাথায় করছে ওকে দোষ দেওয়া যাবে না তাহলে বরং...সবচেয়ে ভালো সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসা যাক! জামাইবাবু না হয় নাই গেল! কুটকি আর ছুটকি তো যেতেই পারে আমি যাবো না হয় সঙ্গে! দিদির কী মত?”

মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল, বাবাকে ছেড়ে গেলে বাড়িতে কাউকে থাকতে হবে সারাদিন, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারও আছে বিশদ আলোচনার পর সবাই একমত হল যখন, কুটকি-ছুটকি মানে কুটকি আর দিদিই যাবে ছোটমামার সঙ্গে, গোল বাধল জায়গা নিয়ে বাবা বলছে দীঘা, মায়ের ইচ্ছে রাঁচি কুটকি সুন্দরবন যাবে বলে লাফাচ্ছে আর দিদি বলছে দার্জিলিং অতএব হট্টগোল! এর মধ্যে একবার ছোটমামা চেঁচিয়ে বলল, ব্যাস! আমি যা বলবো সেটাও ফাইনাল আরে বাবা আমি তো সঙ্গে যাবো না কী!

“আমরা যাবো হাফলং

বাবা বলল, হাফলং তো অনেক দূর তুই একা এদের সামলে এতদূর যেতে পারবি?”

ছোটমামা মুচকি হেসে বললো, একা কই? কুট্টুসও যাবে আমাদের সঙ্গে!”

 

২) কুটকির আনন্দ আর ধরে রাখে কে? একেই মা-বাবা এ যাত্রায় সাথে নেই, তাই “ওদিকে যেও না, সবসময় দিদির হাত ধরে থাকবে, সব জিনিস দেখেই খাব খাব করবে না”...এসব জ্ঞান দিয়ে বিরক্ত করার মানুষজন নেই তার সঙ্গে যোগ হল কুট্টুস-এর সহযাত্রা ছোটমামা ঘোষণা না করা পর্যন্ত কুটকির মাথায় কুট্টুস এর যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠেনি যেন পাখিটা ওরই সম্পত্তি যেখানে! ও যাবে, মানে সঙ্গে কুট্টুস তো যাবেই ভাগ্য ভালো, মা বাবাও এই নিয়ে আর বিশেষ আপত্তি করল না

ছোটমামা খেয়ালে মানুষ হলে কী হবে, প্ল্যান যখন করেছেন সেইমত কাজ গুছিয়ে রাখছেন প্রথমেই ট্রেন-এর টিকিট কেটে নিয়ে হাজির কামাখ্যা এক্সপ্রেস পরশু সকাল সাড়ে দশটায় হাওড়া থেকে ওদের ট্রেন ছাড়ার কথা বেড়াতে যাওয়ার খাবার পেয়ে কুটকির সব বন্ধুরা একে একে হাজির তাদের মনে একটু চাপা দুঃখ ও বটে ভাবল, আমাদের যে কেন এমন একটা মামা জোটেনি কপালে?” মামা সবার সঙ্গে মিশলেন হইহই করে সবাই মিলে মামাকে দিয়ে প্রমিস করালো যে, পরেরবার গরমের ছুটিতে শুধু কুটকি ছুটকি নয়, ওদের সক্কলকে সাথে করে পাড়ি দিতে হবে এর মধ্যে কুটকি আর কুট্টুস-এর গানে সারা বাড়ি মাতোয়ারা মা-বাবা-দিদি নাজেহাল তো বটেই, পাশের বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত পর্দা সরিয়ে রমা, মানে কুটকি-ছুটকির মাকে না জিজ্ঞাসা করে পারল না, আরে, মেয়েটার হলটা কী? আর পাখিটাই বা বাড়ি মাথায় করছে কেন!”

কিছুই না, যত ছুটির গান এদ্দিন পর্যন্ত শিখেছে কুটকি, সেগুলোই জোরে জোরে ওগরাতে লেগেছে,আর কি! ‘আমাদের ছুটি ছুটি, চল নেব লুটি, ওই আনন্দঝর্না’ আবার কখনো ‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি’ এমনি যা মনে আসছে ছুটির আমেজের গান পাখিটা কি এই অবস্থায় চুপ করে থাকবে বলে মনে হয়? কুটকিকে গাইতে দেখে সেও শুরু করেছে তার যা কাজ, নকল করা এই দুইয়ের রাগ-রাগিনী নিয়ে ঘোষালবাড়ি সরগরম

রমা একটা বাক্সে দুই বোনের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখলেন কিছু হালকা গরমের জামা দিলেন, দরকারে যদি লাগে ট্রেনে শীত করে রাতে শোয়ার সময় সে খেয়ালও আছে বাবা এসে বললেন, যাক, আর চিন্তা নেই কালকের ছুটিটা কোনক্রমে মঞ্জুর করিয়েছি মামাভাগ্নিদের ট্রেনে তুলে দিতে পারব অন্তত!” আর মামাকে কয়েকশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেন খরচাপাতিও তো হয়েছে কিছুটা, হবেও

পরদিন যাত্রার ক্ষণ উপস্থিত যে যার মতন ব্যস্ত এখন মা নাডুর কৌটো বাক্সে গুঁজে দিতে ছাড়ছে না, বাবা গেছে মোড়ের মাথায় রিক্সা ডাকতে ততক্ষণে সব গুছিয়ে ফাইনাল করে রাখতে গেছে বাবা কুটকির তখনও একটা ডায়রি পেন ঢোকানো হয়নি ব্যাগে ওমা তাইতো! মনে পড়তেই চট করে কাজ সেরে নিল সে ছুটকির সাজ যে শেষ হয় না এখনও ক্লিপ লাগানো বাকি চুলে ওদিকে প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ বাড়ির বাইরে, মানে রিক্সা আগত

তল্পিতল্পা বিশেষ কিছু নেই মামার একটা ব্যাগ আর ছোট সুটকেস দু বোনের একটা পুঁচকে বাক্স রমা নিজেই আস্তে আস্তে বাইরে বের করছিল হঠাৎ দেখা গেল ছোটমামা একটা কী খুঁজছে এঘর ওঘর করে নিশ্চয়ই হাতঘড়িটা গুম করেছে বাড়িতে জিগ্গেস করতে মামা বললেন যে চুল আঁচরানোর আগে এই ট্রেনের টিকিট তা বের করে টেবিলের ওপর রেখেছিলেন, তারপর আর খুঁজে পাচ্ছেন না পাঞ্জাবির পকেটে রাখবেন বলে বাইরে রাখলেন তো মাল উধাও ভেবেচিন্তে কিছুই কুল করতে পারছে না মা তো ব্যস্তসমস্ত হয়ে চারবার দেখছে বাবা ওদিকে বাইরে থেকে হাঁক ডাক দিতে শুরু করেছে,বাড়ি থেকে কেউ বেরোচ্ছে না দেখে এই ড্রয়ার ওই ড্রয়ার হাতড়াতে হাতড়াতে মা আনমনেই একবার কুটকিকে জিগ্গেস করল, টিকিটটা দেখেছিলিস কোথাও?”

কুটকির উৎসাহে এখনো একটুও ভাঁটা পড়েনি চেঁচিয়ে বলল, কই না তো!” তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, কুট্টুস-এর মুখে একটা সাদা কাগজ যেন দেখেছিলাম তারপর তো সে ছাদে চলে গেছে এখানে তো দেখছি না

পাশের ঘর থেকে মামা শুনতে পেয়েছে ভাগ্নির কথা বাবাও আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে উঠোনে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিল মেয়ের কথা শুনে তো মাথায় হাত ব্যাস! তারপর আর দেখে কে? ছাদের সিঁড়িতে বাড়ির সবাই লাইন দিয়েছে, আর ঘোষালবাড়ির সদর থেকেও শোনা যাচ্ছে বাড়ির ভেতরর গোলমাল, কুট্টুস! এই কুট্টুস! কুট্টুসসোনা, কুট্টুস রে, কুট্টুস...”

1 টি মন্তব্য: