Rafael Nadal in French Open 2024 |
ইন্টারনেট থাকলে কী হয়? শত শত বাজে রিলস আর অর্থহীন তর্কবিতর্ক এর মধ্যে এক একটা ছোট্ট কাজের জিনিস এসে মন ভালো করে দেয়, যা ট্রেন্ড করিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
ফ্রেঞ্চ ওপেন শুরু হয়েছে কয়েকদিন হল। টেনিস নিয়ে উন্মাদনা না থাকলেও স্কুল কলেজ জীবনে ফ্রেঞ্চ ওপেন, ইউ এস ওপেন আর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন দেখার একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেভাবে ক্লাব ফুটবল ফলো না করলেও ইউরো কাপ আর ওয়ার্ল্ড কাপ ঠিকই দেখে ফেলতাম। ক্রিকেটের কথা ধরছি না, ২০১১ সাল অব্দি আমরা অনেকেই ক্রিকেট নিয়ে যা তা লেভেলের পাগলামি করেছি।
যাই হোক, যে খবরের কথা বলছি, সেটা তেমন কিছু নয়। কাল মেন্স সিঙ্গলসের প্রথম রাউন্ডে রাফায়েল নাডেলের সঙ্গে অ্যালেক্সান্ডার ইয়েভরেভের ম্যাচ ছিল। ২০২৩ সালে স্কিপ করার পর রাফা এই বছর আবার ফিরে এসেছিলেন, রিটায়ারমেন্ট সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। কোর্টে তাঁকে দেখা মাত্র আনন্দে ফেটে পড়েছে জনতা, রাফার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, অনুরাগীরা তুমুলভাবে তাঁকে সাপোর্ট করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। ফিলিপ চার্টিয়ার কোর্টে প্রায় পনেরো হাজার দর্শক বসতে পারে, রাফার এক একটা শট তাদের আনন্দকে শতগুণ বাড়িয়ে তুলছিল। হবে নাই বা কেন? ক্লে কোর্টের বেতাজ বাদশাহ বলে পরিচিত এই ছেলেটি চোদ্দ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে ইতিহাস গড়ে দিয়ে গেছে, তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, রাফার প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়েভরেভ তার সেরা ফর্মে আছেন। কয়েকটা রাউন্ডে পিছিয়ে গিয়ে যখন অবশেষে রাফার ফোরহ্যান্ড শটটা কোর্টের বাইরে গিয়ে পড়ল, পনেরো হাজার দর্শকের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল স্পষ্ট। শোনা গেল সেই নীরব প্রশ্নও? এই কি শেষ? ইজ দিজ দ্য এন্ড অফ দ্য কিং অফ ক্লে? ইজ দিস দ্য এন্ড অদ রাফায়েল নাদাল?
রাফাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, তিনি এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি।
"It's difficult for me to talk. I don't know if it's going to be the last time that I am going to be here in front of you, honestly, I am not 100 per cent sure, but if it's the last time, I enjoyed it. The crowd has been amazing during the whole week of preparation and today. The feelings that I have today are difficult to describe in words but for me it's so special to feel the love of the people the way that I felt, in the place that I love the most."
ইয়েভরেভকে অভিনন্দন জানিয়ে রাফা বলেছেন, "The amount of feelings that I had on this amazing court during all my tennis career is just unbelievable. I never could imagine when I was a kid that I would be here, almost 38 years old, with all the success that I had here, winning so many times, something that I never could dream about. I don’t know for how long, but I want to keep going for a while, because they are having fun, I am having fun, and I need to see, I need to give myself a little bit longer chances to see if my level is growing and my body is holding, and then let’s make a decision."
রাফা রিটায়ার করবেন কী করবেন না, ঘটনা সেটা নয়! আসল ঘটনা হল, ইয়েভরেভ কী করলেন? ম্যাচের পর যখন গোটা মিডিয়া তাঁকে ছেঁকে ধরেছে, রাফা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন ভিতরে, জীবনের সেরা এক ম্যাচ জিতে যাওয়া ছেলেটা কী ভাবে সেই জয় সেলিব্রেট করল? কোনও সন্দেহ নেই, ইয়েভরেভ আর্গুয়েবলি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ জিতেছেন, চোদ্দবার চ্যাম্পিয়ন থাকা রাজাকে পরাজিত করেছে নিজের অসামান্য স্কিল আর এনার্জি দিয়ে, এন্ডর্ফিনের গতিও বেড়ে গেছে শরীরে, নিজেকে সত্যিই হয়তো অ্যালেক্সান্ডার মনে হচ্ছিল তাঁর? সৌরভ গাঙ্গুলির মতো জামা খুলে ওড়াতে বা বিরাট কোহলির মতো মাঝের আঙুল উঁচিয়ে অ্যাগ্রেশন দেখাতে কোনও বাধা ছিল না।
কিন্তু খেলার জগতে যারা সত্যিকারের খেলোয়াড়, তাদের জন্য একটা কথা আজও আছে। অনলি স্পোর্টসম্যানশিপ প্রিভেলস...
সেই মুহুর্তে, সেই পালসেটিং জয়ের মুহুর্তে দাঁড়িয়েও ইয়েভরেভ উপলব্ধি করেছিলেন, দ্য মোমেন্ট বিলংস টু রাফা, জনতা যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। আজ, এই ম্যাচের রেজাল্ট দেখে হয়তো তার স্কিল নিয়ে তারিফ করবেই তারা, তার জয়কে খেলো করে দেখবে না, কিন্তু তার সামনে দিয়ে যে মানুষটা পিঠে কিটব্যাগ নিয়ে একা ভিতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রায় কুড়ি বছর ধরে গোটা দুনিয়ার টেনিসপ্রেমীরা হার্ট এন্ড সৌল দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছে, তাঁকে নিয়ে লড়াই করেছে, অনুপ্রেরণা পেয়েছে, তাঁর পোস্টার ঘরে লাগিয়েছে। তাদের জীবনের কত কত আনন্দের মুহুর্ত, কত অ্যাড্রেনালিন রাশের পিছনে এই মানুষটার অবদান আছে। তারা চায় ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরে যাক, কুড়ি বছর আগের সেই তেজি ছেলেটা তাঁর এজিং বডির হাজারটা চোট জখম যন্ত্রণা ভুলে ফের কোর্টে প্রত্যাবর্তন করুক! একের পর এক ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কামব্যাক করুক, যা রাফা তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ারে বারবার করেছে।
তো ইয়েভরেভ কী করল? সে মাইক হাতে নিয়ে বলল, "Thank you, Rafa, from all of the tennis world, it’s such a great honour." তারপর মিডিয়া আর প্রেজেন্টারকে অনুরোধ করল রাফার সঙ্গে ইন্টারভিউ কন্টিনিউ করার।
শুনতে খুব ছোট্ট একটা ঘটনা বলেই মনে হয়, কিন্তু আজকাল এরকম ছোট্ট ঘটনাও বিরল হয়ে উঠছে। ইয়েভরেভ আমাদের মনে করিয়ে দিল, ছোটবেলায় শেখানো এই উক্তিটা (যা আজকাল শোনাই যায় না) সে ভুলে যায়নি।
“Be gracious in defeat, magnanimous in victory.”
শেষবার যখন স্পোর্টসম্যানশিপের এমন একটা নজিরের সাক্ষী হয়েছিলাম, তখন ২০১৪ সাল। দ্য গ্রেটেস্ট স্পোর্টস স্পেক্টটেকাল বলে খ্যাত সেই মুহুর্তটা অনেকের কাছে দ্য মোস্ট আনফরচুনেট স্পোর্টস ইভেন্টও ছিল, কারণ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের সেই ম্যাচে জার্মানি ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারিয়েছিল। ব্রাজিলকে, যারা কিনা চিরকালের ফুটবল পাওয়ারহাউস। যাদের এনার্জি দেখলেই প্লেয়াররা অর্ধেক কৌশল ভুলে যায়। কিন্তু সেই ম্যাচে দুনিয়ার ফেভারিট টিমকে একেবারে দুরমুশ করে ফেলেছিল জার্মানি। কারণ যাই থাক! হোম ক্রাউডের প্রেসার, নেমারের মতো প্লেয়ারের অনুপস্থিতি, ডিফেন্সিভ ফেইলিওর, জার্মান কোচের নিঁখুত প্ল্যানিং আর খেলোয়াড়দের অসামান্য স্কিল...
কিন্তু, তা সত্ত্বেও, আনন্দের প্রকাশ দেখাতে গিয়ে একবারের জন্যও মাত্রা ছাড়ায়নি জার্মান টিম। দু একটা গোল করার পর যখন তারা বুঝে যায় ম্যাচটা ডমিনেট করে ফেলেছে, তারপর প্রতিটা গোল করার পর জার্মান প্লেয়াররা একদম সাবডিউড সেলিব্রেশন করেছে, সিংঘনাদ করে বা গোরিলার মতো বুক চাপড়ে আস্ফালন করেনি। ম্যাচটার ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি তারা টিম হিসেবে ব্রাজিলের অল টাইম স্টেটাসকে যে রিকগনিশন দিল, সেটা তখন কেউ বুঝতে পারেনি। বেশ কয়েকমাস পর ব্রাজিলের খেলোয়াড়রাই বলেছিল, তারা কৃতজ্ঞ যে জার্মানির টিম ফুটবলের ইতিহাসে তাঁদের কৃতিত্বকে মনে রেখে যথাযথ ব্যবহার করেছে, যেরকম স্পোর্টসম্যানশিপ দেখিয়েছে। ঠিক যে কাজটা কাল ইয়েভরেভ রাফাকে মিডিয়ার আলোতে এগিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত দিয়ে করল।
খেলা হোক বা জীবন, জয় আর পরাজয়কে অ্যাক্সেপ্ট করার যে গ্রেস আর হিউমিলিটি, সেসব ক্রমে এক্সটিংক্ট হয়ে আসছে। পোস্টটা দিলাম, যদি কারো এই অবসোলেট কথাটা আবার মনে পড়ে যায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন