সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪

গোয়ালিয়র ঘরানা- সিটি অফ মিউজিক (২)

জিওয়াজি রাজ সিন্ধিয়া

দিন কয়েক আগে গোয়ালিয়র ঘরানা নিয়ে একটা ছোট পোস্ট করেছিলাম। গান গাইতে গিয়ে (বলা উচিত তান টানতে গিয়ে) কীভাবে হসসু খান মারা গেলেন আর তারপর তাঁর ভাই হদ্দু খান আর বড় জ্যাঠা বড়ে মুহম্মদ খানের পরিবার গোয়ালিয়র ঘরানাকে একটু একটু করে মজবুত করে ফেলল, এই সব আর কি! সেটা পড়ে আমার এক প্রিয় বন্ধু জিগালো, এরপর হদ্দু খানের কী হল? সে অনেক কথা, আর সব গল্প মিলেমিশে ঘ্যাঁট হয়ে গেছে বলে আলাদা করে একজনের গল্প বলা মুশকিল। তবে কিনা সংক্ষেপে গোয়ালিয়র ঘরানার ইন্টারেস্টিং গল্পগুলো লেখাই যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাতেই কুমারপ্রসাদবাবু প্রায় সবই লিখে গিয়েছেন, আর বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন, সে সুসাহিত্য পড়ে অনেকেই মার্গ সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন, তারপর আর কিছু লিখে লাভ আছে কী?

ব্যক্তিগতভাবে, আমার যদিও কুদরত রঙবিরঙ্গী পড়তে অসুবিধা হয়েছে, (মারবেন না প্লিজ, বলছি) বই হিসেবে পড়তে আমার চমৎকার লেগেছে, কিন্তু বিষয়বস্তু প্রায় সবটাই মাথার ওপর দিয়ে গেছে। সেটা হওয়ারই ছিল, কারণ এই গ্রন্থ লেম্যানদের জন্য নয়। যারা কিছুটা জানেন, কিছুটা শুনেছেন, আরো অনেকটা জানতে চান, তাদের জন্য অবশ্য লেখাটা অসম্ভব মূল্যবান। কিন্তু আমাদের মতো পাবলিক, যারা এ বি সি ডি জানে না, তারা ইংরেজি শর্ট স্টোরি রাইটিং এর কেরামতি কী বুঝবে? প্রথমেই এই বই তুললে ঝামেলা হতে পারে! বই থেকেই একটা উদাহরণ দিচ্ছি--

"আমি সামান্য বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে যা মনে করি, তা বলতে গেলে গোয়ালিয়র এর বৃদ্ধ গায়ক শরতচন্দ্র আরোলকরের উক্তি আগে শোনাতে হয়। তাঁর বক্তব্য, আমাদের বারো শ্রুতিও নেই, আমাদের সুর নদীর মতো প্রবাহিত ধারা, তার জায়গায় জায়গায় আমরা ঘাট বেঁধে দিয়েছি। এটা কোমল রেখাব, এটা ভৈঁরোর অতি কোমল রেখাব, এটা কাফির কোমল গান্ধার, এটা জয়জয়ন্তীর, এটা নায়কীর এবং এটা দরবারীর ইত্যাদি। এইটাই থান কথা। আমরা ভারতবাসী, হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমরা চাই সিস্টেমাইজ করতে, পুঁথিতে লিখে শাস্ত্র অকাট্য বলে বাক্সবন্দী করতে চাই আমাদের ঐতিহ্য। 

আসলে আমাদের মার্গসঙ্গীত অন্যান্য সঙ্গীত থেকে ভিন্ন। কারণ আমাদের গানে মীড় আছে, সুত আছে, ঘসিট আছে। আমরা এক সুর থেকে অন্য সুরে যেতে হলে লাফিয়ে যাই না, ভেসে যাই। তারই ফলে ভীমপলশ্রীর মতো রাগে আরোহণে কোমল গান্ধার ও কোমল নিখাত চড়ে যায়। অবরোহণে সেই পর্দাই নেমে যায়, তাদের স্থান ভিন্ন!"

পড়তে চমৎকার লাগল। তাই না? আমাদের সুর নদীর মতো, সেই সুরের দরিয়ায় ঘাট বেঁধেছে ভারতের শিল্পীরা। কিন্তু এরপর তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন, সবকিছু আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাবে। বারো শ্রুতি, কোমল রেখাব, মীড়, ঘসিট, কোমল গান্ধার, আরোহণ অবরোহণ, রাগরাগিণী, ভাইব্রেশন, বাদ্যযন্ত্র, ভূপালির গান্ধার, হাম্বীর এর ধৈবত...আমাদের মতো এক শ্রেণীর বোকা পাঠক আছে যারা কিচ্ছুটি জানে না। এসব খায় না মাথায় দেয় কেউ আমাদের আঙুল ধরে শিখিয়ে দেয়নি। যে সময় প্রথম আমি বইটা পড়েছি, আমার মিনিমাম পসিবল আইডিয়াও ছিল না। তাহলে আর বইয়ের রস উপভোগ করা হবে কী করে? 

আমার ধারণা, একদম ক অক্ষর গোমাংসের জন্যও অবশ্য লেখা যায়, যদি আগে থেকে অব্জেক্টিভ ক্লিয়ার করে দেওয়া হয়। ফোকাস হল, তানসেন চাই না, চাই বাচ্চা লেভেলের কানসেন। 'ফনকার' চাই না, 'শুনকার'-এর প্রাইমারি লেভেল পৌঁছাতে পারলেই হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল ঠাট বজায় রেখে ঘুরতে পারবে। কিন্তু ওই লেভেলে পৌঁছাতে গেলেও আগে পাঠককে ধরে রাখা দরকার, তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আগে গান না শুনিয়ে গানের গল্প শোনানো হোক। গানের গল্পের মধ্যেই মাঝেমাঝে গানও আসে, ঠিক যেমন কল্পবিজ্ঞানে বাস্তব বিজ্ঞানও আসে, স্পাই গল্পে রাজনীতি আর অর্থনীতিও ঢুকে পড়ে, তখন সেটা গল্পের খাতিরেই জেনে নিতে হয়। গানও শুনে ফেলতে হবে, আর গল্পের খাতিরেই মন দিয়ে শুনতে হবে। কী করে? আরো কয়েকটা গল্প বলে বোঝানোর চেষ্টা করি।

আগেই বলেছি ভাইয়ের মৃত্যুর  পর বেশ কয়েক বছর হদ্দু খান একা একা সঙ্গীত সাধনা করেছেন, গোয়ালিয়র এর খেয়াল (খেয়াল মানে আসলে ইম্যাজিনেশনই, এ হল ধ্রুপদের নেক্সট ভার্সন আর কি! কিছুটা ডাম্ব ডাউন করে বন্দিশ মানে লিরিক্সে জোর দেওয়া, যদিও আগ্রার মতো অনেক ঘরানায় খেয়ালকে ধ্রুপদের মতো গাওয়া হত। সোজা কথায়, আপনার যদি ক্লাসিকাল শুনে ঘুম পায়, তাহলে যেটা শুনে কম ঘুম পাবে, সেটা সম্ভবত খেয়াল। ব্যতিক্রম বাদে!) গায়েকিকে আরো স্ট্রং করেছেন। তাঁর ছেলেগুলোও ছিল এক একটা জিনিস। তাঁর ছোট ছেলে ছোটে মুহম্মদ খান নাম করেছিলেন, কিন্তু গোয়ালিয়র ঘরানার মিস্ট্রি ম্যান হল তাঁর বড় ছেলে রেহমত খান। এই আধপাগলা, নেশাখোর, পথপাগল লোকটা সারা দেশে ঘুরেছেন, কখনও বেনারস কখনও নেপাল কখনও বা মহারাষ্ট্রের সাংলি গিয়ে ডেরা বেঁধেছেন, গেয়েছেন তুলনায় কমই। কিন্তু যাঁরা সেই গান শুনেছেন, তাঁরা সবাই রেহমত খানের নাম শুনলে চোখ বন্ধ করে কানে হাত দেন। প্রায় একশো বছর আগের একটা রেকর্ডিং আছে, কিন্তু ইটুকু শুনলেই ভদ্রলোকের গলার জোর বুঝতে পারবেন!

https://www.youtube.com/watch?v=PR_NyQ4AyM4

যাই হোক, হদ্দু খান  ভাইয়ের মৃত্যুর ট্রমা কাটিয়ে গোয়ালিয়র মহারাজ জিওয়াজি মহারাজ সিন্ধিয়ার দরবারে গায়ক হিসেবে যোগ দেন, কিন্তু দুই ছেলের চেয়েও তাঁর বেশি সফট কর্নার ছিল চচা বড়ে মুহম্মদ খান (যাঁর সামনে গাইতে গিয়ে ভাই হাসসু প্রাণ হারিয়েছেন) এর ছেলে মুবারক আলি খানকে নিয়ে। ইনি অলওয়ারের রাজার কাছে গাইতেন, কিন্তু বড্ড মুডি ছিলেন। ইচ্ছে না হলে তাঁর গান জমত না, সে সামনে রাজাই থাকুক আর জিবেগজাই থাকুক। তা সেবার জিওয়াজি রাজ সিন্ধিয়াকে ভাইয়ের গান শোনাবেন বলে জোর করে নিয়ে এসেছেন, তা মুবারক খান দরবারে বসে বিশাল বিশাল হাই তুলে এমন এক গান ধরলেন যে সবাই হুটিং করতে লাগল, হদ্দু খান লজ্জায় মাটিতে মিশে যান আর কি। জিওয়াজি রাও চোখ নাচিয়ে বললেন, "এ কোন রোদ্দুর রায়কে ধরে আনলে হে? এর চেয়ে ভালো তো আমিই গেয়ে দেব!"

হদ্দু খান মুখচুন করে ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এর এক সপ্তাহ পরেই একজনের বাড়িতে রাবড়ি জিলিপি খেতে গিয়েছেন মুবারক খান, সেখানে কথায় কথায় গানের আসর জমে উঠল। মুবারক খান মুডে এসে গেলেন আর এমন গাইতে লাগলেন যে পাড়াপড়শিরা এসে ভিড় করে দাঁড়াল। রাস্তাঘাট ফাঁকা, গরুতে সবজি খাচ্ছে, বেড়াল কুকুর এসে পেঠা খেয়ে নিচ্ছে, কারো হুঁশ নেই। সেই গান কানে আসতেই হদ্দু খান পড়িকিমরি করে ছুটলেন, রাজার কাছে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, "চলুন স্যার। উস্তাদ কো মুড আ গয়া!"

রাজাগজা বলে কথা, বললেই পাড়ার মজলিশে যাওয়া যায় না। কিন্তু এই রাজাও ছিলেন তেমন গানের ভক্ত। মাহুতকে চার লাত্থি মেরে ওঠালেন, বেচারির আফিমের নেশা ছিটকে গেল। হাতিতে করে রাজা চললেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁকে দেখে ওস্তাদের মুড যদি বিগড়ে যায়? হদ্দু খান নিজে আগেভাগে দৌড়ে গেলেন, সবাইকে কানে কানে বললেন কেউ টুঁ শব্দ করবে না রাজাকে দেখে। আসর বসেছিল একতলার ছাদের ঘরে, রাজার হাতি এসে হাজির হল গলির মধ্যে, মাহুত হাতিকে একদম বাড়ির কাছে নিয়ে গেল, রাজামশাই চুপিচুপি জানলায় কান লাগিয়ে মুবারক খানের তান শুনতে লাগলেন। মুবারক চোখ বন্ধ করে তান লাগাচ্ছেন, জিওয়াজি রাও চোখ বন্ধ করে শুনছেন। হাতিটাও নাকি চোখ বন্ধ করে  কান নাড়িয়ে তারিফ করছিল। কয়েক ঘণ্টা এরম চলল। গান শেষ হলে রাজামশাইকে দেখে মুবারক খান থ। তিনি লজ্জায় কিছু বলতে পারছেন না। রাজামশাই ইনামের বরসাত করে বললেন, "আপনিই শিল্পী স্যার। সবাই রাজাদের জন্য গান, আপনি নিজের জন্য গান। মিঁয়া তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাসের মতোই আপনি অমর হয়ে থাকবেন!"

রাজাগজাদের আর্ট আর কালচার নিয়ে এই প্যাশন শুধু গোয়ালিয়রেই ছিল না। সময় বদলায়। একসময় জিওয়াজিরাজ সিন্ধিয়া মারা গেলেন, রাজকুমার ছোট, গোয়ালিয়র এস্টেট কস্ট কাটিং করতে গিয়ে গায়কদের  বেতন কমিয়ে দিলেন। অনেক সাধারণ মানুষ দশ টাকাও পায় না, এদিকে গাইয়েরা দু একজন হাজার টাকাও মাইনে পাচ্ছেন, এস্টেটকে দোষ দেওয়াও যায় না। হদ্দু খান বা গোয়ালিয়রের তাঁর ভাইপো নত্থে খান (যিনি তাঁদের প্রথম গোয়ালিয়রে ডেকে পাঠিয়েছিলেন) তারা পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। এরা দুনিয়াদারি কিছুই বুঝতেন না, সের সের জিলিপি খেতেন, মালাই খেতেন, পোলাও কালিয়া খেয়ে রেয়াজ করতেন, বখশিশের টাকা সাধারণ মানুষকে দিয়ে দিতেন! অনেকে ভাবল, গোয়ালিয়র গায়েকির এই শেষ! এরা এবার যাবে কোথায়, খাবে কী? কিন্তু এই ঘটনার কিছু বছর আগেই হদ্দু খান এমন এক কাজ শুরু করেছিলেন যা এই ঘরানার ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

মহারাষ্ট্র থেকে আসা বেশ কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার তখন গোয়ালিয়রে থিতু হয়েছিল। এরা অনেকেই ফাটাফাটি কীর্তন গাইতেন, কিন্তু ক্লাসিকালের বেস ছিল না। প্রথমে হদ্দু খান আর তারপএ নত্থে খানের দত্তক পুত্র নিসার হুসেইন খান এদেরকে গান শেখাতে শুরু করলেন। আমি যতটা সহজে লিখে দিলাম, ব্যাপারটা ততোটাও সহজ নয়। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা, গানবাজনা পরিবারের বাইরে যাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার, উপযুক্ত মনে না হলে বাপ ছেলেকেও শেখাত না, সেখানে মুসলমান ওস্তাদরা অন্য মুলুক থেকে আসা হিন্দু পণ্ডিতদের তালিম দিচ্ছেন মানে কেলেংকেরিয়াস ব্যাপার। মারাঠি ব্রাহ্মণদেরও কুর্নিশ, তারা জেঁচে মুসলমান ওস্তাদজীর কাছে শিখতে এসেছিলেন। হদ্দু খানের প্রথম শিষ্য ছিলেন বাসুদেও রাও জোষী, এদিকে নিসার অলি খান তালিম দিচ্ছেন রামচন্দ্র চিচবড়করকে। এই দুই মারাঠি মানুষ 'আতা মাঝি সাটাকলি' বলে এইসা গান শিখলেন যে গোয়ালিয়র ঘরানার একটা শাখা পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রের পার্মানেন্ট সিটিজেন হয়ে গেল। 

সে কথা পরে, কিন্তু এস্টেট মাইনে কমিয়ে দেওয়ার সময় বাসস্থান আর খাওয়াপরার যে অভাব দেখা দিল, তার সুরাহা করতেও এগিয়ে এলেন এই হিন্দু পরিবারের মানুষ। হদ্দু খান নিজে বেশিদিন বাঁচেননি, বড় ছেলে রেহমত খান তো ভবঘুরেই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিসার হুসেইন খান আজীবন শংকর রাও পণ্ডিতের পরিবারের কাছে অতিথি হয়ে থেকেছেন। (ভবিষ্যতে এই রাও ফ্যামিলি গোয়ালিয়র ঘরানার গায়েকিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নিয়ে গেছে। কৃষ্ণরাও শংকর রাও পণ্ডিত গোয়ালিয়রে শংকর গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয় নির্মাণ করেছেন, একগাদা বই লিখেছেন, রেডিওতে কাজ করার সময় অসংখ্য বন্দিশ রেকর্ড করেছেন, পদ্মভূষণও পেয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরিরাও কম যান না। লছমন রাও পন্ডিত এই সেদিন অব্দি গোয়ালিয়রের সবচেয়ে সিনিয়ার গায়ক ছিলেন, ইউটিউবে তাঁর প্রচুর রেকর্ডিং আছে। তাঁর মেয়ে মিতাও প্রতিভাবান শিল্পী, মিতা পণ্ডিতের লেখা বই পড়ে অনেকেই এইসব গল্প জেনেছেন) একজন মাংহখেকো মুসলমানকে মারাঠি ব্রাহ্মণ ফ্যামিলি ঘরে এনে অতিথি করেছেন মানে কল্পনা করতে হলে গানবাজনা নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ ঠিক কতটা সেন্সিটিভ ছিলেন! গঙ্গা জমুনি তেহজিব কথাটা হাওয়া থেকে আসেনি! তাই বলে নিসার হুসেইন এর মেজাজ কম ছিল না, শংকর রাও এর পরিবারে তিনি রাজার মতো থাকতেন।

সকালবেলা কুয়োর কাছে গিয়ে বসে আলাপ ধরতেন, সবাই মিলে তখন কুয়ো থেকে বালতি করে জল তুলে তাঁকে স্নান করাত। এই স্নানের কোনও সময় ছিল না, যতক্ষণ না স্যার থামতে বলছেন, গান চলবে, স্নানও চলবে। তারপর আহার। সেই মেওয়া মিষ্টি মালাই দেওয়া খাবার, গোস্তও রাঁধতে হত ওস্তাদের জন্য, অনেক সময় শংকর রাওয়ের ঘরের লোকজন না খেয়ে আগে ওস্তাদজিকে খাওয়াত, টাকাপয়সা ধার নিয়ে আসত, কিন্তু মুখ খুলে একবারের জন্যও কমপ্লেন করত না। বহুবছর এরকম চলেছে। বিনিময়ে নিসার হুসেইন শিষ্যদের প্রাণ দিয়ে শিখিয়ে গেছেন। সেই যুগে অনেক নামী নামী ওস্তাদ শংকর রাও এর বাড়িতে এসে আসর জমাত, এমনকি একবার (সম্ভবত ১৮৯২ সালে) নাকি স্বামী বিবেকানন্দও এসেছিলেন। তিনি পাখোয়াজ বাজিয়ে গানও গেয়েছিলেন বলে  জানা যায়। 

নিসার হুসেইন ছিলেন মেজাজি লোক, ট্রেনে করে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বেরোতেন। এদিকে ট্রেনে উঠলে গাড়ির শব্দ শুনে তাঁর গানের ইচ্ছে হত। অনেকবার নাকি প্ল্যাটফর্মে বসেই গান গাইতেন, ট্রেন হয়ে যেত লেট। একবার কলকাতায় এসেছেন, ফোর্ট উইলিয়ামে নাকি পার্টি চলছে, ওস্তাদজি গটমট করে ঢুকে গেলেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে সবাই অনুরোধ জানাল, একটা গান হয়ে যাক। আর যায় কোথায়, নাসির হুসেইন হিন্দুস্তানি রাগের ওপর 'লং লিভ দ্য কুইন' গানটা গেয়ে দিলেন, সবাই তাজ্জব। ভারতীয় রাগে ইংরেজি গান, কেউ এমনটা কস্মিনকালেও ভাবেনি। লাটসাহেব অনুরোধ করলেন, "আরেকটা হোক!"

নিসার হুসেইন ট্রেনে করে এসেছেন, ট্রেনের দুলুনি তাঁর মাথায় ছিল। তিনি রেলের সিটি আর ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তালবদ্ধ তরানা গাইতে লাগলেন, সবাই ধন্য ধন্য করে উঠল। লাটসাহেব খুশি হয়ে বললেন, আপনার আর কোনোদিন ট্রেনে টিকিট কাটতে হবে না। 

(লছমন রাওরা এই গানটা শুনিয়েওছেন কয়েকবার। একটা রেকর্ডিং পেয়েছি খুঁজে। তেইশ মিনিট থেকে শুনুন। 

https://www.youtube.com/watch?v=YLSWmS8EZus) 

নিসার হুসেইন খান আর হদ্দু খানের শিষ্যরা শিখেপড়ে নিয়ে গোয়ালিয়রেই থেকে গেছিলেন। কিন্তু একজন ছিল, সে গান শেখার জন্য মহারাষ্ট্র থেকে গোয়ালিয়র এসেছিল। খালি পায়ে। হেঁটে।  প্রায় চারমাস পর গোয়ালিয়র আসার পর তাঁকে দেখে পুরো আধপাগলা ভিখারির মতো লাগছে, তাঁকে দেখেই সবাই দুরছাই করছে। অবশ্য তাঁর পরিবারের অনেকেই সত্যিই মাধুকরী করে দিন চালাত, ব্রাহ্মণ হয়ে তাঁদের জন্য সেটা অস্বাভাবিক ছিল না, অস্বাভাবিক ছিল মুসলমান ওস্তাদদের কাছে গিয়ে গান শেখা। কিন্তু এই মানুষটি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। 

কে জানত, এই ছেলেই আগামীতে গোয়ালিয়র ঘরানার পার্ফেকশনিস্ট হয়ে উঠবে। হদ্দু খান তাঁকে শুনে বলেছিলেন, আমার ভাই হসসু যেন ফিরে এসেছে। এইবার বলুন, কার কথা হচ্ছে?

(১. যারা এইসব শুনে ঠিক রস পাচ্ছেন না, বা এখনকার মতো এক্স ফ্যাক্টর পাচ্ছেন না, তাঁরা ওঙ্কার দাদরকরকে শুনতে পারেন, এই ছেলেকে শুনে নাকি এখনকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেরাও সিগারেটে টান দিতে ভুলে যায়

https://www.youtube.com/watch?v=oACbmNkih0I 

২.যদি আগ্রহ থাকে আর হাতে সময় থাকে, ইউটিউবে রাগা কোয়েস্ট চ্যানেলে ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল বোঝানোর জন্য একটা ছোট ক্র‍্যাশ কোর্স আছে চৌঁতিরিশটা ভিডিওর, একদম স্বর সপ্তক কোমল স্বর থেকে রাগ অব্দি সব কিছু আছে, শুনে নিলে একটা ভাসাভাসা আইডিয়া থাকবে। কোনও একটা স্পেসিফিক টার্ম বুঝতে হলে গোপা চক্রবর্তীর চ্যানেলে একেবারে লেম্যান টার্মে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে ঠিকাই হোক বা লয় আর লয়কারির অন্তর

বলাবাহুল্য, এসব কথাই একদম আমার মতো টোটাল আনাড়িরদের জন্য। বাকিরা ইগ্নোর মারি!)

কৃষ্ণ শংকর রাও পণ্ডিত
লছমন রাও পণ্ডিত
রেহমত খান, হদ্দু খানর ছেলে
বংশতালিকা ও গোয়ালিয়র ঘরানা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন