সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

অনলগর্ভা (উত্তরাখণ্ড-২০২৪)

 


প্রায় একমাস হতে চলল উত্তরাখণ্ডের জঙ্গলে আগুন লেগেছে। গোটা হিমালয় তো ছেড়েই দিলাম, শুধু কুমায়ুঁ অঞ্চলেই পাঁচশো'র বেশি জায়গায় দাবানল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে, আটশো হেক্টেয়ার বন পুড়ে ছাই, আগুনের শিখা প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট ওপরে উঠে গেছে। ছোট ছোট শান্ত সুন্দর পাহাড়ি গ্রামগুলো কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে থাকে, রোদের চিহ্ন নেই। যারা পেরেছে তারা পালিয়েছে, যারা পারেনি তারা মেনে নিয়েছে। এবার শেষ বিকল্প বরাবরের মতো... বৃষ্টি।

বারামাসার রিপোর্ট আর উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় মানুষদের করা ভিডিও দেখে বোঝাই যায়, প্রশাসন হাত তুলে নিয়েছে। অবশ্য হাত তারা আগে থেকেই তুলে আছে। প্রতি বছর ওয়াইল্ড ফায়ারের তীব্রতা আরো বাড়ছে, কারো বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। আগে গ্রীষ্মের প্রখর তাপে পুড়ে, প্রাকৃতিক কারণে বনে আগুন লাগত, এক জায়গায় আগুন লাগলেই পাঁচটা গাঁয়ের লোক একসঙ্গে এসে সেই আগুন নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত, গ্রাম পঞ্চায়েত আর স্থানীয় প্রসাশন থেকেও যথাসম্ভব সাহায্য করা হত। আমি নিজে এমন দেখেছি।

এখন সে সব চুলোয় গেছে। জানুয়ারি মাস থেকেই আগুন লাগতে শুরু করে, কেউ কেয়ার করে না। ব্যাপারটা পুরোপুরি নর্মালাইজ হয়ে গেছে। বন থাকলে বন তো জ্বলবেই, পশুপাখি তো পুড়ে মরবেই, ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে চোখ লাগিয়ে বসে থাকলেই জাতির গৌরব বাড়ছে আজকাল। স্থানীয় বন্ধুদের পোস্ট পড়ে যা বুঝলাম, মানুষ হিসেবে আমাদের কালেক্টিভ কানসিয়াসনেসটাই উধাও হয়ে গেছে। পাশের গ্রামে আগুন লাগলে এখন ছেলেছোকরারা সাহায্য করা দূর, উল্টে মস্করা করে 'ব্যাটারা পাপের শাস্তি পেয়েছে' মার্কা কমেন্ট করে। তারপর পাশের গ্রামেও আগুন লাগে, তখন কিছু করার থাকে না। দু গাঁয়ের লোক মিলে সরকারকে দোষারোপ করে (যদিও ভোটে সেই একই সরকারকে জিতিয়ে দেয়), তাতে সরকারের বয়েই গেছে। বন বিভাগ বা পরিবেশ মন্ত্রকের প্রিভেন্টিভ মেজার্স বলতে নীল বাটে সান্নাটা, চেপে ধরলেই বন বিভাগ বলে, ওসব উপদ্রবীদের কাণ্ড। এনজিটি সতর্ক করেছিল আগেই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, তবুও বনবিভাগের কর্মীদের ঠিক ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে কাজ ছেড়ে ইলেকশন ডিউটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এখন আর কেউ দায় নিতে রাজি নয়। এদিকে ইলেকশনের সিজনে এই নিয়েও মিডিয়ায় চিরাচরিত প্রোপাগাণ্ডা শুরু হয়ে গেছে। চোখে পড়ল, অপইন্ডিয়ার মতো রাইট উইং প্রোপাগাণ্ডা ওয়েবসাইটরা ইতিমধ্যেই উপদ্রবীদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম অ্যাঙ্গল খুঁজে বিকৃতভাষ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের কুমায়ুঁ গাড়োয়াল নিবাসী বন্ধুদের কাছে জানলাম, ভীমতাল থেকে Mi-17 V-5 হেলিকপ্টার বাম্বি বাকেট থেকে হাজার হাজার লিটার জল তুলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। বন বিভাগ হাত তুলে নিয়েছে বলে আর্মিকে ডাকা হয়েছে। এদিকে গরমের ত্রাহিমাম থেকে রক্ষা পেতে উত্তর ভারতের অর্ধেক মানুষ আপাতত পাহাড়ে ছুটি কাটাচ্ছে, তাদের অধিকাংশেরই এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। ছেলেমেয়েরা মহা উৎসাহে হেলিকপ্টারের ছবি তুলছে, কালো ধোঁয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে ম্যাগি হাতে সেল্ফি তুলছে, স্পিকারে গান বাজাচ্ছে। 

জঙ্গলে এরকম অনিয়ন্ত্রিত আগুন লাগলে কী হয়? পরজীবী প্রাণী আর ছোট ছোট অসংখ্য কীটপতঙ্গ মারা যায়, প্রজাপতিরা মারা পড়ে। যে সমস্ত পাখির ছানা সদ্য জন্মেছে, তারা পুড়ে মারা যায়। বন্যপ্রাণীদের ঘরবাড়ি হেস্তনেস্ত হয়ে যায়, গুলদার চিতাবাঘ ইত্যাদি জীবরা তখন তল্লাটের গ্রামে এসে হামলা চালায়, তারপর মারা পড়ে মানুষের হাতে। কচি ঘাস পুড়ে যায়, প্রতি বছর আগুন লাগলে মাটির উর্বরা শক্তি কমে আসে, স্বচ্ছ জলের ন্যাচারাল স্রোতগুলো নষ্ট হয়ে যায়, বন পাহাড়ের গোটা ইকোসিস্টেমটাই ধ্বসে যায়, সে সব গড়ে উঠতে বহু বছর লাগে। আর এখন তো সে সময়ই নেই। গায়ের ঘা শুকোতে না শুকোতেই আবার আগুন লাগছে। প্রাকৃতিকগত ভাবে ততোটা নয়, যতটা অ্যান্থ্রপসিন অ্যাক্টিভিটির জন্য, মানুষ ছাড়া কেউ দায়ী নয়। ফলও ভুগতে হবে মানুষকেই। ফসল বর্বাদ হবে, বৃষ্টি হবে না, হলে অতিবৃষ্টি হবে, ক্লাউড বার্স্ট হবে, পাহাড়ি গ্রাম ধ্বসে যাবে। 

এসব কমন সেন্সের কথা। ছোটবেলায় সবাই পড়েছে। গাছ লাগানোর শিক্ষা কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে সবাই জানে। ইকোসেনসিটিভ জোনে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে ডিনামাইট ফাটালে কী হতে পারে সবাই জানে? (জোশিমঠের ঘটনা নিয়ে আরো কারো কিছুই বলার নেই) তবু কারো কোনও প্রতিক্রিয়া নেই, কোনও হেলদোল নেই।

আমাজনের জঙ্গলে ৩২ ফুট উঁচু আগুনের শিখা লকলক করছে, মানুষ মরছে চিলিতে। ইউরোপে পর্যন্ত দেখছি শীতকাল সংকুচিত হচ্ছে, গ্লেশিয়ার উধাও হয়ে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ায় ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিকূল প্রভাব চোখে পড়ছে, তবু সবাই নিরুত্তাপ। 

উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই পাঁচজন মারা গিয়েছে আগুনে পুড়ে। মানুষ স্বার্থপর জীব ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে এতটাও ইনসেন্সিটিভ হল কী করে? আগুনের ছবি আর ম্যাগির প্লেট নিয়ে কেউ ছবি তুলতে পারে? এরকম অবস্থাতেও ভোটের কথা ভেবে হিন্দু মুসলমান করতে পারে? পারে যে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

উত্তরাখণ্ড আর হিমাচলের মতো জায়গায় দাবানল নিয়ন্ত্রণ এর জন্য চিরকাল বনবিভাগ আর গ্রামের লোকজন হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। বিএমসি করার সময় অবসরপ্রাপ্ত ইকো ডেভেলপমেন্ট অফিসাররা বলেছিলেন, শীতের পর দেবদারু ইত্যাদি গাছের শুকনো পাতা সরিয়ে কচি ঘাস আর নতুন পাতা গজানোর ব্যবস্থা করা হয়, বনবিভাগের বিভিন্ন রেঞ্জে 'পতরৌল' আর 'আগল্যায়েন' পোস্টের লোকজনদের নিয়োগই করা হত পিরোল মানে শুকনো পাতা সরানোর জন্য। গত দেড় দু দশকে সে সব কমতে কমতে প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। অ্যাওয়েয়ারনেস ক্যাম্পেনের জন্য আর বাজেট দেওয়া হয় না, স্কুল কারিকুলামে প্রকৃতির কোনও গুরুত্ব নেই। পাহাড় বন জঙ্গল শুধু ইন্সটাগ্রামের ছবি হয়েই রয়ে গেছে। আদিবাসী রাইটস আর এনভায়রনমেন্ট এর কথা বলতে গেলেই অ্যান্টিন্যাশনাল তকমা মেলে, আর পশুপাখিদের নিয়ে কিছু বলা তো ঘোরতর অপরাধ। থার ডেজার্টে এনার্জি ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক এর কাজ গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের প্রায় শেষ করে দিচ্ছে, চিল আর শকুনের পাশাপাশি আরবান পাখির অধিকাংশ প্রজাতি বর্ডারলাইনে চলে গেছে। স্টেট অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস আর ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সার্ভে আর বিশ্লেষণ করে বিবেক মেনন জানিয়েছেন, ৩৩৮টি প্রজাতির ৬০% পাখির সংখ্যা কয়েক দশক ধরে কমছে। অনেক পাখি আইইউসিএন-এর রেড লিস্টে চলে গেছে। মানুষের এম্প্যাথি দিন দিন কমছে, পাখি নিয়ে আজকাল আর বাচ্চারাও মাথা ঘামায় না। 

'অল দ্যাট ব্রিথস' আর 'এলিফ্যান্টস হুইস্পারারস' এর মতো সিনেমা এখনও হয়৷ সে সব বিদেশে পুরস্কৃত হচ্ছে, কিন্তু সে সব নিয়ে মেনস্ট্রিমে কথা হয় না। ট্যাক্স ফ্রি হয় কেরালা স্টোরি আর আর্টিকল ৩৭০ এর মতো ছবি। 'পোচার' এর মতো হালকা সিরিজও কোনও সোশ্যাল ডিস্কোর্স তৈরি করতে পারে না, লোকজন  হিউমান অ্যানিমাল নিয়েই নাচছে। প্রজেক্ট চিতা নিয়ে এত লাফালাফি করা হল, কিন্তু চিতাগুলো যে মারা গেল, সে নিয়ে সরকার একটা কথাও খরচ করবে না। চেন্নাই থেকে দিল্লি প্লেনে করে গেলে মাঝেমধ্যে প্লেনটা অনেক নিচে দিয়ে যায়, তখন বোঝা যায়, একটা এত বড় দেশ, তার প্রায় গোটাটাই পাথুরে জমি হয়ে আছে, ব্যারেন ল্যান্ডস! সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। 

আসামের কনজারভেসনিস্ট পূর্ণিমা দেবী বর্মন 'হাড়গিলে'দের নিয়ে কাজ করে সম্মানিত হচ্ছেন, আলোক শুক্ল আজীবন কাজ করে আন্তর্জাতিক স্তরে নাম করছেন, কিন্তু দেশে পরিবেশকর্মীদের পদে পদে লাঞ্চিত হতে হচ্ছে। ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট আর বায়োলজিকাল ডাইভার্সিটি অ্যাক্ট দুটোকেই অ্যামেন্ড করে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, রিলায়ান্স এর বনতারা প্রজেক্ট হোক বা ছত্তিশগড়ের পারসা কোল মাইন, সব কিছুই আরামসে পাস হয়ে যায়, পরিবেশ মন্ত্রক প্রোজেক্ট অ্যাপ্রুভ করার জন্যই বসে আছে। নদীগুলোর অবস্থা কহতব্য নয়, ক্লাইমেট সার্কল পাল্টে গেছে, এপ্রিল মাসে গোটা দেশের তাপমাত্রা ৪০-৪৫, কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কারো কোনও বক্তব্য নেই। একটা পার্টির ম্যানিফেস্টোতেও এনভায়রনমেন্ট নিয়ে তেমন কিছু লেখা নেই, ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে অবশ্য আছে। আরো হাইওয়ে বানানো হবে, আরো এইট লেন করিডোর হবে, আরো বনজঙ্গল কাটা হবে। উত্তরাখণ্ড এর মতো জায়গায় যে দাবানলের সমস্যা আরো বাড়বে, সেটা বুঝতেও কষ্ট হয় না। 

তাপমাত্রা বাড়ছে, সবুজ উধাও হচ্ছে, উপকূলবর্তী গাঁগুলো ক্রমে ভেসে যাচ্ছে, (আরতি কুমার রাও এর লেখা মার্জিনল্যান্ডস' পড়লে সুন্দরবন এর বর্তমান অবস্থা বোঝা যায়) হড়কা বান আর গ্লফ ডিজাস্টার এর এখন কেউ মাথা ঘামায় না, উত্তরাখণ্ড আপাতত ব্রাজিলের আমাজনের আগুনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা তাদের পিছনে ফেলে দেব।  দেখেশুনে বড়ই অসহায় লাগে, কিছু করারও নেই। পরিবেশ ফরিবেশ নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না, এসব নিয়ে পোস্ট দিলে বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললেও খিল্লিই শুনতে হয়। নির্বিকার হয়ে থাকতেই চেষ্টা করি, তবু মাঝে মাঝে রাগ হয়। এসব আর থামার নয়। ভাগ্যিস হাফ জীবন কেটে গেছে। 

প্রকৃতি আর মানুষ, দুটোই পাল্টে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে। এর কোনও প্রতিকার নেই। আর কয়েক দশক, তারপর ডিউন দেখতে আর হলে যেতে হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন