এলিয়াস কানেটি 'ভয়েসেস অফ মারাকেশ' বইয়ে কথাটি বলে গিয়েছেন। সেই মারাকেশেই এসে যখন ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়েছি, তখন কথাটা মাথায় রেখে নগর ভ্রমণই ভালো। কারণ, মারাকেশের সুনামের পাশাপাশি দুর্নামও কম নেই। বাইরের লোককে ঠকিয়ে বেশি পয়সা নেওয়া কিছুই নয়, জেমা আল ফানার স্কোয়ারে সাপুড়েরা নাকি সোজা গলায় সাপ ঝুলিয়ে দেয় বলে ভয় দেখিয়েছিল অনেকে, গুনে গুনে কয়েক হাজার টাকা বের না করলে সেই সাপ মুখের সামনে লকলক করেই যাবে। আবার এই সেই হিকায়ত স্টোরিটেলিং ট্রাডিশনের তীর্থস্থান, যেখানে হাজার বছর ধরে গল্পবলিয়েরা দাস্তানগোই করে লোকজনকে সম্মোহিত করে দিচ্ছে।
ভাগ্যিস, তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। প্রথম থেকেই সতর্ক চোখে ঘুরছি, কেউ ডাকাডাকি করলেই আগাম 'সো কাইন্ড অফ ইউ, থ্যাঙ্কিউ বাট নো থ্যাঙ্কিউ! শুক্রান!' বলে আড়াই গজ দূরে সরে যাচ্ছি। কিন্তু সবসময় যে সেই মেজাজ বজায় থাকবে সে উপায় নেই, কারণ মারাকেশের মতো প্রাণচঞ্চল এবং অথেন্টিসিটি বজায় রাখা টুরিস্টি প্রাচীন শহর আমি অন্তত বেশি দেখিনি।
সবাই যখন জেমা আল ফনার স্কোয়ার নিয়ে বাতেলা দিচ্ছিল, হেইনা সেইনা... ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ফর লোকাল আর্ট, মেল্টিং পট অফ সাবসাহারান কালচার অ্যান্ড আরব আর্ট, বিগেস্ট স্ট্রিট ফুড মার্কেট ইন দ্য আরব ওয়ার্ল্ড, আমি সত্যি বলতে একটু নাক উঁচু ভাবেই ব্যাপারটা নিয়েছিলাম। প্লাজা দেখে দেখে দাড়ি সাদা হতে চলল, বিগ বিগার বিগেস্ট কত প্লাজাই যে দেখলাম তিন কন্টিনেন্ট জুড়ে! এরপরেও যে কোনো স্কোয়ারে গিয়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে, তেমনটা হওয়ার কথা নয়!
কিন্তু মারাকেশের মাদিনা মানে ওল্ড টাউনের জেমা আল ফানা অহংকারে এক গ্লাস জল ঢেলে দিল। শুধু তাই নয়, জল ঢেলে গ্লাসটা আমাকে ছুঁড়ে মারল, সেই চোট খেয়ে মাথাটা ঘুরতে শুরু করল।
কী এমনটা হল? সে বলার সাধ্যি কি আমার আছে রে ভাই? বলতে পারি, দিন সাতেক ধরে চক্কর মারলেও জেমা এল ফনাই ঘোরা হবে না, বাকি শহর তো ভুলেই যান, যদি অবশ্য চোখকান খুলে ঘোরা আপনার স্বভাবে থাকে। ধরে নিন, শহরের মধ্যের এই জায়গাটা আসলে নিজেই একটা শহর, তার চার প্রান্তে ষোলটা স্টেশন আছে৷ সেই স্টেশনগুলো আসলে মাদিনার মধ্যের শুক বা শৌক (Souk)-এর মধ্যে যাওয়ার জাঙ্কশন। সেখান থেকে অগুন্তি ট্রেন (গলি) ছাড়ছে, ট্রেনে বসলে এমন সব জায়গায় পৌঁছে যাবেন, যার সঙ্গে এই জাঙ্কশনের বা তার বাইরের জনপদের কোনও সাদৃশ্যই নেই, আবার আছেও।
আছে, কারণ ট্রেনলাইন জুড়ে সবটাই আমাগো দেশ, মানে রেড সিটির অংশ, লাল পাথরের স্থাপত্য, আটশো বছরের পুরোনো বাড়ির মেজাজ, মোজায়েক টাইলস লতাপাতা আর ঘোড়ার নাল দিয়ে সাজানো দ্বার, অথবা সাহারা মরুভূমি থেকে উটের কারাভান নিয়ে আসা লবণ বণিকদের সরাইখানা, আশ্চর্যজনকভাবে এখনও টিকে আছে দু একখান, কারণ টুরিস্টি শহরের সাজসজ্জার পরেও একটা স্বতঃস্ফূর্ত, বের্বেরভাষী মরক্কোন জীবনের একটা 'র' আমেজ রয়ে গেছে। সব জায়গায়। সে জেমা আল ফানা হোক বা একেবারে জনশূন্যহীন কোনও পাড়া। দ্য স্প্রিট ইজ দ্য সেম।
নেই, কারণ জেমা আল ফানার কাফে ফ্রান্স বা আলো ঝলমল রেস্তোরাঁ সারির সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই, এক কিলোমিটার দূরেই একশোজন কামার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খুপরি ঘরে কাজ করে চলেছে, সেলাইয়ের মেশিন নিয়ে দশকের পর দশক ধরে একই জায়গায় বসে সুচে সুতো পরাচ্ছেন বুড়ো দর্জিরা, বা গাধার গাড়ি করে রিসর্টে থাকা বড়লোকদের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়ার কাজ এখনও করে চলেছে গরীব মজুররা। শৌকের ভিতর দিয়ে মেদিনার এমন সব প্রত্যন্ত, ভাঙাচোরা দেওয়াল, ক্ষয়ে যাওয়া পেলাস্তারা সংলগ্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাওয়া যায়, যেখানে একজন টুরিস্টও থাকবে না, অথচ তার দু খানা গলি ছাড়িয়েই লক্ষাধিক মানুষের জোয়ার নেমেছে।
একটা সন্ধ্যে আর একটা দিন কাটিয়ে এইটুকু জায়গায় এতরকম জিনিস দেখলে কার আর মাথার ঠিক থাকে? এমনিতেও এমন একটা জনবহুল শহরে এইটুকু সময়ে কোনটুকু আর আবিষ্কার করা যায়? এরমধ্যে আবার ওয়েদার ফরকাস্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাতে বৃষ্টি হয়ে কাদামাদা হয়ে একাক্কার কাণ্ড, যদিও রোদ্দুর উঠতেও দেরি হয়নি। হাজার হাজার মানুষের ভিড় সামলে, বাঁদর সাপ হেনা আর্টিস্টদের খপ্পরে না পড়ে, মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর জ্যাকেট পরো জ্যাকেট খোলোর নাটক সামলে এগোতেই জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে! কী ভিড় রে ভাই! রাতে মনে হয় এই চত্বরে কয়েক লক্ষ লোক এসে জড় হয়! টাঞ্জিয়া খেতে গিয়ে এক্সট্রা টাকা দিতেই হল, বারদশেক রাস্তা ভুলে মারা হল। তারপরেও বলতে হচ্ছে, মারাকেশ অসম্ভব সুন্দর শহর! নাহ, ইউরোপের মতো সুন্দর না, ইস্তাম্বুল বা লা পাজের মতোও নয়, বলা যায় অনেকটা বেনারসের মতো! বাড়াবাড়ি? হয়তো! কথাটা মাথায় এসেছ্ব বলে লেখা! বিইটি লাইজ ইন দ্য কন্ট্রাডিকশনস!
সন্দেহ নেই, বেশিরভাগটাই মোহাবেশের মতো শহরটার সৌন্দর্য দেখেই গেল, হ্যান্ডিক্রাফটের এত অসামান্য কাজ আর হাতে আঁকা ছবি (একটা আর্ট গ্যালারিও দেখলাম, সেখানে অনেক নামকরা শিল্পীর কাজ ছিল, দেখে থ হয়ে গেলাম) দেখেই মাথা ভোম্বল হয়ে যায়, কিন্তু এরই মধ্যে দেখি রেকর্ড প্লেয়ারের দোকানে ভারতীয় সিনেমার রেকর্ড সাজিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ, লিউট বাজিয়ে ভিক্ষা চাওয়া ডিসফিগার্ড লোক, আফ্রিকার মুখোশ আর বেতের ঝুড়ির পসরা সাজানো দোকানদার, উদ্ভট পোষাক পরা আর ছাগলের চামড়ায় জল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। কোনও জমানায় বেচারিদের ওতে করেই জল সঞ্চয় করতে হত মরুভূমির পেরোনোর সময়, শেষ হয়ে গেলে অক্কা, এখন ওই জিনিস দেখিয়ে, ছবি তুলিয়ে টাকা রোজগার করতে হয়।
যা বুঝলাম, বলিউড নিয়ে লোকজন এখানে সত্যি পাগল। পাড়ায় বেরোলেই 'ইন্ডিয়া, শারুখ' বলে চেঁচায়! (আমার কিছু বেরসিক বন্ধু আছে যাঁদের শাহরুখকে সেক্সি মনে হয় না, বেচারিদের যে কী বলি! হ্যাঁ, সিনেমা বোগাস করেন ঠিক হ্যায়, কিন্তু 'ক্যারিশমা'... শাহরুখ খান সে নেহি!)
এক মার্কিনি মোরোক্কান ভদ্রলোক এখানেই থেকে গিয়েছেন সারাজীবন ধরে, তিনি ভারত আর মরক্কোর তারিফে পঞ্চমুখ। বার বার বলতে লাগলেন, এই দুটো দেশে কত মিল! সব ইঞ্জিনিয়ার আসে এখান থেকেই, মানুষজন কত উদার, কত কালচার্ড, ইন্ডিয়া মরক্কো ভাই ভাই। এসে থেকে শুনছি, অসম্ভব লিবারাল দেশ আমাদের। মেয়েদের গভার্নমেটে কাজ করতে দিই, যদিও ব্যবসাপত্তর না করাই ভালো। মাথা ঢেকে রাখাই ভালো। কিন্তু তাই বলে আমাদের গেঁয়ো ভেবো না। আমাদের হামাম আছে ( কমন নেই) কিন্তু বালকনি নেই। বাড়িতে বালকনি দেখলে আমাদের হেঁচকি ওঠে! এ কী কাণ্ড! প্রাইভেসি বলে একটা জিনিস থাকবে না। এই দেশে লিকার লিগাল কিন্তু, তবে সামনে না খাওয়াই ভাল। খাও ইচ্ছে হলে ঘরে ঢুকে। আমাদের কি কনজার্ভেটিভ ঠাউরেছ? রাজাকে পুজো করি, সে অন্য কতা! কী আর করি, সকাল থেকেই মাথা নাড়ছি। ভারত আর মরক্কো যে ভাই ভাই হতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই!
প্রেস ফ্রিডম, হাংগার ইন্ডেক্স আর হেলথের প্যারামিটারে দুই দেশের অবস্থাই (দুরবস্থা বলা কি ঠিক? মনে হয় না। ১৮০ টা দেশে ১৪৩ আর ১৬২ কি খারাপ র্যাঙ্ক?😌) যদিও মরক্কো বেচারি 'ডেমোক্রেসি' হতে পারল না। কন্সটিউশনাল মোনার্কির এই জগতে আজও রাজা আছেন, যদিও দেশের বাইরে থাকেন বছরে দুশ দিন। মিডিয়া অবশ্যি তাঁকে খুব সম্মান করে। কেউ বিরোধ করলেই বলা হয়, রাজামশাই ভালো, রাজনীতির লোকজন সব ঝামেলা করছে। সুপার্ব ন্যারেটিভ! উনি তো বরং বাঁচাচ্ছেন ফ্রি ভয়েসকে। তা ফ্রি ভয়েস বাঁচানোর ছিরি হল, রাজামশাই গদিতে বসে নস্যি নিচ্ছেন আর সাংবাদিকরা বিরোধ করলেই জেলে ঢুকছে। বাকি রাজার গোদি মিডিয়া থুড়ি মরক্কোর গদি মিডিয়ার কথা না বললেই হল।
কিন্তু একটাই মুশকিল, এদের রান্নাবান্না ব্যাপারটা ইন্য লেভেলের! যেদিকে দেখো মণ্ডামেঠাই চাঁপ বিরয়ানি কষা মাংস কেক মালাই ইত্যাদি। খাবার কথা আর কী বলব? সকাল সকাল মিন্ট টি আর চিজ আর ডিমের মাখো মাখো অমলেট খেয়েছি অলিভ দিয়ে, তারপর থেকেই চলছে। খেজুর আভাকাডো শেক খেয়েছিলাম কাল, তোহফা জিনিস, তারপর খাস আফ্রিকান ঝাল টমেটো মিষ্টি লংকার চাটনি সহযোগে স্কিউয়ার গ্রিল আর কুশকাউস, এদিকে আজ ল্যাম্ব তাঞ্জিয়া খেতে গিয়ে শুনলাম, একে নাকি ব্যাচেলার্স ডিশ বলে। মানে, ব্যাচেলার হলেই না আজ মাংস ম্যারিনেট করে হালকা আঁচে মাটির কলসিতে দিয়ে ভুলে যাবে আর কাল বিকেলে নামাবে, নেহারির বাবা! খেতে মচৎকার নো ডাউট, শুধু মিনিট দশেক সাবান দিয়ে হাত না ধুলে পরে মনে হতে পারে গুরুদ্বারার গাওয়া ঘিয়ে তৈরি কড়াপ্রসাদ খেয়েছি। যাকগে, আরো হাজারখানেক খাবার বাকি! হারিরা আর অরেঞ্জ কেক থেকে শুরু করে ভেড়ার মাথা আর তেজিনে থেকে কুশকাউস.. এসব বড্ড ভালো জিনিস, এসবকে কেউ কিচ্ছু বললে ভালো হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন