শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

“ম্যায় রাত কা আখিরী জাজিরা”


“ম্যায় রহা তে নেহি তুরদা

ম্যায় তুরদা হাঁ তান রাহ বন্দে”

প্রবাদপ্রতিম পাঞ্জাবি কবি ডক্টর সুরজিৎ পাতর মারা গেলেন। আধুনিক ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের মধ্যে একজন তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি কথা হল, সম্ভবত এ যুগের সবচেয়ে আদরের জনকবি, ‘দ্য পিপলস পোয়েট অফ পাঞ্জাব’ বলে খ্যাত এই মানুষটি গত এগারো মে সকালে দেহ রাখলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন পাঞ্জাবের মাটির গন্ধ আর সেই গন্ধে বেড়ে ওঠা লোককথা আর লোকগানের সেই সমস্ত অজস্র কাহিনি, যা তাঁকে লিখিয়ে নিয়েছে গত ষাট বছর ধরে। মাত্র একদিন আগেই ডক্টর পাতর বারনালা জেলার একটা সাহিত্য সভায় কবিতা পাঠ করছিলেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর আবৃতি শুনছিল। এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার কথাগুলো হয়তো তাঁদের কিছুটা আশার আলো দেখাতে পেরেছিল। ‘জগা দে মোমবাতিয়াঁ’ শিরোনামের এই কবিতার আক্ষরিক অর্থ ‘মোমবাতি জ্বেলে দাও’, কবিতার কয়েক লাইন হল...

“হানেরা না সমঝে কি চাণন ডর গয়া হ্যায়

চাঁদ না সোচে কি সুরজ মর গয়া হ্যায়

বাল জোতে জিন্দেগি দে মান মাট্টিয়াঁ

উঠ জগা দে মোমবাতিয়াঁ

তু জগা দে মোমবাতিয়াঁ”

অর্থও কঠিন কিছু নয়, যদিও পাতরজি এখানেও কিছুটা স্বভাবসিদ্ধ ভাবে রূপক এনে ফেলেছেন। অন্ধকার আর আলোর যুদ্ধে আমাদেরকেই মোমবাতি জ্বালাতে হবে, জ্বালাতে হবে জীবনের গৌরবের জন্যই। আদ্যন্ত রাজনৈতিক কবিতা, অন্ধকার বলতে দেশের অবস্থার কথাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পঞ্জাবের জনপ্রিয় জনকবি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেও সেই কাজই করে গিয়েছেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে গিয়েছেন, কবিতার মধ্যে দিয়ে আলোর সন্ধান দিয়েছেন হতাশ, বিরক্ত, পরাজিত জনতাকে, তাদের সাহস দিয়েছেন।       

সুরজিৎ পাতর সেই ব্যতিক্রমী কবিদের একজন, যিনি শিক্ষাজগতে প্রণম্য, বিনোদন জগতে প্রভাবশালী, লাটিয়েন্স দিল্লির ব্যক্তিত্বরা তাঁকে রাজ্যসভা সদস্য করে রাখার জন্য সাধাসাধি করে গিয়েছে, কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের কবি হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আজীবন মানুষের সংগ্রাম, তাঁদের জীবন ও যাতনার কথা লিখেছেন, লিখেছেন অমর হয়ে যাওয়া কিছু গজল, এমনকি ‘উধম সিং’ এর মতো সিনেমায় সংলাপ ও গানও লিখেছেন, কিন্তু জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেও প্রয়োজনে পথে নেমে মাটির ঋণ শোধ করতে দু’বার ভাবেননি। নক্সাল আন্দোলন হোক বা চুরাশি পরবর্তী উত্তাল সময়, পাঞ্জাবি ডায়াস্পোরার নানাবিধ সমস্যা হোক বা হালের কৃষক আন্দোলন, সুরজিৎ পাতরের কবিতা সবসময় মানুষের পক্ষে অনড় থেকেছে। সরকারের চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে অসহিষ্ণুতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র ধাবোলকর, গোবিন্দ পান্সারে আর এম এম কালবুর্গির হত্যাকাণ্ডের পর অন্যান্য সাহিত্যিকদের নিয়ে বিরোধ মিছিল করেছেন, সেই ২০১৫ সালেই ফিরিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। গত বছর কৃষক আইন বা ‘ফার্ম ল’-এর বিরুদ্ধে যখন পাঞ্জাবের কৃষকরা আন্দোলন শুরু করেন, তাঁদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন বারবার, কবিতা লিখেছেন মিছিলের জন্য, সরকারের যুক্তিহীন ও অসংবেদী পদক্ষেপের বিরোধ করতে পদ্মশ্রী সম্মানও ফিরিয়ে দিতে দু'বার ভাবেননি। কৃষকরা দিল্লির বর্ডারে গিয়ে তাঁর কবিতা পড়ছে, এমন দৃশ্য বার বার দেখা গেছে। 


“অসি হুন মুড় নেহি সকতে

অসি হুন মুড় গয়ে ফির তা সমঝো মুড় গয়া ইতিহাস

জিত গয়ি নফরত দি সিয়াসত

অসি হুন মুড় নেহি সকতে…”

(আমরা পিছু ফিরতে পারি না। পিছিয়ে গেলে তো ইতিহাসও মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে, ঘৃণার রাজনীতিই তাহলে জিতে যাবে, আমরা পিছু ফিরতে পারি না) 


এই সব কথা নতুন কিছুই নয়। যাঁরা পাতর সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও কলমের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানতেন, এই সদাহাস্যময়, মিশুকে, গুণী মানুষটার মনের ভিতর একটা বিপ্লবী ছেলে বাস করে, মানুষের পক্ষ টেনে কথা বলতে হলে তাঁকে ভাবতে হয় না। কিন্তু তাঁর এই মানসিকতাকে যদি হিসেবে নাও ধরা হয়, শুধু একজন কবি হিসেবেও তাঁর গুরুত্ব কিছু কম ছিল না। মুক্তছন্দ আর গদ্যে নানক বাণীর ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ রিসার্চ করেছেন সুরজিৎ পতার, পাঞ্জাবি সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার সাহিত্য নিয়েও তাঁর অসীম জ্ঞান ছিল, লোরকা, নেরুদা, গিরিশ কার্নাডদের বইপত্র পাঞ্জাবিতে অনুবাদও করেছেন, এখনও করছিলেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি একদম সহজ ভাষায়, সহজ চালে, দেশ ও দশের জীবন নিয়ে কঠিন কথা, জটিল কথা বলে ফেলতে পারতেন। 

যে সাবলীলতায় সুরজিৎ পাতর প্রেম আর রুহানিয়াতের কবিতা লিখেছেন, সেই সাবলীলতায় বৈরাগ্য আর বিদ্রোহের কবিতাও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় পাঞ্জাবের মানুষের সংগ্রাম, আশা, নস্টালজিয়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আবেগ প্রতিফলিত হত, মিলিটেন্সি আর রাজনৈতিক অস্থিরতার সমস্যাকে সূক্ষ্ম ভাবে ছুঁয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু তাঁর হাতিয়ার ছিল মানুষ। লোকোক্তি আর চলতি ভাষার ব্যবহার করতে তিনি দক্ষ ছিলেন, কবিতার প্রয়োজনে লেখার শৈলী পাল্টে ফেলতেন অনায়াসে। কোথাও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও ছন্দপতন মিলবে না, আবার কোথাও ইচ্ছে করেই মুক্তছন্দ রেখে গজগামিনী চালে এগিয়ে গিয়েছেন। অলংকার, রূপক আর দৃশ্যকল্প ব্যবহারের তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর কবিতায় কিন্তু প্রকৃতি আর পশুপাখিও মানুষের রূপ নিয়েই ধরা দেয়, তাদের সঙ্গে পাঠকের একটা নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়ে অজান্তেই। মূলত পাঞ্জাবিতেই লিখতেন পাতর সাহেব, কিন্তু তাঁর পাঠক ছড়িয়ে ছিল সারা দুনিয়ায়। 

তাঁর মৃত্যুতে গোটা ভারতবর্ষ স্তব্ধ। চতুর্থ ধাপের নির্বাচন ভুলে শত শত মানুষ তাদের প্রিয় কবি সাহিবের স্মৃতিচারণ করে চোখের জল ফেলছেন, পাঞ্জাবি হিন্দি উর্দু তামিল তেলুগু কন্নড়া কাশ্মিরী মনিপুরী ভাষার সাহিত্যিকরা দীর্ঘ পোস্ট করছেন, অস্ট্রেলিয়া ইউরোপ ইউ এস থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটা ন্যাশনাল কাগজ তাকে নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছে। দ্য ওয়্যার, দ্য হিন্দু, টিওআই ইত্যাদি তো আছেই, হিন্দির পত্রপত্রিকাতেও আন্তরিক সব স্মৃতিচারণ দেখতে পেলাম। এখনকার পাঞ্জাবি গায়করা বিশেষ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। 


যাঁরা মনে করেন, এ যুগে আঞ্চলিক ভাষার কবিদের তেমন পাঠক নেই, প্রভাবও নেই, তাদের সুরজিৎ পতার ওরফে কবি সাহিবের শেষকৃত্য দেখা উচিত ছিল। অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটল এই কবির বিদায়পর্বে। একটা ভিডিওতে দেখলাম, শয়ে শয়ে লোক সমবেত হয়েছে, অনেকের হাতেই তাঁর লেখা পাঞ্জাবি কবিতার বই, মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান নিজে একের পর এক কবিতা পাঠ করছিলেন, তাঁর চোখেও জল। নিজে মৃতদেহকে কাঁধ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এগিয়ে গেছেন, অনুসরণ করেছেন শহরের মানুষ। তাঁর নামে পাঞ্জাবি কবিতায় পাতর সম্মান ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। গোটা জলন্ধর শোকাকুল, কেউ কেউ তাঁর লেখা গজলের সিডি লাউডস্পিকারে বাজাচ্ছে। বোঝা যায়, সুরজিৎ পাতর পাঞ্জাবের জনমানসকে ঠিক কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কতটা জড়িয়ে ছিলেন তাদের জীবনের গভীরে। তাদের শৈশব ও কৈশোরে, তাঁদের প্রেম ও বিপ্লবে।

২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে, সমসাময়িক কালে আর কোন ভারতীয় কবিকে এইভাবে বিদায় জানানো হয়েছে আমার মনে নেই। হিন্দি কবি কৃষ্ণ কল্পিত বলেছেন, সত্যিকারের কবিকে এভাবেই বিদায় জানানো দরকার। মংলেশ দাবরালের মতো এপিক কবি চুপিসাড়ে চলে গেছিলেন, অনেকে জানতেও পারেনি। কিন্তু সুরজিৎ পাতারের পাঠকরা তাঁকে যে সম্মান দিয়ে ‘বিদা’ করল, সে কথা ভাবলে চোখে জল চলে আসে। হয়তো এই ভালোবাসা তাঁর প্রাপ্যই ছিল। কবি সাহিব অবশ্য তাঁর বিদায়ের অনেক আগেই এই লাইনগুলো লিখে গেছিলেন...

এক লফজ বিদা লিখনা

এক সুলগতা সফা লিখনা

দুখদায়ী হ্যায় নাম তেরা

খুদ সে জুদা লিখনা


সীনে মে সুলগতা হ্যায়

ইয়ে গীত জরা লিখনা

ওয়রক জল জায়েঙ্গে

কিসসা না মিরা লিখনা


সাগর কি লেহেরোঁ পে

মেরে থল কা পতা লিখনা

এক জর্দ সফে পর

কোই হর্ফ হরা লিখনা

মরমর কে বুতোঁ কো

আখির তো হওয়া লিখনা

বাংলায় অনুবাদ না হলেও আশা করি কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হবে না। এই ‘ইমোশন’ অনুবাদে ধরা সম্ভবও নয়, আর আমি যে লাইনগুলো ব্যবহার করছি, তার অধিকাংশ তো আগেই একদফা পাঞ্জাবি থেকে হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে। 

দেখে খুবই অবাক লাগল, বাংলা সাহিত্য জগতে কেউউ সুরজিৎ পাতরকে নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করল না। ব্যতিক্রম থাকতেই পারেন, কিন্তু সংবাদমাধ্যমেও কিছু চোখে পড়ল না। আমি কবিতার বিদগ্ধ পাঠক কোনোকালেই নই, কিন্তু সুরজিৎ পাতরের মতো নামকরা কবির কথা আলাদা করে জানতে লাগে না। নন-পাঞ্জাবি পাঠককূলও যেভাবে তাঁকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, ভালোবেসেছে, পাঞ্জাবি কবিদের মধ্যে একমাত্র পাশ আর শিব প্রসাদ বাটালবীই তেমনটা অর্জন করতে পেরেছেন। যাঁরা জানেন না, চমকীলা সিনেমার ‘বিদা করো’, উড়তা পঞ্জাবের ‘এক কুড়ি জিদা নাম মোহাব্বত’, লভ আজকল এর ‘আজ দিন চাড়েয়া’ সহ অনেক বলিউডি অ্যাডাপ্টেশনও শিব প্রসাদ বাটালবীর গান নিয়েই হয়েছে, তাঁকে বলা হত ‘কিটস অফ পাঞ্জাব'। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মারা যান তিনি। এদিকে ‘পাশ’ ছিলেন পঞ্জাবের বিদ্রোহী জনকবি, অমর সিং চমকীলার মতো অশ্লীল গান নয়, তিনি কবিতা লিখতেন সরকারকে চোখ রাঙিয়ে, রাজ্যের অরাজক ব্যবস্থা আর ধার্মিক রাজনৈতিক নেতাদেরও কেয়ার করতেন না, তাঁর কলম ছিল তীক্ষ্ণ, তাঁর কবিতায় একটা আগুন ছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। দুষ্কৃতীদের হাতে ‘চমকীলা’র মতোই খুন হয়েছিলেন পাশ, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।

এই তিনজন অসম্ভব জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে একমাত্র সুরজিৎ পাতরই দীর্ঘজীবী হয়েছেন, কারণ তাঁর সংবেদী কলম ও আন্তরিক ব্যবহার পাষাণহৃদয় টেররিস্ট থেকে শুরু করে ক্ষমতালোভী নেতাদেরও কাঁদিয়ে দিত বলে জানা যায়। তাঁর মিরাকুলাস জীবন, জনকবি শিক্ষক বুদ্ধিজীবী তকমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তাই আমাকে তাঁর কিছু কবিতা পড়িয়ে নিয়েছে। আলাদা করে খুব আমার তাঁর বই বিশেষ পড়া নেই, আর আমি কবিতা তেমন বুঝিও না। তবুও, তাঁর কলমের সততা, তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু আমাকে মুগ্ধ করেছিল। 

সুরজিৎ পাতর জন্মেছিলেন জালন্ধরের পাতার গ্রামে। এখন অনেকেই জেনে গেছেন, পাঞ্জাবের শিল্পীরা অনেক সময়েই নামের সঙ্গে গ্রামের নাম লিখে থাকে, তাই সুরজিৎ সিং হয়ে গেলেন সুরজিৎ ‘পাতর’। তাঁর বাবা কেনিয়ায় কাজ করতেন, ছুটিছাটা ছাড়া বিশেষ আসতেন না, চার দিদির সঙ্গেই ছোটবেলা কেটেছিল তাঁর। বড় হয়ে কপুরথলায় সায়েন্স পড়তে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সায়েন্স ছেড়ে আর্টসে চলে যান তিনি। এরপর দীর্ঘ দিন পাঞ্জাবি লিটারেচার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, পি এইচ ডি করার সময় থিসিস লিখেছিলেন ‘Transformation of Folklore in Guru Nanak Vani’ বিষয়ে, পরবর্তীতেও সারাজীবন এই নিয়ে চর্চা করে গেছেন।


ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পদ্য লেখার সূত্রপাত, আর প্রথম থেকেই পাতর সাহেব নিজস্ব একটা শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। সহজ, কিন্তু ইম্প্যাক্টফুল। তাঁর কবিতা পড়লে পাঠক ততোটা চমকায় না, যতটা চমকায় কবিতা পড়ার পর। তাঁর লেখার একটা দীর্ঘস্থায়ী জাদু ছিল, যা পাঠকের অবচেতনে রেশ রেখে যেত। 


বরাবরই তিনি সাহসী কবি, কলমের সঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় পেতেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষকে দুঃখে দেখলে তাঁর কলম আগুন জ্বেলে দিত, সে কোভিড কাল হোক বা খালিস্তান সমস্যা। কিন্তু তবু, এই বিপ্লবীর কবির কলমে একটা অদ্ভুত মায়া, একটা অদ্ভুত মাধুর্য ছিল, যা পড়লে মনে হত, এই কবিতায় হিংস্রতার আহ্বান নেই, টক্সিক সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য নেই, কিন্তু মুক্তির একটা পথ আছে। লড়াই আছে, কিন্তু সে লড়াই মানুষকে পিষ্ট করে না, বরং তাঁর কাঁধে হাত রেখে তাঁকে চাগিয়ে তোলে। মুক্তগদ্য হোক বা ছন্দবদ্ধ কবিতা, কবি সাহিবের কবিতায় এই জিনিসটাই ‘কমন’ ছিল, সাধারণ মানুষের ‘স্ট্রাগল’, তাঁদের নিত্য সংগ্রাম। সে প্রেমের স্ট্রাগল/বিরহ হোক, সমাজের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজের স্বপ্নপূরণ হোক, রাজনৈতিক বা বেসিক এমিনিটির জন্য জনতার স্ট্রাগল হোক। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বলতেন, "কবিতার কাজই তো মানুষের জীবনের স্ট্রাগলের কথা জানানো। নেরুদা বা লোরকা, যে কোনও বড় কবিকে দেখুন, তিনি যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, তিনি জনগণের কবি তখনই হয়েছেন, যখন তাদের জীবনকে সাহিত্যতে ধরতে পেরেছেন। এই নীরব স্ট্রাগলের ভাষাকে শব্দ দেওয়া, ভাব দেওয়া, ছন্দে ধরা, এটাই তো কবির কাজ।”

সুরজিৎ প্রাজী নিজে যে সেটা খুব ভালো করে পারতেন সে বলাই বাহুল্য। এই আদর্শ নিয়েই হয়তো লিখেছিলেন--

“মেরে দিল মে কোই দুয়া করে

য়ে জমিন হো সুরময়ী

য়ে দরখত হো হরে ভরে

সব পরিন্দে হি

ইয়াঁহ সে উড় গয়ে...

**

ম্যায় শুনু জো রাত খামোশ কো

কি মিট্টি সে মুঝে পেয়ার নেহি

গর ম্যায় কহুঁ কি আজ ইয়ে তপতি হ্যায়

গর কহুঁ কি প্যায়ের জ্বলতে হ্যায়

উয়ো ভি লেখক হ্যায় তপতী রেত পে জো

রোজ লিখতে হ্যায় হর্ফ চাপো কে

উয়ো ভি পাঠক হ্যায় সর্দ রাতোঁ মে জো

তারো কি কিতাব পড়তে হ্যায়।

পঞ্চাশ বছরের কবি জীবনে যে জায়গা সুরজিৎ পাতর অর্জন করেছিলেন, তা আমাকে সত্যিই বিস্মিত করে। এগারো তারিখে তাঁর মৃত্যুর খবর আসতেই পাঞ্জাবের উত্তপ্ত রাজনীতিকে কেউ এক বালতি ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে মনে হল, চায়ের দোকানে, রাস্তাঘাটে, সভা-সমিতিতে পক্ষ বিপক্ষ ভুলে পার্টির ক্যাডাররা প্রিয় কবির কবিতা আর গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, জলন্ধর এর কয়েকটা  বইয়ের দোকানের সামনে ভিড় জমে গেছিল। সবাই কবি সাহিবের বই চায়। কেউ 'পতঝড় দি পাঞ্জেব' চায়, কেউ রিভিজিট করতে চায় ‘হওয়া উইচ লিখে হর্ফ’! সুরজিৎ পাতর জীবন নিয়ে আর কিছু লিখব না, বরং তাঁর দু একটা কবিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। অনুবাদ না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হবে না।


১) 

ম্যায় পেহলি পংক্তি লিখতা হুঁ

অউর ডর জাতা হুঁ রাজা কে সিপাহিয়োঁ সে

পংক্তি কাট দেতা হুঁ


ম্যায় দুসরি পংক্তি লিখতা হুঁ

অউর ডর জাতা হুঁ বাগি গুরিল্লো সে

পংক্তি কাট দেতা হুঁ


ম্যায়নে অপনে প্রাণো কে খাতির

অপনি হজার পংক্তিও কো

অ্যায়সে কি কতল কিয়া হ্যায়

উন পংক্তিয়োঁ কি আত্মায়েঁ

অকসর মেরে আসপাস হি রেহতি হ্যায়

অউর মুঝসে কেহতি হ্যায়


কবি সাহিব

কবি হ্যায় ইয়া কবিতা কে কাতিল হ্যায় আপ?


শুনে মুন্সিফ বহুত ইন্সাফ কে কাতিল

বড়ে ধর্ম কে রাখওয়ালে

খুদ ধর্ম কি পবিত্র আত্মা কো

কতল করতে ভি শুনে থে


সির্ফ ইয়েহি শুননা বাকি থা

কি হমারে ওয়াক্ত মে খৌফ কে মারে

কবি ভি বন গয়ে

কবিতা কে হত্যারে!


২) 

তুমহারে দিওয়ার পর টঙ্গি চমকদার ঘড়ি

মেরা সুরজ নেহি

ন তুমহারে কমরে কি ছত মেরা আসমান

অউর ম্যায় সির্ফ য়েহি নেহি


জো তুমহারে সামনে হ্যায় এক ওয়জুদ

তুম নেহি জানতে

ম্যায় আকেলা নেহি

ইস দরওয়াজে সে বাহর খড়ি হ্যায়


উদাস নসলো কে খুন পর পলি

মেরি গেয়ারহ হজার জহর ভরি রাতেঁ

খুঁখার অত্যাচারী

মেরি কালী ফৌজ

মেরি তারিখ কা আক্রোশ


৩)

ম্যায় রাত কা আখিরী জাজিরা

ঘুল রহা, বিলাপ করতা হুঁ

ম্যায় মারে গয়ে ওয়াক্তো কা আখিরী টুকড়া হুঁ


জখমী হুঁ

অপনে বাকয়োঁ কে জঙ্গল মে

ছিপা করাহতা হুঁ

তমাম মর গয়ে পিতরো কে নাখুন

মেরি ছাতী মে ঘোঁপে পড়ে হ্যায়

জরা দেখো তো সেহি

মর চুকো কো ভি জিন্দা রহনে কি কিতনি লালসা হ্যায়


৪) 

মাতম

হিংসা

খৌফ

বেবসী

অউর অন্যায়


ইয়ে হ্যায় আজকল মেরি নদিয়োঁ কে নাম


৫) 

মেরি শুলী বানায়েঁঙ্গে

ইয়া রবাব

জনাব

ইয়াকি ম্যায় ইউহিঁ খড়া রহুঁ তাউম্র

করতা রহুঁ পত্তো পর

মৌসমো কা হিসাব কিতাব

জনাব

কোই জবাব


মুঝে কেয়া পতা- মুঝে কাহাঁ ভেদ

ম্যায় তো খুদ এক বৃক্ষ হুঁ তুমহারি তরহ

তুম অ্যায়সা করো

আজ কা অখবার দেখো

অখবার মে কুছ নেহি

ঝরে হুয়ে পত্তে হ্যায়


ফির কোই কিতাব দেখো

কিতাবো মে বীজ হ্যায়


তো ফির সোচো

সোচো মে জখম হ্যায়

দাতোঁ কে নিশান হ্যায়

রাহগীরো কে পদচিহ্ন হ্যায়


ইয়া মেরে নাখুন

জো ম্যায়নে বচনে কে লিয়ে

ধরতী কে সিনে মে ঘোঁপ দিয়ে হ্যায়


সোচো সোচো অউর সোচো

সোচ মে ক্যায়েদ হ্যায়

সোচ মে খৌফ হ্যায়

লগতা হ্যায় ধরতী সে বঁধা হুয়া হুঁ


জাও ফির টুট জাও

টুটকর কেয়া হোগা

বৃক্ষ নেহি তো রাখ সেহি

রাখ নেহি তো রেত সেহি

রেত নেহি তো ভাপ সেহি


অচ্ছা ফির চুপ হো জাও

ম্যায় কব বোলতা হুঁ

মেরে তো পত্তে হ্যায়।

হওয়া মে ডোলতে হুয়ে


****


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন