মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

সিটি অফ মিউজিক

 

কয়েকমাস আগে ইউনেস্কো ভারতের একটা শহরকে সিটি অফ মিউজিক বলে ভূষিত করেছে। ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ক্রিয়েটিভ সিটিজের সূচিতে আরো কিছু শহর আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে এই শহরটার নাম দেখে অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চন হয়েছিল দেখেছি,তার কারণও আছে। 

প্রথমেই বলে দিই, শহরটার নাম গোয়ালিয়র। ভারতের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত এই শহরটায় আমি নিজে একসময় মাস চারেক থেকেছিলাম, আর খুবই সন্ত্রস্ত হয়েই থাকতে হয়েছিল সে সময়টা। না, চম্বলের দস্যুরা আজকাল আর শহরে এসে উৎপাত করে না, ল্যান্ড মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যেও ছিল না। যা ছিল, তা হল ধুলোর ভয়। ট্রিপল আইটির সবুজ ক্যাম্পাস থেকে বাইরে বেরোনোর পর যে ফিরে আসত, তাকে দেখে আর চেনার কোনও উপায় থাকত না। 

এমন ধুন্ধুমার ধুলোসর্বস্ব শহর যে একযুগ ধরে ভারতীয় ক্লাসিকালের পূণ্যভূমি ছিল সে কথা বিশ্বাস করা একটু কঠিন তো বটেই। তবে কথাটা ভুল নয়। কারণ, গোয়ালিয়র একমাত্র শহর যেখান থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার সূত্রপাত। আর সম্ভবত এই শহরটাই বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, গোয়ালিয়র ঘরানার বেসক্যাম্প চিরকাল গোয়ালিয়রই ছিল, নাম এক রেখে রাজধানী বদলে নেওয়ার নীতিতে তাদের বিশ্বাস ছিল না। গোয়ালিয়র এর সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক ঠিক কতটা প্রাচীন আর কতটা গভীর, সে কথা এখন আর অনেকেই জানে না। দেখে ভালো লাগল, ইউনেস্কো অন্তত সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি। রাগ, রশক, রঞ্জ, আর রঞ্জিশের যে ঐতিহ্য এখানকার রিয়াসতের রক্তে মিশে আছে, সেটা বোঝানোর জন্য একটা গল্প বলা যাক। অনেকেই জানেন হয়তো, কিন্তু নিজে কিছু কিছু নতুন ঘটনা জেনেছি বলেই জার্নাল করে রাখছি আর কি!

মুশকিল হল, এই জগতটা এত বিশাল যে প্রতিটা গল্পের আগে আর পরে লক্ষ লক্ষ গল্প আছে। কী ছেড়ে কী বলব? আমার মতো বহু পাবলিক আছে, যারা ক্লাসিকাল সঙ্গীত সম্পর্কে কিস্যুটি জানে না, থাট তাল তান স্বর সব মিলে জগাখিচুড়ি, রাগ রাগিনী বোঝা তো অনেক পরের কথা। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ইউটিউব ঘেঁটে একটা ভাসাভাসা ধারণা হলেও অনেক। ঘরানা ফরানা শুনলে অনেকেরই মনে হয় হার্ড সাইফির গল্প এর চেয়ে সহজ। 

যাদের বাড়িতে গানবাজনার চর্চা নেই, তাদের এই সমস্যা হবেই। তবে কিনা, গান না বুঝলেও গানের গল্প বুঝতে অসুবিধা নেই। যে কোনও গানই হোক! তাই আমি চটি পরে জ্যাজ কন্সার্টে গেছি, আবার কিছু না বুঝেও সংকট মোচনের সঙ্গীত সভায় গিয়ে ধ্রুপদ খেয়াল ঠুমরি সব শুনে এসেছি। আমাদের মতো আনাড়িদের জানাই, মোদ্দা কথা হল, ধ্রুপদ হল ধ্রুব পদ, মানে এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ার সঙ্গীত, তাতে নিয়ম একদম ধ্রুব মানে স্ট্রিক্ট থাকে। বাকি সব পরে এসেছে। আগে ঘরানা বা স্কুল অফ মিউজিক ছিল না, ছিল বানী। বানী মানে ধরে নিন, কী করে এই নিয়ম ফলো করে গান গাওয়া হচ্ছে! ডাগুর বানী, নৌহর বানী, খণ্ডার বানী আর গৌহর বানী নিয়েই কাজ কারবার হত। পরবর্তীতে খেয়াল গায়েকি এলে শিল্পীরা দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গিয়ে থাকতে শুরু করে, তাদের জায়গায় এক একটা ঘরানা শুরু হয়। গোয়ালিয়র তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, বা ফার্স্ট লিস্টেই নাম আসবে। অতরৌলী, জয়পুর, ক্যায়েরানা, রামপুর, পটিয়ালা, ম্যায়হর সহ একগাদা ঘরানা আছে, যদিও পরে সবাই ছড়িয়ে গেছে। এখন পটিয়ালার শিল্পীরা কোচিতে, ম্যায়হর স্কুলের গায়করা ভ্যানকুভারে বসে কন্সার্ট করছে। সব গায়েকির রহস্য ওপেন সোর্স প্রায়, তবুও আমজনতার আগ্রহ নেই। এককালে এমন অবস্থা ছিল, এক একটা রাগের গায়েকির রহস্য জানতে স্পাই লাগানো হত, একটা নামকরা শিল্পীর বন্দিশ পণ রেখে সোনাদানা হাতিঘোড়া ছয় মাসের রেশন পাওয়া গেছে, এমন নজিরও আছে। সে দিন আর নেই। 

যাকগে, ব্যাক টু গল্প। প্রথমেই যে বলছিলাম, রাগ (মানে সঙ্গীতের রাগ), রশক (জেলাসি), রঞ্জ (শোক) আর রঞ্জিশ (মানে দুশমনি বা আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক আর কি) নিয়ে এক একটা জমাটি গল্প আছে, শুনলে একদম গায়ে শিহরন জাগে। তবে একটু গভীরে ঢুকলে বোঝা যায়, প্রতিটা গল্পই আবার লেয়ার্ড, বহুস্তরীয়। রশকের গল্পে ইশক আছে, রঞ্জিশের গল্পে স্যাক্রিফাইসও পাওয়া যায়। কেমন? এই হল তার একটা উদাহরণ। যদি পড়েন, কী মানে উদ্ধার করলেন কমেন্টে জানাতএ পারেন!

১৮৫৯ সালে রেওয়ার গোবিন্দগড় প্রাসাদে একটা সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আদেশ দিয়েছেন মহারাজ রঘুরাজ সিং বাঘেল। অনেকের মতে, এই জায়গাতেই রেওয়া দরবারের রামতনু পাণ্ডে আর চন্দেরির ব্যায়েজনাথ মিশ্রার এক কম্পিটিশন হয়েছিল বেশ কয়েকশো বছর আগে (অনেকে আবার বলে, সেটা হয়েছিল আকবরের দরবারে। ঠিকঠাক কোনও প্রমাণ নেই) সেই দিনটা ইতিহাসের খাতায় উঠে গেছে। কেউ কনফিউজড হবেন না, রামতনু আর ব্যায়েজনাথ বলতে তানসেন আর ব্যায়জু বাওরার কথাই হচ্ছে। যাই হোক, এইবারের প্রতিযোগিতা আরো ভয়ানক। কারণ, যেই দুই পরিবারের গায়কদের মধ্যে কম্পিটিশন হবে, তাদের 'রঞ্জিশ'-এর গল্প সবাই জানে। গোয়ালিয়রের দুই যুবক হদ্দু আর হসসু খানের সঙ্গে মোকাবিলায় নেমেছেন তাদেরই চচা মানে বড় জেঠা বড়ে মুহম্মদ খান। বড়ে মুহম্মদ খানের তান শুনে গোটা হিন্দোস্তান সম্মোহিত হয়ে যায়, এদিকে হদ্দু-হসসু জুটিও কম যায় না, তারা কয়েকদিন আগে জয়পুরের দরবারে বড় বড় শিল্পীদের মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে এসেছে। সবাই উত্তেজিত, রাজামশাই খোদ জমকালো পোশাক আর মনিমুক্তো দেওয়া দস্তানা পরে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করছেন। সবাইকে চুপ করাতে তিনি বললেন, "দেখা যাক, কে বড়? রেওয়া না গোয়ালিয়র? কম্পিটিশন ইজ অন, নো ওয়ান উইল স্টপ টিল ডেথ। আজ দরবারে গানের নদী বইবে, সঙ্গে রক্তের নদীও বইবে নাকি?"

একদিনে বড়ে মুহম্মদ খান, অন্যদিকে হদ্দু আর হসসু খান। মুহম্মদ খান আলাপ শুরু করলেন, হদ্দু হসসু তাদের গায়েকি দিয়ে সেই আলাপকে এগিয়ে নিয়ে চলল। বোঝা মুশকিল দুই ভাই আলাদা আলাদা গাইছে। সুরের মূর্ছনায় দরবার গমগম করছে, সবাই সম্মোহিত হয়ে আছে। গোয়ালিয়র ঘরানার গায়েকিতে আলাপ আর তানেএ মাঝে 'বহলাওয়া' বলে একটা জিনিস আছে, (যদিও এই জিনিসটা পরে অনেক ভালো করে ইভলভ করেছে) আলাপ আর তানের মাঝের এই বোল বিস্তারের একটা নিজস্ব শৈলী আছে। তা বড়ে মুহম্মদ খান বহলাওয়া হয়ে তানে এসে গেছেন, হসসু আর হদ্দু খানও জোর তান লাগাচ্ছেন। সুরের যুদ্ধ তো নয়, যেন দুই দলের যোদ্ধারা তরোয়াল ভাঁজছে। একে বলে নঙ্গি তলোয়ার তান। সেকালে শ্রোতারাও সুরের সমঝদার ছিল, সবাই হাততালি দিয়ে এই যৌথ তানাতানির তারিফ করছেন। সবাই মিলে এমন সুর লাগিয়েছে যেন হাতি ডাকছে। মানে, সমঝদার এর ভাষায়, হাতি চিঁঘাড় তান। হদ্দু আর হসসু একে একে গাইছে, কিছুতেই তারা হার মানবে না। বড়ে মুহম্মদ খান আড়চোখে একবার তাদের দিকে তাকালেন, তার চোখে অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল।

শট ফ্রিজ। এইবার ব্যাক টু ফ্ল্যাশব্যাক! কেন হাসলেন বড়ে মুহম্মদ খান? কারণ, এই প্রতিযোগিতার আগে দুই পরিবারের মধ্যে অনেক জল বয়ে গেছে। সে গল্প ভুললে চলবে? সেই আদ্যিকালের কতা! অমীর খুসরোর বারোজন কাওওয়াল শিষ্য ছিল, তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল 'কাওওয়াল বাচ্চাদের ঘরানা'! এদের মধ্যে দুজন ছিলেন নেমত খান সদারঙ আর ফিরোজ খান অদারঙ, তারা 'খেয়াল' গেয়ে ফেমাস হয়ে গেছিল। তাদের নাতি ছিল শক্কর খান আর মকখন খান, তারা প্রথম থেকেই গানবাজনা নিয়ে রেষারেষি করত। কে বড় গায়ক? এই রেষারেষি কয়েক প্রজন্ম ধরে চলছে, দিন দিন সম্পর্ক আরো কটু হয়ে উঠেছে। 

শক্কর খানের বড় ছেলে মোহাম্মদ খান গোয়ালিয়র এর রাজা দৌলতরাও সিন্ধিয়ার রাজগায়ক ছিলেন, তাঁর স্যালারি গুগলের সিটিওর স্যালারিকেও ছাড়িয়ে যাবে, হাতি করে দরবারে যেতেন। এদিকে মকখন খানের ছেলে নত্থন পির বখশ লখনউতে ঝড় তুলেছেন। সেখানকার নামকরা শিল্পী শোরি মিয়াঁর কাছে টপ্পা শিখেছেন, আগ্রার শ্যামরং-সরসরঙ এর কাছে ধ্রুপদের তালিম নিয়েছেন, আর কওয়ালির গুণ তো তাঁর রক্তেই ছিল। তাদের খ্যাতি বেড়েছে, দুশমনিও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আর দুশমনি বাড়লে যে খুনোখুনি হবে, সে আর নতুন কী? প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল না সে যুগে। ফলে স্পাইক্রাফট আর অ্যাসাসিনেশন অ্যাটেম্পট চলতেই থাকত। গুপ্তহত্যার নজিরও কিছু কম নেই। 

শক্কর খান নত্থন পির বখশের ছেলে কাদর এর সুপারি দিয়ে তাকে সগগে পাঠালেন। নত্থন বুঝে গেলেন এ ব্যাটারা গোটা পরিবারকে সাবাড় করবে। তিনি লখনউ ছেড়ে পালালেন। গোয়ালিয়রে ভাইপোকে চিঠি লিখলেন, কিন্তু গোয়ালিয়রেও তো শত্রু ফ্যামিলির লোক আছেন... বড়ে মুহম্মদ খান। কিন্তু আপাতত জান বাঁচাও। ভাইপোর কথায় ভরসা পেয়ে তারা চলে এলেন গোয়ালিয়র, সঙ্গে হদ্দু আর হসসু খান, তার দুই নাতিও এল। কিন্তু এসেছেন যখন, আর অপোনেন্ট ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় যোদ্ধা যখন কাছেই আছেন, তখন তো চুপ করে বসে থাকা চলে না। হসসু আর হদ্দু তখন পুঁচকে ছেলে, কিন্তু তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে বড়ে মুহম্মদ খানের গানের রহস্য বুঝে আসার জন্য গুপ্তচর করে তোলা হল। সেই পুঁচকে বয়স থেকেই দু ভাই স্পাই। সেকালে সবাই লুকিয়ে রেয়াজ করত, গানের সিক্রেটের কত দাম ছিল আগেই বলেছি। কিন্তু বাচ্চাদের কে সন্দেহ করবে? দুই ভাই ছোটখাটো চেহারা দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে, জানলার পাল্লা দিয়ে গলে বড়ে মুহম্মদ খানের তেহখানাতে চলে যেত, আর তার তান শুনে শুনে বাড়ি এসে প্র‍্যাক্টিস করত। এই করে বছর কাটতে লাগল। সদা সতর্ক থাকতে হত দুই ভাইকে, সন্দেহ হলেই মুণ্ডু ঘ্যাঁচাং। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তিতে ছেদ পড়ল না, ট্রেড সিক্রেট বেহাত হতে লাগল ধীরে ধীরে। একে কী বলব? মিউজিকাল এসপিওনাজ? 

এদিকে কয়েক বছর পর যখন হদ্দু হসসু নিজে গাইতে শুরু করল, বড়ে মুহম্মদ খানের স্পাইরা শুনে জানাল, এরা তো মনে হচ্ছে ঝামেলা পাকিয়েছে গুরু! এ তো হুবহু তোমার তান। বড়ে মুহম্মদ খান প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু কয়েকবার তাদের গাইতে দেখেই তিনি বুঝে যান সর্বনাশ হয়েছে। বন্দিশ ইজ স্টোলেন, ব্রো! ল্যাও ঠেলা! রেগেমেগে তিনি গোয়ালিয়র ছেড়ে রেওয়ার মহারাজের কাছে চলে যান, কিন্তু রাগটা পুষে রাখেন। বদলা নিতে হবে... এই কথাটা তিনি নিয়ম করে নিজেকে মনে করাতেন। প্রতিটা ওস্তাদের নিজের মার থাকে, আর সেই মার চালতে হয় শেষ দানেই। সুতরাং, রেওয়া মহারাজার দরবারে বসে, হদ্দু হসসু খানের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন। 

হাতি চিঁঘাড় তানের পর দুই ভাই এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। কিন্তু এইবার বড়ে মুহম্মদ খান শুরু করলেন এমন এক তান, যা তিনি ছাড়া ভূভারতে কেউ পারত না। কড়ক বিজলি তান এর এই সুর গলায় খেলানো সহজ নয়, নিশ্বাস নেওয়ার সময় থাকে না, লান্সের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে, হাড়গোড় কটকট করতে থাকে, মেরুদণ্ড বেঁকে যায়। বড়ে মুহম্মদ খানের সেই তান শুনে হদ্দু খান বুঝলেন আর কিছু করার নেই, তিনি চুপ করে গেলেন। কিন্তু হসসু খান উত্তেজনার বশে একই তান গাইতে গেলেন। তারপর সেটাই হল, যা বড়ে মুহম্মদ খান চাইছিলেন। হসসু খানের মেরুদণ্ড এর হাড় মট করে ভেঙে গেল, লান্স ফেটে গেল, মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরোতে লাগল। রক্তারক্তি কাণ্ড, সবাই চুপ। হসসু খান প্রাণ হারালেন। বড়ে মুহম্মদ খান সত্যিই দরবারে রক্তের নদী বইয়ে দিলেন।

গল্প এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। হসসু খান মারা যাওয়ার পর হদ্দু খান একদম  নিস্তেজ হয়ে পড়লেন, তার আর কিছুই ভালো লাগে না। গাইতে ইচ্ছাই করে না। মহারাজ জিয়াজিরাজ সিন্ধিয়ার সঙ্গেও মনের মিল নেই। সব ছেড়ে তিনি লখনউ ফিরে এলেন। রাজা বাদশা নবাবদের ছেড়ে নিজের জন্য গাইতে শুরু করলেন। কোনোরকম প্রতিযোগিতা নেই, কোনও দর্শক নেই, শ্রোতা নেই, তিনি নিজেই গাইছেন, নিজের জন্যই রেয়াজ করছেন। এরকম করে বছর কাটতে লাগল। পরিচিত পরিবেশের বাইরে এই একান্ত সঙ্গীত সাধনা ক্রমে হদ্দু খানকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যা কেউ কল্পনাও করেনি। প্রকৃতি তাঁর গায়েকিকে এক অতীন্দ্রিয় রূপ দিল। হয়তো এ তাঁর নিয়তিতেই ছিল।

বহলাওয়া থেকে ঝুমরা তাল... গোয়ালিয়র ঘরানার যে সমস্ত কিছুকে আজ শ্রোতারা জানে, সেই সমস্ত কিছুকে চেহারা দেওয়ার ক্রেডিট হদ্দু খানের। গোয়ালিয়ার ঘরানার কপিবুক অস্টাঙ্গ গায়েকির সমস্ত নিয়ম মেনেও হদ্দু খান যে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, সে জন্য তাকে নোবেলেই দেওয়া যেত, যদি ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল এর জন্য সেকালে নোবেল দেওয়া হত। মজার কথা হল, বড়ে মুহম্মদ খান চিরকাল হদ্দু খানকে স্নেহ করে গেছেন। হসসুর মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্কে এক অদ্ভুত উষ্ণতা এসেছিল, যা আজীবন রয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে এই দুই ফ্যামিলি মিলেই গোয়ালিয়র ঘরানা গড়ে তোলে। আবার, এই দুই ফ্যামিলির পরবর্তী প্রজন্মের গাইয়েদের হাত ধরেই অন্যান্য ঘরানার সূত্রপাত হয়েছে, সেটাও দেখতে হবে। যেমন, জয়পুর-অতৌলিয়া ঘরানার আলাদিয়া খান বড়ে মুহম্মদ খানের ছেলে মুবারক অলি খানের শিষ্য, আবার কিরানা ঘরানার অব্দুল করিম খানের সঙ্গেও এই পরিবারের নিবিড় যোগ আছে। এই ঘরানার হাত ধরেই ভারতীয় ক্লাসিকাল পরবর্তীতে ধর্ম, গোষ্ঠী, সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে, হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে গিয়েছে, পরম্পরাগত সঙ্গীত আর আধুনিক সঙ্গীতের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনও হয়েছে গোয়ালিয়র ঘরানার শিল্পীদের হাতেই। কিন্তু সে গল্প আবার পরে কখনও হবে। 

(গোয়ালিয়রে আজও হদ্দু হসসু খানের নামে একটা অডিওটোরিয়াম আছে, তার দীর্ণ দশা আমি পনেরো বছর আগেই দেখে এসেছিলাম। কিন্তু ইতিহাসটা রয়ে গেছে। আর কিছুই না, গোয়ালিয়র এর নাম শুনলে এখন আমার প্রথমেই সিটি অফ মিউজিক কথাটা মনে পড়বে। মহারাজ রঘুরাজ সিং বাঘেল ছাড়া এসব শিল্পীদের কোনও অয়েল পেন্টিংও নেই সম্ভবত, তবে মীরা পণ্ডিত আর প্রবীণ কুমার সহ অনেকেই বিশদে বই লিখেছেন, আর আমাদের চেনা বইগুলো তো আছেই।)








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন