সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

অন্য হীরামণ্ডি ও তমঞ্চাজান

 


নেটফ্লিক্সে সঞ্জয় লীলা বানশালীর 'হীরামণ্ডি নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। তবে ওই হইচইই সার, কারণ মাঝে একদিন খানিকটা এগিয়ে এগিয়ে দেখে বুঝলাম, আই অ্যাম নট দ্য টার্গেট অডিয়েন্স। এমনিতেও ভদ্রলোকের ক্রিয়েটিভ চয়েজটা আমার টেস্টের সঙ্গে বিশেষ মেলে না। তবে প্রোডাকশন ডিজাইনের জন্য যতটা বাজেট নেটফ্লিক্স বরাদ্দ করেছিল, সেসব ঠিক জায়গায় অ্যালোকেট হলে দশজন পায়েল কাপাড়িয়া সিনেমা করতেই পারতেন। আমি প্রায় নিশ্চিত, কাল কানে প্রাইজ পাওয়া ওই সিনেমা হাতেগোনা ভারতীয় ছাড়া কেউই দেখবে না। তাঁর আগের কাজগুলোও কানে সম্মানিত হয়েছে, সেগুলোই বা কে দেখেছে? শৌনক সেন, বিনয় শুক্লা বা রিন্টু থমাস-সুস্মিত ঘোষ জুটির দুনিয়া কাঁপানো কাজগুলো ঠিক কতজন দেখেছেন আর আলোচনা করেছেন? যাকগে, এই সুবাদে ব্লগে লেখা একটা পুরোনো লেখার কথা মনে পড়ল। ঠিক হীরামণ্ডিকে নিয়ে নয়, কিন্তু কিছুটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। প্রায় তিন চার বছর আগের লেখা, তখনও সঞ্জয় লীলা বানশালি এই সিনেমা করবেন বলে লেখালিখি চলছে। ঝেড়েমুছে পোস্ট করে রাখলাম।

লাহোরের হীরামণ্ডির কথা এক প্রজন্ম আগেও প্রায় সকলেই জানত। এখন জানে কি জানে না বলতে পারছি না, তবে জানলেও যে কারণে জানে, হীরামণ্ডির খ্যাতি ঠিক সে কারণে ছিল না। হীরামণ্ডি দিল্লির জি বি রোড বা কলকাতার সোনাগাছি নয়, লাহোর, ভারত আর হিন্দুস্তানি ক্লাসিকালের জগতকে সুদৃঢ় করতে, জনপ্রিয় করতে, সাধারণ মানুষের কাছে সেই মিউজিকাল হেরিটেজকে নিয়ে আসতে এই পাড়াটা যে ভূমিকা পালন করেছে, সেরকম নজির খুব বেশি নেই ইতিহাসে।

গোড়ার দিকে নজর দেওয়া যাক! আকবরের সময়, ১৫৮৪ থেকে ১৫৯৮ সাল অব্দি রাজধানী ফতেপুর সিক্রি থেকে লাহোরে শিফট করেছিল, কিন্তু লাহোরে যে কেল্লাটি চারশো বছর আগে গয়াসুদ্দিন বলবন বানিয়ে গেছিলেন, সেটার অবস্থা তখন খুবই খারাপ, ফলে শহরজুড়ে রেনোভেশন হয়। কেল্লার দক্ষিণ প্রান্তে দরবারের সভাসদ, খাস আমলাদের জন্য শাহী মোহল্লার পত্তন করা হয়। বিউরোক্রেট থেকে আদানি আম্বানি, কবি গায়ক শিল্পীরা সবাই এই পশ অঞ্চলেই থাকতেন, তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হত। বলাবাহুল্য, এই শাহী মোহল্লাতেই কোর্টেসান বা তবায়ফরাও থাকত, কারণ তারা প্রত্যেকেই দরবারের কমিশনড আর্টিস্ট ছিলেন, সে সঙ্গীতশিল্পী হোক বা নৃত্যশিল্পী(মুজরা)। একজন তবায়ফকে টিউশনির জন্য পেলে লোকজন বর্তে যেত প্রায়, এলিট সোসাইটির ওই অদব আর কে শেখাবে? মুগল সাম্রাজ্যের অনেকেই হন্য হয়ে ঘোরাফেরা করত, যদি দিদিমণি রাজি হন!

ঝামেলা বাধল অষ্টদশ শতাব্দীতে। নাদির শাফ আর আহমদ শাহ আব্দালি দিল্লি দখল করার জন্য আক্রমণ করে, পথে পড়ে লাহোর। ব্যস! লুটপাট শুরু হয়ে যায়! মুগল শাসনে হাল ধরার কেউ ছিল না, ফলে তবায়ফ আর অন্যান্য শিল্পীদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে! অনেকে পালায়, বাকিরা ধরা পড়ে আফগান বা পারস্যের দস্যুদের হাতে, তারা আবার আসার সময় মেয়েদের লুট করে নিয়ে এসেছিল, জোর করে সবাইকে দেহব্যবসার কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, দু একজন ফড়ে শাহী মোহল্লার দালাল হয়ে মুনাফা কামাতে শুরু করে। কিন্তু এই পরিস্থিতিও বেশিদিন থাকেনি। লাহোর সহ গোটা পাঞ্জাবে বারবার আক্রমণের ফলে ছত্রভঙ্গ অবস্থা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ১৭৬২ সালে দস্যুদের হাতে শিখদের পবিত্র হরমিন্দর সাহেব গুরুদ্বারা ধ্বংস হওয়ার পর লোকজন বেঁকে বসে। এনাফ ইজ এনাফ। বড় কোনো সিপাহসালার ছিল না, লোকজন একদম তেড়েমেড়ে গিয়ে ছুটকো দস্যুদের পিটিয়ে শহরছাড়া করে আসে, আর ঢ্যাঁড়া বাজিয়ে বলে দেয়, এইবার কেউ এলে একদম মেরে তক্তা থুড়ি কড়াপ্রসাদ বানিয়ে দেবে। ১৭৯৯ সালে এক ছোকরা রঞ্জিত সিং ভাংগি মিসাল বলে একজন শাসকের হাত থেকে লাহোরের দখল নেন আর ক্রমে গোটা পাঞ্জাবকে একসূত্রে বাঁধতে শুরু করেন। মহারাজা রঞ্জিত সিং মোগল রাজাদের মতো অতটাও বৈভবশালী ছিলেন না, কিন্তু সংস্কৃতি আর গানবাজনা নিয়ে আগ্রহ ছিল। তিনি আবার তবায়ফদের ফিরিয়ে আনেন শাহী মোহল্লাতে। এখন সবাই জানে, সেই শাহী মোহল্লাই হীরামণ্ডি নামে বিখ্যাত। 

মহারাজা দেহন সিং ছিলেন মহারাজ রঞ্জিত সিংহের খুবই কাছের মানুষ ও দরবারের মন্ত্রী, তার ছেলে হিরান সিং এর নামেই হীরামণ্ডির নাম পড়ে। কাছেই এক বিশাল পাথরের দ্বার, সেই টাকসালি ফাটক এখনও দিব্যি টিকে আছে। তিরিশ ফুট চওড়া যে দেওয়াল দিয়ে এই শহরটা ঘিরে রাখতে চেয়েছিল মুগলরা, তাতে একটা দুটো নয়, তেরোটা গেট নির্মাণ করতে হয়েছিল শহরে ঢোকার জন্য। আকবরি গেট, ভাটি গেট, এরম ভাবেই দিল্লি, কাশ্মীরী, মাসিতি, লাহোরি, মোচি, মোরি, রোশনাই, শাহ আলামি, শেরানওয়ালা, য়াক্কি আর টাকসালি। বোঝাই যাচ্ছে, টাকসালি এসেছে টাকসাল (ট্যাঁকশাল) বা রয়াল মিন্ট থেকে, যা অবস্থিত ছিল গেটের কাছেই। 

রঞ্জিত সিংহের ছেলের যুগে এখানে শস্য কেনাবেচার একটা মার্কেটও হয়েছিল, কিন্তু তাতে হিরামণ্ডির শানোশৌকত বেড়েছে বই কমেনি। মুখতলিফ ঘরানার ওস্তাদরা আসতেন, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা হত, মিউজিক কন্সার্ট হত, প্রতিযোগিতাও হয়েছে৷ ১৯৪০ এর শুরুর দিকে ওস্তাদ বড়ে গুলাম অলি খাঁ আর ওস্তাদ উমিদ অলি খাঁয়ের মধ্যে একটা মোকাবিলা হয়, সে কথা আজও অনেকে মনে রেখেছে। দুজনেই দিগগজ গায়ক, কেউই হার মানতে রাজি নয়। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলেছে, গান আর শেষ হয় না। অর্ধেক লাহোর শহরের জনতা রাত জেগে সেই গান শুনছে। অবশেষে কেউই হার মানল না, প্রতিষ্ঠিত গায়ক জীবন লাল মট্টু দুজনের মাথাতেই সেহরা বেঁধে দুজনকেই জয়ী ঘোষণা করে দিলেন। জনতা ধন্য ধন্য করতে লাগল। জয়ধ্বনি দিতে দিতে তবায়ফরা নেমে এল পথে, ওস্তাদজিদের পায়ে মাথা নোয়াল সবাই। শুনলে বিশ্বাস হয় না, এসব ঘটনা সত্যিই ঘটেছে! তাও কিনা এমন একটা শহরে, যেখানে এখন হীরামণ্ডির নাম শুনলে পাকিস্তানে লোকজন মাথা নামিয়ে নেয়। চুলোয় যাক সেই সমস্ত ব্রিটিশ হতচ্ছাড়াগুলো, যারা লাহোর কবজা করে এই পাড়াটাকে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট বানিয়ে ফেলল। জাহান্নমে যাক সেই জিয়া উল হল, যে নিজের দেশের একটা কালাচারাল হেরিটেজকে সামলে রাখার জায়গায়, তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার জায়গায় পুলিশ পাঠিয়ে সে জায়গাকে চিরকালের মতো বদনাম করে ফেলল। মাফ করবেন, কিন্তু খিস্তি দেওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না।

যাই হোক, এসব নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। গল্পচ্ছলে পড়তে গেলে ফরাসি লেখিকা Claudine Le Tourneur d'Ison একটা বইই লিখে ফেলেছেন, এই পাড়ার ইতিহাস বর্তমান রাজনৈতিক সামাজিক অ্যাস্পেক্ট সবই জানা যায়, কিন্তু সার্বিক ইতিহাস ছাড়াও তো একটা ইতিহাস থাকে, যাকে বলে পিপলস হিস্ট্রি। একটা জায়গায় বেড়ে ওঠা, একটা জায়গার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বহু মানুষের জীবনে সেই জায়গার ছাপ রয়ে যায়, তাদের পার্সোনালিটিকে  প্রভাবিত করার পিছনে এই জায়গাগুলোর গুরুত্ব ভুলে গেলে চলে না। হীরামণ্ডিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পাড়ার সঙ্গে অভিন্ন সম্পর্ক আছে, এমন বহু মানুষ, বহু শিল্পী আছেন। আমি বরং তাদের একজনের কথাই মনে করিয়ে যাই!

লাহোরের শেখুপুরিয়া বাজার থেকে বারুদখানার দিকে যদি কেউ হাঁটতে শুরু করে, তাহলে কিছু দূর এগোতে না এগোতেই তার কানে রেকর্ডের শব্দ ভেসে আসবে। হীরামণ্ডি থাক না থাক, তাদের গান রয়ে গেছে আজও। আর সবচেয়ে আশ্চর্য হল, প্রি পার্টিশন ভারতে যে মেয়েরাও গান গাইত, আর অসামান্য গান গাইত, সে সব জানার বা বোঝার কোনও উপায়ই থাকত না, যদি না হীরামণ্ডি থাকত। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন কোল্মবিয়া আর এইচএমভির মতো কোম্পানি ভারতবর্ষে এসে গান রেকর্ড করার কথা ভাবে, অধিকাংশ গায়ক তাদের দিকে এমন করে তাকাত যেন ভস্ম করে দেবে। দু একজন বাদে কেউই প্রথমদিকে রাজি হয়নি, মেয়েরা তো নয়ই। এমন সময় কয়েকজন খবর দিল, ওরে, অত চক্কর না কেটে লাহোরে যা। হীরামণ্ডিতে গিয়ে দাদরা ঠুমরি খেয়াল সব পাবি। সব এ ওয়ান কোয়ালিটি জিনিস, ভেজালও নেই, আর ফালতু কেউ ন্যাকামিও করে না। 

মিউজিক কোম্পানি যদি সেই পরামর্শ না শুনত, রেকর্ডিং ব্যাপারটা মেনস্ট্রিমে আসতে সম্ভবত আরো তিন দশক লাগত। সিনেমা গান নাটক শ্রুতিনাট্য কিছুই রেকর্ড হত না, জনপ্রিয়তাও পেত না। পপুলার মিউজিক যে ক্রমে ভারতে একাধিপত্য বিস্তার করেছে, তার ক্রেডিটও অনেকটা হীরামণ্ডির। বিশেষ করে হীরামণ্ডির একজন গায়িকার, যাঁর গান আশি বছর পরেও শেখুপুরিয়া থেকে এগোলে কানে এসে লাগে। কে তিনি? তাঁর নাম গুলজার, তবে কিনা আমাদের চেনা গুলজার নয়, ইনি হলেন গুলজার বেগম। ১৯১৮ সালে সরদার বেগমের কোঠায় জন্মানোর সময়েই সবাই জানত, এই মেয়ে গায়িকা হবে। না, ভবিষ্যবাণী টানী নয়, আসলে গুলজার বেগমের ফ্যামিলিতে সঙ্গীতকে ঈশ্বরের জায়গা দেওয়া হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তেহমিজ-তেহজিবের পাশাপাশি গানবাজনার শিক্ষা দেওয়া হত, বড় বড় ওস্তাদের শাগির্দি করতে হত বছরের পর বছর ধরে। লাহোরে সরদার বেগমের কোঠার এমন একটা এলিট স্টেটাস ছিল যে সেখানে একটা মুজরা বা ঠুমরি শুনতে হলে আগে শ্রোতাকে পরখ করে দেখা হত, যে সে এন্ট্রি পেত না। বার্লিনের কিটক্যাট ক্লাবের মতো ব্যাপার। পকেটে যতো খুশি মালকড়ি থাকুক না কেন, জাতে ওঠাত 'অউকাত' না থাকলে ইউ টার্ন করে ফেরত যেতে হবে। সরদার বেগমের বড় ছেলে হাজি উমর বাঁশি বাজাতেন, সেই বাঁশি শোনার জন্য লোকজন আশেপাশের বাড়ির ছাদে উঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। 

তা এমন একটা পরিবারে জন্মেছেন যখন, তখন গুলজার বেটি আর পালাবে কোথায়? সাত বছরের আগেই সেই মেয়েকে যথাসম্ভব তৈরি করে ওস্তাদ ফিদা হুসেইনের শাগির্দিতে পাঠানো হল। এরপর প্রায় এক দশক ধরে শাস্ত্রীয় সংগীতের খুঁটিনাটি শিখলেন তিনি, কিন্তু গুরুর আদেশ পালন করে একবারের জন্যও বাইরের কারো সামনে গানের একটা কলিও গাইতে দেখা যায়নি তাকে। ১৯৩৪ সালে প্রথম, অম্মিজানের ঘরোয়া মেহফিলে গুলজার বেগমের প্রথম পাবলিক পারফর্ম্যান্স হয়। গান শুনে তো শ্রোতারা ধন্য ধন্য করতে লাগল। সে এমন কিছু নয়। আসল কথা হল, প্রথম পাবলিক পারফর্ম্যান্সেই এমন কিছু হল, যা কেউ ভাবেনি। সঙ্গীতের সমঝদার আর সরদার বেগমের কদরদানরা বলল, এ মেয়ে তো জন্নত থেকে এসেছে। কিন্তু গুলজার নাম নিলে ওকে কেউ চিনবে কী করে? আসলে, সেই সময় লাহোরে গুলজার বলে দুজন গায়িকা আগে থেকেই ছিল। এক হলেন নুরজহাঁর বড় বোন গুলজার বিবি আর আরেকজন হলেন সে যুগের সাইলেন্ট সিনেমার অভিনেত্রী মিস গুলজার। শ্রোতাদের মধ্যে একজন বাড়ফট্টাই করে বলল, "তোমার মেয়ের গলা তো বন্দুকের গুলির মতো! পুরো দেশি তামাঞ্চা মাইরি! গান শুনিয়েই সবাইকে কতল করবে। ওর নাম দেওয়া যাক তমঞ্চাজান।"

ব্যস, গুলজার বেগমের নাম পড়ে গেল তমঞ্চাজান। আসলে ঘটনা হল, সে কালে সিনেমায় যে সমস্ত নায়িকাদের জনপ্রিয়তা ছিল, যেমন ফিরোজা বেগম, ভিক্টোরিয়া অ্যাস্থর আব্রাহম, নসীম বানো, দেবিকা রানি, জদ্দন বাই, তাদের অনেককেই এরকম বোল্ড সেক্সিস্ট নাম দেওয়া হত। রিভলবার রানি, ছপপন ছুরি... অস্ট্রেলিয়ান মূলের অভিনেত্রী মেরি এন ইভান্সকে তো ভারতে ফিয়রলেস নাডিয়া বলে ইন্ট্রোডিউজ করা হয়েছিল। সিনেমার নামের ছিরিও তেমন, সে যুগে 'হন্টরওয়ালি' নাকি ব্লকবাস্টার হিট ছিল। তা যুগের হাওয়া পাল্টালে শিল্পীদেরও পাল্টাতে হয়, তাই সম্ভবত সরদার বেগম মেয়ের এই নাম নিয়ে আপত্তি করেননি। বরং একটা খেলনা পিস্তল কিনে দিয়েছিলেন কোমরে বেঁধে রাখার জন্য। কী আইরনি! একজন রোজ চোদ্দ ঘণ্টা ক্লাসিকাল সঙ্গীতের রেয়াজ করছে, ট্রাডিশনাল ডান্স শিখছে, এদিকে তার নাম তমঞ্চাজান! প্রাক স্বাধীনতার সময় থেকেই মেয়েদের অব্জেক্টিফাই করা আর মোরাল ডিগ্রেডেশনের এই ধারা একটু একটু করে দেখা যাচ্ছিল, তা একসময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। 

যাই হোক, গুলজার বেগম ওরফে তমঞ্চাজানের সঙ্গীত শিক্ষা কন্টিনিউ হয়েছিল। হীরামণ্ডিতে মিডিওকার জিনিসের কদর নেই, আর সে যুগে ইনায়তি সুনিয়ারি, শমসাদ অলিপুরওয়ালি বা অনবরি সিয়ালকোটনের মতন সিনিয়ার গায়িকারা বাজার কাঁপাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কম্পিট করতে গেলে সাধনা করতেই হবে।

ধীরে ধীরে তমঞ্চাজান হীরামণ্ডিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। গান কেমন গাইতেন সে নিয়ে মন্তব্য করার কোনও মানে নেই। তবে তাঁর গলায় রেঞ্জও ছিল, আর স্থান কাল পাত্র হিসেবে একটা গান প্রস্তুত করার জন্য যে এক্স ফ্যাক্টর পারফর্ম্যান্সে প্রয়োজন, সেই বোধও ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি। দেখতেও নো ডাউট সুন্দরী ছিলেন, আর সেই সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে এক একটা গানের পরিবেশনাকে অন্য লেভেলে নিয়ে যাওয়ার কায়দাও রপ্ত করে ফেলেছিলেন ধীরে ধীরে। ফলে যাই গাইতেন, সব কিছুই ইকোয়ালি জনপ্রিয় হত। সেকালে সিনেমার লোকজন তাঁর গানের জনপ্রিয়তার ওপর নজর রাখতেন, সুরও তৈরি হত অ্যাকর্ডিংলি।

কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, তমঞ্চাজান হীরামণ্ডির অন্যতম গায়িকা হয়ে উঠেছেন। ঠিক এই সময়েই কোল্মবিয়া, জেনোফোন আর এইচ এম ভির মতো কোম্পানিরা সেখানে এসে গান রেকর্ড করার প্ল্যান করছিলেন। তমঞ্চা জানকে পেয়ে তারা হাতে চাঁদ পেল। গুলাম হ্যায়দরের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি জেনোফোন রেকর্ড এর জন্য বেশ কিছু পাঞ্জাবি লোকগান রেকর্ড করলেন। গুলাম হ্যায়দর সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীতে ইনি লতা মঙ্গেশকরকে দিয়েও গান গাইয়েছেন। কিন্তু তিনি বারবার বলেও তমঞ্চাজানের দু একটার বেশি গান রেকর্ড করাতে পারেননি সিনেমার জন্য। তবে তমঞ্চাজানের পরামর্শ নিয়ে পরে তিনি প্রচুর গান বানিয়েছেন, বোম্বের অন্যান্য কম্পোজারদেরকেও নিয়ে আসতেন তাঁর গান শোনার জন্য।

তমঞ্চাজান এই সময় বারবার অভিনয়ের অফারও পেয়েছেন, কিন্তু কোঠার মেহফিল জমবে না বলে অভিনয় নিয়ে আগ্রহ দেখাননি। রেডিও নিয়ে অবশ্য তাঁর উন্মাদনা ছিল। তিরিশ এর দশকের শেষের দিকে রেডিও লাহৌর শুরু হয়, তমঞ্চাজান সেখানে নিয়মিত গাইতেন। শুধু ঠুমরি বা পাঞ্জাবি গান নয়, গজল গায়েকি বা বেনারস আর লখনইয়ের শৈলীও দেখা গেছে, লোকগীতিও কম গাননি। পাঞ্জাবের রবিনহুড বলে খ্যাত জগগা ডাকু লুটপাট করে গরীবদের সব টাকা বিলিয়ে দিত, ব্রিটিশরা তাকে এনকাউন্টার করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে লোকে একগাদা গান বেঁধে ফেলল, কিন্তু মেনস্ট্রিমে কেউ সে গান গাওয়ার সাহস করে না। তমঞ্চাজান কথাটা জানতে পেরে রেডিওতে গিয়ে জগগা ডাকুর জীবন নিয়ে সেই গান গেয়ে এলেন, "জগগা জমেয়াঁ তে মিলন বাধাইয়াঁ..." রেডিওতে সেই গান এমন ফেমাস হয় যে তারপর এরকম আরো গান ব্রডকাস্ট হতে থাকল। সেকালে তমঞ্চাজান ছাড়াও লাহোরের নামচীন ব্যক্তিত্বরা রেডিও প্রজেক্টের অংশ ছিলেন, করতার সিং দুগগল, জীনত বেগম, সুরিন্দর কৌর আর অমৃতা প্রীতমদের মতো লেখক ও শিল্পীরা প্রায়ই একসঙ্গে আড্ডা মারতেন। 

লেখক প্রাণ নেভিল বলেছেন, হীরামণ্ডির সম্ভবত শেষ হয়ে যাওয়ার আগে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল অব্দি তমঞ্চাজানের গান শুনতে সেখানে ভীড় লেগে যেত, মজলিশ শেষ হলে দশ বারোটা চাদর লাগত টাকা তোলার জন্য। তমঞ্চাজান যখন 'দিওয়ানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে' গাইতেন, হীরামণ্ডিতে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেত। 

কিছুই চিরকাল থাকে না। স্বাধীনতার ঠিক আগেই কমিউনাল রায়টস শুরু হয় লাহোরে, সরদার বেগমের কোঠার পাশাপাশি অন্যান্য তবায়ফদের যাঁরা সংরক্ষণ দিতেন, তাঁরা সবাই একে একে লাহোর ছেড়ে চলে যান। হীরামণ্ডির পরিবেশও বিষিয়ে আসছিল, গানের মজলিশে রাজনীতির উত্তপ্ত আলোচনা, তর্ক বির্তক  কথা-কাটাকাটি শুরু হত। তমঞ্চাজান বড় আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে হিন্দু মুসলমান কিছুই ভাবেন না, গায়িকা ছাড়া তার কোনও পরিচয় নেই। কেউ তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে, দেশভাগ বা পলিটিক্স নিয়ে মত রাখতে বললে তিনি চুপ।করে যেতেন। পার্টিশন নিয়ে তার কী বক্তব্য ছিল কোনোদিন খোলাখুলি জানাননি, কিন্তু নীরবে একটা কাজ করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের পর আর কোনোদিন গান গাননি। একবারের জন্যও না।

সময় এগিয়ে চলল। লোকে তমঞ্চাজানকে ভুলে গেল। ভুলে গেল হীরামণ্ডির সেই জাঁকজমক, কয়েকশো বছর ধরে বেঁচে থাকা সঙ্গীত সাধনাকেও। কয়েক বছর পর হয়তো কোনও সিনেমা হবে, সঞ্জয় লীলা বানশালি নাকি সিনেমা করবেন বলে ঠিক করেছেন, সেই দেখে আবার কয়েকজন আগ্রহী হবেন হীরামণ্ডিকে নিয়ে! কিন্তু হীরামণ্ডির তমঞ্চাজান বা তাঁদের মতো শিল্পীরা সঙ্গীত জগতে বা হিন্দুস্থানের কালচারাল লেগেসি বাঁচিয়ে রাখতে ঠিক কতটা অবদান দিয়েছিলেন, সেই নিয়ে কি আদৌ কোনও ডিসকোর্স হবে? কে জানে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন