শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

মরক্কো সফর- (৩) দ্য সিম্ফনি অফ সানসেট

 


সূর্যাস্তের একটা নিজস্ব ঐকতান আছে। বলা যায়, দ্য সিম্ফনি অফ দ্য সানসেট, প্রতিটা শহরের সূর্যাস্তের এই কম্পোজিশন তার নিজস্ব। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে এই সিম্ফনি সঞ্চয় করার চেষ্টা চালাচ্ছি। সাহারা থেকে ফিরে এসে মরক্কোয় যে কয়েকটি দিন কাটল, প্রতিটা দিনেই অসামান্য এক একটা সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম। কয়েক বছর পর ফিরে চাইব যখন, প্রথমেই সূর্যাস্তের সেই সুরগুলো স্মৃতিতে ভিড় করে আসবে।

প্রথমেই বলা দরকার মারাকেশের সূর্যাস্তের কথা। ঘটনাসূত্রে মারাকেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত হয় যে জায়গায়, সেখানে ইচ্ছে করেই যাওয়া হয়নি। লা পালমেরাই (Palmeraie) নামের এই জায়গাটার ইতিহাস অবশ্য চিত্তাকর্ষক, বর্ণনা শুনে জায়গাটাও সুন্দর বলেই মনে হয়। প্রায় হাজার বছর আগে আরব যোদ্ধারা এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাম গাছ লাগানোর প্ল্যান করেছিল একটা বিরাট ওয়েসিস বা মরুদ্যান বানানোর জন্য, তার জন্য ব্যবহার হয়েছিল খেট্টর ইরিগেশন সিস্টেম। খেট্টরের এই প্রযুক্তিও কম ইন্টারেস্টিং নয়, ভূমিগত কুয়ো বা অ্যাকোয়াডাক্ট থেকে ভূপৃষ্ঠে জল টেনে নিয়ে আসার নজির আরব দুনিয়ায় বেশ কিছু আছে। যাই হোক, অত বড় না হলেও শুনেছি  হাজারটারও বেশি গাছ আছে আজও, পালমাইরির এই পাম গ্রোভে হাজার খানেক গাছের পিছনে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য ঠিক কেমন হতে পারে, নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন। আমরা অবশ্য যাইনি, কারণ পাম ওয়েসিস থেকে হিউমান ওয়েসিস ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তাই সারাদিন এদিক সেদিক করে, মেশুই ল্যাম্বের লোভনীয় সুবাসের মায়া কাটিয়ে, গরম বাঁচাতে গ্লাসের পর গ্লাস ফ্রুট শেক খেয়ে, কুতুবিয়া মসজিদের কুকি হকারের কাছে কয়েক দিরহাম ঠকে, শেষমেশ ছ'টা নাগাদ উপস্থিত হলাম মারাকেশের নিজস্ব মক্কা... জামা আল ফানায়। ততক্ষণে রুফটপ রেস্তোরাঁর রুফ ফুল, ওপরে যেতে হলে কয়েক দিরহাম গচ্চা দিয়ে ফালতু চা বা ড্রিংক নিতে হবে, তাই সই। ভাগ্য ভালো, বৃদ্ধ এক দম্পতি দমকা হাওয়ার জন্য বিরক্ত হয়ে একটা টেবিল ছেড়ে দিলেন আর আমরাও কাঠ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় থিতু হয়ে নিচের পৃথিবী থুড়ি স্কোয়ারের দিকে নজর দিলাম।

এইবার, জামা আল ফানার স্কোয়ারটা যে ঠিক কী জিনিস, তার খানিকট আভাস আমি আগের একটা পোস্টে দিয়েছি৷ সেলিব্রেশন অফ লাইফ বলা আন্ডারস্টেটমেন্ট হয়ে যাবে। এই প্রকাণ্ড লাইভ ইভেন্ট যে প্রায় পাঁচশো (মিনিমাম) বছর ধরে প্রতিদিন হয়ে চলেছে, সেটা ভাবলেই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। জেমা আল ফনা নামটার ব্যাখাও নানাভাবে করা যায়, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না, কারণ যতগুলো মানে আমি অন্তত মনে মনে ভেবেছি, তার সবগুলোই এখানে পার্ফেক্টলি খেটে যায়৷ ফনা নামটার সঙ্গে কোথাও গিয়ে আরবির 'আফনান' ﺍﻓﻨﺎﻥ কথাটার যোগ আছে, মানে শাখাপ্রশাখা। তা এই স্কোয়ারকে যদি বোধিবৃক্ষ বলে কল্পনা করার চেষ্টা করি, (বিশেষ মেহনত করতেও হবে না, জায়গাটার মাহাত্ম্যই এই),  তাহলে সেই বৃক্ষের 'শাখাপ্রশাখা' মানে 'শোউক'রূপী বাজারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে অনন্ত অসীমে ছড়িয়ে গেছে। আবার উর্দুতে দেখতে গেলে 'ফনা' হল too perish, বা আরো ভালো করে বোঝাতে হলে 'মরণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া', হিন্দিতে যাকে বলে  'নিয়োছাওয়ার কর দেনা'; (ইশক মে ফনা হো জানা শুনেছেন তো? ওই) আবার 'ফন' হল আর্ট, ফনকার মানে আর্টিস্ট... এদিকে জেমা অল ফনা আবার হাজার বছর ধরে আর্টিস্টদের তীর্থস্থান। 'ফিনা' বলেও একখান কথা আছে শুনলাম, মানে আরবিতে ওপেন স্পেস। জেমা মানে আবার দেখা যাচ্ছে, congregation, কিন্তু মসজিদ বা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক স্থলের জন্যও শব্দটা ব্যবহার হয়। তাহলে কী দাঁড়াল? সব কেমন খাপেখাপ মিলে যাচ্ছে না! 

এমন কি বলা যেতে পারে না, যে জেমা আল ফানা এমন একটা স্প্রিচুয়াল ওপেন স্পেস, স্পেসটাইমের এই অদ্ভুত জায়গার সম্মোহন ফন আর ফনকার, মানে আর্টিস্ট ও তাদের আর্টকে সম্মোহন করে, তাদের নিজের সেরা দিয়ে এই স্প্রিচুয়াল আপহিভালের জন্য 'ফনা' হয়ে যেতে এনকারেজ করে, উদ্বুদ্ধ করে। যদি তা না হত, তাহলে কেন ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও চোদ্দ ঘণ্টা হেনা আর্টিস্টরা লোকদের ডেকে যায়, সাপ আর বাঁদরখেলার মতো আদ্যিকালের বোকাসোকা অ্যানিমাল ক্রুয়েল্টি সম্পৃক্ত খেলার রেওয়াজ এখনও বর্তমান, কেন অনবরত কুড়িরকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলে বাদ্যকররা, যে সব বাজনা এখন পাওয়াই যায় না, কেনই বা ইংরেজি আর ফরাসীভাষী টুরিস্টদের সামনে এখনও স্ট্রিট আর্ট আর হিকায়তদের আসর বসে? বেদুইনদের মতো সাজগোজ করে মাঝবয়সী মানুষগুলো নেচে নেচে লোক জড় করে? প্রতিদিন। অক্লান্ত, অবিরাম। নো সেমিকলন, নো কমা, নো দাঁড়ি। আর এই এত এত ফনকার, এই হাজার বছর প্রাচীন শিল্প আর তাদের স্রষ্টাদের এই যাপন শুধুই উপার্জনের জন্য নয়, এই পারফর্ম্যান্সের, এই এক্সিস্টেন্সিয়ান আর্টিসস্টির আবহমান উপস্থাপনার মধ্যে একটা মারাত্মক তীব্রতা আছে, একটা নেশা আছে, যা এখানে না এলে, দীর্ঘক্ষণ ধরে চাক্ষুষ ব্যাপারটা না দেখলে, বোঝা সম্ভবও নয়। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই ব্যাপারটা বুঝতে চায়, তাহলে তার সেরা সময় হল 'ঘুরুব', উর্দুতে বলে ঘুরুব এ আফতাব, মানে...  সূর্যাস্ত। ওই যে বলছিলাম, সানসেটের একটা নিজস্ব সিম্ফনি আছে। আমরা বুঝি না বুঝি, বিশ্বচরাচর সেটা ঠিকই বোঝে। সেই সময়টায়, সানসেট সিম্ফনির তালের হাইনোটের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জামা আল ফানা যেভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তাতে অভিজ্ঞতাটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, যা সত্যিই অতিমানবিক, অতীন্দ্রিয়। গোটা এক ঘণ্টা ধরে, সূর্যের পড়ন্ত আলো কমতে কমতে অন্ধকার হয়ে আসা আর বিজলি বাতি জ্বলে ওঠার পাশপাশি আকাশের রঙ বদলে যাওয়া, আর মসজিদ শৌক মাদিনার পটভূমিতে যে জিনিসটার সাক্ষী হয়ে রইলাম, সেটা শুধুই লক্ষাধিক মানুষের ভিড় নয়, শুধুই কসমিক এক্সিস্টেন্সের অন্তহীন বিলাপ বা উচ্ছ্বাস নয়, শুধুই একটা 'সানসেট মোমেন্ট' নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি। এর চেয়ে বেশি বোঝানো সম্ভবও নয়।

ফেজ। কাসাব্লাঙ্কা, মহমেদিয়া, রাবাত হয়ে ট্রেনে করে এখানে আসা। মারাকেশ থেকে ফেজে আসলে অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, কারণ মদিনার সেই গোলকধাঁধা থেকে শুরু করে ফেজে মারাকেশের প্রায় সব কিছুই আছে, মারাকেশ থেকে ফেজ অনেক বড়, দুনিয়ায় বৃহত্তম আরবান কার ফ্রি জোন, পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে এখানের আবহাওয়া অনেকটা মোলায়েম, শহরটা পরিচ্ছন্নও বেশি, এখানকার মদিনার অবস্থানও তুলনামূলক ভাবে বেশি উচ্চতায়, গোটা শহরটাই টিপটপ, পাম গাছের সারি দিয়ে সজ্জিত চওড়া রাজপথ আছে, ওদিকে মদিনার ভিতরে সঙ্কীর্ণ গলিপথগুলো খাড়াই বা উতরাই বেয়ে এগিয়ে গিয়েছে, 

কিন্তু... মারাকেশের সেই অতিরিক্ত এনার্জি আর জেমা আল ফানার উন্মাদনা এখানে নেই। গ্রাহকদের বিক্রেতারা সাধাসাধি করে খানিক, কিন্তু লাফালাফি করে না। অনেকে তো পাত্তাও দেয় না, তারা নিজের কাজ করতেই ব্যস্ত।

তবে তাই বলে এই শহরটাকে হেয় করার কোনও কারণ নেই, কারণ ফেজ সব অভাব পুষিয়ে দিয়েছে তার ইন্টেলেক্টুয়াল হেরিটেজ দিয়ে। ফেজ ইসলামিক আর্কিটেকচার এর তীর্থস্থান, এখানের অলিগলিতে হুটহাট এমন সব অভাবনীয় স্থাপত্য আর শিল্পকলার নমুনা চোখে পড়ে যে চোখ কপালে উঠে যায়। 

প্রায় পনেরো'শ বছর আগে এখানে প্রথম এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল, তারপর থেকে ফেজ চিরকালই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হয়ে থেকেছে। আব্দেল্লাতিফ লাব্বি থেকে মোহাম্মদ বেনিস, আল্লাল আল ফাসসি থেকে ফাতিমা বোহারকার মতো ফেজের কবি আর লেখকরা তো আছেনই, টেনেসি উইলিয়ামস থেকে এডিথ হোয়ার্টন অব্দি অনেকেই এই শহরে ফিরে ফিরে এসেছেন। ২০১১ সাল থেকে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ডস পোয়েটস ফর চেঞ্জ বলে একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় ফেজে, সেখানে অন্যান্য দেশের সাহিত্যিকরাও আসেন। ফেজের গলিতে গলিতে অসামান্য সব আর্টের ছড়াছড়ি, সে সূক্ষ্ম মোজায়েকের কাজ করা ফাউন্টেন হোক বা সাইকেডেলিক আর্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা আধুনিক শহরের পেইন্টিং। কিন্তু এই সমস্ত শিল্পের ঊর্ধ্বেও একটা শিল্প আছে আল্লাহতালার, যা বোঝা যায় ঠিক সূর্যাস্তের সময়েই। মাদিনার গেট থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের রাস্তায় উঠে গিয়ে অনেকটা ওপরে গিয়ে একটা কবরখানা, পাথরের ভাঙা তোরণ আর স্থাপত্য দিল্লির কথা মনে করিয়ে দেয়, সেখানে দাঁড়িয়ে গোধুলিবেলায় যখন এই সীমাহীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের চলমান ছবির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, অ্যাটলাস পর্বতশ্রেণীর আড়ালে যখন সূর্যের শেষ রশ্মি মিলিয়ে যায় আর আকাশরেখায় অদ্ভুত রঙের ছায়াখেলা শুরু হয়, তখন অনুভব করি, একেকটা শহরের বুকে আলাদিনের চিরাগের মতো কত জাদু, কত কবিতা লুকিয়ে থাকে! সাধেই কি লাব্বি ফেজকে কবিতার গাছ বলে তুলনা করেছেন...

Some say it's a question of public interest, 

but I say it's a question of memory. 

From time to time, 

the memory of men reaches saturation point, when they offload the heavy weight of the past and make room to prepare for the beloved new.

These days, 

old species aren't fashionable. 

They have invented trees that grow quickly and make do with only water and sunshine, 

and who go about being trees both quietly and soullessly.

I am the poem tree. 

They have tried to manipulate me, 

but their efforts came to naught; I'm intractable, the master of my own mutations...

মরক্কো ছাড়ার আগে যে শহরে সূর্যাস্ত দেখলাম, তার কথা বলার আগে একটা নিজস্ব রিয়ালাইজেশনের কথা জানাই। এই উপলব্ধি আমার নিজের, তাই বাকিদের কথা বলতে পারব না। 

বছর কয়েক ধরে ইন্সটাগ্রামে ভালো ভালো জায়গার ছবি দেওয়ার চল শুরু হয়েছে, সে ব্যাপারটা আমার নিজের পছন্দ হোক না হোক সে অন্য কথা, কিন্তু তাতে অনেকেই লাভবান হয়েছে। লোকজন মালদীব থেকে মাচুপিচু, সব জায়গায় গিয়ে ছবি তুলছেন, ফোটোশপ করছেন আর অন্যদের লোভ দেখাচ্ছেন। এইবার, এই ব্যাপারটা কাউন্টার করতে দেখছি অনেকেই ইন্সটাগ্রাম ভার্সেস রিয়ালিটি বলে কতগুলো রিল করে, তাতে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে আসলে যে জায়গাগুলো ইন্সটাতে এডিট করে সুন্দর দেখানোর চেষ্টা করা হয়, সেগুলো নিতান্তউ সাধারণ জায়গা, মোটেও অত সুন্দর না! খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, ব্যাপারটা আঙুর ফল টক ছাড়া কিছুই নয়। হ্যাঁ, দশটার মধ্যে দুটো ছবি হয়তো এমনটা করে থাকতেই পারে, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, কিন্তু সার্বিকভাবে, ইন্সটাগ্রামে যে শহর বা দৃশ্য দেখে অসামান্য সুন্দর মনে হয়, চোখের সামনে সেই সমস্ত জায়গা এলে মনে হয়, ইন্সটাগ্রাম কোন ছার? জায়গাগুলো আসলে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সুন্দর।

কথাটা উল্লেখ করতে হল, কারণ মরক্কোর চেফচাউয়েন এর কথা ইন্সটাগ্রামের সুবাদে এখন সারা দুনিয়ার লোক জানে, মরক্কোর এই নীল শহরে গিয়ে কায়দা করে ছবি তোলাচ্ছেন অনেকেই, কিন্তু জায়গাটার অবস্থান এবং সামগ্রিক সৌন্দর্য যে ঠিক কেমন, ঠিক কতটা সুন্দর, এত এত ছবি দেখেও আমার সেই সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। উত্তর মরক্কোর ল্যান্ডস্কেপ যে এমন সতেজ সবুজ এবং আলপ্সের সঙ্গে অনায়াসে তার তুলনা করা যায়, ফেজ থেকে চেফচাউয়েনের ঘন্টা পাঁচেকের বাস যাত্রা না করলে আমি জানতেও পারতাম না। এখানকার ভূদৃশ্য চমৎকার, একের পর এক বুনিয়াল, পুষ্পবতী গাছ, গ্লেশিয়াল লেক না হলেও স্বচ্ছ জলের অসংখ্য পাহাড়ি হ্রদ চোখে পড়ে। চেফচাউয়েন শহরটা আসলে পুরোপুরি হিল স্টেশন, প্রথমবার বাস হেয়ারপিন বেন্ড নেওয়ার পর শহরটা চোখে পড়ে যখন, সত্যিই বিশ্বাস হয় না পাহাড়ের আড়ালে এমন একটা রূপকথার রাজ্য লুকিয়ে আছে। 

যাই হোক, নীল সাদা রঙে ডুব মেরে বসে থাকা এই ছোট্ট গ্রামটা ঠিক কেমন দেখতে, সে নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করব না। এইটুকু অবশ্য জানানো যায় যে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মারিজুয়ানার চাষ হয়, (যদিও ব্যাতিক্রম কাউকে বিশেষ জয়েন্ট ফুঁকতে দেখলাম না), শহরে যত না মানুষ, তার চেয়ে বেশি বেড়ালের রাজত্ব, চতুর্দিকে গড়াগড়ি খেতে থাকা অজস্র কমলালেবু আর এই গ্রামের ইতিহাস আর স্থাপত্যের সঙ্গে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, বের্বের সহ আরো অনেক গোষ্ঠীর গল্প জড়িয়ে আছে। 

মরক্কোতে আমাদের শেষ সানসেট কাটল এই গ্রামেই। আসলে গ্রামে নয়, বরং সেখান থেকে একটা ঝরনা পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় অনেকটা উঠে গিয়ে একটা স্প্যানিশ মসজিদ কাম ভিউপয়েন্টে, চতুর্দিকে ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড়ের সারি, আর সবুজ ঘাসের বন ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। সেই ঘাসের জমিতে শুয়েবসে আছে অনেকেই, আর সেখান থেকে চেফচাউয়েনের নীল সাদা গ্রামটা হ্যামলেটের মতোই দেখতে লাগছে। সূর্য প্রায় মধ্যগগনে, যখন আমরা সেই ঘাসের ওপর গিয়ে বসেছি। এরপর কয়েক যুগ ধরে সূর্যাস্ত এর পালা চলল, প্রকৃতির মঞ্চে আলোর খেলা সম্পন্ন হল। আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম, আর কীই বা করার আছে?

নীল গোলাপি বেগুনি রঙের আভা যখন ক্রমে অন্ধকারের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আর নীল গ্রামে একটা একটা করে সাদা হলুদ আলো জ্বলে উঠছে, এমন সময় আচমকা, আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে, স্প্যানিশ মস্ক থেকে ভেসে এল আজানের সুর, আর যেন তার সঙ্গে সঙ্গত করতেই গ্রামের বিভিন্ন মসজিদ থেকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই একই ঈশ্বরবন্দনা, সেই একই আজান... সেই ঐশ্বরিক মুহুর্তে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা একদল মানুষের ক্যামেরা স্তব্ধ হয়ে গেল, লক্ষ করলাম অনেকে ফোন নামিয়ে রাখল, কেউ কেউ হাত ভাঁজ করে বুক স্পর্শ করল, কেউ চোখ বন্ধ করল, আকাশে রঙের আলপনা আর আঁধারময় বেগুনি আলোর আমেজ জুড়ে একটা  নীল আলো খেলে গেল, কোনো এক মসজিদ থেকে ফেলা ফ্লাডলাইট এর আলো... আজানের সুর আরস ফনা হয়ে যাওয়া দিনের আলো একে অপরের সঙ্গে মিশে এক নিজস্ব সিম্ফনি তৈরি করেছে... এই অপরূপ মুহুর্তের কোনও বর্ণনা করা যায় না... আর তখুনিই, ঠিক সেই মুহুর্তে, আমি আচমকা এক মুহুর্তের জন্য অনুভব করতে পারলাম, আমি হয়তো আজও পুরোপুরি নাস্তিক হতে পারিনি।
























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন