শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

মরক্কো সফর-(২) সাহারায় শিহরন

 

গত তিন দিন ধরে পৃথিবীর যে সমস্ত বিস্ময়কে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে, কাকতালীয় ভাবে সেই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটল ইন্টারন্যাশনাল আর্থ ডে- র দিন, সাহারা মরুভূমির দশতলা উঁচু বালির পাহাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখে। খুচরো কিছু অভিজ্ঞতা তখনও বাকি ছিল, কিন্তু কোনোটা নিয়েই খুব বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ সত্যি বলতে, গোটা অভিজ্ঞতাটাকে বোঝানোর জন্য এই দু লাইনের কথোপকথনটাই যথেষ্ট...
"তোল তোল! আরে তোল ছবিটা!"
"ধুরছাই! ছবিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।"
(রিপিট)
যাকগে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি, বছর যেভাবে ঘুরছে, কিছু কিছু না লিখে রাখলে পরে আবছা একটা স্মৃতিচিত্র ছাড়া কিছুই মনে থাকে না, অনেক কিছুই হাওয়া হয়ে যায়, তাই পোস্টটা করে রাখাই সঙ্গত।
সাহারা মরুভূমি নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন নতুন কিছু নয়, প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই গ্রেট ডিজার্ট নিয়ে অসংখ্য বইপত্র আছে, সিনেমা তথ্যচিত্র কিছুরই কমতি নেই। অনেকে সাহারা বলতেই উটের কারাভান আর অনন্ত বালির সমুদ্র দেখতে পান কল্পচক্ষুতে। তবে সাহারা নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশনের কারণ কিঞ্চিৎ আলাদা। লরেন্স অফ আরাবিয়া বা শঙ্কুর মরুরহস্য নয়, আমি আদতে সাহারা নিয়ে উৎসাহী হয়েছিলাম এক জলজ্যান্ত মানুষের জন্য, যাঁর নাম স্টিফেন ক্রোপলিন।
'ম্যান অফ দ্য সাহারা' বলে খ্যাত এই ক্লাইমেট রিসার্চার আর জিওলজিস্ট সাহারা মরুভূমি নিয়ে যত গবেষণা করেছেন, পৃথিবীতে কেউ করেনি। ভদ্রলোক ফিল্ড রিসার্চ এর উদ্দেশ্যে প্রায় আশিটার ওপর অভিযান করেছেন সাহারার প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে গিয়ে, বালির স্তরের নিচে সেডিমেন্ট ডেপোজিশন নিয়ে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে চাঞ্চল্যকর সব আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু বিজ্ঞানী বাদেও তাঁর অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি কিছু কম নয়। ১৯৮২ সালে গিল্ফ কেবির অঞ্চলে একা পাড়ি দিয়েছিলেন স্টিফেন, সেখানে গিয়েই বালির ঝড়ের কবলে পড়েন, তাপমাত্রা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কমে যায়, স্লিপিং ব্যাগে ঢুকেও ঠকঠক করে কাঁপছেন, এদিকে বাইরে গর্জন করে স্যান্ডস্টর্ম চলছে। তাঁকে নিতে যে প্লেন আসার কথা ছিল, সেই প্লেনের পাত্তা নেই। দু একদিন পর মরিয়া হয়ে স্টিফেন হাঁটতে শুরু করেন। কয়েকদিন পর, প্রায় একশো কিলোমিটার পথ ট্রেক করে মরোমরো অবস্থায় একটা মরুদ্যানে এসে পৌঁছান তিনি। কেরিয়ারের প্রথমেই এমন একটা ধাক্কা খেলে অন্য কেউ কোলন ইউনিভার্সিটির শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে অন্যদের রিসার্চ ডেটা নিয়েই জীবন কাটাতেন হয়তো, কিন্তু স্টিফেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি রোড লেস ট্রাভেল্ড বেছে নিতে দু'বার ভাবেননি।
চল্লিশ বছর ধরে অভিযান করতে গিয়ে কখনও মরুদস্যুদের হাতে পড়েছেন, কখনও অজানা রোগের কবলে পড়ে মরতে মরতে বেঁচেছেন, কখনও বা সপ্তাহব্যাপী মরুঝড়ের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। নর্থ আফ্রিকা জুড়ে তাঁর এইসব অভিযানের গল্প নেচার পত্রিকা আর ন্যাট জিওতে বেরোত, (অন্যন্য জায়গা যেমন তিব্বত বা আমাজনের অভিযানের কথাও থাকত) সেই সব পড়ে আমি মাথাটা খারাপ করেছিলাম। সাহারা শুনে যে শিহরন জাগে আমার মনে, তার জন্য জটায়ু বা প্রখর রুদ্র নয়, এই ষাটোর্ধ্ব জিওলজিস্টই সবচেয়ে দায়ী।
কেন জানি মনে হয়, নতুন প্রজন্মের সিংহভাগ ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তি নিয়ে জানতে যতটা উৎসাহী আর উদ্যোগী, এআই বা আইফোন নিয়ে যত স্বচ্ছন্দ, দেশ দুনিয়ার অজানা জায়গা বা এক্সপিডিশন নিয়ে তাদের আগ্রহ ততোটাই কম। মানে, আমাদের তুলনা টেনেই বলছি। আমি তো ছোটবেলা থেকে এই স্বপ্নই দেখে আসছি কবে আমাজন যাব? কবে আল্পসের অমুক গুহায় যাব? কবে টিটিকাকা হ্রদে যাব? এখন বিশেষ কাউকে সেই সব স্বপ্ন দেখতে দেখি না, সবাই নতুন ফোন পেলেই সব দুঃখ ভুলে যায়। ভুলও হতে পারে। যাকগে!
মারাকেশ থেকে সাহারা যাওয়া এখন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, যদিও সাতদিন বা পাঁচদিনের কোর সাহারা কারাভান ট্রিপ এখন আর কেউই করে না, বিজ্ঞানী বা ফিল্মমেকারদের ছাড়া, কারণ মরুদস্যুদের হামলার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে গেছিল মাঝে। তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ সাহারা বলতে তো শুধুই আদিগন্ত স্যান্ড ডিউন্স নয়, (যদিও সেটাই সবচেয়ে বেশি) সাহারা সংলগ্ন মফস্বল আর টাউনগুলোয় নর্থ আফ্রিকার প্রায় কুড়ি লক্ষ লোকের বাস, তাদের ইতিহাস সংস্কৃতি জীবনযাত্রা.. সে সব সাহারারই অংশ। এই জনজাতির কিছু কিছু আজও নোমাড লাইফ কাটাচ্ছেন, তবে অনেকেই কিঞ্চিত আধুনিকতার দিকে ঝুঁকেছে, তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করে টুরিজম শুরু হয়েছে আলজিরিয়া বা মরক্কোর কিছু এলাকায়। তবে স্থানীয় গাইডের কাছে জানলাম, এখনও ভবঘুরে জাতির অনেকেই আছে, তারা লোকালয় থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসে।
যাই হোক, মরক্কোর সাউথ ইস্ট অঞ্চলে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, অ্যাটলাস মাউন্টেন আর ড্রা ভ্যালি পেরিয়ে, দাদেস আর টোডার গর্জ অতিক্রম করে আমরা সাহারার মধ্যভাগে প্রবেশ করব, যেখানে বালির সমুদ্র আর দিগন্তবিস্তারিত স্যান্ডডিউন্স চলে গেছে কয়েকশো মাইল, আর কোথাও কিস্যু নেই। আর আগেই বলেছি, এই অঞ্চলের ভূদৃশ্য এতটাই ইউনিক, এতটাই অদ্ভুত...যে চাক্ষুষ না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
মরক্কোকে অনায়াসে লাল মাটির দেশ বলা চলে, যদিও মাটির জায়গায় পাথর বললে বেশি 'অ্যাপ্ট' হবে। আর সেই লালেরও রকমফের আছে। কোথাও পাটকিলে লাল, কোথাও খয়ের রঙের লাল, কোথাও আবার জং ধরা শুকনো ছুরির মতো। মাঝে মাঝে লালের সঙ্গে সবুজ, গোলাপি আর বেইজও মিশে যায়, চকমকি ধাতব কণা রোদ পড়ে ঝলসে ওঠে, পাশাপাশি চোখে পড়ে সবুজ পাথরের সারি। হ্যাঁ, সবুজই। পাথরের সঙ্গে ধাতুর কণা মিশে থাকে বলে যে পাহাড়ের রঙ পাল্টে যায়, সে কথা আর্জেন্টিনার সাল্টা আর পেরুতে গিয়েই জানা হয়েছিল। এই যাত্রাতেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটল, রঙের পর রঙ, ফুলে ফুলে নয়, পাথরে পাথরে বসন্ত লেগেছে।অধিকাংশ সময় ধরে অ্যাটলাস পর্বতশৃঙ্খলা তার রংমিলান্তি ম্যাজিক দেখিয়ে গেল। মাঝে মাঝে সুগভীর গিরিখাত, প্রায় শুকিয়ে আসা নদী, আবার সবুজের প্রলেপও যে একেবারে চোখে পড়ে না, তাও নয়। অনেকগুলো নদীর স্রোত এই পাহাড়, সেই নদীগুলোর খাতে উপত্যকা গড়ে উঠেছে, অলিভ আর আমন্ডের পাশাপাশি মরসুমি ফলের চাষও হয়। যে কথা বলছিলাম, আলজিরিয়া, টিউনিসিয়া আর মরক্কো জুড়ে বিরাজ করছেন মহামান্য অ্যাটলাস সম্রাট, না'হলে সাহারা মরুভূমিকে ভূমধ্য সাগর থেকে শুরু হয়ে সোজা অ্যাটলান্টিক ওশান অব্দি ছড়িয়ে যেত।
মারাকেশ থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার ঘণ্টা পাঁচেক পর প্রথম বোঝা গেল, সময়ে অনেকটা পিছিয়ে এসেছি। আধুনিকতার জোয়ার এসেছে, ফলে কাফে রেস্তোরাঁ আছে, মাখন মোলায়েম অ্যাশফল্ট রোড আছে, তবে জালেবিয়া আর তুয়ারেগ স্কার্ফ পরিহিত যুবকরাও আছেন, মেষপালক বেদুইন আর উট নিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধও চোখে পড়ে। এই অঞ্চল এককালে ট্রান্স সাহারান কারাভান রুটের অন্যতম পথ ছিল, বের্বের গোষ্ঠীর বিভিন্ন ডিনাস্টির আঞ্চলিক ইতিহাস এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি এখানে, কারণ মরক্কোয় বের্বের ভাষার চলন আজও ভালোরকম আছে।
আইট বেনহাদাউ (Aït Benhaddou) আসতে আসতে সন্দেহ থাকে না, আমাদের কানে শুনতে Berber 'বর্বর' থুড়ি অসভ্যের মতো লাগলেও তাঁদের এলেম বড় কম ছিল না, উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় এই গোষ্ঠীর মানুষ ক্ষার (khar) নির্মাণ করেছিল, যা আসলে এক ধরনের ফোর্টিফাইড ভিলেজ, মানে একটা গোটা গ্রামের মানুষের বাসস্থান আর ব্যবসাপত্তর সোশালাইজিং এর জন্য একটা দুর্গজাতীয় কেল্লা (দূর থেকে দেখলে তামাং বা স্পিতির মনাস্টেরির কথা মনে পড়বে) কিন্তু আবার একইসঙ্গে স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শনও বটে। মোনোলিথিক স্ট্রাকচার, একটা দেয়াল দিয়েই গোটা জায়গাটা বানানো হয়েছে বলা যায়, কিন্তু একটা গ্রামের সঙ্গে পার্থক্য বিশেষ নেই। ওইনিলা নদী বয়ে গেছে পাশ দিয়ে, যদিও বেশিরভাগ সময় এখানে জল থাকে না। Aït Benhaddou এর এই ক্ষার ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তো বটেই, সিনেমা সিরিজের জগতেও অসম্ভব জনপ্রিয়। লরেন্স অফ আরাবিয়া থেকে গ্ল্যাডিয়েটর বা গেম অফ থ্রোনস (খালিসি যে বর্বর রাজাকে মেরে তাদের লোকদের লিবারেট করেছিল), কয়েকদিন আগে গ্ল্যাডিয়েটর ২ এর শুটিংও হয়েছে৷ জায়গাটা দেখে প্রথমে বিশ্বাস হয় না যে এত বড় আর উঁচু একটা 'কাসবা' শুধুই কাঠ, ইট, পাথর আর কাদামাটি শুকিয়ে তৈরি হয়েছে, তাও হাজার বছর আগে। এই ক্ষারে এখনও কিছু ঘর মানুষ বাস করে, হ্যান্ডিক্রাফট বানায়, ছবি আঁকে। ন্যাচারাল কালার দিয়ে ছবি এঁকে আগুনের তাপে ধরলে সেই ছবিতে রঙ ধরে, সচক্ষে দেখলাম। ইনসুলেশনের ব্যবস্থা ভালোই, তবে বিজলিবাতি নেই, জল সাপ্লাই করা হয় নবনির্মিত গ্রাম থেকে পাইপে করে। এখন না হলেও এককালে ট্রান্স সাহারা ট্রেড রুটে এই ক্ষারের স্ট্রাটেজিক লোকেশন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অন্যান্য কাসবার লোকজনের সঙ্গে যুদ্ধও হয়েছে বহুবার। ড্রা উপত্যকাতে এরকম বেশ কিছু বের্বের কাসবা আছে, তাই এখানকার নাম দেওয়া হয়েছে ল্যান্ড অফ থাউজ্যান্ডস কাসবাস।
এই পথ ধরে এগোলে পাহাড়ের রক ফর্মেশনগুলো উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলাতে থাকে। কিন্তু দাদেস নদী সংলগ্ন দাদেস উপত্যকা আসতে আসতে এই বদলগুলো এতটাই চোখ ধাঁধানো হয়ে যায় যে দমবন্ধ করে চেয়ে থাকতে হয়। একের পর এক হেয়ারপিন বেন্ড, রাস্তা ক্রমে ঘুরে ঘুরে উঠছে, নীচে দেখা যাচ্ছে অলিভ বা ল্যাভেন্ডারের ক্ষেত, গোলাপ বাগান, দাদেস নদীর লাগোয়া গ্রাম, দু দশ ঘর ইট রঙের বাড়ি, লালচে দেওয়ালে পড়ন্ত বিকেলের আলো পড়ে আরো লাল মনে হয়। আর তার সঙ্গে অসামান্য সব রক ফর্মেশন তো আছেই। এই দাদেস নদী অ্যাটলাস পর্বতশ্রেণী থেকে শুরু হয়ে প্রায় দুশ মাইলেরও বেশি পথ অতিক্রম করে সাহারায় গিয়ে ড্রা নদীতে মিলেছে, এমনিতে শুকনো খাত থাকলেও মাঝেমধ্যে ঋতুবদলের সময় নদীতে হড়কা বান ডাকে, তখন পাহাড়ের নরম সেডিমেন্টারি পাথরগুলোকে কেটে এগিয়ে যায় জল। এককালে নাকি গোটা অঞ্চলটাই সমুদ্রের নিচে ছিল, কোরাল রিফ আর সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল এখনও পাওয়া যায়, টেকটনিক শিফট না হলে হয়তো এই পাহাড় বা গর্জ থাকত না, সাহারাও মরুভূমি হত না।
যাই হোক, দাদেস ভ্যালির সবচেয়ে চোখ ছানাবড়া করা রাস্তা শুরু হয়, যেখানে রোড অফ থাউজ্যান্ড কাসবা মানে হাইওয়ে আর-৪৭০ দাদেস নদীটাকে ক্রস করে চরকি পাক দিতে দিতে বৌমালনে দাদেস এর ছোট্ট সাজানো শহরকে পাশ কাটিয়ে উপত্যকার আরো বন্য গভীরতার দিকে অগ্রসর হয়। সে কি রঙ!কোথাও ট্যান কালার, কোথাও রাস্ট রেড, কোথাও আবার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সব আকৃতি, অসংখ্য ভিউপয়েন্ট, বুটিক কাফে! বাঁদরের আঙুলের মতো দেখতে সব পাহাড়, (মাংকিহ ফিঙ্গার বলে একটা ভিউপয়েন্টও আছে) মাঝে মাঝে ১৬০০ ফুট উচ্চতা এক একেকটা খাড়াইয়ের। এই অঞ্চলে এসে একটা মাঝারি জায়গায় রাত কাটানো হল। বের্বেররা আমুদে লোক, রোজ গানবাজনা করা তাদের বাঁধা। জিম্বে ফিম্বে নিয়ে একদম জমাটি আসর বসিয়ে দিল।আমি ব্যাজার মুখে বসে ভাবছিলাম এইসব নাটক করে হয়তো টুরিস্টদের কাছে টিপ চাইবে, কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই বোঝা গেল, আন্দাজ ভুল। আসর একবার জমে গেলে এরা প্রায় ট্রান্সে চলে যায়, ড্রামরোলের বিট এর তীব্রতা বাড়ে, গানের স্বর তীব্র হয়, বাজিয়েদের চোখ ঝলসে ওঠে অনাবিল উত্তেজনায়।
দাদেস উপত্যকা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে শুরু হয়েছে তোদরা উপত্যকা। বের্বের উচ্চারণে নামটা চ দিয়েই বলে, কিন্তু সেটা অ্যারাবিক কীভাবে উচ্চারণ করে জানি না। গতিপ্রকৃতি প্রায় একই, কিন্তু তোদরা নদীর গিরিখাত প্রায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো, নদী সংকীর্ণ লাইমস্টোন রিভার ক্যানিয়ন এর আকার নিয়েছে, তাছাড়া অঞ্চলটা রক ক্লাইম্বিং এর জন্য আদর্শ।
আগে তিনেরহীর আর তামাতাতাউচের মতো টাউনগুলো প্রায় ভুতুড়ে গ্রাম ছিল, এখন সে সব বোঝার উপায় নেই। বাইকাররা মোটমাট বোঝাই করে আসছে, ক্যাম্প করছে বেদুইন নোমাদদের গ্রামে, তারপর এগিয়ে যাচ্ছে সাহারার দিকে। দুশটারও বেশি ক্লাইম্বিং রুট খোঁজা হয়েছে, অনেক জায়গায় লক্ষ করলাম পিটন লাগানোই আছে, গ্রিপ করার জায়গাএ অভাব নেই, শক্ত পাথর, অ্যাঙ্কর করে বা ফিক্সড রোপ লাগিয়ে দিলেই হল! তিনেরহীরে অনেকটা সময় কাটানো হল বের্বের কার্পেটমেকারদের সঙ্গে, মিন্ট দেওয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প হল, ক্যাকটাসের সুতো আর ভেড়ার লোম দিয়ে হাতে তৈরি এক একটা কার্পেট দেখে মুগ্ধ হতে হয়, যদিও দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। লক্ষাধিক টাকার এই জিনিস অবশ্য পরে থাকে না, সবই উঠে যায় শুনলাম। এই অঞ্চলের কৃষকরা নাকি এখনও আদ্যিকালের গোষ্ঠীর নিয়ম মেনেই চাষবাস করছে, আবার একইসঙ্গে গড়গড়িয়ে আরবী ফারসী ইতালিয়ান স্প্যানিশ বলতেও কসুর করছে না। একদিকে ল্যাভেন্ডার গাছের পাতা ছিঁড়ে শেয়াল বা জাহাজ বা পাখি বানাচ্ছে, অন্যদিকে মস্ত তুয়ারেগ পাগড়ির সঙ্গে স্পোর্টস শু পরছে। এরম দেখলে একটু বোকা বনে যেতে হয় বইকি!
তোদরা ভ্যালির ছেড়ে এগোতে বোঝা গেল, ব্যাপ্তি কাকে বলে? বিশাল এক মরুভূমি যে এগিয়ে আসছে, সেই স্থানমাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য প্রকৃতি সব ব্যবস্থাই করেছে। দু দিকে অসীম খোলা প্রান্তর, কালো কাঁকর আর বালি ছাড়া কিচ্ছু নেই, মাঝখান দিয়ে একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে। গরম ক্রমে বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জঙলি ঝোপ, খেজুরের ঝাড়। দিগন্ত কথাটা আকছার ব্যবহার করি বলে বোঝা যায় না, দিগন্ত ঠিক কতদূর? এই টেরেনটা আমাকে কান ধরে বিষয়টা বোঝাল। যেদিকেই তাকাও, শ খানেক কিলোমিটারের ভিসিবিলিটি থাকবে। এমন অদ্ভুত জায়গায় কোনোদিন যাইনি, সবাই চুপ মেরে গেছে, চোখ ছানাবড়া করে প্রকৃতির ম্যাজিক দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। বালি মাটি কাঁকর, বালি মাটি কাঁকড়, সেই বালি মসৃণ রাস্তাতেও রাজত্ব বিস্তার করছে এইবার। দুদিকে ছাড়া ছাড়া শুকনো ঝোপ, ক্যাকটাস। কতরকম খেজুর গাছও যে দেখলাম। কতগুলো তো এতটাই বেঁটে যে দাঁড়িয়ে খেজুর পেড়ে খাওয়া যাবে। ঘন্টা দুয়েক টানা ড্রাইভ করলেও একটা গ্রাম নেই, সব ভোঁ ভাঁ। কেউ কেউ সাইকিল চালিয়ে যাচ্ছে, উটের পাল আর ভেড়ার দল রাস্তা ক্রস করছে। চারিদিকে একটা প্রাচীন, বুনো ভাব। এর মধ্যে মানবনির্মিত এই রাস্তাটাই বরং বেমানান লাগে। কিন্তু মানুষ বলে কথা, তাই এহেন জায়গাতেও দু চারখান প্রাসাদ সরিখা রিসর্ট আছে, একদম বালি আর মাটি দিয়ে তৈরি শহর মনে হয়। এমন সময় দূরে দেখা গেল, পাহাড়। সোনালি বালির পাহাড়। স্যান্ডইউন্স কথাটা তো আর নতুন কিছু নয়, বালি আর মরুভূমিও অদেখা জিনিস নয়, কিন্তু সেই প্রকাণ্ড বালির সাম্রাজ্য চোখে পড়তেই টপ টপ করে চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। হ্যাঁ, সাহারায় এলে আজও কারো কারো শিহরন হয়। বাকিটা আর লেখার নয়, বলার নয়, বোঝার নয়, শুধুই অনুভবে রেখে দেওয়ার। আগ্রহীদের জন্য কিছু ছবি রেখে দিলাম।



























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন