রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪

ট্রাস্ট: এক সাহসী সেরিব্রাল উপন্যাস

 



মাঝেমাঝে এমন হয়, কোনও বিশেষ বই খুব নাম করে গেলেও সেটা পড়ার আগ্রহ হয় না। কিন্তু তারপর হুট করে একদিন সেই লেখকের কোনও কথা শুনে বা পড়ে মনে ধরে যায়, তখন ইচ্ছে করে তাঁর লেখা বইটাও পড়ে দেখতে। এমনটা সচরাচর হয় না ঠিকই।

রিসেন্টলি এটা হয়েছে হার্নান ডিয়াজের পুলিৎজার জয়ী 'ট্রাস্ট' পড়ার আগে। ডিয়াজ খাস আর্জেন্টিনার লোক, আমেরিকায় এসে ইংরেজিতে লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা টোন পুরোপুরি লাতিন আমেরিকান, তাঁর আমেরিকাকে দেখার চোখও আর চারটে মার্কিন লেখকের চেয়ে ভিন্ন। কয়েক মাস আগে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি পাঠক আর লেখকের মধ্যে যে একটা 'সেক্রেড কানেকশন' আছে বলে দাবী করা হয়, সেই কথাটাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, "I dislike the word sacred because I’m a profound atheist and I’m very much militantly against the intrusion of the sacred in literature and art. I think art is a secular space. I think art is a space of pleasure, of enjoyment, of a very strange way of learning about the world and experiencing who we are on this planet. It’s a space of doubt. The sacred has this ring of absolute certainty to it that I can’t get behind. I’m not trying to be a quibbler or anything, it’s just a word that raises all sorts of red flags for me. Sacred. I’m a profoundly profane writer. And person."

এইটুকু পড়ে যদি মনে হয় স্রেফ নাস্তিকতার কারণেই হেরনান ডিয়াজজে আমার পছন্দের তালিকায় নিয়ে এসেছি সেটা ঠিক হবে না। এই বিশেষ ইন্টারভিউটা পড়ার পর আমি ডিয়াজের নানান বক্তব্য আর আগকার সাক্ষাৎকার আর প্রতিবেদন খুঁজে খুঁজে পড়লাম। তাতে আমার মনে হয়েছে, এই সময় এমন সাহসী, স্বতন্ত্র চিন্তার, সুবিবেচক লেখক প্রায় হাতেগোনা। হেরনান ডিয়াজের বেশ কিছু কথার সঙ্গে আমার মতের মিল আছে, এমন কদাচিত ঘটে। যেমন মানব কৌলের কিছু কিছু কথা আমার মনের কথাও বটে। হিন্দওয়ীর একটা সাক্ষাৎকারে মানবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'আপনি এত প্রলিফিক রাইটার, একের পর এক লিখছেন, সব বই হিট হচ্ছে, পাঠকরা আপনার জন্য পাগল। কিন্তু সাহিত্যে একটা কথা আছে যে একটা জিনিস মাথায় এলে সেটাকে সময় দিতে হয়, নিয়ে বসে থাকতে হয়, যাতে বইটা আরো ভালো হয়! আপনি তো যখন তখন ইচ্ছে হলেই লিখতে বসে যান। যা ইচ্ছে লিখে দেন, কিছুই বাধানিষেধ মানেন না।' তাতে মানব বলেছেন, 'ভালো কথা। আমি তো এসব শুনিনি বেঁচে গেছি। কিন্তু আসল কথা হল, ভালো লিখতেই হবে কে দিব্যি দিয়েছে? আমি খারাপই লিখতে চাই। সাতসকালে উঠে কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুললাম, ব্যাকগ্রাউন্ডে ফরাসি গান হচ্ছে, আমার চার প্যারা যা মনে আসছে লিখতে আনন্দ হচ্ছে, তাই লিখছি। সিগারেট খেতে ভালো লাগছে খাচ্ছি, সেটাও লিখছি। প্রেমে পড়ছি বলে সেটা লিখতে আনন্দ হচ্ছে, তাই লিখছি। ভালো না খারাপ, তোমার মরালিটির সঙ্গে মিলছে না মিলছে না, আমার বয়ে গেছে!' হক কথা! (এবং মানব কৌলের লেখা গোল্ডমাইন বলাই ভালো, এমন খারাপ লিখে চলুন প্রার্থনা করি)

যাই হোক, ডিয়াজের মনোভাব জেনে তাঁর বইটা পড়ার ইচ্ছে হল। পড়লাম। খুব একটা সুখকর রিড বলে মনে হল না, যদিও ডিয়াজের কলম অত্যন্ত শক্তিশালী, তাঁর লেখা অসম্ভব স্মার্টও বটে। তবু উপভোগ করতে আমার বেগ পেতে হল, কারণ লেখকের প্রত্যাশাও ছিল তাই। পাঠকের সব কিছু গুলিয়ে যাবে, কম্ফোর্ট রিডের জিনিস এ নয়। প্রথমে তো, বইটা এমন একটা স্ট্রাকচার ফলো করেছে যে সব নোশন ভেঙে যাবে। তারপর বিষয়বস্তু বাচ্চাভুলানো নয়, একটা মিনিমাম সেন্স অফ হিউমান মাইন্ড অ্যান্ড এক্সিস্টেন্স না থাকলে গল্পের চরিত্রদের মনোভাব বোঝা খুব চাপের হবে। পাঠকদের সুবিধার জন্য খানিকটা বলে দিচ্ছি।

'ট্রাস্ট' চার ভাগে লেখা। প্রথম অংশ 'বন্ডস', সেখানে এক মার্কিন শেয়ার মার্কেট মিলিয়েনার ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীর গল্প চলছে। অ্যান্ড্রু আর মিল্ড্রেড, দুজনেই যাকে বলে প্রডিজি নিজ নিজ ক্ষেত্রে। কিন্তু মিলড্রেডের জীবনের শেষটা যথেষ্ট করুণ।

আপনি ভাবলেন এটাই বুঝি গল্প। সে গুড়ে বালি। দ্বিতীয় অংশ একটা মেমোয়ার বা স্মৃতিকথা যেখানে এক আমেরিকান ফিনান্সিয়ার বলছে যে কুড়ির দশকে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় সে আমেরিকার মার্কেটকে কীভাবে রক্ষা করেছে!

তৃতীয় অংশে এসে বইটা ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে। এই অংশটায় ইডা পার্টেঞ্জা বলে এক গোস্টরাইটের জীবন নিয়ে গল্প এগোচ্ছে, তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে এক আমেরিকান ফিনান্সিয়ারের স্মৃতিকথা লেখার জন্য, কারণ সেই ভদ্রলোকের ধারণা, এক অন্য লেখক তাঁর আর তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে ভুলভাল তথ্য দিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন, সেই বইটার নাম 'বন্ডস। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রথম অংশ এই বইটাই। বন্ডস। আর দ্বিতীয় অংশ যা আমরা আগেই পড়ে বসে আছি, সেই মেমোয়ারই তিন নম্বর পার্টে ইডা লিখছেন। তাঁকে এনডিএ সাইন করতে হয়েছে যে মিল্ড্রেডের জীবন নিয়ে মাথা ঘামাবে না বা তার লেখার কথা বাইরে জানাবে না কোনোদিন। তার মানে ইডার নিজের জীবনেও যথেষ্ট কম্পলিকেসি আছে, আর সেই ঘটনা চমৎকার ভাবে ধরেছেন লেখক।

চার নম্বর অংশ প্রায় পঞ্চাশ দশক পর। অ্যান্ড্রু মারা গিয়েছেন আর ইডা এখন প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। কিন্তু ইডা সারাজীবন ভেবে গিয়েছে, মিলড্রেড এর সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল? পঞ্চাশ বছর পর মিলড্রেডের ডায়েরি আবিষ্কার করে পাবলিক ডোমেনে আনা হয় আর ইডা তখন অ্যান্ড্রু আর মিলড্রেডের জীবনের গোপন অংশটুকু খুঁজে বার করবেন বলে ঠিক করেন।

হারনান ডিয়াজের এই গল্পের মধ্যে গল্পের মধ্যে গল্পের এই কাজটা যে কাল্ট হয়ে যাবে, তাতে আমার সন্দেহ নেই। পাঠক হিসেবে সকলের কাছে বইটা দশে দশ পাবে না সঙ্গত কারণেই, কিন্তু বইটা অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় নেই। আগামীতে ডিয়াজের আরো লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন