রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪

কুরকোভিয় ইউক্রেনিয়ান সাহিত্য

আন্দ্রেই কুরকোভ ইউক্রেনের লেখকদের মধ্যে একটা বিশিষ্ট জায়গা করেছেন। ভদ্রলোক প্রলিফিক রাইটার, 'ডেথ অ্যান্ড দ্য পেঙ্গুইন' আর 'গ্রে বিজ' এর মতো ফিকশন লিখে তুমুল সাড়া ফেলেছেন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর যে বইটি আগে পড়েছি, ২০১৪ সালের সেই বইটা-- ইউক্রেন ডায়েরিজ-- একটা নন ফিকশন৷ গত বছর ইউক্রেনে যুদ্ধ চলাকালীন তিনি খবরের কাগজে একটা কলামও লিখতেন, সেটা প্রায় সবটাই পড়েছি, সেইটাও মনে হয় 'ডায়েরি অফ অ্যান ইনভেশন' নামে ছাপা হয়েছে। কিন্তু সদ্য যে বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ, তার নাম দ্য সিলভার বোন। ২০১৭ সালে কুরকোভের বন্ধু তাঁকে একটা বিশাল ফাইল উপহার দেন। সেটা আর কিছুই নয়, ১৯১৭-১৯২১ সালের মাঝে উইক্রেনের কেস ফাইলের তাড়া, এতদিন কেজিবির আর্কাইভে পচছিল। সে যাই হোক, কুরকোভ দেরি না করে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে (মানে ১৯১৯-১৯২৩) দুটো হাফ মিস্ট্রি-হাফ ডিটেকটিভ ফিকশন লিখে ফেলেন, গোয়েন্দার নাম স্যামসন কোলেচকো। তার প্রথমটা 'দ্য সিলভার বোন' নামে বেরিয়েছে, দ্বিতীয়টা 'দ্য হার্ট ইজ নট মিট' নামে এই বছর অনুবাদ হয়ে আসবে। কিন্তু ভুল করবেন না, এই বইগুলো চিরাচরিত গোয়েন্দা বা রহস্য গল্প নয়, এখানে প্রেক্ষাপট আর অ্যাম্বিয়েন্সের গুরুত্ব রহস্যের চেয়ে ঢের বেশি, কিছুটা ব্ল্যাক কমেডিও আছে আর কুরকোভের সারিয়াল ট্রিটমেন্টও মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যায়।


তবে আমি এই বইটায় ডুবে যাওয়ার একমাত্র কারণ, কুরকোভের অসামান্য কলমে উঠে আসা ১৯১৯ সালের কিইভ। সময়টা ইউক্রেনের ইতিহাসে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কিইভ দখল করার জন্য সোভিয়েত ইনভেশন হবে, এদিকে কিইভে একেবারে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুরের ভাষায় ছিছালেদর অবস্থা। কোসাক দস্যুরা ঘোড়ায় চড়ে লুটপাট করছে, তরোয়াল দিয়ে যাকে পারছে কেটে ফেলছে, রেড আর্মির আধিকারিকরা বুঝতে পারছে না কী করবে? পুলিশের অর্ধেক লোক জারশাহির সময়ও ছিল, বাকিদের তুলে আনা হয়েছে মাঠঘাট থেকে। বলশেভিকদের লাফালাফি আছে, এদিকে প্রতিপক্ষদের কনফিউশান আর অ্যাগ্রেশনও কম নয়। ঝামেলায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। কাজকর্ম ডকে, ভয়ে কেউ অন্ধকার হলে রাস্তায় বেরোচ্ছে না, রেড আর্মি মারে না কোসাক মারে না এমনি ডাকাত বা সহায়সম্বলহীন চাষাভুষো এসে সব লুট করে খুব করে যায়, ভরসা কিছুই নেই। রুবেল পাওয়া যাচ্ছে না, এদিকে সোভিয়েতদের কুপন বিশেষ বিশেষ জায়গা ছাড়া কেউ নিতে চায় না। বাজারে খাদ্যশস্য কিছুই নেই। মাঝেমধ্যেই ভুলভাল চিঠি লিখিয়ে রেড আর্মির লোক সাধারণ মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ছে, যা ইচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা সময়, বইয়ের প্রথম লাইনেই স্যামসনের বাবা কোসাক দস্যুর হাতে খুন হন, তরোয়ালের ঘা খেয়ে তার নিজের দান কান কাটা পড়ে। সেই কাটা কান নিয়ে ছুটতে থাকে স্যামসন, ঢুকে পড়ে এক চোখের ডাক্টারের বাড়িতে৷ কিন্তু কান তো আর জোড়া লাগার নয়!

তবু স্যামসন কানের মায়া কাটাতে পারে না, বাবার দেরাজে রেখে দেয় সেটা। বাড়িতে সবাই মারা পড়েছে, স্যামসন একা হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছিল সে, কিন্তু চাকরি নেই। আর চাকরি পেলেও মাইনে কেউই পায় না। ভাগ্য এমন, পুলিশ তার দেরাজ কাম ডেস্কটা তুলে নিয়ে যায়৷ স্যামসন ছোটে থানায়। তাকে বলা হত, দেরাহ ফেরানো হবে না, কিন্তু ইচ্ছে হলে সে পুলিশে চাকরি করতে পারে, ওই ডেস্কটাই তার বসার জায়গা হবে। মাইনে নেই, তবে সোভিয়েত ক্যানটিনে পেট ভরে খেতে পাবে, (ব্রেড অবশ্য দেয় না তারা) বন্দুক পাবে। ক্রাইম আর অপরাধীদের আটকানোর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। ভেবেচিন্তে স্যামসন কাজটা নিয়ে নেয়। হবু স্ত্রীর সঙ্গে নিজের ভঙ্গুর জীবন আর র্যাম্পান্ট কোরাপশন আর অ্যানার্কির সঙ্গে লড়তে লড়তে স্যামসন আবিষ্কার করে, দেরাজে রাখা তার কাটা কানটা সব কিছু শুনতে পাচ্ছে, সে ঘরে থাকলেও থানার খবর চলে আসছে তার কাছে। এরপর কী হয়, সেই নিয়েই বাকি গল্প।

কুরকোভের লেখা চমৎকার। আর বরিস ড্রেলাউক অনুবাদও করেছেন দারুণ। তরতর করে বই এগোয়৷ এদিকে পাঠক পড়তে পড়তে আবিষ্কার করে, একশো বছর আগের রাশিয়াব সিভিল ওয়ার আর উইক্রেনের ইনভেশনের এই ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের মিল লক্ষ করার মতোই! এরই মাঝে একটা রহস্য আর রহস্য সমাধানও আছে, যা সরাসরি পুলিশ ফাইল থেকেই উঠে এসেছে।

বইটা পড়ার কিছুদিব পর জানলাম ইন্টারন্যাশনাল বুকারের জন্য দ্য সিলভার বোন লংলিস্টে আছে। এই ধরনের বই সাধারণত প্রাইজ ফাইজ পায় না বটে, কিন্তু সমসাময়িক পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম ঘটলেও ঘটতে পারে। ইউক্রেনের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকলে অবশ্যই পড়ে ফেলুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন