দিন কাটে, যেমন আগেও কাটত। সে নিয়ে আর আলাদা করে লেখার কী মানে আছে? তবুও মাঝেমধ্যে লিখি, কারণ আদতে কোনও কিছুরই তো কোনও মানে নেই।
মার্চ মাস শেষের দিকে, শীত প্রায় পায়ে জুতো গলিয়ে বসে পাইপ টানছে, কিন্তু যাব যাব করেও টিপিকাল অস্ট্রিয়ান বুড়োর মতোই রকিং চেয়ার ছেড়ে নড়ছে না। যদিও মার্চ মাস আসতে আসতে তাঁর সম্মান গেছে কমে, বসন্তের হাওয়া আর তাকে পরোয়া করছে না। জাপানে চেরি স্প্রিং বা সাকুরার মরসুম, জাপানিজ চেরি ফুলের নাকি যত্নআত্তি লাগে গেইশাদের মতোই, সময়ের আগে পরে গেলে তাদের দেখা পাওয়া ভার, কিন্তু ভিয়েনার ম্যাগনোলিয়া জার্মানদের মতোই বুক চিতিয়ে আসে, পারদ দশ ডিগ্রি নামল বা চড়ল, তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। ফেব্রিয়ারি থেকেই শহরভর্তি গোলাপি সফেদ ফুলের মেলা, তাদের সঙ্গ দিতে ওয়াইল্ড গার্লিক আর বেগুনি ঘাসফুলও মাঠে নেমে পড়েছে। দু একদিন মেঘলা করলেও এমনিতে ঝকঝকে রোদ উঠছে আর আমি ডিক্যাথেলনের ফ্লিস আর জ্যাকেট গলিয়ে দুপুরবেলা হাঁটতে বেরিয়ে পড়ছি। মার্চ মাস এলেই আমার মাথায় মাঝেমধ্যে এমিলি ডিকিনসনের 'ডিয়ার মার্চ' কবিতাটা ঘোরে, যদিও কবিতার লাইনগুলো আমার আর ঠিক করে মনে থাকে না। গুগলই ভরসা!
Dear March—Come in—
How glad I am—
I hoped for you before—
Put down your Hat—
You must have walked—
How out of Breath you are—
Dear March, how are you, and the Rest—
Did you leave Nature well—
Oh March, Come right upstairs with me—
I have so much to tell—
I got your Letter, and the Birds—
The Maples never knew that you were coming—
I declare - how Red their Faces grew—
But March, forgive me—
And all those Hills you left for me to Hue—
There was no Purple suitable—
You took it all with you—
কিছুদূর এগিয়ে মেট্রো স্টেশন পেরিয়েই নিঝুম সব পাড়া, সেখানে শান্তিনিকেতনী বসন্ত উৎসব চলছে বললে বাড়াবাড়ি হবে না। সবুজ মখমলের মতো ওয়াকিং ওয়ে, ছিমছাম সব বাড়ি, টেরেস সংলগ্ন রুফ গার্ডেনে টুলিপের টব, পুষ্পলতা আড়াল করে থাকে পুরোনো গির্জা বা কোঅপারেটিং হাউসিংয়ের বাড়িগুলো, রোদ ঝলমলে প্যাটিওতে বসে থাকে আদুরে বেড়াল, কোঁচকানো চামড়ায় রোদ লাগায় সাবেকি বুড়োরা, কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চারা পার্কে ছুটোছুটি করে।
আমি দেখতে দেখতে হাঁটি। শীত শীত লাগলে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকাই বটে, কিন্তু ভুলেও দস্তানা পরি না এদেশিয়দের মতো। সাইকেল বা ইলেক্ট্রিক বাইক নিয়ে ছেলেমেয়েরা পাশ কাটিয়ে যায়, তারা কিন্তু অনেকেই গ্লাভস পরে থাকে। মাঝেমাঝে এক একটা গাছ একেবারে ফুলে ভর্তি, ফুলের ভারে নুয়ে পড়ে প্রায়, আর লাগোয়া কোর্টইয়ার্ডগুলোয় অনবরত শোনা যায় পাখির গান। আমি জন্মকানা, কাক ছাড়া কোনও পাখিই সাধারণত আমার চোখে ধরা দেয় না, কিন্তু সেই দুঃখ পোষাতে আমি গাছ দেখে যাই। গাছের পর গাছ, ন্যাড়া, পত্রহীন। কিন্তু এই শীতেই আমার চোখে তাদের আসল রূপ ধরা পড়ে, প্রতিটা কঙ্কালকায় বৃক্ষ ও তাদের শাখাপ্রশাখার প্রসারিত ভুতুড়ে আঙুল ও শুষ্ক রোমের আড়ালে বোঝা যায় তাদের সত্যিকারের স্বভাব, দেখা মেলে তাদের আত্মার। কখনও বা মনে হয়, হাজার হাজার গাছের মধ্যে একজনের সঙ্গেও অন্যজনের মিল নেই, আর কার সাধ্যি এই অ্যানাটমির বিশ্লেষণ করে? এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় উইম ওয়েন্ডার্স পরিচালিত 'পার্ফেক্ট ডেজ'-এর সেই দৃশ্য, যেখানে ছবির নায়ক প্রতিদিন কাজের ফাঁকে লাঞ্চ করতে গিয়ে একটা পার্কে গিয়ে বসে আর একটা গাছের ছবি তোলে। একটাই গাছ, তার ছবি সে সারাজীবন ধরে তুলছে। প্রতি সপ্তাহে তোলা ছবিগুলো প্রিন্ট করে সে বাড়ি নিয়ে আসে, ভালো ছবিগুলো রেখে দেয় বাক্সে যত্ন করে, আলোয় ঝলসে যাওয়া ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলে। তার একচিলতে ঘরে শয়ে শয়ে ছবি, একই গাছের। এক, কিন্তু এক নয়! আমাদের বোধবুদ্ধির আড়ালে সব কিছুই বয়ে যায়, বদলে যায়, আমাদের চোখে পড়ে না।
মাঝেমধ্যে রোদ ভালো থাকলে আমি কিন্ডারগার্টেন লাগোয়া পার্কে বসে থাকি, ভাবি এইবছর কোথায় ঘুরতে যাব? গতবছর বাল্টিকস আর ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলো প্রায় দেখে নেওয়া হয়েছে, যুদ্ধ চলছে বলে ইউক্রেনে যাওয়া হল না! এইবছর কি বাকিগুলোয় যাওয়ার সুযোগ হবে? স্কুলের দেওয়ালে রঙিন ছবি আঁকা হয়েছে নতুন করে, সেখানে একটা মস্ত বড় জিরাফ না জেব্রা কী যেন আছে। সেই জিরাফের সামনে কচিকাঁচাদের দল হুড়োহুড়ি করে, সেদিকে চোখ চলে যায় বারবার। এরকম ভুলভাল ভাবতে ভাবতেই আবার ওঠা হয়, ফেরার সময় টম্যাটো শশা ইত্যাদি কেনার থাকে মাঝেমধ্যে। প্রায় দেড় মাস বাড়িতে থাকার সময় রান্নাবান্না করতে হয়নি, তাতে আরাম হয়েছে বটে, কিন্তু স্বস্তি মেলেনি। কামচালাউ রান্নাবান্না করার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন সুখানুভূতি আছে হয়তো, যদিও রোজ রোজ রান্না করলে সেটা বোঝা যায় না। কিনোয়া সেদ্ধ করব না রাতে আলু কপি ভেজে নেব ভাবতে ভাবতে হাঁটি, হলদে সাদা ফুল মাড়িয়ে এগোই। কুকুরকে হাঁটাতে নিয়ে বেরোনো বৃদ্ধার সঙ্গে নরম হাসি বিনিময় করে, গাছের সারি পিছনে রেখে, সবুজ বাগান ডাইনে রেখে, কানে হাওয়া লাগিয়ে, বসন্তের লাবণ্যকে বুকে রেখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ভালোই তো আছি। আনন্দেই আছি বলা যায়! বসন্তের রোদ্দুর পিঠে নিয়ে হাঁটতে পারছি, এমন অঢেল সবুজে চোখ রাখতে পারছি, চশমার পাওয়ার বাড়লেও দৃষ্টিশক্তি কমে যায়নি, মেঘেদের আঁকিবুকি দেখছি, পাখিদের ডাক কানে আসছে...দেখার বাসনাটা এখনও বজায় আছে বইকি! হোয়্যাট ইফ দিস লাইফ ফুল অফ কেয়ার, উই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড অ্যান্ড স্টেয়ার!
আর কীই বা চাই সুখী হতে! এরকম করে কয়েক বছর কাটিয়ে দিতে পারলেই চুকে যায়!
এরকম করেই কাটে! দিন চলে যায়...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন