রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪

প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথের গ্রাফিক জীবন

 


প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথের লেখা আমার সেভাবে পড়া হয়নি, তবে মিস্ট্রি আর ক্রাইম লেখক হিসেবে তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, তা আমার অজানা নয়। তাঁর প্রথম বই থেকেই হিচকক 'স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন' সিনেমাটি করেছিলেন, সেটা মনে হয় অধিকাংশ মানুষ দেখেছেন। সত্যি বলতে তাঁর লেখা বেশিরভাগ বইই সিনেমা হয়ে গেছে, তার মধ্যে সমসাময়িক আর উল্লেখযোগ্য হল কেট ব্ল্যাঞ্চেট আর রুনি মারা অভিনীত পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'ক্যারল'।

গ্রেস এলিস আইসনার পুরস্কার জয়ী 'লুম্বারজেন্স' সিরিজের স্রষ্টা, হানাহ টেমপ্লারের সঙ্গে মিলে তিনি এই বিশেষ বইটির নির্মাণের সময় প্যাট্রিশিয়া স্মিথের জীবনকে ধরতে চেয়েছেন, একটা বিশেষ টাইম পিরিয়ডে। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি, প্যাট ঘোষিত সমকামী ছিলেন এবং পাশাপাশি কুইয়র(queer) জগতের আইকনও ছিলেন। এখন ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক আর অন্ততপক্ষে পশ্চিমী আর্ট দুনিয়ায় মোটামুটি স্বীকৃত যে 'ঘোষিত' ব্যাপারটা নিয়ে আলাদা করে কেউ প্রশ্ন করলেই শিল্পীরা খিল্লি করে।

এই বছরের নামকরা ছবি 'অল অফ আস স্ট্রেঞ্জার্স' কুইয়র লাইফ আর একাকীত্বেরই গল্প, আর অ্যান্ড্রু নিজেও 'ঘোষিত সমকামী'। ইন্টারভিউতে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'অভিনয়ের কথা আলোচনার সময় আমি ঘোষিত কি ঘোষিত সে নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে?' সবাই এই নিয়ে একমত হন। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর রবার্ট ডাউনি জুনিয়ার বলেন, 'আমিও কিন্তু ঘোষিত হেট্রোসেক্সুয়াল। এবার থেকে বলতে হবে নাকি?'

সে যাই হোক, এখন এসব হলেও প্যাট্রিশিয়ার সময়ে, মানে চার আর পাঁচের দশকে ঘোষিত সমকামী হওয়া মুখের কথা ছিল না। এমনকি বইয়ে সমকামীদের নিয়ে গল্প লিখতে হলে ব্র্যান্ডভ্যালু খারাপ হত, প্রকাশকরা হাত তুলে নিত। গল্পটা যে সময়কে ধরেছে, তখন প্যাট নিজের জীবনে প্রবল হতাশায় ভুগছেন। 'স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন' এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে রাখলেও কোনও জবাব আসেনি কারো কাছ থেকে, এদিকে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই। কিন্তু শুধু ডে জব করে আর চলছে না। তার স্বভাবও খুব একটা মিশুকে নয়, বরং রগচটা, চেন স্মোকার, নেশা করতে অলওয়েজ রাজি এই মেয়েটার দুর্মুখ স্বভাব আর রিবেলিয়াস আচরণ দেখে সবাই বিরক্ত। তার ওপর প্যাট নিজের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে পড়েছেন ফাঁপরে। মেয়েদের সঙ্গ তার পছন্দ, কিন্তু নিজেকে নিজে ব্যাপারটা বোঝাতে তার অসুবিধা হচ্ছে। এমন কিছু নিয়ে কেউ খোলাখুলি কথা বলত না, এমন কিছু হলেও থেরাপি নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। মনে রাখতে হবে, সময়টা হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে ডিস্কোর্স শুরু হওয়ার ঢের আগে। প্যাট রাত্রিরে পাব থেকে সঙ্গিনীকে ঘরে নিয়ে আসছেন, খটখট করে টাইপরাইটারে গল্প লিখছেন, তারপর পরদিনই আবার ছুটছেন সাইকোলজিস্ট এর কাছে, তাদের থেরাপির এক একটা সিটিং এর ফিস জোগাড় করতে গিয়ে তার অবস্থা খারাপ! টাকার জন্য টাইমলি কমিক্সে গিয়ে স্ট্যানলির সঙ্গে কমিক্সের গল্প লিখতে হচ্ছে, সেটা তার মোটেও পছন্দ নয়। একটা চমৎকার সিন আছে। স্ট্যান লি প্যাটকে জিজ্ঞেস করছেন, 'কমিক্সকে এত দূরছাই করছ! তোমার কাজের দামই বা কে দিচ্ছে! তুমি তো রহস্য বই লেখো।"

প্যাট সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলছেন, "আমি রহস্য বই লিখি না, আমি ভালো বই লিখি!"

এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে তার প্রথম বইটা ছাপা হয় এবং হিট হয়ে যায়। প্যাট তখন মনেপ্রাণে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছেন এবং জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে তিনি 'প্রাইস অফ দ্য সল্ট' বলে একটা উপন্যাস লিখে ফেলেন। কিন্তু সমকামীদের নিয়ে উপন্যাস, তাও আবার হ্যাপি এন্ডিং! প্যাটের সমস্ত চেষ্টাচরিত্র মাঠে মারা যায়, কেউই তাঁর এই বই ছাপতে রাজি নয়। এদিকে লেখিকা হিসেবে তিনি তখন বিখ্যাত হয়ে গেছেন, ঝামেলা শুধু মরালিটির কচকচির। লোকে কী বলবে? কিন্তু প্যাট ঠিক করেছেন বই ছাপবেনই। শেষমেশ একজন রাজি হয় এক শর্তে, বই ছাপা হবে ছদ্মনামে। তাই হয়। ক্লেয়ার মর্গান নামে সেই উপন্যাস বাজারে আসে। এরপর চল্লিশ বছর কেউ জানত না বইটা কে লিখেছে, নব্বইয়ের গোড়ার দিকে অবশেষে প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথ বইটা 'ক্যারল' নাম নিয়ে স্বনামে ছাপতে পেরেছিলেন।

যাই হোক, ফ্লাংগ আউট অফ স্পেসের প্যাটের সেই মনোদশাকে অসামান্য ভাবে ধরেছে। মানুষের স্বভাব যে কতটা জটিল, এই বইটা পড়লে খানিকটা বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, প্যাট্রিশিয়া স্মিথকে একদম মানুষ করেই দেখানো হয়েছে, শুধু শুধু তাকে নায়িকা করার চেষ্টা করেননি স্রষ্টারা। চরিত্রের দিক থেকে দেখতে গেলে প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথ খুব সুবিধের মহিলা কোনোকালেই ছিলেন না, ইহুদিবিদ্বেষ আর ভুলভাল চোখা মন্তব্যের জন্য তাঁকে চিরকাল কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু, একজন মানুষ যে একমাত্রিক হন না, তার চরিত্রে যে নানারকম শেড থাকে আর সেই শেডের স্পেক্ট্রামও পরিস্থিতি অনুয়ায়ী বদলে বদলে যায়, সেটা গ্রাফিক নভেলে অনবদ্য ভাবে তুলে এনেছেন এলিস- টেম্পলার জুটি।

সব মিলিয়ে এই কাজটাকে আমি দশে দশ দিলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন