রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪

দিনযাপন (বসন্ত ২০২৪)

 


দিন কাটে, যেমন আগেও কাটত। সে নিয়ে আর আলাদা করে লেখার কী মানে আছে? তবুও মাঝেমধ্যে লিখি, কারণ আদতে কোনও কিছুরই তো কোনও মানে নেই।
মার্চ মাস শেষের দিকে, শীত প্রায় পায়ে জুতো গলিয়ে বসে পাইপ টানছে, কিন্তু যাব যাব করেও টিপিকাল অস্ট্রিয়ান বুড়োর মতোই রকিং চেয়ার ছেড়ে নড়ছে না। যদিও মার্চ মাস আসতে আসতে তাঁর সম্মান গেছে কমে, বসন্তের হাওয়া আর তাকে পরোয়া করছে না। জাপানে চেরি স্প্রিং বা সাকুরার মরসুম, জাপানিজ চেরি ফুলের নাকি যত্নআত্তি লাগে গেইশাদের মতোই, সময়ের আগে পরে গেলে তাদের দেখা পাওয়া ভার, কিন্তু ভিয়েনার ম্যাগনোলিয়া জার্মানদের মতোই বুক চিতিয়ে আসে, পারদ দশ ডিগ্রি নামল বা চড়ল, তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। ফেব্রিয়ারি থেকেই শহরভর্তি গোলাপি সফেদ ফুলের মেলা, তাদের সঙ্গ দিতে ওয়াইল্ড গার্লিক আর বেগুনি ঘাসফুলও মাঠে নেমে পড়েছে। দু একদিন মেঘলা করলেও এমনিতে ঝকঝকে রোদ উঠছে আর আমি ডিক্যাথেলনের ফ্লিস আর জ্যাকেট গলিয়ে দুপুরবেলা হাঁটতে বেরিয়ে পড়ছি। মার্চ মাস এলেই আমার মাথায় মাঝেমধ্যে এমিলি ডিকিনসনের 'ডিয়ার মার্চ' কবিতাটা ঘোরে, যদিও কবিতার লাইনগুলো আমার আর ঠিক করে মনে থাকে না। গুগলই ভরসা!
Dear March—Come in—
How glad I am—
I hoped for you before—
Put down your Hat—
You must have walked—
How out of Breath you are—
Dear March, how are you, and the Rest—
Did you leave Nature well—
Oh March, Come right upstairs with me—
I have so much to tell—
I got your Letter, and the Birds—
The Maples never knew that you were coming—
I declare - how Red their Faces grew—
But March, forgive me—
And all those Hills you left for me to Hue—
There was no Purple suitable—
You took it all with you—
কিছুদূর এগিয়ে মেট্রো স্টেশন পেরিয়েই নিঝুম সব পাড়া, সেখানে শান্তিনিকেতনী বসন্ত উৎসব চলছে বললে বাড়াবাড়ি হবে না। সবুজ মখমলের মতো ওয়াকিং ওয়ে, ছিমছাম সব বাড়ি, টেরেস সংলগ্ন রুফ গার্ডেনে টুলিপের টব, পুষ্পলতা আড়াল করে থাকে পুরোনো গির্জা বা কোঅপারেটিং হাউসিংয়ের বাড়িগুলো, রোদ ঝলমলে প্যাটিওতে বসে থাকে আদুরে বেড়াল, কোঁচকানো চামড়ায় রোদ লাগায় সাবেকি বুড়োরা, কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চারা পার্কে ছুটোছুটি করে।
আমি দেখতে দেখতে হাঁটি। শীত শীত লাগলে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকাই বটে, কিন্তু ভুলেও দস্তানা পরি না এদেশিয়দের মতো। সাইকেল বা ইলেক্ট্রিক বাইক নিয়ে ছেলেমেয়েরা পাশ কাটিয়ে যায়, তারা কিন্তু অনেকেই গ্লাভস পরে থাকে। মাঝেমাঝে এক একটা গাছ একেবারে ফুলে ভর্তি, ফুলের ভারে নুয়ে পড়ে প্রায়, আর লাগোয়া কোর্টইয়ার্ডগুলোয় অনবরত শোনা যায় পাখির গান। আমি জন্মকানা, কাক ছাড়া কোনও পাখিই সাধারণত আমার চোখে ধরা দেয় না, কিন্তু সেই দুঃখ পোষাতে আমি গাছ দেখে যাই। গাছের পর গাছ, ন্যাড়া, পত্রহীন। কিন্তু এই শীতেই আমার চোখে তাদের আসল রূপ ধরা পড়ে, প্রতিটা কঙ্কালকায় বৃক্ষ ও তাদের শাখাপ্রশাখার প্রসারিত ভুতুড়ে আঙুল ও শুষ্ক রোমের আড়ালে বোঝা যায় তাদের সত্যিকারের স্বভাব, দেখা মেলে তাদের আত্মার। কখনও বা মনে হয়, হাজার হাজার গাছের মধ্যে একজনের সঙ্গেও অন্যজনের মিল নেই, আর কার সাধ্যি এই অ্যানাটমির বিশ্লেষণ করে? এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় উইম ওয়েন্ডার্স পরিচালিত 'পার্ফেক্ট ডেজ'-এর সেই দৃশ্য, যেখানে ছবির নায়ক প্রতিদিন কাজের ফাঁকে লাঞ্চ করতে গিয়ে একটা পার্কে গিয়ে বসে আর একটা গাছের ছবি তোলে। একটাই গাছ, তার ছবি সে সারাজীবন ধরে তুলছে। প্রতি সপ্তাহে তোলা ছবিগুলো প্রিন্ট করে সে বাড়ি নিয়ে আসে, ভালো ছবিগুলো রেখে দেয় বাক্সে যত্ন করে, আলোয় ঝলসে যাওয়া ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলে। তার একচিলতে ঘরে শয়ে শয়ে ছবি, একই গাছের। এক, কিন্তু এক নয়! আমাদের বোধবুদ্ধির আড়ালে সব কিছুই বয়ে যায়, বদলে যায়, আমাদের চোখে পড়ে না।
মাঝেমধ্যে রোদ ভালো থাকলে আমি কিন্ডারগার্টেন লাগোয়া পার্কে বসে থাকি, ভাবি এইবছর কোথায় ঘুরতে যাব? গতবছর বাল্টিকস আর ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলো প্রায় দেখে নেওয়া হয়েছে, যুদ্ধ চলছে বলে ইউক্রেনে যাওয়া হল না! এইবছর কি বাকিগুলোয় যাওয়ার সুযোগ হবে? স্কুলের দেওয়ালে রঙিন ছবি আঁকা হয়েছে নতুন করে, সেখানে একটা মস্ত বড় জিরাফ না জেব্রা কী যেন আছে। সেই জিরাফের সামনে কচিকাঁচাদের দল হুড়োহুড়ি করে, সেদিকে চোখ চলে যায় বারবার। এরকম ভুলভাল ভাবতে ভাবতেই আবার ওঠা হয়, ফেরার সময় টম্যাটো শশা ইত্যাদি কেনার থাকে মাঝেমধ্যে। প্রায় দেড় মাস বাড়িতে থাকার সময় রান্নাবান্না করতে হয়নি, তাতে আরাম হয়েছে বটে, কিন্তু স্বস্তি মেলেনি। কামচালাউ রান্নাবান্না করার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন সুখানুভূতি আছে হয়তো, যদিও রোজ রোজ রান্না করলে সেটা বোঝা যায় না। কিনোয়া সেদ্ধ করব না রাতে আলু কপি ভেজে নেব ভাবতে ভাবতে হাঁটি, হলদে সাদা ফুল মাড়িয়ে এগোই। কুকুরকে হাঁটাতে নিয়ে বেরোনো বৃদ্ধার সঙ্গে নরম হাসি বিনিময় করে, গাছের সারি পিছনে রেখে, সবুজ বাগান ডাইনে রেখে, কানে হাওয়া লাগিয়ে, বসন্তের লাবণ্যকে বুকে রেখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ভালোই তো আছি। আনন্দেই আছি বলা যায়! বসন্তের রোদ্দুর পিঠে নিয়ে হাঁটতে পারছি, এমন অঢেল সবুজে চোখ রাখতে পারছি, চশমার পাওয়ার বাড়লেও দৃষ্টিশক্তি কমে যায়নি, মেঘেদের আঁকিবুকি দেখছি, পাখিদের ডাক কানে আসছে...দেখার বাসনাটা এখনও বজায় আছে বইকি! হোয়্যাট ইফ দিস লাইফ ফুল অফ কেয়ার, উই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড অ্যান্ড স্টেয়ার!
আর কীই বা চাই সুখী হতে! এরকম করে কয়েক বছর কাটিয়ে দিতে পারলেই চুকে যায়!
এরকম করেই কাটে! দিন চলে যায়...

মোনিকা


গত কয়েকমাসে বেশ কিছু নতুন আর জনপ্রিয় গ্রাফিক নভেল পড়া হয়েছে আর কোথাও না কোথাও আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে মেনস্ট্রিম গ্রাফিক নভেলের দুনিয়াটা ক্রমে আরো লিটারারি হয়ে উঠছে, তুলনায় পপুলার উপন্যাসগুলো (পুরস্কার পাওয়া বইগুলো বাদে) বিষয়বস্তুকে আরো ডাম্ব ডাউন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ব্যতিক্রম আছে, আর এই ভাবনাটা সাময়িক হলেও হতে পারে। তবে আপাতত এমনটাই মনে হচ্ছে। এই ঘেপচু কথা মাথায় আসার প্রধান কারণ-- মোনিকা।


ড্যানিয়েল ক্লাউস আজ থেকে গ্রাফিক নভেল করছেন না। এই দুনিয়ায় তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় আর 'মোনিকা' ফ্যান্টাগ্রাফিকস থেকে রিলিজ হওয়ার আগেই প্রিবুকে প্রচুর কপি উঠে গিয়েছিল। এদিকে বই মার্কেটে আসার পর যা রিভিউ এল, তাতে বাচ্চা প্রকাশক হলে ঘাবড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। না, মন্দ বলেনি, কিন্তু সকলেরই মত, এই জিনিস পাঠক খাবে না। তবে গ্রাফিক নভেল হিসেবে ক্লাউস যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন এই বইয়ে, তার জবাব নেই। কিন্তু না, বই বিক্রি কমেনি, বরং হুড়মুড়িয়ে বেড়েছে। মোনিকার গল্প একলাইনে বলা যায়। মোনিকার একটা ট্রাবাল্ড ছোটবেলা আছে, আর তার বাবার ঠিক নেই। বউ জুড়ে সে বাবাকে খুঁজছে। কিন্তু তাতে কিছুই বোঝা যাবে না। বইয়ের পাঁচটা সেকশনের মধ্যে কোনটা সত্যি ঘটছে, কোনটা মোনিকা লিখছে, কোনটা ভাবছে আর কেন ভাবছে/লিখছে... সে নিয়ে ইন্টারনেট আর পাঠকের দুনিয়ায় হাজার হাজার পাতার গবেষণা চলছে। এই প্রতিটা ভাগের আঁকার টোন আর কালার কম্বিনেশন আলাদা, যদিও যদি কেউ ক্লাউসের এইটবল সিরিজ পড়ে থাকে, তাঁরা কিছুটা সাদৃশ্য পাবেন। সভ মিলিয়ে মোনিকা পড়ে আমার আনন্দ হল না ঠিকই, কিন্তু আমি এমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়লাম যে বার দুয়েক বইটা আমাকে আবার পড়ে দেখতে হল। গ্রাফিক নভেল নিয়ে আগ্রহ থাকলে অবশ্যই পড়ে দেখুন।

কমিক্সে ফরাসি নুয়া


Jean-Patrick Manchette ফরাসি ক্রাইম থ্রিলার লেখক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত। তাঁর লেখা দুটো বই 'নো রুম অ্যাট দ্য মর্গ' আর 'নাদা' বহুদিন আগে মডার্ন ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রতিভাবান লেখক মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে মারা গিয়েছেন, কিন্তু সেই অল্পসময়ের মধ্যেই মঁসেত এমন একটা নিজস্ব দুনিয়া খাড়া করেছিলেন, শুধু নাম শুনে যার নাগাল পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। কয়েকমাস আগে খানিকটা ভাগ্যক্রমেই তাঁর বই 'থ্রি টু কিল' উপন্যাস নির্ভর একটা গ্রাফিক নভেল আমার হাতে এসে পড়ে, শিল্পী আর কেউ নন, বিডি কমিক্সের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী জ্যাক তার্দি। তার্দির সঙ্গে মঁসেতের সখ্য ছিল, তাঁরা দুজনে মিলে বেশ কিছু কাজ একসঙ্গে করেছিলেন। তার্দি এই বিশেষ বইটা, ফরাসিতে নাম Le Petit bleu de la côte ouest পড়ে সেটা কমিক্সে এনেছিলেন, ইংরেজি অনুবাদে সেটা 'ওয়েস্ট কোস্ট ব্লুজ' হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাফিক নভেলটা পড়ে আমি যাকে বলে বোকা বনে যাই। তার্দি বলেছেন, মঁসেতের লেখা বা সংলাপ তিনি যতটা সম্ভব না বদলে রেখে দিয়েছেন, সংলাপেও বদল ঘটাননি, যাতে মেজাজটা হারিয়ে না যায়। কিন্তু আমার খুব ভরসা ছিল না, তাই পরে বইটা পড়েও দেখেছি। এরপর আমি পাগলা হয়ে মঁসেত-তার্দি জুটির স্ট্রিটস অফ প্যারিস:স্ট্রিটস অফ মার্ডার দুই ভলিউম পড়ে ফেললাম, কিন্তু ওয়েস্ট কোস্ট ব্লুজ আমার মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। তার্দির আঁকা নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা নেই, কিন্তু মঁসেতের লেখা নিয়ে দু এক কথা বলে কিছুটা আন্দাজ দেওয়া যাক।


মঁসেতের দুনিয়া যাকে গ্রিটি, ডার্ক, অনাড়ম্বর, সেখানে ন্যাকামি আর আড়ষ্টতার কোনও জায়গাই নেই। গোয়েন্দা ফোয়েন্দা নিয়ে তিনি সাধারণত মাথা ঘামান না, কন্ট্র্যাক্ট কিলারদের জীবন নিয়েই লিখেছেন বেশি। এরই মধ্যে কিছু কিছু গল্পে এমন সব প্যারিসিয়ান বা অন্যান্য ছোটখাটো ফরাসি মফস্বলের চরিত্র ঢুকে পড়ে, যাদের জীবনও সেই তার্দির ছবির মতোই গ্রে, সাদাকালো, ডিপ্রেসিভ। যত বড় খুনেই হোক না কেন, কারো কোনও অপরাধবোধ নেই, আর থাকলেও সেই সবের বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই। এক একটা করে কাজ আসছে, মানুষ মরছে, টাকা পাচ্ছে, বন্দুকের যত্ন নিচ্ছে, সেক্স করছে, আবার কাজ আসছে, আবার মানুষ মারছে, ডাইনারে গিয়ে নির্বিকার মুখে বিয়ার খাচ্ছে, আবার বন্দুক পরিষ্কার করছে... নো কাব্য ফাব্য। তার চেয়ে বরং সোনামুখ করে বন্দুকের পরিচর্চা করা ভালো।

কিন্তু এরই মধ্যে, বিশেষ করে ওয়েস্ট কোস্ট ব্লুজে, মঁসেত প্রায় প্রতিটা সিনে এক একটা জ্যাজ গানের ডিটেল দিয়ে গেছেন। যতবার গাড়িতে ব্লুজ বাজছে, জানানো হচ্ছে কার কোন গানটা বাজছে! আর গান বাজছেও বটে! খুনের আগে, অ্যাক্সিডেন্টের পর, শুটআউটের মধ্যিখানে, প্যারিস থেকে পালানোর সময়, হাইওয়ে থেকে বাঁক নেওয়ার আগে... সর্বক্ষণ গান বাজছে! আর অন্য চারটে গল্পের চেয়েও এই বইটা একটু আলাদা, কারণ এই গল্পটাও কোনও কিলারের নয়, এক সাধারণ মানুষের যে কিনা এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছে! মঁসেতের লেখায় এমন একটা নির্লিপ্ত ভাব আছে, যা খাস ফরাসি তো বটেই, পাশাপাশি তাতে এক রুটিন লাইফের বিমর্ষতা চোখে পড়ে। মজার কথা হল, এই রুটিন লাইফ এক একজন পেশাদার খুনির। ফরাসি ক্রাইমের ভক্তরা অতি অবশ্যই মঁসেত পড়ুন, ঠকবেন না।

কুরকোভিয় ইউক্রেনিয়ান সাহিত্য

আন্দ্রেই কুরকোভ ইউক্রেনের লেখকদের মধ্যে একটা বিশিষ্ট জায়গা করেছেন। ভদ্রলোক প্রলিফিক রাইটার, 'ডেথ অ্যান্ড দ্য পেঙ্গুইন' আর 'গ্রে বিজ' এর মতো ফিকশন লিখে তুমুল সাড়া ফেলেছেন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর যে বইটি আগে পড়েছি, ২০১৪ সালের সেই বইটা-- ইউক্রেন ডায়েরিজ-- একটা নন ফিকশন৷ গত বছর ইউক্রেনে যুদ্ধ চলাকালীন তিনি খবরের কাগজে একটা কলামও লিখতেন, সেটা প্রায় সবটাই পড়েছি, সেইটাও মনে হয় 'ডায়েরি অফ অ্যান ইনভেশন' নামে ছাপা হয়েছে। কিন্তু সদ্য যে বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ, তার নাম দ্য সিলভার বোন। ২০১৭ সালে কুরকোভের বন্ধু তাঁকে একটা বিশাল ফাইল উপহার দেন। সেটা আর কিছুই নয়, ১৯১৭-১৯২১ সালের মাঝে উইক্রেনের কেস ফাইলের তাড়া, এতদিন কেজিবির আর্কাইভে পচছিল। সে যাই হোক, কুরকোভ দেরি না করে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে (মানে ১৯১৯-১৯২৩) দুটো হাফ মিস্ট্রি-হাফ ডিটেকটিভ ফিকশন লিখে ফেলেন, গোয়েন্দার নাম স্যামসন কোলেচকো। তার প্রথমটা 'দ্য সিলভার বোন' নামে বেরিয়েছে, দ্বিতীয়টা 'দ্য হার্ট ইজ নট মিট' নামে এই বছর অনুবাদ হয়ে আসবে। কিন্তু ভুল করবেন না, এই বইগুলো চিরাচরিত গোয়েন্দা বা রহস্য গল্প নয়, এখানে প্রেক্ষাপট আর অ্যাম্বিয়েন্সের গুরুত্ব রহস্যের চেয়ে ঢের বেশি, কিছুটা ব্ল্যাক কমেডিও আছে আর কুরকোভের সারিয়াল ট্রিটমেন্টও মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যায়।


তবে আমি এই বইটায় ডুবে যাওয়ার একমাত্র কারণ, কুরকোভের অসামান্য কলমে উঠে আসা ১৯১৯ সালের কিইভ। সময়টা ইউক্রেনের ইতিহাসে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কিইভ দখল করার জন্য সোভিয়েত ইনভেশন হবে, এদিকে কিইভে একেবারে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুরের ভাষায় ছিছালেদর অবস্থা। কোসাক দস্যুরা ঘোড়ায় চড়ে লুটপাট করছে, তরোয়াল দিয়ে যাকে পারছে কেটে ফেলছে, রেড আর্মির আধিকারিকরা বুঝতে পারছে না কী করবে? পুলিশের অর্ধেক লোক জারশাহির সময়ও ছিল, বাকিদের তুলে আনা হয়েছে মাঠঘাট থেকে। বলশেভিকদের লাফালাফি আছে, এদিকে প্রতিপক্ষদের কনফিউশান আর অ্যাগ্রেশনও কম নয়। ঝামেলায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। কাজকর্ম ডকে, ভয়ে কেউ অন্ধকার হলে রাস্তায় বেরোচ্ছে না, রেড আর্মি মারে না কোসাক মারে না এমনি ডাকাত বা সহায়সম্বলহীন চাষাভুষো এসে সব লুট করে খুব করে যায়, ভরসা কিছুই নেই। রুবেল পাওয়া যাচ্ছে না, এদিকে সোভিয়েতদের কুপন বিশেষ বিশেষ জায়গা ছাড়া কেউ নিতে চায় না। বাজারে খাদ্যশস্য কিছুই নেই। মাঝেমধ্যেই ভুলভাল চিঠি লিখিয়ে রেড আর্মির লোক সাধারণ মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ছে, যা ইচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা সময়, বইয়ের প্রথম লাইনেই স্যামসনের বাবা কোসাক দস্যুর হাতে খুন হন, তরোয়ালের ঘা খেয়ে তার নিজের দান কান কাটা পড়ে। সেই কাটা কান নিয়ে ছুটতে থাকে স্যামসন, ঢুকে পড়ে এক চোখের ডাক্টারের বাড়িতে৷ কিন্তু কান তো আর জোড়া লাগার নয়!

তবু স্যামসন কানের মায়া কাটাতে পারে না, বাবার দেরাজে রেখে দেয় সেটা। বাড়িতে সবাই মারা পড়েছে, স্যামসন একা হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছিল সে, কিন্তু চাকরি নেই। আর চাকরি পেলেও মাইনে কেউই পায় না। ভাগ্য এমন, পুলিশ তার দেরাজ কাম ডেস্কটা তুলে নিয়ে যায়৷ স্যামসন ছোটে থানায়। তাকে বলা হত, দেরাহ ফেরানো হবে না, কিন্তু ইচ্ছে হলে সে পুলিশে চাকরি করতে পারে, ওই ডেস্কটাই তার বসার জায়গা হবে। মাইনে নেই, তবে সোভিয়েত ক্যানটিনে পেট ভরে খেতে পাবে, (ব্রেড অবশ্য দেয় না তারা) বন্দুক পাবে। ক্রাইম আর অপরাধীদের আটকানোর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। ভেবেচিন্তে স্যামসন কাজটা নিয়ে নেয়। হবু স্ত্রীর সঙ্গে নিজের ভঙ্গুর জীবন আর র্যাম্পান্ট কোরাপশন আর অ্যানার্কির সঙ্গে লড়তে লড়তে স্যামসন আবিষ্কার করে, দেরাজে রাখা তার কাটা কানটা সব কিছু শুনতে পাচ্ছে, সে ঘরে থাকলেও থানার খবর চলে আসছে তার কাছে। এরপর কী হয়, সেই নিয়েই বাকি গল্প।

কুরকোভের লেখা চমৎকার। আর বরিস ড্রেলাউক অনুবাদও করেছেন দারুণ। তরতর করে বই এগোয়৷ এদিকে পাঠক পড়তে পড়তে আবিষ্কার করে, একশো বছর আগের রাশিয়াব সিভিল ওয়ার আর উইক্রেনের ইনভেশনের এই ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের মিল লক্ষ করার মতোই! এরই মাঝে একটা রহস্য আর রহস্য সমাধানও আছে, যা সরাসরি পুলিশ ফাইল থেকেই উঠে এসেছে।

বইটা পড়ার কিছুদিব পর জানলাম ইন্টারন্যাশনাল বুকারের জন্য দ্য সিলভার বোন লংলিস্টে আছে। এই ধরনের বই সাধারণত প্রাইজ ফাইজ পায় না বটে, কিন্তু সমসাময়িক পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম ঘটলেও ঘটতে পারে। ইউক্রেনের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকলে অবশ্যই পড়ে ফেলুন।

অক্টোপাস যখন গোয়েন্দা




যে সমস্ত পাঠকরা নিয়মিত পপুলার সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই এই বইটা পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু তবু পোস্ট করলাম, কারণ বাকিদেরও পড়ে ফেলাই ভালো। কেন? এটাও গোয়েন্দা গল্প নাকি? হুঁ, তা বলাই যায়!

তফাত হল, এই গল্পের গোয়েন্দা সোয়েল বে অ্যাকোয়ারিয়ামে থাকা এক জায়ান্ট অক্টোপাস, যার নাম মার্সিলেস। সেই অ্যাকোয়ারিয়ামেই কাজ করেন টোভা বলে এক মহিলা, যিনি প্রায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। টোভার অতীত খুব একটা সুখের নয়। স্বামী মারা গিয়েছে ক্যান্সারে, আর একমাত্র ছেলে এরিক যৌবনে পা রাখার আগেই জলে ডুবে মারা গেছিল প্রায় তিরিশ বছর আগে। ছেলেকে হারানোর সেই দুঃখ আজও ভোলেননি তিনি। এই অ্যাকোয়ারিয়াম আর সেখানকার প্রাণীদের নিয়েই থাকেন, যদিও সমুদ্রকূলের এই ছোট্ট শহরের মানুষজন খুবই ভালো, হেল্পফুল, আন্তরিকও বটে। টোভার বন্ধুরা তাঁকে সামলে সামলে রাখেন। কিন্তু, তাঁর বয়স বাড়ছে, শরীরও ভাঙছে স্বাভাবিকভাবেই। টোভা শুধু ভাবেন এরিকের কথা। কী হয়েছিল তার তিরিশ বছর আগের সেই রাতে? কেন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? কেউ এর উত্তর দিতে পারে না। কারো জানা নেই। অথবা, আছে? আছে, একজন এই রহস্যের সমাধান করতে পারে! কে সে? না, কোনও মানুষ নয়, টোভার বন্ধু সেই জায়ান্ট অক্টোপাস... মার্সিলেস।

এমন মন ভালো করা বই বহুদিন পড়িনি। এক একটা চরিত্র এমন যত্ন দিয়ে গড়া যে নিজের বাড়ির মানুষ বলে মনে হয়। আর তেমনই উষ্ণতা দেওয়া কাহিনি! বই শেষ হবে, কিন্তু সেই উষ্ণতার রেশ রয়ে যাবে। সবসময় খুনখারাপি আর গম্ভীর সাহিত্য তো পড়ছেন, মাঝেমধ্যে এই হালকা ফিলগুড বইগুলো পড়ে দেখতেই পারেন। আমার বিশ্বাস, ভালো লাগবে।

আ পারফেক্ট সেমেট্রি: পারফেক্ট আর্জেন্টিয়ান সমকালীন গল্প?

 


ফেদেরিকো ফালকো এখন আর্জেন্টিনার সমসাময়িক গল্পকারদের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে থাকবেন, যদিও তাঁর লেখা অধিকাংশ লেখাই এখনও ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। ভাগ্য ভালো, চারকো প্রেস হিস্প্যানিক ওয়ার্ল্ড থেকে রত্ন তুলে আনার কাজটা মন দিয়েই করছে। 'আ পারফেক্ট সেমেট্রি' একেবারে পুঁচকে একটা বই, মাত্র পাঁচটি গল্প, একশো পঁচিশটা পাতা। কিন্তু এই বইটা পড়ে আমাকে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করতে হল। এই গল্পগুলো আদৌ গল্প কিনা আর গল্প হলেও আমার পছন্দ হচ্ছে কিনা, আর অপছন্দ হলে আমি এত মন দিয়ে পড়তে পারছিই বা কী করে...এইসব প্রশ্ন এমন মাথার মধ্যে কামড়াতে লাগল যে বইয়ের তিনটে গল্প আমাকে তিনবার পড়ে ফেলতে হল। অনেক ভেবেচিন্তে আমি ঠিক করলাম, গল্পগুলো জাস্ট ফাটাফাটি। কিন্তু গল্পের পাঠক হিসেবে আমি একেবারেই ক্যালানে, কারণ গল্প বলতে যে জিনিসটা আমার মাথায় সাধারণত (বিশেষ বিশেষ নাম বাদ দিয়ে) ঘর করে আছে, আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে সেই গল্পকেই শুধু গল্প বলা হয় না। আমি যে ফেসবুক পোস্ট দিচ্ছি আর চারটে পোস্টে রিচ না পেয়ে পোস্ট দেওয়া কমিয়ে দিই, এইটাই একটা গল্প হতে পারে। সকালবেলা চা খেতে গিয়ে দেখলাম দুধ ফেটে গেছে আর দুধ আনতে গিয়ে ব্যাপারটা বলতে দোকানের মেয়েটা বলল লিকার চা খাওয়াই বেটার.. সেই নিয়েই একটা সার্থক গল্প হতে পারে। তাতে কোনও বিশেষ ওঠানামা দরকার নেই, প্লটের বাঁকবদল ঘটানোর দরকার নেই, কিছুই দরকার নেই... শুধু গল্পটা যে পড়ছে, সে যেন চোখের সামনে আমাকে দেখতে পায়। আমার দুনিয়ার সবকিছু তার কাছে রূপ রস বর্ণ গন্ধ নিয়ে হাজির থাকুক, আমি শুধুই গল্পের চরিত্র না হয়ে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে ধরা দিতে পারি, সেটাই দরকার। আর এই জায়গাতে এসেই ফালকো ছক্কা হাঁকড়েছেন।

আ পারফেক্ট সেমেট্রির গল্পের চরিত্ররা এতটাই আসল, এতটাই আসল যে গল্প পড়ছি বলে মনেই হয় না। প্রতিটি গল্পই আর্জেন্টিনার কোর্দোবা অঞ্চলের পটভূমিকায় লেখা আর নিজে সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে বলেই বলছি, কোর্দোবার পরিবেশ ও প্রকৃতি একদম হুবহু ফুটে উঠেছে এই গল্পগুলোয়, নিঃসন্দেহে কোর্দোবা (সম্ভবত কয়েক দশক আগের কোর্দোবাই হবে) এই বইয়ের এক জরুরি অংশ। আর গল্প, সেও আজব! ভীষণ বাস্তব, আবার ভীষণ অবাস্তবও বটে! মানে, এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কিন্তু এমন ঘটনা তো ঘটছেই। যেমন, ১০৪ বছর বয়সী বাবাকে যেন মৃত্যুর পর অন্য শহরে কবর না দেওয়া হয়, সেইজন্য শহরের মেয়র এক সেমেট্রি শিল্পীকে ডেকে এনেছেন, তিনি পার্ফেক্ট এক কবরখানা বানাবেন আর জলদি বানাবেন। কিন্তু যার জন্য এত ঝামেলা, সেই বুড়ো সেই সেমেট্রিতে গিয়ে শোবে না বলে পণ করেছে। যেমন, হঠাৎ করে এক কিশোরী মেয়ে নাস্তিক হয়ে যায় আর টিন এজ হার্মোনের প্রভাবে এক অক্রিশ্চান মারমন পাদরির দিকে আকৃষ্ট হয়... বা ঘরের আশেপাশে সমস্ত গাছ কাটা পড়ছে বলে এক মেয়ে আর তার বৃদ্ধ বাবা জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে আর যে কেউ মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য থাকলেই চুকে যায় কিন্তু কোনও স্থানীয় মানুষ রাজি না হওয়ায় মেয়েটা শেষে এক জাপানিজ ইমিগ্রেন্টকে বিয়ে করতে রাজি হয়... এসব সাদামাঠা ঘটনার মাধ্যমে ফালকো কতগুলো অসাধারণ জীবনের ছবি এঁকে গেছেন।

বইটার অনুবাদ অসামান্য। প্রসঙ্গত, এই জেনিফার ক্রাফট ওল্গা তোকারচুকের বুকারজয়ী 'ফ্লাইটস' বইটাও অনুবাদ করেছিলেন। ছোট্ট একটু স্যাম্পল...

Meanwhile the plantains on the central path, the cypresses, the casuarinas, the damson and ornamental plums, the gingko bilobas that would yellow up the gorge, they planted with their root balls and all, exactly as the nurseries had sent them. For the time being they were no more than sickly little trees tied to their stakes, just branches with hibernating buds, sleeping through their latencies. As soon as the cold released its hold and the roots discovered their new liberty, they would untangle and start to extend into the fertile earth, down, down, until they found the centre of the hill.Their stems would swell on the surface and their branches would be covered with new leaves. By the time spring was over the shapes that Victor Bagiardelli had imagined on his own would enrapture the inhabitants of Colonel Isabeta. And so, for years and years, as the trees grew to their maximum size and attained their ideal shape, as the colours of their foliage changed with the seasons, while always, in any month, just exactly as he had planned for it to happen, there would be some bush flowering, and summer after summer the fragrances of fresh pollen would inundate the whole. Every time a resident of Colonel Isabeta died and the cortege transported the body to the cemetery, the trees Victor Bagiardelli had chosen would bend their branches to comfort the mourners in their distress.

শেষে অনুবাদ নিয়ে তাঁর একটা ছোট্ট প্রবন্ধ আছে, সেটা পড়লেই অর্ধেক পয়সা উসুল হয়ে যাবে। যাই হোক, আপাতত লাতিন সাহিত্য ফের দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। ফালকোরও আরো লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল।

ইন্ডিয়ান এডিশন নেই মনে হয়। দামটা অস্বাভাবিক বেশি দেখাচ্ছে। ইবুক পড়াই ভালো।

গেস্ট ইন দ্য হাউস : এক মাথাখারাপ করা ভূতের বই

 


ভূতের বই যদি পড়তেই হয়, তাহলে এরকম ভূতের বই পড়াই ভালো। কিন্তু মুশকিল হল, এটা ঠিক সে অর্থে ভূতের বই নয়। সাইকোলজিকাল থ্রিলার বা ফ্যান্টাসিও নয়। কিন্তু এমিলি ক্যারলের এই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অসামান্য গ্রাফিক নভেলটা পড়ে যে আপনি ভূত দেখবেন তাতে সন্দেহ বিশেষ নেই। আমিও দেখেছি। ক্যারলের আঁকা তো যাকে বলে 'স্টানিং' আর্টওয়ার্ক, নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকতে হয় মাঝেমাঝে, তখন গল্পের কথা মাথা থেকে বেরিয়েই যায়। কিন্তু একবার গল্পটা শেষ হয়েছে, আমিও খুশিমনে বালিশে মাথা দিয়ে পরদিন বিয়েবাড়ি খাব বলে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় আমার মাথা চিড়চিড় করে উঠল, আমি সত্যি সত্যি ভূত দেখার মতো লাফিয়ে উঠে ফের বইটা উল্টেপাল্টে দেখলাম, আর তারপরেই আমার গা শিরশির করে উঠল। এটা কী পড়লাম রে ভাই? গোদা বাংলায়, হোয়্যাট দ্য ফাক ডিড আই জাস্ট রেড?

'গেস্ট ইন দ্য হাউস' অ্যাবির গল্প। অনেক দেরি করে এক ভালোমানুষ ডেন্টিস্টের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, তার আগের স্ত্রী শীলা মারা গিয়েছে। সে ছবি আঁকত। তাদের এক মেয়েও আছে, মেয়েকে একটু চোখে চোখে রাখবে, এছাড়া অ্যাবির কাছে আর কিছুই চাওয়া নেই তার বরের। ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর না হলেও তারা একটু আউটস্কার্টে থাকে, বাড়ির পিছনে একটা বড় লেক। লোকজন বিশেষ নেই। সেই বাড়িতে এসে অ্যাবি আচমকা ভূত দেখতে শুরু করে। বহুস্তরীয় কাহিনি, বই জুড়ে ইস্টার এগ ছড়ানো, সে প্যানেলের সংলাপে হোক বা ছবির আঁচড় আর রঙে। মোদ্দা কথা, বইটা আপনি যা ভেবে পড়তে চলেছেন, সেটাকে অতিক্রম করে আরো বহুদূর ছড়িয়ে যাবে।

গ্রাফিক নভেলে যে ঠিক কীরকম কাজকর্ম হচ্ছে, বোঝার জন্য এই বইটা পড়ে ফেলুন।

জামাইকাদির ক্যারেবিয়ান সাহিত্য

 


এই বছর আমার আবিষ্কার করা কলমদের মধ্যে সত্যি করে আমার মন কেড়েছেন যিনি, তিনি অ্যান্টিগুয়ার লেখিকা জামাইকা কিনক্যাড। বলাই যায় আমি তাঁর কলমের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

'অ্যাট দ্য বটম অফ দ্য রিভার' আর 'আ স্মল প্লেস পড়ে তিন নম্বর বইটা পড়ব বলে বসে আছি। ভদ্রমহিলা ক্যারেবিয়ান সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ নামকরা, আজীবন লিখছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, এখন আশির কাছাকাছি বয়স। কিন্তু শত শত ভালো লেখকদের মতো তাঁকেও আগে পড়িনি, নামও বিশেষ শুনিনি পরিচিতদের কাছে। গত মাসে আমার বন্ধু ভিশি আমাকে তাঁর লেখার কথা জানায় আর একটা পাতলা পঁয়ষট্টি পাতার বই রেকামেন্ড করে। গোটা বইটাই ওই যাকে বলে স্ট্রিম অফ কনশাসনেস স্টাইলে লেখা, গল্পের শিরোনাম আলাদা আলাদা থাকলেও তেমন কোনও স্পষ্ট গল্প নেই। সাধারণত এইধরনের লেখা আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়, পোস্টমডার্ন সাহিত্যে যাঁরা এক্সপেরিমেন্ট করে প্রখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেকেই পড়তে গিয়ে আমি নাকানিচোবানি খেয়েছি, পড়লেও অ্যাপ্রিশিয়েট করার ক্ষমতা আমার নেই, ডোনাল্ড বার্থেল্মের লেখা পড়তে গিয়ে তো আমি কফিতে চিনির জায়গায় নুন দিয়ে ফেলেছিলাম মাথা খারাপ হয়ে। কিন্তু, জামাইকা ক্যানকেডের এই পুঁচকে বইটা আমাকে একেবারে বশ করে ফেলল। তাঁকে পড়তে গেলে অত বিদ্যার দরকার নেই, স্টোরিলাইন না বুঝলেও চরিত্রদের মনের সঙ্গে একটা নিবিড় যোগ তৈরি হয়, অ্যান্টিগুয়ার প্রকৃতি, সেখানকার মানুষের জীবন ও যাপনের মায়াচিত্র পাঠককে সম্মোহিত করে রাখে। আমি প্রায় ঘোরের মধ্যে দুটো বই শেষ করলাম। এইবার তিন নম্বরটা পড়ব।

ভদ্রমহিলা ঠিক কী লেখেন বা কেমন লেখেন, তার একটা স্যাম্পল দিলাম।

“I saw a world in which the sun and the moon shone at the same time. They appeared in a way I had never seen before: the sun was The Sun, a creation of Benevolence and Purpose and not a star among many stars, with a predictable cycle and a predictable end; the moon, too, was The Moon, and it was the creation of Beauty and Purpose and not a body subject to a theory of planetary evolution. The sun and the moon shone uniformly onto everything. Together, they made up the light, and the light fell on everything, and everything seemed transparent, as if the light went through each thing, so that nothing could be hidden. The light shone and shone and fell and fell, but there were no shadows. In this world, on this terrain, there was no day and there was no night. And there were no seasons, and so no storms or cold from which to take shelter. And in this world were many things blessed with unquestionable truth and purpose and beauty. There were steep mountains, there were valleys, there were seas, there were plains of grass, there were deserts, there were rivers, there were forests, there were vertebrates and invertebrates, there were mammals, there were reptiles, there were creatures of the dry land and the water, and there were birds. And they lived in this world not yet divided, not yet examined, not yet numbered, and not yet dead. I looked at this world as it revealed itself to me—how new, how new—and I longed to go there.”

যাঁরা ক্যারেবিয়ান সাহিত্য নিয়ে আগে নড়াচড়া করেননি, জামাইকাদির বই দিয়ে শুরু করতে পারেন।

ট্রাস্ট: এক সাহসী সেরিব্রাল উপন্যাস

 



মাঝেমাঝে এমন হয়, কোনও বিশেষ বই খুব নাম করে গেলেও সেটা পড়ার আগ্রহ হয় না। কিন্তু তারপর হুট করে একদিন সেই লেখকের কোনও কথা শুনে বা পড়ে মনে ধরে যায়, তখন ইচ্ছে করে তাঁর লেখা বইটাও পড়ে দেখতে। এমনটা সচরাচর হয় না ঠিকই।

রিসেন্টলি এটা হয়েছে হার্নান ডিয়াজের পুলিৎজার জয়ী 'ট্রাস্ট' পড়ার আগে। ডিয়াজ খাস আর্জেন্টিনার লোক, আমেরিকায় এসে ইংরেজিতে লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা টোন পুরোপুরি লাতিন আমেরিকান, তাঁর আমেরিকাকে দেখার চোখও আর চারটে মার্কিন লেখকের চেয়ে ভিন্ন। কয়েক মাস আগে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি পাঠক আর লেখকের মধ্যে যে একটা 'সেক্রেড কানেকশন' আছে বলে দাবী করা হয়, সেই কথাটাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, "I dislike the word sacred because I’m a profound atheist and I’m very much militantly against the intrusion of the sacred in literature and art. I think art is a secular space. I think art is a space of pleasure, of enjoyment, of a very strange way of learning about the world and experiencing who we are on this planet. It’s a space of doubt. The sacred has this ring of absolute certainty to it that I can’t get behind. I’m not trying to be a quibbler or anything, it’s just a word that raises all sorts of red flags for me. Sacred. I’m a profoundly profane writer. And person."

এইটুকু পড়ে যদি মনে হয় স্রেফ নাস্তিকতার কারণেই হেরনান ডিয়াজজে আমার পছন্দের তালিকায় নিয়ে এসেছি সেটা ঠিক হবে না। এই বিশেষ ইন্টারভিউটা পড়ার পর আমি ডিয়াজের নানান বক্তব্য আর আগকার সাক্ষাৎকার আর প্রতিবেদন খুঁজে খুঁজে পড়লাম। তাতে আমার মনে হয়েছে, এই সময় এমন সাহসী, স্বতন্ত্র চিন্তার, সুবিবেচক লেখক প্রায় হাতেগোনা। হেরনান ডিয়াজের বেশ কিছু কথার সঙ্গে আমার মতের মিল আছে, এমন কদাচিত ঘটে। যেমন মানব কৌলের কিছু কিছু কথা আমার মনের কথাও বটে। হিন্দওয়ীর একটা সাক্ষাৎকারে মানবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'আপনি এত প্রলিফিক রাইটার, একের পর এক লিখছেন, সব বই হিট হচ্ছে, পাঠকরা আপনার জন্য পাগল। কিন্তু সাহিত্যে একটা কথা আছে যে একটা জিনিস মাথায় এলে সেটাকে সময় দিতে হয়, নিয়ে বসে থাকতে হয়, যাতে বইটা আরো ভালো হয়! আপনি তো যখন তখন ইচ্ছে হলেই লিখতে বসে যান। যা ইচ্ছে লিখে দেন, কিছুই বাধানিষেধ মানেন না।' তাতে মানব বলেছেন, 'ভালো কথা। আমি তো এসব শুনিনি বেঁচে গেছি। কিন্তু আসল কথা হল, ভালো লিখতেই হবে কে দিব্যি দিয়েছে? আমি খারাপই লিখতে চাই। সাতসকালে উঠে কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুললাম, ব্যাকগ্রাউন্ডে ফরাসি গান হচ্ছে, আমার চার প্যারা যা মনে আসছে লিখতে আনন্দ হচ্ছে, তাই লিখছি। সিগারেট খেতে ভালো লাগছে খাচ্ছি, সেটাও লিখছি। প্রেমে পড়ছি বলে সেটা লিখতে আনন্দ হচ্ছে, তাই লিখছি। ভালো না খারাপ, তোমার মরালিটির সঙ্গে মিলছে না মিলছে না, আমার বয়ে গেছে!' হক কথা! (এবং মানব কৌলের লেখা গোল্ডমাইন বলাই ভালো, এমন খারাপ লিখে চলুন প্রার্থনা করি)

যাই হোক, ডিয়াজের মনোভাব জেনে তাঁর বইটা পড়ার ইচ্ছে হল। পড়লাম। খুব একটা সুখকর রিড বলে মনে হল না, যদিও ডিয়াজের কলম অত্যন্ত শক্তিশালী, তাঁর লেখা অসম্ভব স্মার্টও বটে। তবু উপভোগ করতে আমার বেগ পেতে হল, কারণ লেখকের প্রত্যাশাও ছিল তাই। পাঠকের সব কিছু গুলিয়ে যাবে, কম্ফোর্ট রিডের জিনিস এ নয়। প্রথমে তো, বইটা এমন একটা স্ট্রাকচার ফলো করেছে যে সব নোশন ভেঙে যাবে। তারপর বিষয়বস্তু বাচ্চাভুলানো নয়, একটা মিনিমাম সেন্স অফ হিউমান মাইন্ড অ্যান্ড এক্সিস্টেন্স না থাকলে গল্পের চরিত্রদের মনোভাব বোঝা খুব চাপের হবে। পাঠকদের সুবিধার জন্য খানিকটা বলে দিচ্ছি।

'ট্রাস্ট' চার ভাগে লেখা। প্রথম অংশ 'বন্ডস', সেখানে এক মার্কিন শেয়ার মার্কেট মিলিয়েনার ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীর গল্প চলছে। অ্যান্ড্রু আর মিল্ড্রেড, দুজনেই যাকে বলে প্রডিজি নিজ নিজ ক্ষেত্রে। কিন্তু মিলড্রেডের জীবনের শেষটা যথেষ্ট করুণ।

আপনি ভাবলেন এটাই বুঝি গল্প। সে গুড়ে বালি। দ্বিতীয় অংশ একটা মেমোয়ার বা স্মৃতিকথা যেখানে এক আমেরিকান ফিনান্সিয়ার বলছে যে কুড়ির দশকে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় সে আমেরিকার মার্কেটকে কীভাবে রক্ষা করেছে!

তৃতীয় অংশে এসে বইটা ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে। এই অংশটায় ইডা পার্টেঞ্জা বলে এক গোস্টরাইটের জীবন নিয়ে গল্প এগোচ্ছে, তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে এক আমেরিকান ফিনান্সিয়ারের স্মৃতিকথা লেখার জন্য, কারণ সেই ভদ্রলোকের ধারণা, এক অন্য লেখক তাঁর আর তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে ভুলভাল তথ্য দিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন, সেই বইটার নাম 'বন্ডস। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রথম অংশ এই বইটাই। বন্ডস। আর দ্বিতীয় অংশ যা আমরা আগেই পড়ে বসে আছি, সেই মেমোয়ারই তিন নম্বর পার্টে ইডা লিখছেন। তাঁকে এনডিএ সাইন করতে হয়েছে যে মিল্ড্রেডের জীবন নিয়ে মাথা ঘামাবে না বা তার লেখার কথা বাইরে জানাবে না কোনোদিন। তার মানে ইডার নিজের জীবনেও যথেষ্ট কম্পলিকেসি আছে, আর সেই ঘটনা চমৎকার ভাবে ধরেছেন লেখক।

চার নম্বর অংশ প্রায় পঞ্চাশ দশক পর। অ্যান্ড্রু মারা গিয়েছেন আর ইডা এখন প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। কিন্তু ইডা সারাজীবন ভেবে গিয়েছে, মিলড্রেড এর সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল? পঞ্চাশ বছর পর মিলড্রেডের ডায়েরি আবিষ্কার করে পাবলিক ডোমেনে আনা হয় আর ইডা তখন অ্যান্ড্রু আর মিলড্রেডের জীবনের গোপন অংশটুকু খুঁজে বার করবেন বলে ঠিক করেন।

হারনান ডিয়াজের এই গল্পের মধ্যে গল্পের মধ্যে গল্পের এই কাজটা যে কাল্ট হয়ে যাবে, তাতে আমার সন্দেহ নেই। পাঠক হিসেবে সকলের কাছে বইটা দশে দশ পাবে না সঙ্গত কারণেই, কিন্তু বইটা অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় নেই। আগামীতে ডিয়াজের আরো লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল।

মলয়ালম বই বুদ্ধন চিরিক্কুন্নিল্লা।(অস্মিত বুদ্ধ)

 


এই মলয়ালম বইটা বাংলায় আনার জন্য আমি কাঠবেড়ালির মতো খানিকটা মাটি বয়ে দিয়েছি। সরাসরি মলয়ালম থেকে বাংলা নয়, বইটা আগে হিন্দিতে অনুবাদ হয়েছিল, যদিও সে অনুবাদটা খুব একটা কাজের নয়। মলয়ালম বা অন্য ভারতীয় ভাষা জানা অনুবাদক বাংলায় খুবই কম, থাকলেও আমার সঙ্গে চেনা নেই। বাংলায় এমন কিছু কিছু বই সরাসরি অনুবাদ হলেও সিংহভাগ প্রকাশক কপিরাইট নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ, সাহিত্যসেবার নিরিখে বেআইনি অনুবাদ করে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেই চলে। এমনিতেও বাংলা বাজারের পেশাদারিত্ব নিয়ে...

যাকগে, এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা থাক, মোদ্দা কথা হল জোষে পাষুক্কারণের এই 'আউট অফ দ্য বক্স' লেখাটা রাজীবদা অসম্ভব যত্ন আর মমতায় অনুবাদ করেছেন। প্রকাশকও আশা করি যত্নসহকারে প্রোডাকশন করছেন। কিন্তু কাজটায় যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তাঁর নাম এস এ কুদসি। মলয়ালম ভাষার অনুবাদক। ম্যান্ডারিন সাইফি ইংরেজিতে নিয়ে আসতে কেন লিউয়ের যা ভূমিকা, আরব আর গাল্ফ এর সাহিত্য মলয়ালমে আনতে তাঁর ভূমিকা প্রায় একই। এছাড়াও ফার্সি আর ইন্দোনেশিয়ান ইত্যাদি বই নিয়ে কাজ করেছেন, অন্যান্য অনুবাদক ও প্রকাশকদেরও নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রকের তরফ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন কুদসি স্যার, এমনকি তাঁর খোঁজও আমি পেয়েছি ভিনদেশি এক প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। এমন সদাহাস্য, মৃদুভাষী, নিঃস্বার্থ মানুষ বড় একটা দেখা যায় না আজকাল। মলয়ালম সাহিত্য নিয়ে যে আমি জেনুইনলি ইন্টারেস্টেড, এটুকু জানতে পেরে নিজেই এই বইটা সাজেস্ট করেছিলেন।

না আমি মলয়ালম ভাষা জানি, না আমি প্রকাশক, জোর দিয়ে বলতেও পারি না যে কেউ বই করতে আগ্রহী হবেন। না হলে কেরালায় আধুনিক সাহিত্য (শুধু সাহিত্য কেন, আর্টের সব ফর্মেই তাঁরা শতযোজন এগিয়ে) যে সমস্ত অসামান্য কাজকর্ম হচ্ছে, সেসব আরো বেশি করে বাংলায় নিয়ে আসার জন্য কুদসি স্যার বা জোষ পাষুক্কারণের মতো আরো অনেকের সঙ্গেই কথা বলা যেত। কে আর মীরা, বেনয়ামিন, অখিক কে, ও ভি বিজয়ন, কে এল মোহনবর্মা, এস হরিশ বা জে আর ইন্দুগোপানের মতো মেনস্ট্রিম লেখকদের লেখাতেও প্রচুর বৈচিত্র্য আছে। 'হ্যাংওম্যান' কলকাতা বেসড ঐতিহাসিক উপন্যাস। বেনিয়ামিনের 'গোট ডেজ' সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা যেখানে একজন আরব দেশে গিয়ে ছাগলদের সঙ্গে থাকত, সেই নিয়ে একটা বড় বাজেটের সিনেমা আসন্ন। কে আর মীরার 'কাবার' বাবরি মসজিদ আর রাম মন্দির নির্মাণের সমসাময়িক রাজনীতি চমৎকার ভাবে সাহিত্যে ধরেছে। 'ভাল্লি' অসামান্য ইকো ফিকশন। এদিকে আব্রাহাম ভার্গিসের ইংরেজিতে লেখা 'দ্য কোভেনান্ট অফ ওয়াটার' তো দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। ম্যাজিক রিয়ালিজম আর পোস্ট মডার্ন সাহিত্যের অলিগলির সঙ্গে মলয়ালম সাহিত্যের পরিচয় নতুন নয়।

অনেকেই অনেক বইয়ের ভিড়ে এই বইটা মিস করে যাবেন হয়তো, কিন্তু যাঁরা পড়বেন, তাঁরা এই একটা বইয়েই না থেমে আরো কিছু মলয়ালাম বই পড়ে দেখার চেষ্টা করবেন বলে অনুরোধ রইল। পাঠক, প্রকাশক ও অনুবাদক একসঙ্গে আগ্রহী না হলে অন্য ভাষার ভালো বই আইনি ভাবে বাংলায় আনা একটু চাপের কাজই বটে। প্রকাশক বই নিয়ে যা লিখেছেন তুলে দিলাম...

বুদ্ধন চিরিক্কুন্নিল্লা।(অস্মিত বুদ্ধ) জোসে পাষুক্করণ। ভাষান্তর রাজীব কুমার সাহা ।

বুদ্ধ ফিরে এসেছেন। পুনর্জন্ম নিয়েছেন বিহার প্রদেশের এক গণ্ডগ্রামে, এক দলিতশিশু হয়ে। বিশ শতকের পৃথিবী তাঁকে হাসতে ভুলিয়ে দেয় এক নিমেষে। তিনি হয়ে হাসেন না। হয়ে ওঠেন অস্মিত বুদ্ধ।

আর তারপর, হত্যা, রক্ত, মৃত্যু আর অত্যাচারের কুম্ভীপাকে বাঁধা পড়ে মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে হেঁটে চলেন তিনি। নিঃশব্দে আর্তনাদ করে দলিত তরুণ, মানবজন্ম নয় আর, আমায় গোজন্ম দাও...জোসে পাষুক্করণের মালয়ালাম ডার্ক ক্লাসিক 'বুদ্ধন চিরিক্কুন্নিল্লা'র বাংলা ভাষান্তর আসছে নববর্ষে।

অনুবাদ রাজীব কুমার সাহা। প্রচ্ছদ, প্রকাশকের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খ্যাতনামা মারাঠী শিল্পী গীতালী তারে। জয়ঢাক প্রকাশন।

প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথের গ্রাফিক জীবন

 


প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথের লেখা আমার সেভাবে পড়া হয়নি, তবে মিস্ট্রি আর ক্রাইম লেখক হিসেবে তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, তা আমার অজানা নয়। তাঁর প্রথম বই থেকেই হিচকক 'স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন' সিনেমাটি করেছিলেন, সেটা মনে হয় অধিকাংশ মানুষ দেখেছেন। সত্যি বলতে তাঁর লেখা বেশিরভাগ বইই সিনেমা হয়ে গেছে, তার মধ্যে সমসাময়িক আর উল্লেখযোগ্য হল কেট ব্ল্যাঞ্চেট আর রুনি মারা অভিনীত পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'ক্যারল'।

গ্রেস এলিস আইসনার পুরস্কার জয়ী 'লুম্বারজেন্স' সিরিজের স্রষ্টা, হানাহ টেমপ্লারের সঙ্গে মিলে তিনি এই বিশেষ বইটির নির্মাণের সময় প্যাট্রিশিয়া স্মিথের জীবনকে ধরতে চেয়েছেন, একটা বিশেষ টাইম পিরিয়ডে। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি, প্যাট ঘোষিত সমকামী ছিলেন এবং পাশাপাশি কুইয়র(queer) জগতের আইকনও ছিলেন। এখন ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক আর অন্ততপক্ষে পশ্চিমী আর্ট দুনিয়ায় মোটামুটি স্বীকৃত যে 'ঘোষিত' ব্যাপারটা নিয়ে আলাদা করে কেউ প্রশ্ন করলেই শিল্পীরা খিল্লি করে।

এই বছরের নামকরা ছবি 'অল অফ আস স্ট্রেঞ্জার্স' কুইয়র লাইফ আর একাকীত্বেরই গল্প, আর অ্যান্ড্রু নিজেও 'ঘোষিত সমকামী'। ইন্টারভিউতে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'অভিনয়ের কথা আলোচনার সময় আমি ঘোষিত কি ঘোষিত সে নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে?' সবাই এই নিয়ে একমত হন। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর রবার্ট ডাউনি জুনিয়ার বলেন, 'আমিও কিন্তু ঘোষিত হেট্রোসেক্সুয়াল। এবার থেকে বলতে হবে নাকি?'

সে যাই হোক, এখন এসব হলেও প্যাট্রিশিয়ার সময়ে, মানে চার আর পাঁচের দশকে ঘোষিত সমকামী হওয়া মুখের কথা ছিল না। এমনকি বইয়ে সমকামীদের নিয়ে গল্প লিখতে হলে ব্র্যান্ডভ্যালু খারাপ হত, প্রকাশকরা হাত তুলে নিত। গল্পটা যে সময়কে ধরেছে, তখন প্যাট নিজের জীবনে প্রবল হতাশায় ভুগছেন। 'স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন' এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে রাখলেও কোনও জবাব আসেনি কারো কাছ থেকে, এদিকে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই। কিন্তু শুধু ডে জব করে আর চলছে না। তার স্বভাবও খুব একটা মিশুকে নয়, বরং রগচটা, চেন স্মোকার, নেশা করতে অলওয়েজ রাজি এই মেয়েটার দুর্মুখ স্বভাব আর রিবেলিয়াস আচরণ দেখে সবাই বিরক্ত। তার ওপর প্যাট নিজের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে পড়েছেন ফাঁপরে। মেয়েদের সঙ্গ তার পছন্দ, কিন্তু নিজেকে নিজে ব্যাপারটা বোঝাতে তার অসুবিধা হচ্ছে। এমন কিছু নিয়ে কেউ খোলাখুলি কথা বলত না, এমন কিছু হলেও থেরাপি নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। মনে রাখতে হবে, সময়টা হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে ডিস্কোর্স শুরু হওয়ার ঢের আগে। প্যাট রাত্রিরে পাব থেকে সঙ্গিনীকে ঘরে নিয়ে আসছেন, খটখট করে টাইপরাইটারে গল্প লিখছেন, তারপর পরদিনই আবার ছুটছেন সাইকোলজিস্ট এর কাছে, তাদের থেরাপির এক একটা সিটিং এর ফিস জোগাড় করতে গিয়ে তার অবস্থা খারাপ! টাকার জন্য টাইমলি কমিক্সে গিয়ে স্ট্যানলির সঙ্গে কমিক্সের গল্প লিখতে হচ্ছে, সেটা তার মোটেও পছন্দ নয়। একটা চমৎকার সিন আছে। স্ট্যান লি প্যাটকে জিজ্ঞেস করছেন, 'কমিক্সকে এত দূরছাই করছ! তোমার কাজের দামই বা কে দিচ্ছে! তুমি তো রহস্য বই লেখো।"

প্যাট সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলছেন, "আমি রহস্য বই লিখি না, আমি ভালো বই লিখি!"

এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে তার প্রথম বইটা ছাপা হয় এবং হিট হয়ে যায়। প্যাট তখন মনেপ্রাণে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছেন এবং জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে তিনি 'প্রাইস অফ দ্য সল্ট' বলে একটা উপন্যাস লিখে ফেলেন। কিন্তু সমকামীদের নিয়ে উপন্যাস, তাও আবার হ্যাপি এন্ডিং! প্যাটের সমস্ত চেষ্টাচরিত্র মাঠে মারা যায়, কেউই তাঁর এই বই ছাপতে রাজি নয়। এদিকে লেখিকা হিসেবে তিনি তখন বিখ্যাত হয়ে গেছেন, ঝামেলা শুধু মরালিটির কচকচির। লোকে কী বলবে? কিন্তু প্যাট ঠিক করেছেন বই ছাপবেনই। শেষমেশ একজন রাজি হয় এক শর্তে, বই ছাপা হবে ছদ্মনামে। তাই হয়। ক্লেয়ার মর্গান নামে সেই উপন্যাস বাজারে আসে। এরপর চল্লিশ বছর কেউ জানত না বইটা কে লিখেছে, নব্বইয়ের গোড়ার দিকে অবশেষে প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথ বইটা 'ক্যারল' নাম নিয়ে স্বনামে ছাপতে পেরেছিলেন।

যাই হোক, ফ্লাংগ আউট অফ স্পেসের প্যাটের সেই মনোদশাকে অসামান্য ভাবে ধরেছে। মানুষের স্বভাব যে কতটা জটিল, এই বইটা পড়লে খানিকটা বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, প্যাট্রিশিয়া স্মিথকে একদম মানুষ করেই দেখানো হয়েছে, শুধু শুধু তাকে নায়িকা করার চেষ্টা করেননি স্রষ্টারা। চরিত্রের দিক থেকে দেখতে গেলে প্যাট্রিশিয়া হাইস্মিথ খুব সুবিধের মহিলা কোনোকালেই ছিলেন না, ইহুদিবিদ্বেষ আর ভুলভাল চোখা মন্তব্যের জন্য তাঁকে চিরকাল কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু, একজন মানুষ যে একমাত্রিক হন না, তার চরিত্রে যে নানারকম শেড থাকে আর সেই শেডের স্পেক্ট্রামও পরিস্থিতি অনুয়ায়ী বদলে বদলে যায়, সেটা গ্রাফিক নভেলে অনবদ্য ভাবে তুলে এনেছেন এলিস- টেম্পলার জুটি।

সব মিলিয়ে এই কাজটাকে আমি দশে দশ দিলাম।

শেপ অফ ওয়াটার / সিসিলিয়ান গোয়েন্দা

 


গোয়েন্দা গল্প নিয়ে আলাদা করে যে আমার খুব একটা আগ্রহ আছে, তা নয়। কিন্তু তবু আমি খুঁজে খুঁজে ডিটেকটিভ বা ক্রাইম ফিকশন পড়ি, কারণ কালচারাল অ্যাসপেক্ট। ভালো গোয়েন্দা গল্পে (সে কানাইচরণ হোক বা ইন্সপেক্টর কাগা) একটা দেশ বা শহরের বিশেষত্ব ধরা পড়া, সেখানকার মানুষের খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাক থেকে শুরু করে গোটা স্ল্যাং ও সংস্কৃতির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়, কিন্তু তা গোয়েন্দা গল্পের স্বাভাবিক গতি বা ঘটনাক্রমকে প্রভাবিত করে না। এইজন্য আমি সিওল থেকে সেভিয়া আর প্যারিস থেকে পিকিং অব্দি গোয়েন্দা গল্প খুঁজে যাই, ঘরে বসে দেশভ্রমণ হয়। প্রতি বছর কিছু ভালো গল্প হাতে আসে, আবার কতগুলো পড়ে মনে হয়, না পড়লেই হত! মুশকিল হল, রহস্য গল্প হিসেবে অনেক বইই ভালো নম্বর পায় না, সবাই কিগেশিনো বা মাইগ্রে হতে পারেন না। সে যাই হোক, রিসেন্টলি যে গোয়েন্দাটি আমার মন কেড়েছেন, তিনি সিসিলিয়ান।

আন্দ্রিয়া ক্যামিলেরির ইন্সপেক্টর মন্টেলবানো সিরিজে একগাদা বই, কোনোটাই খুব একটা বড় নয়। এমন ঝরঝরে লেখা আমি ইদানীং আর পড়িনি। কামিলেরির লেখায় সিসিলিয়ান কালচার আর পলিটিক্স এভাবে উঠে এসেছে যে কোনটা কাল্পনিক আর কোনটা আসল আলাদা করে বোঝা সম্ভব নয়। সিসিলিয়ান মাফিয়া, স্থানীয় রাজনীতি, কোরাপশনের পাশাপাশি সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন একদম গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আর গোয়েন্দা বাবাজিও চমৎকার। একটা স্টাডি গার্লফ্রেন্ড আছে তাঁর, মাঝেমধ্যে পালের্মোতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছুদিন থেকে আসেন, ভালো খাবার দেখলে বাবুর নোলা বেয়ে জল পড়ে, কাজ বেড়ে গেলে দুপুরে গিয়ে একটু গড়িয়ে না নিলে চলে না। গুণ্ডা-ফুন্ডাদের সঙ্গেও গলাগলি আছে ভদ্রলোকের, তেমন তেমন হলে তাদের হেল্প নিতেও ছাড়েন না। কিন্তু পুলিশ হিসেবে মন্টেলবানো অসম্ভব তীক্ষ্ণ ও করিৎকর্মা, ভুলভাল করেন মাঝেমধ্যে, আবার সুধরেও নেন। কোর্স কারেকশন করে আসল রহস্য খুঁজে তার জট ছাড়িয়ে ফেলেন, তারপর বেবি অক্টোপাস এর রান্না আর ভালো ওয়াইন খেতে খেতে কমিশনারকে সব বুঝিয়ে বলেন। অক্টোপাস ভাজার মতোই ক্রিসপ, মুচমুচে লেখা, কিন্তু ভালো পাচকের মতো রান্নার ফিলোসফিটা কামিলেরি ঠিকই বোঝেন। ফলে স্বাদে মুচমুচে হলেও রহস্যের গভীরতা কম হয় না। এই বইটাই তাঁর প্রথম বই।

বাবেলভার্স ও কুয়াং ইউনিভার্স

 


আর এফ কুয়াং এখন মেনস্ট্রিম সাহিত্যের স্টার বলা চলে। পপি ওয়ার ট্রিলজি লিখেই তারিফ কুড়িয়েছিলেন, তারপর 'বাবেল' লেখার পর থেকে তো তাঁর আলোচকরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নেবুলা আর লোকাস পুরস্কার পেয়েছে, আর হিউগো পাওয়াও প্রায় পাকাই ধরে রাখা হয়েছিল, এমন সময় হিউগো নমিনেশন থেকে বইটাকে বাদ দেওয়া হয়। সে সব এমনিতে মিটে যেত, কিন্তু চেংডু ওয়ার্ল্ডকনের সময় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তুমুল হইচই হয় যে বইটাকে চাইনিজ সেন্সরশিপের কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে।

সে সব যাই হোক, আর এফ কুয়াং এর খ্যাতি কিছু কমেনি। বাবেল ব্লকবাস্টার হতে না হতেই 'ইয়েলোফেস' মার্কেটে আসে আর গত বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই হয়ে ওঠে। এই দুটো বইই জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে পড়েছি। 'ইয়েলোফেস' পড়তে একদিন লেগেছে, বাবেল পড়তে একমাস। তবে দুটোর মধ্যে বিস্তর তফাৎ আছে বিষয়বস্তুর দিক থেকে। ইয়েলোফেস প্রকাশনা জগতের গল্প, একজন মার্কিনি লেখিকা এক চাইনিজ বংশোদ্ভূত লেখিকার আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে এসে ঘষেমেজে প্রকাশ করেন আর হিট হয়ে যান, তারপর নানান কাণ্ড ! তরতরিয়ে এগোনো যায়।

অন্যদিকে বাবেল (পুরো নাম Babel, or the Necessity of Violence: an Arcane History of Oxford Translators) আটশো পাতার বই, লেখিকার ড্রিম প্রজেক্ট, ভাষা আর ইতিহাসের আঁকেবাঁকে ঘুরে বেড়ায়, ভাষাবিজ্ঞানের প্রচুর গুরুত্বও আছে এই প্লটে, রিসার্চও করেছেন কম নয়। কিন্তু এই ম্যাজিকাল ফ্যান্টাসি পড়তে গেলে মনে রাখতে হয়, বইটা ম্যাজিক নিয়ে নয়, ভাষা নিয়ে। ফলে আমার মতে, ঐতিহাসিক হলেই বইটা আরো বেশি খুলত, ফ্যান্টাসি হিসেবে আমি এক নম্বর কমিয়ে দিয়েছি। অক্সফোর্ড নিয়ে লেখা, ঊনবিংশ শতাব্দীর অক্সফোর্ডের দুনিয়া একেবারে হাতের রেখার মতো চিনিয়েছেন, অথচ ম্যাজিক সিস্টেম এর লজিক বা ম্যাজিকাল ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং জিনিসটি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, অথচ অসামান্য ভালো লেখনী। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে লেখাটাকে ভাবতে পারলে কুয়াং হয়তো বুকারে নমিনেট হয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা হয়নি। দুটো বইই ভালো, যদিও বাবেলকে এগিয়ে রাখার যথাযথ কারণ আছে। সময় থাকলে দুটো বইই পড়া যায়।

দুটো বই- আ জেন্টলম্যান ইন মস্কো আর দ্য হাউস অফ ভিয়া জেমিতো




২৯ মার্চ সবে গেছে। এমনিতে কিছুই নেই, কিন্তু যদি কেউ এই বইটির বিশেষ ভক্ত হন, তাঁদের একটু মনে করিয়ে দিই, প্যারামাউন্টে ২৯ থেকে টিভি সিরিজটা দেখানো হচ্ছে। 'থ্রি বডি প্রবলেম' নেটফ্লিক্স যেভাবে ধেড়িয়ে একটা জেনেরিক 'ভালো সাইফি' শো করে বসে আছে, আশা করি তেমন হবে না। সিরিজটা আসার আগেই আর একবার বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল। সময় নিয়ে। সে কাজটা কাল শেষ হয়েছে। এমন আভিজাত্যপূর্ণ, গ্রেসফুল, মোলায়েম আর যত্নশীল ভাষা আর ট্রিটমেন্ট এই সময়ের আর ক'টা ইংরেজি ভাষার লেখকের আছে জানি না। সে রুলস অফ সিভিলিটি হোক, লিঙ্কন হাইওয়ে হোক, বা এই বইটা। ফ্রিভোলাস বলে একটা কথা আছে, আর এই বইটা যারা পড়েনি, তারা সেই বদনাম করে থাকে বটে। কিন্তু সাবধান করে দিলাম, 'বিষয়বস্তু কী?' এই কথাটা খবরদার জিজ্ঞেস করবেন না এই বইটা পড়ার আগে; কারণ..

“After all, what can a first impression tell us about someone we’ve just met for a minute in the lobby of a hotel? For that matter, what can a first impression tell us about anyone? Why, no more than a chord can tell us about Beethoven, or a brushstroke about Botticelli. By their very nature, human beings are so capricious, so complex, so delightfully contradictory, that they deserve not only our consideration, but our reconsideration—and our unwavering determination to withhold our opinion until we have engaged with them in every possible setting at every possible hour.”
― Amor Towles, A Gentleman in Moscow
যুদ্ধপরবর্তী নেপলস। একটা বাড়ির গল্প কখন একটা শহরের ইতিকথা হয়ে যায়, ডিসইলিউশন্ড আর অসহায় বাবার কথা নিয়ে শুরু হওয়া অটোফিকশন কীভাবে একটা অনবদ্য সিটিস্কেপ মেমোয়ারে বদলে যায়, না পড়লে বোঝা মুশকিল। স্টারনানের লেখা আগে পড়িনি, এটা নিয়েও খুব একটা প্রত্যাশা ছিল না। শুধু নেপলস পছন্দের শহর বলেই শুরু করেছিলাম। এলেনা ফেরান্টের চারটে বই নিয়ে লেখা নেয়াপলিটন সিরিজ পড়ব পড়ব করেও পড়া হয়নি, সেটাই হয়তো এই বইটা ধরার কারণ। চমৎকার লাগছে সন্দেহ নেই।