বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

স্টিমপাঙ্কের দুনিয়ায়

 

হ্যালোউইনের মরসুমে ভূতপ্রেত চর্চা করতে করতে মাথা এমনে বিগড়োল, একেবারে ভূত প্রেত ড্রাকুলার দেশে এসে পড়লাম। ইয়ে, রোমেনিয়ার কথাই বলছি। আজকাল নতুন যুগের সঙ্গে বেশ তাল মেলাচ্ছে বটে, কিন্তু এখনও বুখারেস্ট ব্রাসোভ ক্লুজের বাইরে গ্রামে-গ্রুমে গেলে ভূতপ্রেতের দেখা বিস্তর পাওয়া যায় শুনেছি, যাদুকর বা ওঝাবদ্যির দেখাও মেলে। আর নেকড়ে আর ভাল্লুক তো হরবখত ঘুরছে। বিশেষ করে রোমেনিয়া হল ভাল্লুকের স্বর্গরাজ্য। তা রোমেনিয়ার গল্প যা হবে তা পরে হবেখন, এটা হল একটা বিশেষ অ্যাপ্রিশিয়েশন পোস্ট। ভূত প্রেত দানো দত্যির চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং বটেক! সবটা বলাও যাবে না, তবে ছবি দিয়ে কম্পেন্সেট করার চেষ্টা করছি।

ক্লুজে নাপোকা ট্রান্সিলভিনিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সেখান থেকে নানান জায়গায় যাওয়া যায়, কিন্তু এই বিশেষ জায়গাটা শহরের মধ্যেই একটা গলিতে অবস্থিত, তুলনামূলক ভাবে খুব কম মানুষই এখানকার কথা জানে। তা জিনিসটা কী? না, একটা মিউজিয়াম। তবে যে সে মিউজিয়াম নয়, দুনিয়ার প্রথম স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়াম। বোতন্ড ইস্টভান্ডি বহুদিন এক্সিবিশন মার্কেটে কাজ করেছেন, কিন্তু কিছুই তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। শেষমেশ পাঁচ বছরের চেষ্টায়, ভ্যাম্পায়ারদের দেশে তিনি ফ্যান্টাসির একটা জাদু দুনিয়ার নির্মাণ করেছেন। এমন চমৎকার স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়াম যে একজন মানুষ একা দাঁড় করাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আবার মনে হয়, এইসব প্যাশন প্রজেক্ট একজন দুজন পাগলই করতে পারে। খবরটা শুনেই মাথার পোকা নড়ে উঠল। আমি স্টিমপাঙ্ক এরার ভক্তই বলতে হয়, খুব বেশি জ্ঞানগম্যি না থাকলেও। একটা উপন্যাস লিখতেও শুরু করেছিলাম, সে সত্তর পার্সেন্ট হয়ে পড়ে আছে। তবে আগ্রহটা রয়ে গিয়েছে একইরকম।

কল্পবিজ্ঞানের অ্যাডমায়াররা স্টিমপাঙ্ক সম্পর্কে ভালোই জানে। ভিক্টোরিয়ান যুগে বা প্রাক পেট্রোলিয়াম ইকোনমিতে যখন স্টিম বা বাষ্পই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আর উন্নত জীবনের প্রধান অস্ত্র ছিল, স্টিমপাঙ্ক দুনিয়া গড়ে উঠেছে সেটা মাথায় রেখেই। এইচ জি ওয়েলস আর জুলে ভের্নের দুনিয়ায় যে সমস্ত যন্ত্রপাতি কল্পনা করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই স্টিমপাঙ্ক ইনোভেশন। হাওয়াই সাবমেরিন থেকে শুরু করে মেকানিকাল এক্স রে গগলস,  যাদুঘড়ি থেকে শুরু করে স্টিমপাঙ্ক পাপেট, ভ্যাম্পায়ারদের সঙ্গে লড়াই করার অস্ত্র, বন্দুক, টাইটেনিয়াম টাইপিং মেশিন, গথিক অটোমেটিক আয়না, সাজুগুজুর জিনিস, রেকর্ড প্লেয়ার... হাজারো জিনিস কল্পনা করা হয়েছে, কিছু কিছু বানানোও হয়েছে।

ব্যাক টু মিউজিয়াম! এই অসামান্য জায়গাটির বিশেষত্ব, একবার ঢুকে গেলে সত্যি সত্যিই মনে হয় কল্পনার দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম। দরজা নেই, টিকিট কাটলে দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। সেই দড়ি একটা পুলিকে ঘুরিয়ে একটা আদ্যিকালের পর্দাকে দুদিকে সরিয়ে দেয়, আর উন্মোচিত হয় অন্য এক জগত। সেখানকার গাইডরা কেউ কাউন্ট ড্রাকুলার সহকারী, কেউ হগওয়ার্টসের ছাত্র, কেউ ক্যাপ্টেন নিমোর পার্টনার। চারিদিকে অদ্ভুতুড়ে সব যন্তপাতির মডেল, বিচিত্র আলোর নকশা। পোশন ফুটছে টগবগ করে। গাছড়া ঝুলে আছে মাথার ওপর৷ আদ্যিকালের সব যন্ত্রপাতি বলে মনে হলেও কিন্তু প্রতিটাই অপারেশনাল, মানে শুধুই দেখার জিনিস নয়। এইসব বানাতে গিয়ে/জোগাড় করতে ইস্টভান্ডি বাবুকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে সে কল্পনারও বাইরে! ঘন্টা দেড় দুই পর বাইরে এলে মনে হয়, দেখার মতো একটা জিনিস দেখলাম বটে।

দু তলা জুড়ে মিউজিয়াম, জিনিসপত্রে ঠাসা। স্টিমপাঙ্ক শুধু নয়, ফ্যান্টাসির হরেক উপাদান আছে। প্রকাণ্ড এক বুকসেল্ফ আছে, সেখান থেকে নিয়ম মেনে বিশেষ জায়গা থেকে দুটো বই সরিয়ে নিলে মাঝখান থেকে লাইব্রেরি দু ফাঁক হয়ে একটা গোপন ঘরের সন্ধান মেলে, সেখানে রাখা আছে একটা টাইমমেশিন। আজ্ঞে, চলেও। স্টিমপাঙ্ক রোমিও গেম আছে, হাতের উত্তাপ আর গতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গানের কল আছে, ইন্সটাগ্রাম বা রিলের অ্যাডিকশন ছাড়ানোর মেশিন আছে। বিস্তর ভূতপ্রেত পরী দানো ভ্যাম্পায়ার ইত্যাদিও আছে। মুখে কথা সরে না। চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়েই থাকে। আঙুল কামড়ে বার বার ভাবি, কতটা প্যাশন থাকলে এমন একটা জায়গা তৈরি করা সম্ভব? 

স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়ামে নতুন জিনিসপত্র নিচ্ছে।টেম্পোরারি এক্সিবিশন বা অ্যাকোয়ারমেন্ট, দুটোই হতে পারে, যদি আপনার মডেল পছন্দ হয়! স্টিমপাঙ্ক শিল্পীরা যদি চিলেকোঠায় বসে অদ্ভুত কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে থাকেন, ইন্টারেক্টিভ স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়ামে আপনার জায়গা বাঁধা!

কিছু ছবি পরে আরো অ্যাড করার ইচ্ছে রইল।









প্রাক পঞ্চাশ যুগের স্বাধীন ভারত ও এক পার্সি গোয়ন্দার কাহিনি


ওয়াসিম খান ব্রিটিশ পাকিস্তানি লেখক। তাঁর বেবি গনেশ ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি সিরিজ ইউকেতে বেশ জনপ্রিয় তো বটেই, ভারতেও তাঁর পাঠক কম নেই। আবির মুখার্জির ভক্তরা অনেক সময় ওয়াসিম খানের লেখাও পছন্দ করেন বলে শুনেছি, দুজনে একসঙ্গে একটা পডকাস্টও করেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে ব্রিটিশ পাঠকের কথা ভেবে তিনি বেশ কিছু ক্লিশে 'ইন্ডিয়ান মোটিফ' লেখায় নিয়ে আসেন, হয়তো সেই কারণেই কিন্তু কিন্তু ভাব থেকে এতদিন তাঁর কলমের স্বাদ নেওয়া হয়নি। এদিকে কানাইচরণ রোজ রোজ মিলবে না, ভারতীয় পুলিশ প্রসিডেরালের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। এমন সময় জানা গেল ওয়াশিম খান বছর কয়েক আগে পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছেন। মালাবার হাউস সিরিজের নায়িকা ভারতের প্রথম আইপিএস অফিসার পারসিস ওয়াডিয়া, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস এই সিরিজের প্রথম বই। পড়ে বলতেই হচ্ছে, দারুণ উপভোগ করলাম।

একটু সামারি দেওয়া যাক। সময়টা ১৯৫০ সাল। তবে বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগ্ব্র দিন রাত্রে, যখন মুম্বাই শহরে নতুন বছরের উৎসব চলছে, মালাবার হাউস থানায় একটা ফোন আসে যে জনৈক ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট খুন হয়েছেন। ভদ্রলোক কেউকেটা ব্যক্তি, স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের তরফ এর গোপন একটা তদন্ত করছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রভাব আর ব্যবসা বাণিজ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এহেন ভাগ্যক্রমে এই কেসটা গিয়ে পড়ে পারসিস ওয়াডিয়ার কাছে। পুলিশে প্রথম মেয়ে হওয়ার সুবাদে সে নিজে প্রতিদিন নানান ফ্যাকড়ার সামনে পড়ছে, তারপর এমন হাই ফাই কেস আসতে তাকে (ঘুরিয়ে) বলা হয় ছাব্বিশ দিন পর কন্সটিটিউশন ইম্পলিমেন্ট করা হবে, তার আগে কেস সমাধান না করলে মুণ্ডু ঘ্যাঁচাং! এমনিতেও পুলিশে মেয়েদের কী কাজ?

বাকিটা খাঁটি পুলিশ প্রসিডেরাল। পারসিস আর তার সঙ্গী ব্রিটিশ পরামর্শদাতা অফিসার আর্চি ব্ল্যাকফিঞ্চ সন্দেহের তালিকায় থাকা সকলকে সাক্ষাৎকার করছে, অতীতের পাতা খুঁড়ে বার করছে, ফরেন্সিক, অ্যালিবাই, জবানবন্দির ক্রস ভেরিফিকেশন করছে... কিন্তু যে জিনিসটা বইটাকে সত্যি সত্যি ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে সেটা হল সেটিং।

এমন একটা সময়, যখন বম্বে দ্রুত বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে দেশও। স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সকলের কাছে তার মানে অন্যভাবে ধরা দিচ্ছে। সমসাময়িক রাজনীতি, কাস্ট আর রিলিজিয়ান নিয়ে কচকচি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে দুর্নীতি আর ব্রিটিশদের লেগাসির প্রতি একটা চাপা ভক্তি, সাদা চামড়ার মানুষের প্রশাসনে গুরুত্ব, অর্থনৈতিক বিভাজন... সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে পারসিসের পার্সি ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা সেকালের নগরসংস্কৃতির বিভিন্ন অ্যানেকডোট! অমুক দোকানের ভালো রান্না, তমুক অফিসের সামনে লাগানো গুলমোহর গাছ...  পারসিস এর নিজের জীবনেও কিছু কিছু জট রয়ে গেছে। চরিত্রগুলো যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে, হুড়মুড়ি ভাব নেই, কোথাও মনে হয় লেখক  রকেট চালাচ্ছেন। আবার ঘ্যানঘ্যানও বিশেষ করেন না। প্রি আর পোস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্সের বিপ্লব এর বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে, বর্মার যুদ্ধ আছে, আর সব কিছুই কোনও না কোনও ভাবে গল্পে ঢুকে গেছে। ফলে ইনফো ডাম্প মনে হয় না। এক্সট্রা পয়েন্ট ফর দ্যাট! 

তবে এ সবই মাঠে মারা যেত, যদি রহস্যটা না জমত! আমার কাছে অবশ্য মনে হয়েছে, ওয়াসিম খান ভালোই জট পাকিয়েছেন, খুলেছেনও সাবলীলভাবে। ব্রিটিশ রাইটার হওয়ার কারণে কিছু কিছু জিনিস একটু স্পুনফিড করতে হয়েছে, তবে তাতে গতি থমকায়নি। 

পার্টিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে গল্পে। এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক, ওয়াসিম খানের বাবা নিজেই দেশভাগের সময় পাঞ্জাব থেকে চাপে পড়ে পাকিস্তান যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেখান থেকে তাদের ফ্যামিলি ইউকে ইমিগ্রেট করে যায়। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মতো তিনিও ভারতকে কোনোদিন অন্য দেশ ভাবতে পারেননি। তাঁর মায়ের ক্ষেত্রে অবশ্য মনোভাব ভিন্ন ছিল, তিনি পাকিস্তানে বেশি সময় কাটিয়েছেন। ওয়াসিম নিজে অবশ্য বেশ কিছুটা সময় ভারতবর্ষে থেকেছেন, তার লেখা দেখে বোঝাই যায় এই দেশটাকে তিনি খুব ভালো করে খেয়াল করেছেন। ভারতের প্রতি একটা মমতাবোধও অনুভব করলাম, কেউ কেউ অবশ্য সেটা মেকি বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, তবে আমার কাছে লেখক এর কলম যথেষ্ট যত্নশীল আর এমপ্যাথেটিক বলে মনে হল।

সব মিলিয়ে, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস চমৎকার বই। এই সিরিজের বাকি তিনটে বইও পড়ার ইচ্ছে রইল।

হেল্ড

 

অ্যানা মিশেলস এককালে কবি বলেই পরিচিতি পেয়েছিলেন বলে জানি, 'ফিউজিটিভ পিসেস' উপন্যাসটা তাঁকে গদ্যের জগতে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেই বইটা আমার পড়া হয়নি, 'হেল্ড' বইটা বেশি বড় নয় বলেই হয়তো পড়তে শুরু করেছিলাম।

গল্প শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থায় জর্জ তার ছোটবেলা আর প্রেমিকা হেলেনার কথা ভাবছে। পরের পর্বে জর্জ ফিরে এসেছে, হেলেনার সঙ্গে মিলে একটা ফোটোগ্রাফির বিজনেস খুলে এসেছে। সেখানে আচমকা ছবি তুলতে গিয়ে মৃত মানুষের ছবি ধরা দিতে শুরু করে তার তোলা ছবিতে। গল্প এখান থেকে বেশ বেশ ইন্টারেস্টিং হতে পারত, কিন্তু লেখিকা প্লট নিয়ে মাথা ঘামাননি, তিনি স্পেসটাইমের বিভিন্ন বিন্দুতে মানুষের জীবনের ওপর চোখ বোলাতে চেয়েছেন। ফলে পরবর্তীতে এই গল্প প্রথমে তিরিশ বছর লাফিয়ে ১৯৫০ সালে পৌঁছে যায়, জর্জ আর হেলেনার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় পাঠকের। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। প্রতিটা চ্যাপ্টারে গল্প লাফ মেরে কখনও কুড়ি বছর আগে, কখনও আশি বছর পিছিয়ে... ১৯০৮ থেকে ২০২৫ সাল অব্দি একটা জেনারেশনাল সাগা লেখার চেষ্টা করে গেছে। নাহ, ভুল হল। জেনারেশনাল সাগা কথাটা খাটবে না, কারণ লেখিকা আসলে বিভিন্ন মানুষের গল্প বলেছেন, অতীত ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ায় আসা মানুষদের জীবন, তাদের সত্তা, অতীত, দ্বন্দ আর শোক ডকুমেন্ট করতে চেয়েছেন, কোনও একটা পরিবারের গল্প বিশেষ ভাবে বলতে চাননি। এই হিউম্যান স্টোরির ট্যাপেস্ট্রি বোনার পিছনে সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিচ্ছিন্ন মানুষ আর তাদের জীবনের মাঝে, সে তারা যে সময়ে বা যে অবস্থাতেই জীবন কাটাক না কেন, একটা কমন ইমোশনাল অ্যাঙ্গল খুঁজে ডকুমেন্ট করা। এই গল্পে যারা এসেছে, তাদের পরিবারের গল্প মাঝে মাঝে অতীত বা ভবিষ্যতে কোথাও গিয়ে মিলেছে, বা নাও মিলতে পারে।

অ্যানা মিশেলসের গদ্য মন্দ নয়। কবি হিসেবে তিনি যে ভাষার ওপর যথেষ্ট দখল রাখেন, তা বোঝা যায়। সংলাপ আর পারিপার্শ্বিক বর্ণনার সময়েও তা আরো বেশি করে ধরা পড়ে। কিন্তু, কেন জানি না, আমার কাছে 'হেল্ড' খুব একটা ইন্টারেস্টিং রিড হতে পারেনি। ভালো মন্দ বিচার করার কথাই নয়, কারণ এক একটা বই ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দেয়। একটা বই লেখার সময়ে যে চিন্তাভাবনা আর পরিশ্রম একজন লেখককে করতে হয়, তা শুধু আমার খুব ভালো লাগেনি বলে 'ফালতু বই' বলে উড়িয়ে দেওয়া আমার পছন্দ নয়। অ্যানা মিশেলসের চিন্তাভাবনা, তাঁর গদ্যের স্বচ্ছতা, 'অনেস্টি' ও গভীরতা বহু পাঠকের কাছে সমাদৃত, আমি শুধু বলতে পারি আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে বইটা কানেক্ট করতে পারেনি। একে তো মাত্র সোয়াশো পাতার বই, সেখানে টাইমলাইনে ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ গিয়ে, বিভিন্ন চরিত্র এসে, নাম কে ওয়াস্তে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড আর মারি কিউরিকে এনে... বিরিয়ানি বানাতে গিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেছে। তা খিচুড়ি অবশ্য অতি উপাদেয় জিনিস, কিন্তু এখানে স্বাদটা ঠিক খোলেনি মনে হল।

কয়েকটা চ্যাপ্টার এত ছোট যে সেখানে আসা চরিত্র বা তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সময়ই ছিল না। তার চেয়ে, একটা ফ্যামিলি নিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে গেলে সম্ভবত বইটা আরো চমৎকার  হত বলে আমার ধারণা।

তবে, 'হেল্ড' নিয়ে প্রচুর উচ্ছ্বসিত রিভিউ দেখেছি। নিজে পড়ে বিচার করাই ভালো।

বউবাজারের ড্রাগন পরিবার



ও, আই লাভড দিজ ওয়ান সো মাচ!

ইন্দ্রপ্রমিত দাসের খুচরো লেখা আগেও বেশ কিছু পড়েছি। কিন্তু এই বইটা আমাকে মুগ্ধ করল। ভাব ও ভাষার দিক থেকে চমৎকার সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ তো বটেই, কিন্তু ফ্যান্টাসি গল্প হিসেবেও ইউনিক। ভীষণ ভাবে বাঙালি, আর ততোটাই আন্তর্জাতিক।   

একটা সংক্ষিপ্ত আইডিয়া দিচ্ছি নামধাম বদলে। ধরে নিন, বৌবাজারের কাছে হাউস অফ ড্রাগন মানে ড্রাগন বংশের ফ্যামিলি থাকে। একসময় ড্রাগন কুইনের এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল, তাদের জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ড্রাগনদের একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু কালে কালে ড্রাগন বংশ লোপ পেয়েছে, কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে ড্রাগনদের রাজ্য ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর বেঁধেছে, সেখানকার সমাজ আলাদা, নিয়মকানুন ভিন্ন। এইবার, এই সময়, এই বংশে যদি একটা সন্তান জন্মায় যার পূর্ব জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, সে কলকাতা মেট্রো, বৌবাজারের ভিড় আর বাঙালি চাইনিজ চাউ খেয়ে বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে ড্রাগন বংশের ইমোশনাল সম্পর্ক কতটা থাকবে, কী করে থাকবে?

“Belief is a serpent eating its tail forever, knowing that its tail is finite.”

ইন্দ্রবাবুর বইটা এ-ই জায়গা থেকেই গল্পটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখানে কোনও ভীষণ ক্রাইসিস নেই, বিরাট কোনও যুদ্ধ নেই, শুধু স্মৃতি আর বাস্তবের মধ্যে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এর মধ্যে সেতু বানিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার একটা মায়াময় গল্প আছে। পাশপাশি, এটা একটা কামিং অফ এজ গল্পও বটে, যেখানে দুই ভিন্ন দুনিয়ার দুই ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বড় হচ্ছে। 

গল্প এতটাই মসৃণ ভাবে, তরতর করে এগিয়েছে যে আমি এক সিটিং-এ গোটা বই শেষ করেছি। রু আর অ্যালিস...দুই ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার অংশটা অসম্ভব ভালো। 

ইন্দ্রবাবুর ভাষা লিরিকাল হয়েও সহজ, কিন্তু মাঝেমধ্যে সেই ভাষা মনে চাঁদনি রাতের রোশনাইয়ের মতো মায়াবী আলো ছড়িয়ে দেয়। 

খুব সূক্ষ্ম অথচ সাবলীল ভাবে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর সেক্সুয়ালিটির দ্বন্দগুলো তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি পাঠকের জন্য সবচেয়ে আনন্দের জায়গা, ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড জয়ী এই লেখাটা ভীষণ ভাবে বাঙালি। এমন সুন্দর ভাবে ইংরেজি ন্যারেটিভের মধ্যে বাংলা কথা চলে এসেছে, একটুও বেমানান লাগেনি। 

আকাশ থেকে একটা প্রাণী পড়েছে আর রঞ্জন বলে একটা স্কুলে সেটা নিয়ে এসে বলছে, এটা কি তোমাদের সেই ছোট্ট ড্রাগন? রু বলছে, হ্যাঁ, ছোট বলে উড়তে গিয়ে ডানা খসে গেছে। তখন একটা ছেলে এসে মুখ ভেংচে বলছে, "ডোন্ট বি অ্যান ইডিওট। দ্যাটস আ টিকটিকি!" 

অ্যালিস রু এর মায়ের সামনে চালাকি করছিল বলে তাকে অবলীলায় 'Paka Meye' বলে বলে দেওয়া হচ্ছে। গল্পজুড়ে কলকাতার চিহ্ন, মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের হরেক রকম অ্যানেকডোট ছড়ানো। শেষ পর্যন্ত আসতে আসতে মন ভালো হয়ে যায়, আবার একটু মনখারাপও হয়।

ফ্যান্টাসির ভক্তরা না পড়ে থাকলে অতি অবশ্যই পড়ে ফেলুন।

রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

দিনযাপন (হেমন্ত ২০২৪)


“October, baptize me with leaves! Swaddle me in corduroy and nurse me with split pea soup. October, tuck tiny candy bars in my pockets and carve my smile into a thousand pumpkins. O autumn! O teakettle! O grace!” 


প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি গিয়ে ভাবি, এইবার কি সেই 'অটাম' দেখা হবে? মার্কিনি মুলুক আর কানাডা না হোক, ছবিতে যে দেখে আসছি চিরকাল, সেই গোড়ালি ডোবা পাতার কার্পেটে হেঁটে যাওয়া দিন, সোনালি পাতার রোশনাই, সবুজ হলুদ কমলা লালের হাত ধরাধরি করে শেষ দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়া! বিষাদের দিন হয়, আনন্দের! ফিজগেরাল্ড যেমন বলেছেন, লাইফ স্টার্টস অল ওভার এগেন হোয়েন ইন গেটস ক্রিস্প ইন ফল! 

অটাম আর ফল কি এক? মনে হয় না! সত্যি বলতে, প্রতিটা ঋতু যেন সেখানকার নিজস্বতা নিয়ে বেঁচে থাকে! ইউরোপিয়ান সামার্স আর ভারতীয় গ্রীষ্মের কোনও তুলনা টানা যায় না! অটাম আর হেমন্ত কস্মিনকালেও এক নয়! ইংরেজি 'ফল' আর হিন্দি 'পতঝড়' এর ব্যাঞ্জনা শুধু কানে নয়, মনেও অন্যরকম করে বাজে। আসলে, প্রতি বছরই অটাম দেখি ঠিকই, কিন্তু মন ভরে না! মনে হয়, আরেকটু দীর্ঘজীবী হতে পারত এই সোনালি সময়টা! 

বছর কয়েক আগে স্মরণজিত 'হেমন্তের প্রেমপত্র' নামে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন, সেখানে তিনি লিখেছেন, "দুর্গাঠাকুর ভাসানের পর থেকেই হেমন্তের শুরু। গাছের পাতায় মরচে ধরতে শুরু করে তখন থেকেই। শুরু হয় পাতা ঝরার মরসুম। ব্রোঞ্জের প্রজাপতি এসে জড়ো হয় শহর থেকে গ্রামের পথেঘাটে, মানুষের মনে। নানা বাড়ির আনাচ-কানাচে ও ছাদে জ্বলে ওঠে আকাশপ্রদীপ! একাগ্র সেই আলো যেন অন্য এক পৃথিবীর কাউকে নীরবে বলে, ‘ভুলিনি, আমরা ভুলিনি তোমায়!’

জীবনে হেমন্ত আসার বিশেষ কোনও বয়স আছে বলে আমার মনে হয় না। হেমন্ত মানে বার্ধক্যের দিকে পা বাড়ানোর সূত্রপাত নয়, বরং রংমিলান্তির দিনলিপি হাতবদল করে একটু ভালো করে জীবনকে দেখে নেওয়া! নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া, যেতে সবাইকেই হয়, সেই পার্মানেন্ট 'পতঝড়' সকলের জীবনেই আসে, কিন্তু পাতাঝরার মরসুম আসার আগে, মনের ভিতর আলো জ্বালানোর চেষ্টাটুকু আদৌ করেছি কি? আমাদের মনের আকাশপ্রদীপ কি জ্বলেছে সলতের শেষ বিন্দু অব্দি?

শরতের শেষ বা মাঝামাঝি যাই হোক, মাসখানেক ধরে আমার রুটিন, বিকেলের দিকে কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘন্টা আড়াই তিনের জন্য হাঁটা লাগানো। মাঝেমধ্যে বেশিও হয়ে যায়!
পথও মোটের ওপর এক, কিছুদূর গিয়েই পার্কে ঢুকে পড়ি। প্রাতার নামে পার্ক বটে, আসলে চোদ্দ আনা ফরেস্ট ল্যান্ড। ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়সওয়ারদের জন্য সুঁড়িপথ, আর অসংখ্য পায়ে চলে ট্রেল কাটাকুটি করে গেছে। মাঝে একটা ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পাকা রাস্তা,  সেখানে গাড়ি চলাচল নেই, দুদিকে গাছের সারি, প্যারালালি দুটো কাঁচা রাস্তা৷ অজস্র গাছ দুদিকেই, ঘাসবন, মখমলি মাঠ। অনেকে বড় রাস্তা দিয়ে ছোটে, অনেকে হাঁটে, কেউ কেউ স্কেট করে বা সাইকেল নিয়েও যায়। 

এই পথে গিয়ে পড়লে বোঝা যায়, অটাম কাকে বলে! হলুদের সমারোহ শুধু নয়, এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটালে কেউ যেন মনের মধু ঢালে, মুখে একটা মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়, নাকে একটা সুগন্ধি পাকা কমলার সুবাস আসে। রিলকে লিখেছিলেন, "At no other time does the earth let itself be inhaled in one smell, the ripe earth; in a smell that is in no way inferior to the smell of the sea, bitter where it borders on taste, and more honeysweet where you feel it touching the first sounds. Containing depth within itself, darkness, something of the grave almost.'"

নিয়মিত খেয়াল করলে দেখেছি গাছগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। শুনতে বোকা বোকা লাগে, কিন্তু এক একটা বিশেষ গাছ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। গ্রীষ্মের মাঝ থেকেই কিছু কিছু গাছের পাতা শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছিল, কিন্তু সেপ্টেম্বর আসতে আসতে তাদের আরেক রাউন্ড নতুন পাতা গজিয়ে গিয়েছে, কচিকলাপাতা রঙ গাঢ় সবুজ হয়ে লেমন ইয়েলো, তারপর ক্রোম ইয়েলো হয়ে উঠছে একটা একটা করে। মাঝে দু চারদিন ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল, ভিয়েনায় বন্যা হয়ে যা তা অবস্থা, তারপর দেখি প্রখর তাপে শুকিয়ে যাওয়া মরাঘাসের ওপর লেবুরঙের অসংখ্য পাতা, দূর্বাঘাস, তার মধ্যে কোথাও কোথাও ঘাসফুল আর মাশরুম ফুটেছে, কালো বাদামি ফুটকি দেওয়া ফড়িং আর অন্যান্য উড়ুক্কু পোকা নাচানাচি করে বেড়ায়। প্রজাপতির কথা ভাবছেন তো? রোমান্টিসাইজ করে ঢুকিয়ে দিলে কেউ বুঝতে পার‍ত না ঠিকই, কিন্তু কেন জানি প্রজাপতি আমার চোখে পড়েনি। বরং অচেনা ছুটকু পাখি দেখেছি মাঝেমধ্যে। 

সেপ্টেম্বর শেষ, অক্টোবর চলছে, দুর্গাপূজা চলে গেল! ভিয়েনার চেনামুখের পুজো আর ভয়ংকরী সব কেরিয়ারিস্টিক প্রশ্নের ভয়ে এইবার আমরা প্রাগে পালিয়ে গিয়েছিলাম। চমৎকার ছিমছাম পুজো। আর উত্তুরে শহরে শীত ভালোই পড়েছে, হেমন্তও পুরোদমে হলুদের পিচকিরি চালাচ্ছে! গায়ে একাধিক লেয়ার গলিয়ে পথেঘাটে চক্কর দিই। আমাদের বন্ধু ক্রিস্টেন প্রাগের মেয়ে, ব্রাজিলে গিয়ে দেখা হয়েছিল। দু বছর পর তার সঙ্গে দেখা, আগের মতোই সুন্দরী আছে, আগের মতোই আন্তরিক। ক্রিস্টেনের বয়ফ্রেন্ড উৎকর্ষ হলদ্বানীর ছেলে, তাদের সঙ্গে আড্ডা করে বেশ হালকা লাগল। আজকাল খুব অল্প লোকের সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে। তক্কে জড়াতে ইচ্ছে করে না। কিয়ানু রিভসের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে, "টু প্লাস টু ফাইভ বলছ? বেশ, তাই হবে।" ক্রিস্টেনদের সঙ্গে আড্ডা মেরে মনে একঝলক বাতাস এসে লাগল।

ক্রিস্টেন এমনিতেই ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, এশিয়ান স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে  সে আমাদের প্রশ্ন করে ভারতবর্ষ আর সেখানকার জীবন সম্পর্কে জেনে নিতে চায়। বিভিন্ন পার্স্পেক্টিভ পেলে তার সুবিধা হয়। আমি ইনিয়েবিনিয়ে উত্তর দিই। আমাকে ভারতীয় বা বেনারসী বা বাঙালি ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দিলে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি, আমার সেরকম কোনও বিলংগিংই নেই। প্রতিটা দেশে গিয়েই মনে হয়, এ তো আমারই দেশ! প্রাগ আমার নিজের শহর, আর্জেন্টিনায় আমার চিরকালের বাসা, প্যারিস বা আমাজোনিয়ার মানুষকে আমি জন্ম জন্মান্তর ধরে চিনি। কোথাওই নিজেকে 'স্ট্রেঞ্জার' বলে মনে হয় না, কিন্তু তারপর আমি সেখান থেকে চলে আসি, সেই বিলংগিংনেসটাও আমার সঙ্গেই চলে আসে। যে সমস্ত শহরেই দিন কাটিয়েছি, সেই সময়ে সেই শহরগুলো আমার কাছে আপন হয়ে উঠেছে, কিন্তু কয়েক বছর পর সেখানে ফিরে গেলে (বিশেষ করে দেশে) আর আগের শহরটাকে খুঁজে পাই না। তখন আবার নতুন করা সম্পর্ক পাতাতে হয়। মেজাজে একটা উইকেন্ড কাটিয়ে ফের ভিয়েনায় ফিরে এলাম। সেই পাউঁরুটি ডিম আপেল, উল্টোপাল্টা কাজ, সেই কামচালাউ দুপুররাত্রির রান্নার ফাঁকে বই আর সিরিজের চিরাচরিত দিনলিপি। ব্যতিক্রম শুধু ওই হাঁটাটুকু। যাকে বলে, মনের তেষ্টা মেটানো। 

অক্টোবর শেষ হতে হতে সবুজ ঘাসের রঙ সূর্যাস্তের আকাশের মতোই পাল্টে যেতে থাকে। সব অবশ্য নয়, প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য চিরকাল বিদ্যমান। একদিকে এক থালা গাছ শুকিয়ে  শাকভাজা, অন্যদিকে নতুন ঝোপে সতেজ পান্নার ছাপ দেখি। তবে কিনা সিজন চেঞ্জের ঢাক বাজছে, বুঝতে কষ্ট হয় না। টাল খাওয়া এক একটা গাছ সবুজ তৃণভূমিতে একা দাঁড়িয়ে শোভিত হয়, তারা একটু একটু করে গা মুচড়ে হলদে কালচে পাতা ফেলতে শুরু করে। চেয়ে চেয়ে দেখি, পায়ের তলায় শুকনো পাতার সঙ্খ্যা বেড়ে চলে, চেনা গাছগুলোর পাতায় রঙ ধরে। এমন কিছু ম্যাজিক সৌন্দর্য নয়! তীব্র নয়, খুব ঢিমে চালে হেমন্ত থুড়ি অটাম আর ফল এসে কড়া নাড়ে এই বনপ্রান্তরে। এক একটা গাছে এক একটা শেড, তা বদলে যেতে তিন চারদিন লাগে। আমরা বুঝি না, আমাদের চোখে সামগ্রিক বদল ছাড়া কিছু ধরা দেয় না। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীরা হয়তো ঠিকই বোঝে! হয়তো আমার মনের ভুল, কিন্তু বুকে হাত রেখে বলছি, গরমকালে যে সমস্ত পোষা কুকুরগুলো লাফঝাঁপ করে নিরন্তর খেলা করে যেত, তাদের দুরন্তপনাতেও একটু একটু করে ভাঁটা পড়েছে। আমি মিলন কুন্দেরা বা হান্স ফালাদা কানে দিয়ে হাঁটি। হলুদের শেড ক্রমে গাঢ় হচ্ছে, পায়ের তলায় ঝরাপাতার আস্তরণ গভীর হয়। জঙ্গল পাতলা হচ্ছে, দূরে মাঝেমধ্যে হরিণের দল দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখা যায়। বাতাসে হিমের ছোঁয়া, টি শার্ট থেকে সোয়েট শার্ট, তারপর একটা জ্যাকেট। রোদ এখনও ভালোই ওঠে, কিন্তু সেই আরামদায়ক উষ্ণতা আর নেই। বেখেয়াল হয়ে চলি, মাঝেমধ্যে ইয়ারপিস খুলে বেঞ্চিতে বসে জিরোই! ছোট ছোট সাজানো হ্রদ... লেক বলাই ঠিক হবে.... হাঁসের দল সাঁতার কাটে। সবুজ জলের পাশে একটা শান্ত পরিবেশ, কেউ কেউ বেঞ্চে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, কেউ কেউ দেখি ছবি আঁকছে। জলে সবুজের ছায়া পড়ে, হলুদ পাতা পড়ে, সেদিকে তাকিয়ে ঘোর লেগে যায়। আমিও বসে পড়ি ইতিউতি। জিরোই। ব্লুটুথ বন্ধ করে অবান্তর কথা ভাবি!   

অনেকদিন গান শোনা হয় না সেভাবে! বিশাল ভারদ্বাজের কথা আর সুর যে আমার কী প্রিয়! পুরোনো সুর গুনগুন করি! প্রিয় গান গাইতে গিয়ে মনে পড়ে যায়, উর্দু বইগুলো পড়া হয়নি! লখনউতে আমার বন্ধু ফৌজান আন্সারি কি এখনও উর্দুর ক্লাস নেয়? ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে একযুগ ধরে দেখা হয়নি! নিয়ম মেনেই সবাইকে মিস করি! অক্টোবর এর সময়টা আমাদের এই পুজো সেই পুজো ভাইফোঁটা করেই চলে যেত, হেমন্ত ফেমন্ত নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। হেমন্তও আমাদের সেভাবে দেখা দেয়নি। কিন্তু অক্টোবারের একটা মাহাত্ম্য থাকেই, বিশেষ করে জীবনের একটা বিশেষ সময়, যখন ছেলেরা বন্ধুদের নিয়েই বেঁচে থাকে। তারপরের গপ্পো সবাই জানে। স্মৃতিচারণেরও হয়তো একটা স্পেসিফিক ঋতু আছে। ঋতু না হোক, মাস তো আছে। অক্টোবর! সুজিত সরকারের সিনেমা হোক বা আমজনতার জীবন, উই আর গ্রেটফুল ফর দিস মান্থ। আকাশের তারা হয়ে যাওয়া মানুষ, হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, ফেলে আসা সময়... স্মরণজিতের মতোই মনে মনে বলি, ‘ভুলিনি তোদের বুঝলি! তোদের জন্য, তোমাদের জন্য আর কিচ্ছু করব না জানি। করতে পারব না। কিন্তু তোমাদের মনে রেখে দেব জেনো। ভুলব না কিছুতেই।’


দিন কাটে। হঠাৎ একদিন খেয়াল করি, হলুদ গাছগুলোর পাতা প্রায় অনেকটাই ঝরে গিয়েছে। গাছেদের হাত পা আঙুল ছড়ানো কঙ্কাল দেখা দিচ্ছে, সন্ধ্যে নামার আগে কোনো কোনো কাজে শত শত কাক এসে বসে থাকে। দেখে একটা ভূতুড়ে ছবির দৃশ্য বলে মনে হয়। কমবেশি একই রাস্তায় হাঁটি, একই সময়ে হাঁটি বলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, জার্মান কেতা মেনে আলাপচারিতা হয় না বটে, কিন্তু আমি সবাইকে মনে রাখতে চেষ্টা করি। কেউ দু পায়ে দু রঙের মোজা পরে ছোটে, কেউ চারটে কুকুর নিয়ে হাঁটে। মাঝরাস্তায় গিয়ে আমি একটা বেঞ্চে বসি, তার দুটো বেঞ্চ পরে এক হুডি পরা বয়স্ক মানুষ এসে বই খুলে বসে। আমি প্রায় রোজই উঁকি মেরে নামটা দেখতে চেষ্টা করি, কিন্তু পাই না। বইটা জার্মান এটুকু বুঝতে পেরেছি। জার্মান অনুবাদও হতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় গরমই লাগে একটু একটু। তখন সোয়েটশার্ট খুলে কিছুক্ষণ হাওয়া খাই। সিনামন অ্যান্ড ব্রাউন সুগার... ভিয়েনায় অক্টোবারের হাওয়ায় নাকি দারচিনির গন্ধ ভাসে, মোজার্টের সুর শোনা যায়। লোকজন ইয়াবড় কুমড়ো নিয়ে হ্যালোউইন এর জন্য পরিকল্পনা করছে, অনেকে ক্রিসমাস মার্কেটের জন্য রেডি! এরই মধ্যে ভিয়েনা দারুচিনি দ্বীপ হয়ে গেছে। গোল্ড অ্যান্ড ক্রিস্প... চেস্টনাট রোস্ট করার জন্য কেনার দরকার নেই, চিকু নাশপাতি আপেলের মতো চেস্টনাটও গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাতাসে সিনামনের পাশাপাশি কফি আর রোস্টেড চেস্টনাটের গন্ধ ভাসে।

আমি সেসব বুঝি না, ভিজে মাটি আর গাছের গন্ধ পেয়েই আমি খুশি। রঙিন পাতা কুড়িয়ে হাত বুলোই। এক একটা ম্যাপলের পাতায় চার চারটে রঙের শেড। মনে হয় ঝরে পড়া পাতাগুলো সোনায় মুড়ে দিচ্ছে কেউ।

বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মৌজ করে ছুটোছুটি করছে, দেখলে বেশ ভালোই লাগে। আমাদের তো বেশিরভাগ শহরে একটু হাত পা খেলানোর জায়গাও নেই, ঘাসে ছাওয়া একটা মাঠও পাওয়া যায় না। এরা ভালো আছে! সবুজ হলুদ কমলা পুলওভার পরে কেউ কেউ একদম বনের মধ্যে মিশে যায়, তখন মনে হয় তারাও বনের হরিণ বা কাঠবেড়ালির মতোই। ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করতে করতে কেউ কেউ পড়ে যায়, কিন্তু বেশি কাঁদে না কেউই। আমি দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে মাথা ওপরে করে বসে থাকি। গাছের অ্যানাটমির ওপারে নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, মাঝেমধ্যে প্লেনও উড়ে যায়। মাঝেমধ্যে শিরশিরে বাতাস বয়, বাদামি পাতাগুলো বৃষ্টির মতো উড়ে আসে মাটির দিকে। কাপাসের ফুলের মতো খড়কুটো ওড়ে। দেখে সাধ মেটে না। মাঝেমধ্যে ফোটোগ্রাফার হতেও ইচ্ছে করে বটে, কিন্তু আদ্যিকালের এমআই ফোনে প্রায় কোনও রঙই ধরা পরে না। আমি আবার হাঁটা লাগাই।

অন্ধকার নামার ঠিক আগে বনবীথিকার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দূরে চেয়ে দেখি, গাছের মাথা, পাতা আর আকাশের রঙ মিলে একটা সোনালি কুয়াশার আদল তৈরি হয়েছে দূরে! ধীরে ধীরে আলো কমে আসে, সেই বাষ্পীভূত কুয়াশা এসে ঘিরে ধরে আমাদের। কেটলির ভাপের মতো সোনালি কুয়াশা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলি। 

দিন কাটে। যেমন কাটার কথা...








বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

স্টোনার: এই বইটা পড়বেন না


"Stoner’s colleagues, who held him in no particular esteem when he was alive, speak of him rarely now; to the older ones, his name is a reminder of the end that awaits them all, and to the younger ones it is merely a sound which evokes no sense of the past and no identity with which they can associate themselves or their careers."

এই হল বইয়ের শুরু! যেন বলেই দেওয়া, এই বই এক পরাজিত মানুষের গল্প বলতে চলেছে। বইয়ের শেষে মৃত্যুশয্যায় স্টোনার নিজেকেই বল, হোয়াট ডিড ইউ এক্সপেক্ট?

ওয়েল, নট দিস😒

জন উইলিয়ামস ১৯২২ সালে জন্মেছেন, শান্ত একটা জীবন কাটিয়েছেন, তিরিশ বছরের বেশি একই জায়গায় শিক্ষকতা করেছেন, কাজের সূত্রে দু বছর ভারত আর বর্মায় কাটিয়েছেন, তারপর বয়স হলে মারা গেছেন। বইয়ের সংখ্যা সাড়ে চার (পাঁচ নম্বরটা শেষ করতে পারেননি) শেষের দিকে দু একটা পুরস্কার পেয়েছেন, গ্রেট আমেরিকান নভেলিস্টদের মধ্যে তাঁকে গোনা হয়নি।

কিন্তু আচমকা, তাঁর মৃত্যুর তিরিশ বছর পর তাঁর একটা বই ফরাসিতে অনুবাদ হয়ে এমন সাড়া ফেলে দেয় যে আমেরিকান পাবলিশার নিজেই অবাক হয়ে যায়। গোটা ইউরোপ জুড়ে এই লেখককে নিয়ে লাফালাফি শুরু হয়, ফায়দা নিতে আমেরিকাতেও বইটা আবার করে নবরূপে প্রকাশ করে হয়। আর, থ্যাংকস টু ইন্টারনেট, জন উইলিয়ামস 'স্টোনার'-এর স্রষ্টা হিসেবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। হাজার হাজার পোস্ট, গুডরিডসে পাঁচতারা রিভিউর বন্যা, শয়ে শয়ে রিলস, নতুন প্রজন্মের লোকজন হামলে পড়ে একটা ভিন্টেজ ক্লাসিক পড়ছে, এমন সাধারণত দেখা যায় না। সবাই বলাবলি করছে... দ্য গ্রেটেস্ট নভেল অফ ইউ এস ইউ হ্যাভ নট হার্ড অফ...তার পাশাপাশি আরেকটা কথা যা অনেকের ধ্যান আকর্ষণ করেছে, তা হল, এরকম বিষন্নতার আখ্যান কেউ কোনোদিন লেখেনি। স্টোনার সর্বকালের সেরা মেলানকলিক টেল।

মুশকিল হল, 'মেলানকলি' আর 'বিষাদ' শব্দটার সঙ্গে কী করে যেন একটা কাব্যময়তা জড়িয়ে গেছে। বিষন্নতার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। লোকে মেলানকলিক সাহিত্য চিরকাল পড়ে ভালোবেসেছে, এখনও তার বদল ঘটেনি। কিন্তু স্টোনার আসলে সেরকম বই নয়! তাহলে এমন কী আছে যা নিয়ে এত মাতামাতি?

কী আছে, জানার চেষ্টা করলেই মনে হয় ভালো হত! কিছু কিছু ভালো জিনিস ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেই মনে হয় ভালো। যেমন, গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইজ! আমি লিখে দিতে পারি, এই ভয়ংকর সুন্দর সিনেমাটা যারা একবার দেখেছেন, তাদের ৯৯% দ্বিতীয়বার দেখতে চাইবেন না। 'স্টোনার' নিয়েও আমার মনোভাব খানিক তাইই। পরবর্তীতে নাকি জন উইলিয়ামস বলেছিলেন যে স্টোনার আসলে দুঃখের গল্প নয়, রোজকার দিনযাপন আর তার জটিলতার মধ্যেও একটা শান্ত সৌন্দর্য আছে, একটা আনন্দ আছে, স্টোনার সেইরকমই গল্প। আমিও ভেবেছিলাম, হবেও বা। পার্ফেক্ট ডেজের মতো অসামান্য সিনেমা যেমন! বইটা শেষ করে বলতে বাধ্য হচ্ছি, উইলিয়ামস সাহেব, প্লিজ, বাতেলা দেবেন না! আনন্দ! বাপ রে বাপ! এই বইটা না লিখলেই তো হত!

শেষ করেছি বললাম বটে, কিন্তু শেষ করতে আমার জান বেরিয়ে গেছে। না, লেখার সমস্যা নয়। ভূমিকাতেই জন উইলিয়ামস জানিয়েছেন, গদ্য যদি পড়তে ভালো না লাগে আর শুধু তার মধ্যে নিহিত অর্থ বোঝার জন্য তা জোর করে পড়তে হয় তাহলে তার চেয়ে কষ্টকর কিছু হয় না। উইলিয়ামস সাহেবের কলম অহেতুক জটিলতা তৈরি করে না, সহজ জিনিস সহজ ভাবে লেখেন। যত দুঃখই হোক, যত ডিপ্রেসিংই হোক, যত মরবিডই হোক, পড়তে 'ভালো' লাগে। মানে, গদ্যটা ভালো লাগে, গল্পটা নয়। বারবার থামতে হয়! কেন? কী এমন আছে গল্পে?

সেটাই তো সমস্যা! গল্পে কিছুই নেই। একজন মানুষের জীবন আছে শুধু! উইলিয়াম স্টোনার! কৃষক পরিবারের এই ছেলে পড়াশোনা করতে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে এবং সেই একই ইউনিভার্সিটিতে সারাজীবন পড়িয়ে যায়। ঠিক তাঁর স্রষ্টার মতোই! এই গোটা জীবন ধরে লাইব্রেরি আর বইয়ের দুনিয়াযা বিচরণ আর সেই ক্ষণিক আনন্দের বাইরে তাঁর সঙ্গে যা ঘটে, তার একটাও সুখের বলা চলে না। একঘেয়ে দিনযাপন, আপনজনদের বিদায় নেওয়া, একটা অসম্ভব ডিপ্রেসিং সম্পর্ক, একটা ভেঙে যাওয়া প্রেম, কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি, অসুখবিসুখ...একের পর এক ডিজাস্টার!

স্টোনারের মতো জীবন যেন কাউকে কাটাতে না হয়! সমস্ত জীবন ধরে অসম্ভব নিঃসঙ্গতা ভোগ করে লোকটা মারা যায়, আর আমিও বই শেষ করে বলি, যথেষ্ট হয়েছে! চুলোয় যা! লেটস রিড অ্যানাদার বুক! কিন্তু হায়! পরপর কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ ধরে স্টোনারের জীবনের বিভিন্ন মুহুর্ত আমার মাথার মধ্যে ফিরে ফিরে আসে, আমি আর কিছুতেই মনসংযোগ কর‍তে পারি না! পড়তে পারি না, ভাবতে গেলেই মনে হয়, হায়! 
জীবনের কী অপচয়! কী করে মানুষের জীবন এত দুঃখের হতে পারে! হায়!

এই প্রথম একটা পোস্ট দিয়ে বলছি, এই অসম্ভব ভালো বইটা না পড়াই ভালো। প্লিজ পড়বেন না। সিরিয়াসলি, পড়বেন না।

Monstrillo... মেক্সিকান ভূতের জয়যাত্রা

হ্যালোউইন আর ভূত চতুর্দশীর মরসুমে আমার ভূতচর্চা চলছে। সকাল থেকে রাত ভূত দেখছি। সানডে সাস্পেন্সে ক্লাসিক ভূত, সিরিজে এভিল আর ফ্রম, পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি ভূতের বই। মাংগা গ্রাফিক নভেল থেকে উইয়ার্ড জনরা, সব ঘেঁটেঘুটে দেখছি। এই ধারায় যে আজকাল দুনিয়ায় কতরকম কাজই হচ্ছে! এই বইটা রেকামেন্ড করেছেন সুলেখিকা মহাশ্বেতা।

মন্সট্রিও নাম শুনলেই মন্সটারের কথাই মনে হয় বটে। কিন্তু মেক্সিকোর এই মন্সটারাস বইটা আসলে 'ভূত নয় অদ্ভুত' গোছের! মানে, বিচিত্র প্লটই বটে!

এক মেক্সিকান দম্পতির ছেলে উঠতি বয়সেই মারা গেছে। বেচারির ফুসফুসের রোগ ছিল, সবাই জানতই সে বেশিদিন বাঁচবে না৷ কিন্তু তবুও বেশ কিছুদিন সে দুনিয়ায় ছিল। ছেলে মারা যেতে তার মা ছেলের শরীর চিরে তার ফুসফুস এর একটা অংশ কেটে সঙ্গে রেখে দেয়, সেই নিয়ে মেক্সিকোয় বাপের বাড়ি চলে যায় সে। সেখানে তার মায়ের পরিচারিকা গল্পচ্ছলে জানায় যে শরীরের কাটা অংশকে খাবার দিলে সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা গোটা মানুষ জন্ম নেয়। স্রেফ গাঁজা, বোঝাই যায়। কিন্তু সন্তানহারা মায়ের মন ছেলের ফুসফুসকে একটু একটু করে চিকেন মাটন খাওয়ানোর চেষ্টা করে আর বুঝতে পারে যে ফুসফুসটা সত্যিই সে সব খাচ্ছে। খেয়ে বড়ও হচ্ছে, আর মানুষের মতো না হয়ে এমন এক মন্সটারাস জোঁক সদৃশ প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে, খিদে পেলে যে কামড়ে তোমাকেই খেয়ে ফেলবে।

এইটুকু পড়ে যদি ভাবেন বাকি গল্পটা হাড়হিম করা ভূতের, হতাশই হতে হবে। বইটা আসলে পুরোপুরি ক্যারেক্টর বেসড, মন্সট্রিওর বাবা, মা, মায়ের সমকামী বান্ধবী আর তার নিজের জীবনের ওঠাপড়া নিয়েই এই গল্প এগিয়েছে। মন্সট্রিওর অস্তিত্ব প্রত্যেকের জীবনের ক্রাইসিস আর সত্তার এক একটা দিক খুলে দিতে চেয়েছে, তাদের অ্যাকশনগুলো আসলে তাদের অবসাদ দুঃখ হতাশার ম্যানেফেস্টেশন। চারজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্পটা বলা হয়েছে, এবং শেষ হয়েছে মন্সট্রিওর নিজের বয়ানেই। কী করে শেষ হয়েছে, সে না হয় নাই বললাম।

গেরাদো সামানো কোর্তোভার এটি প্রথম বই। তিনি খুব স্মার্টলি বইটাকে তিন চারজন চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন, খুব বেশি সীমানা ছাড়াননি। ক্যারেক্টর ড্রামা আর উইয়ার্ড টেল স্টাইলের মাঝে সাবলীল ভাবে মেক্সিকোর যাপন আর খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি এসেছে, কিন্তু গল্প মেক্সিকো ছেড়ে বেরোনোর পর ন্যারেটিভ এর ধার একটু হলেও কমেছে মনে হল। তবে শেষ পর্বে গিয়ে লেখক সেরা ফর্ম ফিরে পেয়েছেন, তাই ওটুকু মাফ করে দেওয়াই যায়।

এই সূত্রে মনে পড়ে গেল, কয়েক বছর আগে ইরাকের লেখক আহমেদ সাদাওয়ির 'ফ্র‍্যাংকেস্টাইন ইন বাগদাদ' মূলত সেই কাজটাই করেছিল, যা 'মন্সট্রিও' এই বইটায় করেছে। কিন্তু সাদাওয়ির লেখাটা ভীষণ ভাবে অ্যাবসার্ড আর ঘোর রাজনৈতিক ছিল, বিচ্ছিন্ন গল্প আর চরিত্রের জীবনগুলোকে একটা প্রাইমারি ক্রাইসিসে বাঁধার চেষ্টা তিনি করেননি, ফলে আম পাঠকের একটু একঘেয়ে লাগতেই পারে! মন্সট্রিও সেরকম বই নয়! এখানে একটা নিটোল গল্প নেই নেই করেও আছে। হ্যাঁ, একগাদা অনুত্তরিত প্রশ্ন আছে ঠিকই, আর উইয়ার্ড লিটে, বিশেষ করে এই ঘরানার হরার ফ্যান্টাসিতে 'লজিক' নিয়ে প্রশ্ন করা বোকামিই বটে! কিন্তু বইটায় একটা সেন্ট্রাল (ভূতুড়ে) ক্রাইসিস আছে আর সেই ক্রাইসিস ঘিরে কিছু সাদামাঠা মানুষের জীবন আছে, তাই থমকাতে হয় না। এ ধারার বইপত্র পড়ার শখ থাকলে বইটা হতাশ করবে না বলেই আমার ধারণা।

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪

দ্য রোড: পার্ফেকশন ইন গ্রাফিক নভেল?

 


কর্ম্যাক ম্যাকার্থি গত বছরই মারা গিয়েছেন। তার আগেই অবশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, ফ্র্যাংকো-বেলজিয়ান শিল্পী মানু লার্সেনে তাঁর পোস্ট অ্যাপোক্লিপ্টিক ক্লাসিক 'দ্য রোড' নিয়ে কাজ করছেন। ভদ্রলোকের কাজ সম্পর্কে ভাসাভাসা আইডিয়া ছিল, 'দ্য ব্রডেক রিপোর্ট' বলে একটা গ্রাফিক নভেল বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু দ্য রোডের মতো ভীষণ 'ম্যাকাবরে' দুনিয়াকে কমিক্সে কী করে ধরা যাবে সেই নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল। মাস দুয়েক আগেই শেষমেশ সেই কাজ বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এতদিনে সেটা পড়ার সুযোগ হল। আর পড়ে আমি... বাকরুদ্ধ!
আগে আমার আশঙ্কার কারণটা বলি। ম্যাকার্থির লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা অতি অবশ্যই বুঝতে পারবেন আমি কী নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম! আসলে তিনি তাঁর শক্তিশালী কলমের মাধ্যমে যে দুনিয়াটা রচনা করেন, তা প্লট ভিত্তিক গল্পে বা সিনেমায় নিয়ে আসা ভীষণ চাপের। ম্যাকার্থির ভাষা ছাড়া অন্য কোনও মিডিয়াম--- সে অন্য কারো কলম হোক বা ছবি বা অ্যানিমেশন--- সেই দুনিয়াটা গড়তে পারবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতেও ম্যাকার্থি ভীষণ ডিটেল ওরিয়েন্টেড লেখক, তাঁর গল্পে চরিত্ররা সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এগিয়ে যায়, সেই ট্রাঞ্জিশনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দেশকাল সমাজের বর্ণণা আঁকা হতে থাকে। এমনকি দরকারে ইংরেজির মধ্যে স্প্যানিশ সংলাপ ঢুকে যায়...
'দ্য রোড' দেখতে গেলে খুবই সাধারণ প্লটের গল্প, একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীতে এক বাবা আর তার ছেলে শীত থেকে বাঁচতে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছেন, ঘোরতর শীত, খাবারের অভাব আর ছাইয়ে মোড়া দুনিয়ার পাশাপাশি তাদের ক্যানিবালদের হাত থেকেও রক্ষা পেতে হবে। একটু এদিক ওদিক করলে এই প্লটে অনেক গল্পই ঢুকে যেতে পারে, জম্বি ঢুকিয়ে দিলে 'দ্য লাস্ট অফ আস' হয়ে যাবে, রোবট ঢুকিয়ে দিলে হলিউডের বি গ্রেড সাইফি সিনেমা হয়ে যাবে। কিন্তু ম্যাকার্থি সে সব ন্যাকামি করতেই যাননি। তাঁর লেখায় বাবা আর ছেলে বাদে তেমন কোনও চরিত্র আসেনি, বিশেষ কোনও সাইড প্লট আসেনি, এসেছে শুধু এই অলীক ভয়ংকর দুনিয়ার বর্ণনা! টুকরো টুকরো যথাসামান্য সংলাপ, সেই সমস্ত সংলাপের ধার এতটাই বেশি যে পাঠকের মনে হয় কেউ যেন এক একটা সংলাপের মাধ্যমে তাদের কলজে ছিঁড়ে নিচ্ছে। শুধু ভাষা আর ট্রিটমেন্ট, যথেষ্ট! ওইটুকু দিয়েই বাজিমাত করেছেন, পুলিৎজার প্রাইজও জিতে নিয়েছেন!
এই দুনিয়াটা একটা গ্রাফিক নভেলে কী করে ক্রিয়েট করা যাবে? এই ইউনিক মুডটা কী করে ধরা যাবে ছবিতে, তাও অন্য একজনের ছবিতে? শব্দ আর বাক্য দিয়েই যে অ্যাটমস্ফেয়ার তৈরি হয়েছে, তা প্যানেলের ছবি দিয়ে অনুবাদ হবে কী করে? এই আশঙ্কা ভুল নয়, অন্ততপক্ষে বেশিরভাগ অ্যাডাপ্টেশনের জন্য তো নয়ই।
কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, লার্সেনে অসামান্য কাজ করেছেন। প্রতিটা প্যানেল ভীষণ বাস্তব, ভীষণ বাস্তব, আর ভয়ংকর সুন্দর! ভয়ংকর! এতটাই সুন্দর যে যে কোনও প্যানেল র্যান্ডমলি তুলে ফ্রেম করে ঘরে টাঙিয়ে রাখা চলে। সংলাপ প্রায় নেইই (বইয়ের মতোই), তার জায়গা ভরাট হয়েছে ছবি দিয়েই। সাদাকালো আর মাঝেমধ্যে প্রয়োজন মতো লাল আর খয়েরির শেড, এই গ্রেডেশন এমন চমৎকার ভাবে বইটার মূল ন্যারেটিভকে ফুটিয়ে তুলেছেন যে না পড়লে বিশ্বাস হবে না। কখনও অবিরাম তুষারপাত, কখনও শনশনে হিমেল হাওয়া, কখনও মুষলধার বৃষ্টি...তার পাশাপাশি এসেছে ক্ষয়ে যাওয়া মৃতদেহের ফসিল, ভাগাড় দৃশ্য, জঙ ধরে যাওয়া মেটালিক জাঙ্কয়ার্ড ভিজে আর্দ্র আবহাওয়ায় ধসতে থাকা শহরগুলোর ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠামো... তার মধ্যে দিয়ে চলেছে বাবা আর ছেলে! এবং ভায়োলেন্স! অসামান্য রূপান্তর! এমন এক ডিপ্রেসিং ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে যে পোয়েটিক সৌন্দর্য বের করে আনার যে দক্ষতা ম্যাকার্থির ছিল, তা ছবির মাধ্যমে ভীষণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। প্রায় দু আড়াই বছর ধরে দিন রাত একটা কাজের পিছনে পড়ে থাকলে পার্ফেকশনের লেভেল কী হতে পারে, সেটা দেখার জন্যই এই গ্রাফিক নভেলটা মনে থেকে যাবে। কয়েকটা প্যানেল কমেন্টে দিলাম!
এই কাজটার পর ইচ্ছে রইল ম্যাকার্থির 'ব্লাড মেরিডিয়ান' রিপিট করার! আগেরবার পড়তে গিয়ে মাথা ঘুরছিল, এইবার স্টোরিটেলে এসেছে দেখেছি। বাংলাদেশে সম্ভবত অনুবাদ হওয়ার কথা আছে, তার আগে একটু একটু করে শুনে নেব। ইতিমধ্যে ব্লাড মেরিডিয়ানও গ্রাফিক নভেল হয়ে গেলে ষোলকলা পূর্ণ।
Abrams Comic Art
1936/-

বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪

দ্য কুইন অফ শর্ট নভেলস: বেলজিয়ান সাহিত্যের রানি



ভালো সাহিত্যিক হওয়া আর ভালো স্টোরিটেলার হওয়া এক জিনিস নয়। দুটো মুচুয়ালি এক্সক্লুসিভ হবে এমন জরুরি নয়, তবে হবে না তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারবে না। মহৎ সাহিত্য লিখেও তার মধ্যে একটা নিটোল গল্প বুনে দেওয়ার বিদ্যা যাঁরা আয়ত্ত করেছেন, তাঁরা নমস্য মানুষ। তার চেয়েও বেশি ক্রেডিট সেই সমস্ত কলমের, যাঁরা গল্প হয়তো সেভাবে বলছেন না, কিন্তু যাই বলছেন, পাঠক গল্পের মতো করে পড়ে যাচ্ছে, একবারের জন্যও হোঁচট খাচ্ছে না। আমেলি নাথোম্ব এই ঘরানার সাহিত্যিক। উচ্চারণে হেরফের হতেই পারে, মাফ করবেন।
হঠাৎ করে আমেলির কথা মনে পড়ল কেন? কারণ, কাল সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হবে আর বেটিং টেবিলের ঊর্ধ্বে থাকা যে কয়েকজন কলমের দিকে অনেকে তাকিয়ে থাকেন, তিনি হয়তো আগামীতে এই লিস্টে চলে আসলেও আসতে পারেন। প্রথমত, বেলজিয়ামের সাহিত্যিকদের মধ্যে হয়তো কেউই আমেলির মতো প্রলিফিক নন। তাঁকে বলা হয় দ্য কুইন অফ শর্ট নভেলস। অজস্র গল্প, নভেলা, উপন্যাস লিখেছেন, ফি বছর একটা তো আসেই। আমি আগে বেশ কিছু পড়েছি, আর বারবার মনে হয়েছে, ইনি 'ওস্তাদ' লেখিকা। আমেলির অধিকাংশ কাজই যাকে বলে অটোবায়োগ্রাফিকাল, কিন্তু পড়তে একঘেয়েমি হয় না, কারণ পার্স্পেক্টিভের জায়গা থেকে তিনি প্রতিবার এমন একটা স্ট্যান্ড নেন, যা আগে পাওয়া যায়নি। ন্যারেটিভে সত্তা, অবসাদ, প্রত্যাশা, মৃত্যু সম্পর্কিত যে সমস্ত প্রশ্ন উঠে আসে, যেভাবে উঠে আসে, তাতে পাঠক লেখার গভীরতা অনুভব করে ঠিকই, কিন্তু সেই ক্রাইসিস মাথায় নিয়ে মাঝজলে ডুবে যায় না।
তবে, এই উপন্যাসটার ছবি দিয়েছি একটা বিশেষ কারণে। আমেলির এই ছোট্ট একশো কুড়ি পাতার বইটা অটোফিকশন নয়, বরং তাঁর বাবার জীবন নিয়ে লেখা একটা কাহিনি। অনেকটাই বাস্তব, তবে কতটা কল্পনা কতটা বাস্তব বোঝার উপায় নেই। প্রসঙ্গত, আমেলির বাবা ডিপ্লোম্যাট ছিলেন, তিনি নিজে নানান দেশে থেকে বড় হয়েছেন। কঙ্গোতে ষাটের দশকে বিপ্লবীরা তাঁর বাবা সমেত অনেককে হোস্টেজ নিয়ে রেখেছিল, প্রায় চার মাস ধরে নেগোশিয়েশন চলেছিল তাঁর সঙ্গে। বইয়ের প্রথমেই দেখা যায়, তিনি বন্দুকধারীদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এক্ষুনি ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলি তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এমন সময় তাঁর বাবা প্যাট্রিক নাথোম্ব তাঁর অতীত জীবনের কথা ভাবতে শুরু করেন। যে সাবলীল ভাবে এই স্মৃতিচারণ এগিয়ে গিয়েছে, তাতে মাঝপথে থামতে ইচ্ছে করে না। আমেলির বাবা কোভিডের সময় মারা গিয়েছেন, যতদূর জানা যায় খুবই ইমোশনাল, চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার অভাব ছিল না। আমেলি বহুদিন ধরে তাঁর বাবার অতীত ও জীবনকে আবিষ্কার করার জন্য লেগে আছেন। হয়তো এই বইটা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন! বাবাকে নিয়ে কতজন কত লেখাই তো লেখে, কিন্তু ফার্স্ট পারসনে লেখা এমন অভিনব, সৎ, আউট অফ দ্য বক্স বাস্তবানুগ উপন্যাসিকা ক'টা লেখা হয় কে জানে?


সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪

দ্য নোটবুক ট্রিলজি

No book, no matter how sad, can be as sad as a life.

আগোতা ক্রিস্টফের নাম শুনলে মনে হয় আগাথা ক্রিস্টির হারিয়ে যাওয়া বোন। আসলে অবশ্য তা নয়। ইনি হাঙ্গেরিয়ান লেখিকা, ছাপান্ন সালে রাশিয়া হাঙ্গেরি অধিকার করার পর সুইটজারল্যান্ডে পালিয়ে যান, লেখালিখি করেন ফরাসিতে। অবশ্য বেশিরভাগ লেখাতেই হাঙ্গেরির সমাজ আর ইতিহাস উঠে আসে, কিন্তু ফরাসি লেখালিখির শৈলী বা সুইস উদাসীনতা দেখা যায় পাশাপাশি। তাহলে কী বলব এই বইকে? হাঙ্গেরিয়ান সাহিত্য? ফ্রেঞ্চ লিট? না সুইস সাহিত্যই বলতে হবে?

সে যাই হোক, আগোতা ক্রিস্টফের কলম ইন্ডি ঘরানায় বেশ নামকরা। তিনি চিরাচরিত জিনিস লিখে পাতা ভরান না। আমার এক বন্ধু বছর দুয়েক আগে তাঁর লেখা নোটবুক ট্রিলজি রেকামেন্ড করেছিল, আমি এই সেই করে আর পড়তে পারিনি। এই সপ্তাহে কম্বাইন্ড এডিশনটা ধরলাম, আড়াই দিনে শেষও হয়ে গেল। এইবার আমি ভ্যাবলা হয়ে বসে ভাবছি কী পড়লাম? মন আর মাথা দুইই গুবলেট হয়ে গেল? এত রকম ইমোশন একসঙ্গে মিশে খিচুড়ি হয়ে গেছে যে ঠিক কী লিখব বুঝে উঠতে পারছি না।

এইটুকু বলতে পারি, আগোতা ক্রিস্টফ একটা অনন্য জিনিস লিখেছেন। তিনটে বইই (নোটবুক, প্রুফ, আর দ্য থার্ড লাই) প্রায় দেড়শো পেজ না তার চেয়েও কম, আর তিনটের সুরই একেবারে আলাদা। বিশেষ করে প্রথম বইটা পড়তে গিয়ে বোঝা যায়, এ আর চারটে বইয়ের মতো নয়।

আরেকটু খোলসা করি বলা যাক। প্রথম বই শুরু হচ্ছে হাঙ্গেরির সীমানার কাছে অবস্থিত একটা মফস্বলি টাউনে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এমন সময় এক রগচটা বদমেজাজি বুড়ির মেয়ে তার কাছে নিজের দুই জমজ ছেলেকে রেখে ফ্রন্টে যাওয়া স্বামীকে খুঁজতে যায়। এই ছেলেদুটো নেহাতই বাচ্চা, ডাইনিমার্কা দিদার কাঠখোট্টা মেজাজ আর অপরিষ্কার বাড়িঘরে তাদের টিকে থাকাই মুশকিল ছিল। কিন্তু ছেলেদুটো হাড় বিচ্ছু, বা বলা যায় শার্লকের মতো দুজন জিনিয়াস সাইকোপ্যাথ। তারা চটপট সব বুঝে নেয়, দিদাকে সিধা করে দেয়, নিজের পড়াশোনা খাওয়াদাওয়া হাইজিনের দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়, প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতে বা দয়া দেখাতে দু'বার ভাবে না। দুই ভাই একদম হরিহর আত্মা, তারা দুজনে বিদঘুটে আর মারাত্মক সব কাজকম্মো করে, আর সব কথা লিখে রাখে একটা নোটবুকে। পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে হবে এমন ড্রাই ফ্যাক্ট মার্কা লেখা কেন? না বর্ণনা, না ন্যারেটিভ, না ইমোশন, স্রেফ ফ্যাক্ট, স্রেফ অ্যাকশন! "আমরা বালির বস্তা দিয়ে ছেলেটাকে পেটালাম। সকালে আমরা ঘাস কাটি। দিদা চান করে না। তার গায়ে পচা গন্ধ। আমাদের মুখ ধোয়ার জায়গা নেই..." তিরিশ চল্লিশ পাতা পড়ে বোঝা যায় আসলে আমরা ওই নোটবুকটাই পড়ছি। প্রথম বইটা এমন চমৎকার ভাবে একটা ডার্ক গল্প বলেছে যে সব ভুলে পড়ে যেতে হয়। প্রায় থ্রিলারের ভঙ্গিতে গল্প এগিয়ে চলে। এরই মধ্যে হাঙ্গেরির গ্রাম্য জীবন, যুদ্ধের পরিবেশ, সংস্কৃতি সবই ধরা পড়ে যায়। বইটা এমন একটা জায়গায় শেষ হয় যে পরের বইটা না পড়ে উপায় নেই।

পরের বই 'দ্য প্রুফ' পড়তে গিয়ে দেখি লেখিকা ভোল পাল্টেছেন। প্রথম বইতে প্রায় নিয়ম করে কোনও জায়গা বা চরিত্রের নাম আসেনি, দ্বিতীয় বইতে তা পুরোমাত্রায় আছে। ন্যারেটিভ আছে, বর্ণনা আছে। সব আছে। কিন্তু গল্প শেষ হতে হতে মাথাটা একেবারে ভোম্বল হতে শুরু করে! এই মন খারাপ হচ্ছিল, এই রোমাঞ্চ হচ্ছিল, এই রহস্য সমাধানের কথা ভাবছি, তারপর সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! প্রায় একটা ক্লিফহ্যাঙ্গারে দাঁড় করিয়ে দ্বিতীয় বই শেষ হয়।

তৃতীয় বইতে এসে আগোতা ক্রিস্টফ প্রায় "ধুত্তোর! আউট হলে হব, চালিয়ে খেলো!" বলে যে ধুন্ধুমার চারছয় মার‍তে শুরু করলেন, তাতে আমি হাঁ। ধরুন, একটা বই পড়লেন। গোটা বই ধরে মোসাদের স্পাই একটা বিশাল রহস্যের সমাধান করল। শেষে গিয়ে জানা গেল, পুরোটাই সে স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু স্বপ্নটায় কিছু কিছু সত্যিও আছে। কোনটা বাস্তব কোনটা অবাস্তব বোঝার চেষ্টা করতে করতেই আপনি আবিষ্কার করলেন, আপনার চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করেছে। ভেবেছিলেন হাঁদাভোঁদা পড়ছেন, এদিকে বইটা হিস্টোরিকাল নভেল হয়ে, সাইকোলজিকাল মিস্ট্রি হয়ে থ্রিলার হয়ে আপনাকে কাঁদিয়ে ফেলছে। বই শেষ হতে হতে এমন একটা বিষাদ, এমন এক মেলানকলিক আমেজ এসে জুড়ে বসে যে পাঠক চুপ করে বসে থাকে।

আগোতা ক্রিস্টফ এই ট্রিলজিতে মানুষের নিয়তি আর যুদ্ধের বিপর্যয় এর মাঝামাঝি এমন এক আশ্চর্য গল্প বুনেছেন, যা আগে থেকে বোঝার বা অনুভব করার কোনও উপায়ই নেই। কিন্তু পড়তে পড়তে একসময় বোঝা যায়, লেখিকা পরিকল্পনা করে বা না করে ঠিক সেটাই করেছেন, ঠিক সেভাবেই বইটাকে লিখেছেন, যা হয়তো এই বইটার নিয়তিতে ছিল। দ্য স্টোরি ওয়াজ সাপোজড টু বি দিস!

I answer that I try to write true stories but that at a given point the story becomes unbearable because of it’s very truth, and then I have to change it. I tell her that I try to tell my story but all of a sudden I can’t-I don’t have the courage, it hurts too much. And so I embellish everything and describe things not as they happened but the way I wished they happened.

She says, “Yes, there are lives sadder than the saddest of books.” I say, “Yes. No book, no matter how sad, can be as sad as a life.

হাইলি রেকামেন্ডেড! সম্ভব হলে পড়ে ফেলুন।

দ্য নোটবুক ট্রিলজি
গ্রেভ প্রেস


জুনজো ইতোর সুন্দরী ভূত

 

মাংগা জগতে ভীষণ হইচই চলছে। কেন? কারণ ক্লাসিক হরার মাংগার লেখক জুনজো ইতোর 'কালজয়ী' এবং গ্লোবালি জনপ্রিয় মাংগা 'উজুমাকি'-এর একটা অ্যানিমে ভার্সন রিলিজ করেছে এইচবিও।

বলাবাহুল্য, মাংগা থেকে অ্যানিমে করা নতুন কিছুই নয়। কিন্তু ক্লাসিক মাংগা ফ্যানরা জানেন, বছরের পর বছর ধরে চলা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট মাংগার ওই ম্যাজিক আর ধারাবাহিক আর্ট স্টাইল রঙিন অ্যানিমতে ধরে রাখা অসম্ভব। অনেক সময় অ্যানিমেশনে স্টাইলটাই বদলে যায়, গল্প ছোট করে দেওয়া হয়, স্ক্রিনের কথা ভেবে রদবদলও কম করা হয় না। তাতে অ্যানিমে হিসেবে জিনিসটা দাঁড়াক বা না দাঁড়াক, মাংগার রস আর বজায় থাকে না।

বহুদিন ধরে এই নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কী করে মূল অ্যানিমের মেজাজ অক্ষত রাখা যায়? কাজটা আসলে টেক্নিকালি চ্যালেঞ্জিং, টাকাপয়সার অ্যাঙ্গলও আছে, অনেকবার এগিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে জাপানি প্রয়োজকদের। কিন্তু এই প্রথম, দীর্ঘ রিসার্চ এর পর একটা অ্যানিমে আসছে, যেখানে জুনজো ইতোর ম্যাজিক পুরোপুরি বজায় রাখা হয়েছে। সাদাকালো আর্ট স্টাইল নিঁখুত রেখে, মূল গল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উজুমাকি করতে গিয়ে বারবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে, ডেডলাইন পিছিয়েছে, দু একবার তো মনে হয়েছিল ক্যান্সেলই হয়ে গেল বুঝি! কিন্তু শেষমেশ কাজ শেষ হল। উজুমাকির একটা এপিসোড এসে গেছে আর মাংগার দর্শকরাও দেখে মুগ্ধ। সবাই বলাবলি করছে, এইবার মাংগা অ্যানিমেশনের দুনিয়া আমূল পাল্টে যাবে।

উজুমাকি বহুদিন আগে পড়েছি, সে নিয়ে কিছু বলব না বিশেষ। কিন্তু সম্প্রতি জুনজো ইতোর অন্য আরেক নামকরা কাজ শেষ হল। টমি... বা তোমি বা তোমিয়ে... কে জানে?

তা গল্প শুরু হয়েছে একটা পুলিশ সিন থেকে। টমি বলে একটা মেয়ের মৃতদেহ কেটেকেটে কে ফেলে দিয়েছে, সেই মেয়েটা স্কুলের ট্রিপে গেছিল! কিন্তু পরদিনই টমি ফিরে আসে। সবাই তাজ্জব ? টমিকে যারা মেরেছিল তারা ভাবছে, কী করে এটা সম্ভব? প্রথম, বলিউডি সিনেমা খুন ভরি মাঙ্গ-এর মতো টমি বেঁচে বদলা নিতে ফিরেছে? না টমি মরে গিয়েছিল, সত্যিই বেঁচে ফিরে এসেছে ? জুনজো ইতো, বিইং জুনজো ইতো. .. দ্বিতীয় বিকল্প বেছে নিয়েছেন।

টমি একদম ক্লাসিক হরার মাংগা, সকলের এই জিনিস ভালো লাগবেও না। এরকম গোরি হরার খুব একটা সবাই হজম করতে পারে না, আমিও নই। চার্লস বার্নসের 'ব্ল্যাক হোল' পড়তে গিয়ে আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়েছিল, এদিকে টমি তো আবার সাড়ে সাতশো পেজ এর বিশাল ভলিউম, প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে চলছে।

কুড়িটা গল্প আছে টমিতে। মূল চরিত্র টমি। সে কে? একটা কিশোরী মেয়ে, ছেলেরা তাকে দেখেই তার প্রেমে পড়ে আর এমন পড়ে যে তাকে একদম মেরেই ফেলে (বোঝো! এমন প্রেমের কী দরকার? তবে এরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইতোবাবু) কিন্তু টমি হল টমি... সে মরেও মরে না। কোনও ব্যাকস্টোরির বালাই নেই, মোটের ওপর সিম্পল আর্ট স্টাইল (যদিও গল্প বিশেষে তা ধরন পাল্টেছে) মেন্টেন করে জুনজো ইতো স্মার্টলি একটা ভূতুড়ে গোরি থিমের সিরিয়াল মাংগা তৈরি করেছেন। কিছু গল্প বেশি ভালো, কিছু অভিনব প্লট আছে, অনেকগুলো প্রেডিক্টিভ, তবে মাংগা হরার এর দুনিয়ার নিরিখে সেরা কাজ এর একটা, সেটা বলতে হবে।

আমার 'উজুমাকি' বেশি প্রিয় ফর সিওর, আর সিরিজ না এলে সম্ভবত এটা পড়াও হত না। চারটে এপিসোড আসবে, তার আগে জুনজো ইতোর স্টাইলটা একটু রিভিজন করতে গেছিলাম। ব্ল্যাকহোল এর মতো অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি, বাঁচোয়া! মাংগা ফ্যান হলে পড়তেই পারেন।

সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আনন্দের গল্প? ওয়েল, নট রিয়েলি

 


ইন্দোনেশিয়ার লেখক নর্ম্যান এরিকসন পাসারিবুর 'হ্যাপি স্টোরিজ মোস্টলি' হ্যাপি মনে পড়তে গিয়েছিলাম। হ্যাপি হওয়ার কারণ, পাতলা বই, নামফামও করেছে, হুড়মুড়িয়ে পড়ে আমি গোঁফে তা দিয়ে কেতা দেখাব। কিন্তু প্রথম দুটো গল্প পড়তে গিয়েই হ্যাপিনেস উবে গেল, মাথার মধ্যে সব বনবন করে ঘুরতে লাগল, চোখে পদ্মফুল দেখলাম। সবই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে প্রায়, কিন্তু গল্পগুলোর দোষ নয়, কারণ গল্প ইজ ফাটাফাটি। দোষ আমার, কারণ এই লেখা নিয়ে আমার কোনও আইডিয়াই ছিল না। লেখক কে, তিনি কী বলতে চাইছেন, কী ধরনের লেখালিখি তিনি করেন, সে সব সম্পর্কেও আমার কিছুই জানা নেই।

তাই বই বন্ধ, আগে লেখকের খোঁজ নেওয়া যাক। এখন প্রশ্ন হল, বই পড়তে হলে লেখকের কথা জানতে হবে কেন? কয়েকদিন আগে মডার্ন আর্ট সম্পর্কে কথা ওঠায় আমার এক বন্ধু বলেছে, আর্ট বুঝতে গেলে শিল্পীর সাতকাহন জানতে হবে কেন? তিনি কী ভাবেন, কী ভাবে শিল্পজীবনে এগিয়েছেন, সেসব পড়াশোনা করে একটা ছবি দেখতে বসবে নাকি? কী দরকার? বাত তো ঠিক হ্যায়! দরকার আর কী? কোনও দরকারই নেই। লেখক বা শিল্পীর ব্যাকগ্রাউন্ড বা মনোচিন্তা জেনে নেওয়ার বা বুঝে নেওয়ার তেমন কোনও দরকার নেই, যা বোঝা যায় বা অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় তা পড়লে বা দেখলেই হয়! তবে কিনা মুশকিল হল (ঠিক ভুল আমি বলতে পারব না, সে যোগ্যতা আমার নেই) শিল্প বা সাহিত্যের সমাজ এইভাবে চলে না। লেখকরা পরীক্ষানিরীক্ষা করবে, বাউন্ডারি ভাঙবে, চেনাছকের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আর দর্শন বাক্য আর সংলাপের আড়ালে লুকিয়ে রাখবে, এটাই দস্তুর। সেটা যদি খানিকটা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ইচ্ছে হয়, তাহলে ওইটুকু কাজ করতে হয়। এখন আমি ম্যাঙ্গো রিডার, গম্ভীর সাহিত্য পড়ে আমার পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়নি। তাই আমার পাঠ অভিজ্ঞতাও  যে খুব মসৃণ হবে এসব ক্ষেত্রে তা নয়, তবে কিনা আমার আগ্রহটুকু খাঁটি। আমি সেই রসনাবিলাসীর মতো, আলুর চপ কাবাব পরোটা ফুচকা বিরিয়ানির জগতে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু ক্যাভিয়ার বা ব্লু চিজ পাতে পড়লে যদি প্রথম স্বাদে ভালো নাও লাগে, আমি তবু তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করার চেষ্টা চালিয়ে যাই।

এইসব বাদ দিয়ে জানাই, হোমওয়ার্ক করে জানতে পারলাম নর্মান এরিকসন পাসারিবু আসলে ইন্দোনেশিয়ার  তোবা বাতাক ক্যাথোলিক কৃশ্চান গোষ্ঠীর মানুষ, এবং সমকামী। মূলত কবি, কিন্তু তিনি বাইরে নাম করেছেন ছোটগল্পকার হিসেবেই। কিন্তু আসল কথা হল, পাসারিবু কুইয়ার সাহিত্যের একটা নতুন দিক আবিষ্কার করেছেন আর সেটা এমন চমৎকার ভাবে করেছেন যে স্পেকুলেটিভ কিংবা নন স্পেকুলেটিভ, দুই ঘরানা দিয়েই তার গল্পের ব্যাখা করা চলতে পারে। নর্ম্যানের লেখা সরল রেখায় চলে না, ছত্রে ছত্রে অব্যক্ত কথা আর সমকামী জীবনের যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে (ইন্দোনেশিয়ায় সমকামী সম্পর্কের আইন ধর্ম, সংস্কৃতি আর আধুনিক সমাজের বিবর্তন এর মাঝে আটকে গেছে, হাজার রকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে) চরিত্রদের জীবন কাটাকুটি করে যায় একে অপরের সঙ্গে। নর্ম্যান ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই অদৃশ্য ট্যাপেস্ট্রি, এমন এক বিশাল জাল বুনেছেন তাঁর লেখায়, কারণ তিনি চান তাঁর প্রতিটা লেখাই একাধিকবার পাঠ করা হোক। পাঠকের কাছে এই মনযোগটুকু তিনি প্রত্যাশা করেন।

এইসব পড়ে আমি আবার হ্যাপি স্টোরিজ (ওয়েল, অলমোস্ট)-এ ঝাঁপ মারলাম, আর ধীরে ধীরে এই গল্পগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিয়ে ধরা দিল। ধীরে ধীরে মানে আক্ষরিক অর্থেই ধীরে, কারণ তিন চার মাস ধরে প্রায় প্রতিটা গল্পই আমাকে একাধিক বার পড়তে হয়েছে, কিছু কিছু তো চারপাঁচ পড়েও পুরোপুরি ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবে কিনা নর্ম্যান যে ঝানু লেখক, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকার অবকাশ রইল না। এই পাতলা বইটায় বারোটা গল্প আছে, একশো চল্লিশ পাতা। তবে তাই বলে যদি গল্প প্রতি বারো পাতা ধরে নেওয়া হয়, সেটা ভুল হয়ে যাবে। কারণ, বইটার রেঞ্জ সাধারণ ছোটগল্পের বইয়ের চেয়ে বেশি। প্রথম গল্পটা একটা অণুগল্প মাত্র।

যে কথাটা হ্যাপি স্টোরিজ নিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা হল, এগুলো মোটেও হ্যাপি নয়। ট্রাজিকমিক বলা হয়তো যেতে পারে। টিফানি শাও ইন্ডোনেশিয়ান ভাষার ওয়ার্ড প্লে পুরোপুরি ধরতে পারেননি স্বাভাবিক কারণেই, কিন্তু নর্ম্যান এর ইঙ্গিত শুনে বোঝাই যায়, গল্পগুলো আসলে কাঁটা বিধে থাকা একটা হৃদয় থেকে উঠে এসেছে। 

"Indonesian word “hampir,” means “almost.” As “hampir” is only a letter away from “vampir,” the bloodsucking demon. Tell me, what does it mean to be happy? In a world where we celebrate disneyfied heterosexualities, for queer folks, what is happiness? Often, it becomes the bloodsucking demon, the vampir, the hampir.”

এই বারোটি গল্পের নাম দেখুন:

1) Enkidu Comes Knocking on New Year’s Eve 
2) A Bedtime Story for Your Long Sleep
3) What's your name Sandra?
4) A Young Poet’s Guide to Surviving a Broken Heart
5) The true story of the story of giant
6) Three Love You, Four Despise You
7) Metaxu: Jakarta, 2038
8) Deep Brown, Verging on Black
9) Welcome to the Department of Unanswered Prayers
10) Ad maiorem dei gloriam
11) Our Descendants Will Be as Numerous as the Clouds in the Sky
12) Her Story

কোথাও ডার্ক, কোথাও বিষণ্ণ, কোথাও আবার অভিনব! হেট্রোনর্ম্যাটিভ ফিকশনের আনাচেকানাচে নর্ম্যান আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার জীবনযাত্রাকে যেমন ছুঁয়ে গেছেন, সেখানকার নতুন প্রজন্মের আশা আকাঙ্খা অবসন্নতা ও অসহায়তাকে চিহ্নিত করেছেন, বয়স্কদের জীবনের জটিলটাও তুলে ধরেছেন একটু একটু করে। কোমল হাতে লেখা গল্পগুলো তাদের চরিত্রদের নিয়ে সমব্যাথী, টেন্ডার, কিন্তু এই এম্প্যাথি তাদের জীবনের ঘোরতর বাস্তবকে বদলাতে পারে না। গল্পগুলো মূলত কিউয়ার বটে, যদিও বৈচিত্র্যময়। অ্যাপোক্লিপ্টিক সাই ফাই থেকে চিত্রগুপ্তের দপ্তর, কিছুরই অভাব নেই। 

যতবার পড়ি, নতুন কিছু ধরা পড়ে। প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছি ভাবছি, শেষ গল্পে গিয়ে আমি প্রায় ভূত দেখার মতো করে আবিষ্কার করলাম, আসলে বইটার প্রতিটা গল্পই ইন্টারকানেক্টেড। প্রতিটা মেটাফরের একটা সুদূরপ্রসারী বক্তব্য আছে। প্রতিটা প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ।

মাথায় পোকা নাড়তে আবার গল্পগুলো নাড়াচাড়া শুরু করলাম আর বুঝতে পারলাম, লেখক আমাকে কী বোকাই না বানিয়েছেন! এটা ছোটগল্প সংকলন না উপন্যাস? কালচারাল হিস্ট্রি না ম্যাজিকাল রিয়ালিজম? সাইফাই না সাধাসিধে কুইয়ার সামাজিক গল্প? আরো একটু খোঁজ চালিয়ে বুঝলাম, গল্পের অর্ধেক চরিত্র বাস্তব আর লেখকের আগের বইয়ের সঙ্গেও এই বইয়ের একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে। নর্ম্যান আসলে পাঠকদের সামনে একটা বৃহত্তর গল্পের ইশারা ছেড়ে রেখেছেন, পাঠক সেই ইশারা বুঝে গল্পটা কমপ্লিট করতে পারলে চোখের সামনে একটা অন্য দুনিয়া খুলে যাবে।

চারমাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে আমি ক্ষান্ত দিয়ে লেখকের উদ্দেশে সেলাম ঠুকলাম। যদি বছরে কয়েকশো বই পড়ার টার্গেট না থাকে আর একটা গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারবার পড়তে গেলে আপনার অসুবিধা হয় না, এই বইটা মিস করবেন না।

টিল্টেড অ্যাক্সিস প্রেস
৯৪১/-

মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লাস্ট চিলড্রেন অফ টোকিও

 



জাপানে গত কয়েক বছর ধরে 'স্লাইস অফ লাইফ' বইয়ের বন্যা বয়ে গেছে। এই বেড়াল আর কফিশপ সর্বস্ব ফিলগুড বইগুলো এমন হিট হয়েছে যে বই বেরোনোর আগেই কুড়িটা ভাষায় অনুবাদের সত্ব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর বেরোতে বা বেরোতেই লোকে হামলে পড়ে কিনছে। প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে বেড়ালের ছবি, বইয়ের দোকানে বেড়াল, কফির দোকানে বেড়ালে, সুসি শপে বেড়াল, স্কুলে বেড়াল, অতীত বা ভবিষ্যতে বেড়াল, গোয়েন্দা বেড়াল, লাভগুরু বেড়াল, দার্শনিক বেড়াল, থেরাপিস্ট বেড়াল... বিল্লির দাপটে জাপানিজ সাহিত্য হুড়মুড়িয়ে ক্লাউড নাইনে উঠে গেছে। মাংগা, অ্যানিমে, ক্রাইম, লাভ স্টোরি, কামিং অফ এজ... সব বইই দেখি হিট। তাতে বেড়াল বা স্লাইস অফ লাইফ এলিমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা বই হিট হতেই একদম ফ্র‍্যাঞ্চাইজি খুলে চারটে বই আরো চলে আসে। বিল্লিই এখন দুনিয়ার সবচেয়ে ট্রেন্ডিং প্রাণী, ভরসাযোগ্যও। 

ভুল ভাববেন না, আমি বিল্লি ম্যানিয়ার বিরোধিতা করছি না, স্লাইস অফ লাইফ বই পড়তেও আমার দিব্যি লাগে। খুব শাটল ভাবে সিরিয়াস কথা বলে দেয়, ছিমছাম প্রেম বা বিয়োগের গল্পে লাইফ লেসন দিয়ে দেয়, বেশ কিছু লেখক লেখিকা এই জনরায় এমন হাত পাকিয়ে ফেলেছে যে তাদের আর অগ্রাহ্য করার উপায় নেই৷ পাতলা পাতলা বই, ঝরঝরে অনুবাদ, দু এক সিটিংয়েই শেষ। পড়েও ভালো লাগে। কিন্তু এই স্লাইস অফ লাইফের ঠেলায় জাপানের সমকালীন সিরিয়াস লেখকরা বাজারে এমন কোণঠাসা হয়েছেন যে বলার নয়। অথচ জাপানে চিরকাল সিরিয়াস লেখালিখি হয়েছে, হচ্ছেও। কাওয়াবাতা, সোসেকি, মিশিমোর কথা ছেড়েই দিলাম, য়োকো ওগাওয়া, কেঞ্জাবুরো ওয়ে, ইশিগুরো বা ইয়াশিমোতো তো সমকালীন লেখকদের মধ্যেই পড়বেন। (মুরাকামি প্রভৃতিদের কথা ধরছিই না, স্টার লেখকদের টেনে লাভ নেই)

ইয়োকো তাওয়াদার মতো কিছু কলম আছে, তারা এই রেসের উর্ধ্বে, ব্রকবাস্টার হওয়ার হিড়িকের বাইরে। তাঁর লেখা 'হোয়্যার ইউরোপ বিগিনস' পড়ে আমি লিখেছিলাম, তাওয়াদার লেখায় একটা 'জার্নি' আছে। তিনি বলেছেন, 'দ্যাট লাইজ ইন দ্য ইন বিটউইন'... লেখা বয়ে যায়, চরিত্র বয়ে যায়, সময় বয়ে যায়। কিছুই স্থির নেই। গল্পও স্থির নেই। গল্পের আউটলাইনও স্থির নেই, তাও বয়ে চলেছে। এই ধারাপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে আসলে গল্প কোথায়, অধিকাংশ পাঠক তা খুঁজেই পায় না। তাঁর প্রায় প্রতিটা বইই আলোচিত, কয়েকটা পুরস্কৃতও, কিন্তু গুডরিডসের পাঠকরা বিরক্তি জানান দিতে ইতস্তত করে না। বইয়ের পাহাড় যখন পাঠককে চাপা দিতে চাইছে, তখন থ্রি স্টার রেটিং বই কেন কেউ পড়বে? কূট প্রশ্ন বটে!

কিন্তু, কয়েকজন থাকে, যাদের স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। তাওয়াদাকে নিয়ে আমার একটা ভালো লাগা আছে। এই ছোট্ট বইটা পড়তে গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি ঠিক তাই। গল্প যে কোথায়, গল্পের ক্রাইসিস যে কী, গল্পের প্রেক্ষাপট বা আবহ কী, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! একটা ভবিষ্যতের দুনিয়ার কথা হচ্ছে বটে, তা সেটা ভালো না মন্দ, ডিস্টোপিক বা ইউটোপিক, আমুদে বা বিষণ্ণ, কিছুই 'স্থিরভাবে' বলা যায় না। একবার মনে হয়, কী ডিস্টোপিক ব্যাপার রে ভাই! পরের প্যারায় গিয়ে ভাবি, বাহ, এমনটাই তো হওয়া দরকার, বেশ ফিলগুড ব্যাপার মনে হচ্ছে। 

এই করতে করতে এক বুড়ো থুত্থুড়ে মানুষের একশো পনেরো বছরের জীবনের আগেপিছে ঘুরে বেড়াই, টোকিওর মানুষের জীবন অনুভব করি। চাষবাস, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞানের গলিতে টহল দিই বুড়ো ইয়োশিরোর সঙ্গে! কখনও তার নিজের কথায়, কখনও তার নাতির ছেলের কথায়, কখনও আবার তাদের শিক্ষক বা সহপাঠীর মন বুঝতে চেষ্টা করি। কত কথা উড়ে যায় কত কথা মুছে যায়, কত কথা মন ছুয়ে রিদয়ে হারায় ... কত কথা হল বলা কত কথা তবু বাকি...

...করতে করতে একসময় বই শেষ। ভোম্বলের মতো ভাবি, কী হল? কী ছিল গল্পে? কী পড়লামটা কী? হেঁশোরামের দুনিয়া না কল্পনার উড়ান? হলটা কী? তারপর মন শান্ত হলে বোঝা যায়, গল্প তো তাওয়াদা বলে দিয়েছেন। সবটাই বলেছেন, যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে। চরিত্র, প্রেক্ষাপট, ক্রাইসিস, পরিণাম... সবই তো যথাযথ, পরিমিত! কিন্তু কখন বলেছেন বুঝতে পারিনি! যে লাইনে তিনি গল্পটা বলেছিলেন, সেই লাইনে আমি শুধু সেই লাইনের গল্প নিয়েই মজে ছিলাম, আগেপিছু কিছুই ভাবিনি। এই অবস্থাটা তিষ্ঠোলে একটা সুখানুভূতি হয়। তখন মনে হয়, একটা ভালো কিছু পড়লাম। বেশ আরাম হয়!

এইটুকুই। বাকি গল্প বলার আর দরকার নেই। এই বই পড়তে হলে শুধু পড়ার আনন্দের জন্যই পড়ুন, ভালো বই বা ভালো গল্প পড়ব বলে শুরু করলে হতাশ হতে হবে।


সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লস্ট স্টেপস

 


ঠিক সময়ের আগে অনেক কিছু হাতে এলে ভালো মতো অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় না, সে আমি নিজের অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। তাতে অধৈর্য হওয়া বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বরং নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সময় দেওয়াই ভালো। আমার এক পরিচিত ব্যাঙ্গালোরিয়ান ভদ্রলোক ভীষণ 'পড়াকু' মানুষ, তিনি প্রায় ষাট বছর বয়সে এসে 'উলিসিস' পড়তে শুরু করেছেন, কষ্ট করে হলেও বইটা শেষ করেছেন এবং আপাতত ফের রি-রিড করার তাল করছেন।

এইসব বেতাল কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, আমি আলেহো কার্পেন্টারের (কার্পেন্তিয়ারই উচ্চারণ বটে, আমার হাতুড়ে জিভে ভুল বলে বলে কার্পেন্টারটাই ছেপে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড ) লেখা যেটুকু পড়েছি, তা বাংলাতেই। লাতিন আমেরিকান উপন্যাস সংগ্রহে দুটো নভেলা পড়ার পর আমার আর কিছু পড়ার ইচ্ছে হয়নি, বা বলা ভালো আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কার্পেন্টার পড়ার সময় আমার হয়নি। এতদিন পর পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিক সিরিজে হিস্প্যানিক ক্লাসিকগুলো নতুন করে অনুবাদ করা হচ্ছে দেখে নড়েচড়ে বসলাম, কিন্তু কার্পেন্টারের দুটো বই নিয়ে আমার উৎসাহ জাগানোর প্রধান কারণ অনুবাদক অ্যাড্রিয়ান নাথান ওয়েস্ট। বেঞ্জামিন লাবাতুতের দুটো অসামান্য বই তিনি যতটা সাবলীল ভাবে, বা বলা যায় 'স্মার্টলি' ইংরেজিতে নিয়ে এসেছেন, তাতে আমার মনে হয়েছিল ইনি অন্য জাতের অনুবাদক। মূল ভাষার মনন ও শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখেও তিনি অন্য ভাষায় মূলানুগ অনুবাদ করতে পারেন, কিন্তু সেই অনুবাদ পড়ে কখনও 'কী হচ্ছেটা কী?' বলে হোঁচট খেতে হয় না। 

তা আলেহো কার্পেন্টারের যে দুটি বই ওয়েস্ট অনুবাদ করেছেন, তা হল 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' আর 'এক্সপ্লোজন ইন আ ক্যাথেড্রাল'। আমি প্রথমটা পড়েছি, আর দ্বিতীয়টা শুরু করেছি। এবার ভাবছি মাঝে কয়েকদিন ব্রেক নিয়ে দু একটা অন্য জিনিস পড়ে ফেলব, তার মাঝে এই পোস্টটা করে রাখলে আবার ধরতে সুবিধা হবে। 

প্রথমে, ওয়েস্টবাবুর অনুবাদের কথাই বলতে হয়। এমন 'ভীষণ' গদ্যের অনুবাদ করতে হলে যে ধরনের সাহস আর দক্ষতা লাগে, তা সকলের থাকে না বলাই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে, আমার বাংলা অনুবাদগুলো ঠিক জমেনি, সে আমার ব্যর্থতা (আমি দ্য চেজ নভেলাটা পড়ে বাংলাটা--মৃগয়া--আবার খানিকটা পড়লাম) দুটো ভাষার সেমান্টিকসে আর রিডিং স্টাইলে স্ট্রাকচারাল ডিফারেন্স আছে। একটা টানা চার পাতার বাক্য বাংলায় একইভাবে না ভেঙে অনুবাদ করে দেওয়াই যায়, এবং শৈলী বজায় রাখাতে সেটা করাই সমীচীন (আজকাল গৃহীতও)। কিন্তু সেই চারপাতা দীর্ঘ বাক্যটা ঠিক কীভাবে অনুবাদ করলে পড়া যাবে বা পড়তে সুবিধা হবে, সেটা ঠিক করা যথেষ্ট চাপের কাজ। একটা এক লাইনের বাক্য চার ভাবে লেখা যায়, সেখানে একটা চার পাতার বাক্য চারশো ভাবে লেখা যেতে পারে। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, এবং সর্বোপরি সাবলীল পাঠ, সব কিছুতেই সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে কিঞ্চিত বদল ঘটাতেই হয় ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্য! 

তারপর কার্পেন্টারের লেখা যাকে বলে 'ডেন্স রেনফরেস্ট, এত 'সঘন' ভাষা, সেই সঘনতার সুবাস বজায় রেখে অনুবাদ করা মুখের কথা নয়। আগে যিনি 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' ইংরেজিতে করেছিলেন, তিনি বোধগম্য করতে চেয়ে একটু বেশিই স্বাধীনতা নিয়েছিলেন বলে ভূমিকাতে পড়লাম, 'এক্সপ্লোজান ইন আ ক্যাথেড্রাল' তো মূল স্প্যানিশ থেকে করাই হয়নি, হয়েছিল ফ্রেঞ্চ থেকে। এহেন, বাংলায় এরকম লেখা তুলে আনা যে সহজ নয়, সেটা বোঝাই যায়। তবে এই ক্লাসিকগুলো বাংলায় নিয়ে আসার জন্য যে সদিচ্ছা আর পরিশ্রম করা হয়েছিল, তাতে অসংখ্য পাঠক লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে জেনেছে। সেই সৎ চেষ্টাকে হাই স্যালিউট জানিয়েই বলি, যুগে যুগে ক্লাসিকের নতুন করে অনুবাদ হওয়াটাই দরকার, কাম্যও। 

সেইদিন থেকে দেখতে হলে ওয়েস্টবাবুর অনুবাদ দশে এগারো পাবে। একবারের জন্যও মনে হয়নি, কোথাও একচুলের জন্য অনুবাদকের মনোনিবেশ হারিয়েছেন। আমি পাশাপাশি আগের ইংরেজি অনুবাদ আর নতুন ইংরেজি অনুবাদ রেখে (সঙ্গে স্যাম্পল বাংলা অনুবাদ) দেখেছি, কার্পেন্টার পড়তে হলে সম্ভবত এই নতুন এডিশনটাই বেস্ট।

এইবার বইয়ের কথায়। বিশেষ কিছু বলার নেই, বা বলা উচিত আমার বলার যোগ্যতা নেই। নেই নেই করে বেশ কিছু বইপত্র তো এতদিনে পড়লাম, কার্পেন্টারের মতো 'ভয়ংকর সুন্দর' গদ্য আমি আর দেখিনি। একদম সম্মোহনী নাগপাশের মতো পাঠকের গলা আঁকড়ে ধরে, কিন্তু সেই আলিঙ্গন ছেড়ে বেরোতে আর ইচ্ছে করে না। কার্পেন্টারের এই অ্যালেগরিক কাহিনির স্তরে স্তরে অসংখ্য কাহিনি, কালচারার রেফারেন্স আর দর্শন থইথই করছে। এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রের খোঁজে আমাজনের প্রায় হারিয়ে যাওয়া উপজাতিদের সন্ধান করার এই কাহিনি আসলে হারিয়ে যাওয়া সময়কেও খুঁজে চলে। ঘোর বর্ষায়, বর্ষণসিক্ত বনের অন্ধকারে থাকা উপজাতি জীবনের কোলে বসে গৃহযুদ্ধ আর রাজনীতির ঘটনা বাষ্পের মতো ধোঁয়া হয়ে যেতে থাকে।

I asked myself whether, in bygone days, men had longed for bygone days as I, this summer morning, longed for certain ways of life that man had lost forever.

কার্পেন্টার নিজে দক্ষ মিউজিশিয়ান। তাঁর সব লেখাতেই একটা সঙ্গীতের দর্শন থাকে, কিন্তু তাঁর গদ্যও যেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মিউজিকাল কম্পোজিশন। তবে আমার দৃঢ় ধারণা, স্প্যানিশকে হাতিয়ার করে তিনি তাঁর কলমকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, অন্য ভাষায় সম্ভবত তা হত না। ধরা যাক একটা নৌকো, সেই নৌকার বিভিন্ন অংশের একশো পঞ্চাশটা নাম থাকতে পারে, বৈঠা চালানোর ফলে ক্ষয়ে গিয়ে যে একটা হালকা দাগ পড়ে, তার জন্যও একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে, একটা ফাটলের মধ্যে কাঠের ঘষা লেগে আঁচড় লাগলে তার জন্যও একটা শব্দ লিখে ফেলেছেন, এই সমস্ত শব্দের চোদ্দ আনা শব্দ অন্য ভাষাতে নেইই। (ইংরেজিতে ম্যাক্সিমামই আছে) কার্পেন্টারের লেখার মধ্যে একটা অণুবীক্ষণ আছে, প্রকৃতি আর সমাজের ওপর তাঁর মাইক্রোস্পিক দৃষ্টির পরিণামস্বরূপ যে সমস্ত খুঁটিনাটি গদ্যে উঠে এসেছে, অধিকাংশ ভাষায় সেই ডিটেলিংকে ব্যক্ত করার উপায়ই নেই। 

'এক্সপ্লোজান্স ইন আ ক্যাথেড্রাল' এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক আলেহান্দ্রো চাম্ব্রাস বলেছেন, ছোটবেলায় প্রথম ক্লাসে কার্পেন্টারের একটা ছোটগল্প পড়ানো হয়েছিল, তারপর হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছিল অজানা শব্দের মানে ডিকশিনারি দেখে খুঁজে বার করে আনতে। সেই দশ পনেরোটা শব্দের নমুনাও তিনি দিয়েছেন, পড়ে দেখলাম আমি একটারও মানে জানি না। এমনকি, প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পরেও গুগলে সেই শব্দ টাইপ করলে শুধু ৫০% শব্দেরই মানে আসছে, বাকি গুগল বাবাও হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন। এই তো অবস্থা! 

চাম্ব্রাস আরো বলেছেন, কার্পেন্টার পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে, আপনি একটা অসম্ভব সুরেলা কম্পোজিশন শুনছেন, যা আসলে আপনারই ভাষা, কিন্তু আবার আপনার ভাষা নয়ও। কিন্তু এই গদ্যের সঙ্গীত আর রহস্যে ততোক্ষণে আপনি এমন মজে গেছেন, এমন ভাবে সম্মোহিত হয়েছেন যে আর আসন ছেড়ে উঠতে পারছেন না। এটাই হল আসল কথা, এত সুন্দর আর সহজ ভাবে কার্পেন্টারকে আর কেউ বোঝাতে পারবে বলে মনে হয় না। কার্পেন্টার-এর ভক্ত হলে এই নতুন দুটো অনুবাদ একেবারেই মাস্ট রিড। 

দ্য লস্ট স্টেপ্স
পেঙ্গুইন ক্লাসিকস