সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লস্ট স্টেপস

 


ঠিক সময়ের আগে অনেক কিছু হাতে এলে ভালো মতো অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় না, সে আমি নিজের অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। তাতে অধৈর্য হওয়া বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বরং নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সময় দেওয়াই ভালো। আমার এক পরিচিত ব্যাঙ্গালোরিয়ান ভদ্রলোক ভীষণ 'পড়াকু' মানুষ, তিনি প্রায় ষাট বছর বয়সে এসে 'উলিসিস' পড়তে শুরু করেছেন, কষ্ট করে হলেও বইটা শেষ করেছেন এবং আপাতত ফের রি-রিড করার তাল করছেন।

এইসব বেতাল কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, আমি আলেহো কার্পেন্টারের (কার্পেন্তিয়ারই উচ্চারণ বটে, আমার হাতুড়ে জিভে ভুল বলে বলে কার্পেন্টারটাই ছেপে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড ) লেখা যেটুকু পড়েছি, তা বাংলাতেই। লাতিন আমেরিকান উপন্যাস সংগ্রহে দুটো নভেলা পড়ার পর আমার আর কিছু পড়ার ইচ্ছে হয়নি, বা বলা ভালো আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কার্পেন্টার পড়ার সময় আমার হয়নি। এতদিন পর পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিক সিরিজে হিস্প্যানিক ক্লাসিকগুলো নতুন করে অনুবাদ করা হচ্ছে দেখে নড়েচড়ে বসলাম, কিন্তু কার্পেন্টারের দুটো বই নিয়ে আমার উৎসাহ জাগানোর প্রধান কারণ অনুবাদক অ্যাড্রিয়ান নাথান ওয়েস্ট। বেঞ্জামিন লাবাতুতের দুটো অসামান্য বই তিনি যতটা সাবলীল ভাবে, বা বলা যায় 'স্মার্টলি' ইংরেজিতে নিয়ে এসেছেন, তাতে আমার মনে হয়েছিল ইনি অন্য জাতের অনুবাদক। মূল ভাষার মনন ও শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখেও তিনি অন্য ভাষায় মূলানুগ অনুবাদ করতে পারেন, কিন্তু সেই অনুবাদ পড়ে কখনও 'কী হচ্ছেটা কী?' বলে হোঁচট খেতে হয় না। 

তা আলেহো কার্পেন্টারের যে দুটি বই ওয়েস্ট অনুবাদ করেছেন, তা হল 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' আর 'এক্সপ্লোজন ইন আ ক্যাথেড্রাল'। আমি প্রথমটা পড়েছি, আর দ্বিতীয়টা শুরু করেছি। এবার ভাবছি মাঝে কয়েকদিন ব্রেক নিয়ে দু একটা অন্য জিনিস পড়ে ফেলব, তার মাঝে এই পোস্টটা করে রাখলে আবার ধরতে সুবিধা হবে। 

প্রথমে, ওয়েস্টবাবুর অনুবাদের কথাই বলতে হয়। এমন 'ভীষণ' গদ্যের অনুবাদ করতে হলে যে ধরনের সাহস আর দক্ষতা লাগে, তা সকলের থাকে না বলাই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে, আমার বাংলা অনুবাদগুলো ঠিক জমেনি, সে আমার ব্যর্থতা (আমি দ্য চেজ নভেলাটা পড়ে বাংলাটা--মৃগয়া--আবার খানিকটা পড়লাম) দুটো ভাষার সেমান্টিকসে আর রিডিং স্টাইলে স্ট্রাকচারাল ডিফারেন্স আছে। একটা টানা চার পাতার বাক্য বাংলায় একইভাবে না ভেঙে অনুবাদ করে দেওয়াই যায়, এবং শৈলী বজায় রাখাতে সেটা করাই সমীচীন (আজকাল গৃহীতও)। কিন্তু সেই চারপাতা দীর্ঘ বাক্যটা ঠিক কীভাবে অনুবাদ করলে পড়া যাবে বা পড়তে সুবিধা হবে, সেটা ঠিক করা যথেষ্ট চাপের কাজ। একটা এক লাইনের বাক্য চার ভাবে লেখা যায়, সেখানে একটা চার পাতার বাক্য চারশো ভাবে লেখা যেতে পারে। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, এবং সর্বোপরি সাবলীল পাঠ, সব কিছুতেই সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে কিঞ্চিত বদল ঘটাতেই হয় ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্য! 

তারপর কার্পেন্টারের লেখা যাকে বলে 'ডেন্স রেনফরেস্ট, এত 'সঘন' ভাষা, সেই সঘনতার সুবাস বজায় রেখে অনুবাদ করা মুখের কথা নয়। আগে যিনি 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' ইংরেজিতে করেছিলেন, তিনি বোধগম্য করতে চেয়ে একটু বেশিই স্বাধীনতা নিয়েছিলেন বলে ভূমিকাতে পড়লাম, 'এক্সপ্লোজান ইন আ ক্যাথেড্রাল' তো মূল স্প্যানিশ থেকে করাই হয়নি, হয়েছিল ফ্রেঞ্চ থেকে। এহেন, বাংলায় এরকম লেখা তুলে আনা যে সহজ নয়, সেটা বোঝাই যায়। তবে এই ক্লাসিকগুলো বাংলায় নিয়ে আসার জন্য যে সদিচ্ছা আর পরিশ্রম করা হয়েছিল, তাতে অসংখ্য পাঠক লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে জেনেছে। সেই সৎ চেষ্টাকে হাই স্যালিউট জানিয়েই বলি, যুগে যুগে ক্লাসিকের নতুন করে অনুবাদ হওয়াটাই দরকার, কাম্যও। 

সেইদিন থেকে দেখতে হলে ওয়েস্টবাবুর অনুবাদ দশে এগারো পাবে। একবারের জন্যও মনে হয়নি, কোথাও একচুলের জন্য অনুবাদকের মনোনিবেশ হারিয়েছেন। আমি পাশাপাশি আগের ইংরেজি অনুবাদ আর নতুন ইংরেজি অনুবাদ রেখে (সঙ্গে স্যাম্পল বাংলা অনুবাদ) দেখেছি, কার্পেন্টার পড়তে হলে সম্ভবত এই নতুন এডিশনটাই বেস্ট।

এইবার বইয়ের কথায়। বিশেষ কিছু বলার নেই, বা বলা উচিত আমার বলার যোগ্যতা নেই। নেই নেই করে বেশ কিছু বইপত্র তো এতদিনে পড়লাম, কার্পেন্টারের মতো 'ভয়ংকর সুন্দর' গদ্য আমি আর দেখিনি। একদম সম্মোহনী নাগপাশের মতো পাঠকের গলা আঁকড়ে ধরে, কিন্তু সেই আলিঙ্গন ছেড়ে বেরোতে আর ইচ্ছে করে না। কার্পেন্টারের এই অ্যালেগরিক কাহিনির স্তরে স্তরে অসংখ্য কাহিনি, কালচারার রেফারেন্স আর দর্শন থইথই করছে। এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রের খোঁজে আমাজনের প্রায় হারিয়ে যাওয়া উপজাতিদের সন্ধান করার এই কাহিনি আসলে হারিয়ে যাওয়া সময়কেও খুঁজে চলে। ঘোর বর্ষায়, বর্ষণসিক্ত বনের অন্ধকারে থাকা উপজাতি জীবনের কোলে বসে গৃহযুদ্ধ আর রাজনীতির ঘটনা বাষ্পের মতো ধোঁয়া হয়ে যেতে থাকে।

I asked myself whether, in bygone days, men had longed for bygone days as I, this summer morning, longed for certain ways of life that man had lost forever.

কার্পেন্টার নিজে দক্ষ মিউজিশিয়ান। তাঁর সব লেখাতেই একটা সঙ্গীতের দর্শন থাকে, কিন্তু তাঁর গদ্যও যেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মিউজিকাল কম্পোজিশন। তবে আমার দৃঢ় ধারণা, স্প্যানিশকে হাতিয়ার করে তিনি তাঁর কলমকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, অন্য ভাষায় সম্ভবত তা হত না। ধরা যাক একটা নৌকো, সেই নৌকার বিভিন্ন অংশের একশো পঞ্চাশটা নাম থাকতে পারে, বৈঠা চালানোর ফলে ক্ষয়ে গিয়ে যে একটা হালকা দাগ পড়ে, তার জন্যও একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে, একটা ফাটলের মধ্যে কাঠের ঘষা লেগে আঁচড় লাগলে তার জন্যও একটা শব্দ লিখে ফেলেছেন, এই সমস্ত শব্দের চোদ্দ আনা শব্দ অন্য ভাষাতে নেইই। (ইংরেজিতে ম্যাক্সিমামই আছে) কার্পেন্টারের লেখার মধ্যে একটা অণুবীক্ষণ আছে, প্রকৃতি আর সমাজের ওপর তাঁর মাইক্রোস্পিক দৃষ্টির পরিণামস্বরূপ যে সমস্ত খুঁটিনাটি গদ্যে উঠে এসেছে, অধিকাংশ ভাষায় সেই ডিটেলিংকে ব্যক্ত করার উপায়ই নেই। 

'এক্সপ্লোজান্স ইন আ ক্যাথেড্রাল' এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক আলেহান্দ্রো চাম্ব্রাস বলেছেন, ছোটবেলায় প্রথম ক্লাসে কার্পেন্টারের একটা ছোটগল্প পড়ানো হয়েছিল, তারপর হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছিল অজানা শব্দের মানে ডিকশিনারি দেখে খুঁজে বার করে আনতে। সেই দশ পনেরোটা শব্দের নমুনাও তিনি দিয়েছেন, পড়ে দেখলাম আমি একটারও মানে জানি না। এমনকি, প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পরেও গুগলে সেই শব্দ টাইপ করলে শুধু ৫০% শব্দেরই মানে আসছে, বাকি গুগল বাবাও হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন। এই তো অবস্থা! 

চাম্ব্রাস আরো বলেছেন, কার্পেন্টার পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে, আপনি একটা অসম্ভব সুরেলা কম্পোজিশন শুনছেন, যা আসলে আপনারই ভাষা, কিন্তু আবার আপনার ভাষা নয়ও। কিন্তু এই গদ্যের সঙ্গীত আর রহস্যে ততোক্ষণে আপনি এমন মজে গেছেন, এমন ভাবে সম্মোহিত হয়েছেন যে আর আসন ছেড়ে উঠতে পারছেন না। এটাই হল আসল কথা, এত সুন্দর আর সহজ ভাবে কার্পেন্টারকে আর কেউ বোঝাতে পারবে বলে মনে হয় না। কার্পেন্টার-এর ভক্ত হলে এই নতুন দুটো অনুবাদ একেবারেই মাস্ট রিড। 

দ্য লস্ট স্টেপ্স
পেঙ্গুইন ক্লাসিকস


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন