ইন্দোনেশিয়ার লেখক নর্ম্যান এরিকসন পাসারিবুর 'হ্যাপি স্টোরিজ মোস্টলি' হ্যাপি মনে পড়তে গিয়েছিলাম। হ্যাপি হওয়ার কারণ, পাতলা বই, নামফামও করেছে, হুড়মুড়িয়ে পড়ে আমি গোঁফে তা দিয়ে কেতা দেখাব। কিন্তু প্রথম দুটো গল্প পড়তে গিয়েই হ্যাপিনেস উবে গেল, মাথার মধ্যে সব বনবন করে ঘুরতে লাগল, চোখে পদ্মফুল দেখলাম। সবই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে প্রায়, কিন্তু গল্পগুলোর দোষ নয়, কারণ গল্প ইজ ফাটাফাটি। দোষ আমার, কারণ এই লেখা নিয়ে আমার কোনও আইডিয়াই ছিল না। লেখক কে, তিনি কী বলতে চাইছেন, কী ধরনের লেখালিখি তিনি করেন, সে সব সম্পর্কেও আমার কিছুই জানা নেই।
তাই বই বন্ধ, আগে লেখকের খোঁজ নেওয়া যাক। এখন প্রশ্ন হল, বই পড়তে হলে লেখকের কথা জানতে হবে কেন? কয়েকদিন আগে মডার্ন আর্ট সম্পর্কে কথা ওঠায় আমার এক বন্ধু বলেছে, আর্ট বুঝতে গেলে শিল্পীর সাতকাহন জানতে হবে কেন? তিনি কী ভাবেন, কী ভাবে শিল্পজীবনে এগিয়েছেন, সেসব পড়াশোনা করে একটা ছবি দেখতে বসবে নাকি? কী দরকার? বাত তো ঠিক হ্যায়! দরকার আর কী? কোনও দরকারই নেই। লেখক বা শিল্পীর ব্যাকগ্রাউন্ড বা মনোচিন্তা জেনে নেওয়ার বা বুঝে নেওয়ার তেমন কোনও দরকার নেই, যা বোঝা যায় বা অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় তা পড়লে বা দেখলেই হয়! তবে কিনা মুশকিল হল (ঠিক ভুল আমি বলতে পারব না, সে যোগ্যতা আমার নেই) শিল্প বা সাহিত্যের সমাজ এইভাবে চলে না। লেখকরা পরীক্ষানিরীক্ষা করবে, বাউন্ডারি ভাঙবে, চেনাছকের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আর দর্শন বাক্য আর সংলাপের আড়ালে লুকিয়ে রাখবে, এটাই দস্তুর। সেটা যদি খানিকটা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ইচ্ছে হয়, তাহলে ওইটুকু কাজ করতে হয়। এখন আমি ম্যাঙ্গো রিডার, গম্ভীর সাহিত্য পড়ে আমার পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়নি। তাই আমার পাঠ অভিজ্ঞতাও যে খুব মসৃণ হবে এসব ক্ষেত্রে তা নয়, তবে কিনা আমার আগ্রহটুকু খাঁটি। আমি সেই রসনাবিলাসীর মতো, আলুর চপ কাবাব পরোটা ফুচকা বিরিয়ানির জগতে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু ক্যাভিয়ার বা ব্লু চিজ পাতে পড়লে যদি প্রথম স্বাদে ভালো নাও লাগে, আমি তবু তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করার চেষ্টা চালিয়ে যাই।
এইসব বাদ দিয়ে জানাই, হোমওয়ার্ক করে জানতে পারলাম নর্মান এরিকসন পাসারিবু আসলে ইন্দোনেশিয়ার তোবা বাতাক ক্যাথোলিক কৃশ্চান গোষ্ঠীর মানুষ, এবং সমকামী। মূলত কবি, কিন্তু তিনি বাইরে নাম করেছেন ছোটগল্পকার হিসেবেই। কিন্তু আসল কথা হল, পাসারিবু কুইয়ার সাহিত্যের একটা নতুন দিক আবিষ্কার করেছেন আর সেটা এমন চমৎকার ভাবে করেছেন যে স্পেকুলেটিভ কিংবা নন স্পেকুলেটিভ, দুই ঘরানা দিয়েই তার গল্পের ব্যাখা করা চলতে পারে। নর্ম্যানের লেখা সরল রেখায় চলে না, ছত্রে ছত্রে অব্যক্ত কথা আর সমকামী জীবনের যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে (ইন্দোনেশিয়ায় সমকামী সম্পর্কের আইন ধর্ম, সংস্কৃতি আর আধুনিক সমাজের বিবর্তন এর মাঝে আটকে গেছে, হাজার রকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে) চরিত্রদের জীবন কাটাকুটি করে যায় একে অপরের সঙ্গে। নর্ম্যান ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই অদৃশ্য ট্যাপেস্ট্রি, এমন এক বিশাল জাল বুনেছেন তাঁর লেখায়, কারণ তিনি চান তাঁর প্রতিটা লেখাই একাধিকবার পাঠ করা হোক। পাঠকের কাছে এই মনযোগটুকু তিনি প্রত্যাশা করেন।
এইসব পড়ে আমি আবার হ্যাপি স্টোরিজ (ওয়েল, অলমোস্ট)-এ ঝাঁপ মারলাম, আর ধীরে ধীরে এই গল্পগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিয়ে ধরা দিল। ধীরে ধীরে মানে আক্ষরিক অর্থেই ধীরে, কারণ তিন চার মাস ধরে প্রায় প্রতিটা গল্পই আমাকে একাধিক বার পড়তে হয়েছে, কিছু কিছু তো চারপাঁচ পড়েও পুরোপুরি ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবে কিনা নর্ম্যান যে ঝানু লেখক, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকার অবকাশ রইল না। এই পাতলা বইটায় বারোটা গল্প আছে, একশো চল্লিশ পাতা। তবে তাই বলে যদি গল্প প্রতি বারো পাতা ধরে নেওয়া হয়, সেটা ভুল হয়ে যাবে। কারণ, বইটার রেঞ্জ সাধারণ ছোটগল্পের বইয়ের চেয়ে বেশি। প্রথম গল্পটা একটা অণুগল্প মাত্র।
যে কথাটা হ্যাপি স্টোরিজ নিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা হল, এগুলো মোটেও হ্যাপি নয়। ট্রাজিকমিক বলা হয়তো যেতে পারে। টিফানি শাও ইন্ডোনেশিয়ান ভাষার ওয়ার্ড প্লে পুরোপুরি ধরতে পারেননি স্বাভাবিক কারণেই, কিন্তু নর্ম্যান এর ইঙ্গিত শুনে বোঝাই যায়, গল্পগুলো আসলে কাঁটা বিধে থাকা একটা হৃদয় থেকে উঠে এসেছে।
"Indonesian word “hampir,” means “almost.” As “hampir” is only a letter away from “vampir,” the bloodsucking demon. Tell me, what does it mean to be happy? In a world where we celebrate disneyfied heterosexualities, for queer folks, what is happiness? Often, it becomes the bloodsucking demon, the vampir, the hampir.”
এই বারোটি গল্পের নাম দেখুন:
1) Enkidu Comes Knocking on New Year’s Eve
2) A Bedtime Story for Your Long Sleep
3) What's your name Sandra?
4) A Young Poet’s Guide to Surviving a Broken Heart
5) The true story of the story of giant
6) Three Love You, Four Despise You
7) Metaxu: Jakarta, 2038
8) Deep Brown, Verging on Black
9) Welcome to the Department of Unanswered Prayers
10) Ad maiorem dei gloriam
11) Our Descendants Will Be as Numerous as the Clouds in the Sky
12) Her Story
কোথাও ডার্ক, কোথাও বিষণ্ণ, কোথাও আবার অভিনব! হেট্রোনর্ম্যাটিভ ফিকশনের আনাচেকানাচে নর্ম্যান আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার জীবনযাত্রাকে যেমন ছুঁয়ে গেছেন, সেখানকার নতুন প্রজন্মের আশা আকাঙ্খা অবসন্নতা ও অসহায়তাকে চিহ্নিত করেছেন, বয়স্কদের জীবনের জটিলটাও তুলে ধরেছেন একটু একটু করে। কোমল হাতে লেখা গল্পগুলো তাদের চরিত্রদের নিয়ে সমব্যাথী, টেন্ডার, কিন্তু এই এম্প্যাথি তাদের জীবনের ঘোরতর বাস্তবকে বদলাতে পারে না। গল্পগুলো মূলত কিউয়ার বটে, যদিও বৈচিত্র্যময়। অ্যাপোক্লিপ্টিক সাই ফাই থেকে চিত্রগুপ্তের দপ্তর, কিছুরই অভাব নেই।
যতবার পড়ি, নতুন কিছু ধরা পড়ে। প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছি ভাবছি, শেষ গল্পে গিয়ে আমি প্রায় ভূত দেখার মতো করে আবিষ্কার করলাম, আসলে বইটার প্রতিটা গল্পই ইন্টারকানেক্টেড। প্রতিটা মেটাফরের একটা সুদূরপ্রসারী বক্তব্য আছে। প্রতিটা প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ।
মাথায় পোকা নাড়তে আবার গল্পগুলো নাড়াচাড়া শুরু করলাম আর বুঝতে পারলাম, লেখক আমাকে কী বোকাই না বানিয়েছেন! এটা ছোটগল্প সংকলন না উপন্যাস? কালচারাল হিস্ট্রি না ম্যাজিকাল রিয়ালিজম? সাইফাই না সাধাসিধে কুইয়ার সামাজিক গল্প? আরো একটু খোঁজ চালিয়ে বুঝলাম, গল্পের অর্ধেক চরিত্র বাস্তব আর লেখকের আগের বইয়ের সঙ্গেও এই বইয়ের একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে। নর্ম্যান আসলে পাঠকদের সামনে একটা বৃহত্তর গল্পের ইশারা ছেড়ে রেখেছেন, পাঠক সেই ইশারা বুঝে গল্পটা কমপ্লিট করতে পারলে চোখের সামনে একটা অন্য দুনিয়া খুলে যাবে।
চারমাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে আমি ক্ষান্ত দিয়ে লেখকের উদ্দেশে সেলাম ঠুকলাম। যদি বছরে কয়েকশো বই পড়ার টার্গেট না থাকে আর একটা গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারবার পড়তে গেলে আপনার অসুবিধা হয় না, এই বইটা মিস করবেন না।
টিল্টেড অ্যাক্সিস প্রেস
৯৪১/-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন