মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লাস্ট চিলড্রেন অফ টোকিও

 



জাপানে গত কয়েক বছর ধরে 'স্লাইস অফ লাইফ' বইয়ের বন্যা বয়ে গেছে। এই বেড়াল আর কফিশপ সর্বস্ব ফিলগুড বইগুলো এমন হিট হয়েছে যে বই বেরোনোর আগেই কুড়িটা ভাষায় অনুবাদের সত্ব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর বেরোতে বা বেরোতেই লোকে হামলে পড়ে কিনছে। প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে বেড়ালের ছবি, বইয়ের দোকানে বেড়াল, কফির দোকানে বেড়ালে, সুসি শপে বেড়াল, স্কুলে বেড়াল, অতীত বা ভবিষ্যতে বেড়াল, গোয়েন্দা বেড়াল, লাভগুরু বেড়াল, দার্শনিক বেড়াল, থেরাপিস্ট বেড়াল... বিল্লির দাপটে জাপানিজ সাহিত্য হুড়মুড়িয়ে ক্লাউড নাইনে উঠে গেছে। মাংগা, অ্যানিমে, ক্রাইম, লাভ স্টোরি, কামিং অফ এজ... সব বইই দেখি হিট। তাতে বেড়াল বা স্লাইস অফ লাইফ এলিমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা বই হিট হতেই একদম ফ্র‍্যাঞ্চাইজি খুলে চারটে বই আরো চলে আসে। বিল্লিই এখন দুনিয়ার সবচেয়ে ট্রেন্ডিং প্রাণী, ভরসাযোগ্যও। 

ভুল ভাববেন না, আমি বিল্লি ম্যানিয়ার বিরোধিতা করছি না, স্লাইস অফ লাইফ বই পড়তেও আমার দিব্যি লাগে। খুব শাটল ভাবে সিরিয়াস কথা বলে দেয়, ছিমছাম প্রেম বা বিয়োগের গল্পে লাইফ লেসন দিয়ে দেয়, বেশ কিছু লেখক লেখিকা এই জনরায় এমন হাত পাকিয়ে ফেলেছে যে তাদের আর অগ্রাহ্য করার উপায় নেই৷ পাতলা পাতলা বই, ঝরঝরে অনুবাদ, দু এক সিটিংয়েই শেষ। পড়েও ভালো লাগে। কিন্তু এই স্লাইস অফ লাইফের ঠেলায় জাপানের সমকালীন সিরিয়াস লেখকরা বাজারে এমন কোণঠাসা হয়েছেন যে বলার নয়। অথচ জাপানে চিরকাল সিরিয়াস লেখালিখি হয়েছে, হচ্ছেও। কাওয়াবাতা, সোসেকি, মিশিমোর কথা ছেড়েই দিলাম, য়োকো ওগাওয়া, কেঞ্জাবুরো ওয়ে, ইশিগুরো বা ইয়াশিমোতো তো সমকালীন লেখকদের মধ্যেই পড়বেন। (মুরাকামি প্রভৃতিদের কথা ধরছিই না, স্টার লেখকদের টেনে লাভ নেই)

ইয়োকো তাওয়াদার মতো কিছু কলম আছে, তারা এই রেসের উর্ধ্বে, ব্রকবাস্টার হওয়ার হিড়িকের বাইরে। তাঁর লেখা 'হোয়্যার ইউরোপ বিগিনস' পড়ে আমি লিখেছিলাম, তাওয়াদার লেখায় একটা 'জার্নি' আছে। তিনি বলেছেন, 'দ্যাট লাইজ ইন দ্য ইন বিটউইন'... লেখা বয়ে যায়, চরিত্র বয়ে যায়, সময় বয়ে যায়। কিছুই স্থির নেই। গল্পও স্থির নেই। গল্পের আউটলাইনও স্থির নেই, তাও বয়ে চলেছে। এই ধারাপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে আসলে গল্প কোথায়, অধিকাংশ পাঠক তা খুঁজেই পায় না। তাঁর প্রায় প্রতিটা বইই আলোচিত, কয়েকটা পুরস্কৃতও, কিন্তু গুডরিডসের পাঠকরা বিরক্তি জানান দিতে ইতস্তত করে না। বইয়ের পাহাড় যখন পাঠককে চাপা দিতে চাইছে, তখন থ্রি স্টার রেটিং বই কেন কেউ পড়বে? কূট প্রশ্ন বটে!

কিন্তু, কয়েকজন থাকে, যাদের স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। তাওয়াদাকে নিয়ে আমার একটা ভালো লাগা আছে। এই ছোট্ট বইটা পড়তে গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি ঠিক তাই। গল্প যে কোথায়, গল্পের ক্রাইসিস যে কী, গল্পের প্রেক্ষাপট বা আবহ কী, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! একটা ভবিষ্যতের দুনিয়ার কথা হচ্ছে বটে, তা সেটা ভালো না মন্দ, ডিস্টোপিক বা ইউটোপিক, আমুদে বা বিষণ্ণ, কিছুই 'স্থিরভাবে' বলা যায় না। একবার মনে হয়, কী ডিস্টোপিক ব্যাপার রে ভাই! পরের প্যারায় গিয়ে ভাবি, বাহ, এমনটাই তো হওয়া দরকার, বেশ ফিলগুড ব্যাপার মনে হচ্ছে। 

এই করতে করতে এক বুড়ো থুত্থুড়ে মানুষের একশো পনেরো বছরের জীবনের আগেপিছে ঘুরে বেড়াই, টোকিওর মানুষের জীবন অনুভব করি। চাষবাস, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞানের গলিতে টহল দিই বুড়ো ইয়োশিরোর সঙ্গে! কখনও তার নিজের কথায়, কখনও তার নাতির ছেলের কথায়, কখনও আবার তাদের শিক্ষক বা সহপাঠীর মন বুঝতে চেষ্টা করি। কত কথা উড়ে যায় কত কথা মুছে যায়, কত কথা মন ছুয়ে রিদয়ে হারায় ... কত কথা হল বলা কত কথা তবু বাকি...

...করতে করতে একসময় বই শেষ। ভোম্বলের মতো ভাবি, কী হল? কী ছিল গল্পে? কী পড়লামটা কী? হেঁশোরামের দুনিয়া না কল্পনার উড়ান? হলটা কী? তারপর মন শান্ত হলে বোঝা যায়, গল্প তো তাওয়াদা বলে দিয়েছেন। সবটাই বলেছেন, যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে। চরিত্র, প্রেক্ষাপট, ক্রাইসিস, পরিণাম... সবই তো যথাযথ, পরিমিত! কিন্তু কখন বলেছেন বুঝতে পারিনি! যে লাইনে তিনি গল্পটা বলেছিলেন, সেই লাইনে আমি শুধু সেই লাইনের গল্প নিয়েই মজে ছিলাম, আগেপিছু কিছুই ভাবিনি। এই অবস্থাটা তিষ্ঠোলে একটা সুখানুভূতি হয়। তখন মনে হয়, একটা ভালো কিছু পড়লাম। বেশ আরাম হয়!

এইটুকুই। বাকি গল্প বলার আর দরকার নেই। এই বই পড়তে হলে শুধু পড়ার আনন্দের জন্যই পড়ুন, ভালো বই বা ভালো গল্প পড়ব বলে শুরু করলে হতাশ হতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন