বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

প্রাক পঞ্চাশ যুগের স্বাধীন ভারত ও এক পার্সি গোয়ন্দার কাহিনি


ওয়াসিম খান ব্রিটিশ পাকিস্তানি লেখক। তাঁর বেবি গনেশ ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি সিরিজ ইউকেতে বেশ জনপ্রিয় তো বটেই, ভারতেও তাঁর পাঠক কম নেই। আবির মুখার্জির ভক্তরা অনেক সময় ওয়াসিম খানের লেখাও পছন্দ করেন বলে শুনেছি, দুজনে একসঙ্গে একটা পডকাস্টও করেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে ব্রিটিশ পাঠকের কথা ভেবে তিনি বেশ কিছু ক্লিশে 'ইন্ডিয়ান মোটিফ' লেখায় নিয়ে আসেন, হয়তো সেই কারণেই কিন্তু কিন্তু ভাব থেকে এতদিন তাঁর কলমের স্বাদ নেওয়া হয়নি। এদিকে কানাইচরণ রোজ রোজ মিলবে না, ভারতীয় পুলিশ প্রসিডেরালের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। এমন সময় জানা গেল ওয়াশিম খান বছর কয়েক আগে পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছেন। মালাবার হাউস সিরিজের নায়িকা ভারতের প্রথম আইপিএস অফিসার পারসিস ওয়াডিয়া, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস এই সিরিজের প্রথম বই। পড়ে বলতেই হচ্ছে, দারুণ উপভোগ করলাম।

একটু সামারি দেওয়া যাক। সময়টা ১৯৫০ সাল। তবে বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগ্ব্র দিন রাত্রে, যখন মুম্বাই শহরে নতুন বছরের উৎসব চলছে, মালাবার হাউস থানায় একটা ফোন আসে যে জনৈক ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট খুন হয়েছেন। ভদ্রলোক কেউকেটা ব্যক্তি, স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের তরফ এর গোপন একটা তদন্ত করছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রভাব আর ব্যবসা বাণিজ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এহেন ভাগ্যক্রমে এই কেসটা গিয়ে পড়ে পারসিস ওয়াডিয়ার কাছে। পুলিশে প্রথম মেয়ে হওয়ার সুবাদে সে নিজে প্রতিদিন নানান ফ্যাকড়ার সামনে পড়ছে, তারপর এমন হাই ফাই কেস আসতে তাকে (ঘুরিয়ে) বলা হয় ছাব্বিশ দিন পর কন্সটিটিউশন ইম্পলিমেন্ট করা হবে, তার আগে কেস সমাধান না করলে মুণ্ডু ঘ্যাঁচাং! এমনিতেও পুলিশে মেয়েদের কী কাজ?

বাকিটা খাঁটি পুলিশ প্রসিডেরাল। পারসিস আর তার সঙ্গী ব্রিটিশ পরামর্শদাতা অফিসার আর্চি ব্ল্যাকফিঞ্চ সন্দেহের তালিকায় থাকা সকলকে সাক্ষাৎকার করছে, অতীতের পাতা খুঁড়ে বার করছে, ফরেন্সিক, অ্যালিবাই, জবানবন্দির ক্রস ভেরিফিকেশন করছে... কিন্তু যে জিনিসটা বইটাকে সত্যি সত্যি ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে সেটা হল সেটিং।

এমন একটা সময়, যখন বম্বে দ্রুত বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে দেশও। স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সকলের কাছে তার মানে অন্যভাবে ধরা দিচ্ছে। সমসাময়িক রাজনীতি, কাস্ট আর রিলিজিয়ান নিয়ে কচকচি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে দুর্নীতি আর ব্রিটিশদের লেগাসির প্রতি একটা চাপা ভক্তি, সাদা চামড়ার মানুষের প্রশাসনে গুরুত্ব, অর্থনৈতিক বিভাজন... সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে পারসিসের পার্সি ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা সেকালের নগরসংস্কৃতির বিভিন্ন অ্যানেকডোট! অমুক দোকানের ভালো রান্না, তমুক অফিসের সামনে লাগানো গুলমোহর গাছ...  পারসিস এর নিজের জীবনেও কিছু কিছু জট রয়ে গেছে। চরিত্রগুলো যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে, হুড়মুড়ি ভাব নেই, কোথাও মনে হয় লেখক  রকেট চালাচ্ছেন। আবার ঘ্যানঘ্যানও বিশেষ করেন না। প্রি আর পোস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্সের বিপ্লব এর বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে, বর্মার যুদ্ধ আছে, আর সব কিছুই কোনও না কোনও ভাবে গল্পে ঢুকে গেছে। ফলে ইনফো ডাম্প মনে হয় না। এক্সট্রা পয়েন্ট ফর দ্যাট! 

তবে এ সবই মাঠে মারা যেত, যদি রহস্যটা না জমত! আমার কাছে অবশ্য মনে হয়েছে, ওয়াসিম খান ভালোই জট পাকিয়েছেন, খুলেছেনও সাবলীলভাবে। ব্রিটিশ রাইটার হওয়ার কারণে কিছু কিছু জিনিস একটু স্পুনফিড করতে হয়েছে, তবে তাতে গতি থমকায়নি। 

পার্টিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে গল্পে। এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক, ওয়াসিম খানের বাবা নিজেই দেশভাগের সময় পাঞ্জাব থেকে চাপে পড়ে পাকিস্তান যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেখান থেকে তাদের ফ্যামিলি ইউকে ইমিগ্রেট করে যায়। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মতো তিনিও ভারতকে কোনোদিন অন্য দেশ ভাবতে পারেননি। তাঁর মায়ের ক্ষেত্রে অবশ্য মনোভাব ভিন্ন ছিল, তিনি পাকিস্তানে বেশি সময় কাটিয়েছেন। ওয়াসিম নিজে অবশ্য বেশ কিছুটা সময় ভারতবর্ষে থেকেছেন, তার লেখা দেখে বোঝাই যায় এই দেশটাকে তিনি খুব ভালো করে খেয়াল করেছেন। ভারতের প্রতি একটা মমতাবোধও অনুভব করলাম, কেউ কেউ অবশ্য সেটা মেকি বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, তবে আমার কাছে লেখক এর কলম যথেষ্ট যত্নশীল আর এমপ্যাথেটিক বলে মনে হল।

সব মিলিয়ে, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস চমৎকার বই। এই সিরিজের বাকি তিনটে বইও পড়ার ইচ্ছে রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন