কর্ম্যাক ম্যাকার্থি গত বছরই মারা গিয়েছেন। তার আগেই অবশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, ফ্র্যাংকো-বেলজিয়ান শিল্পী মানু লার্সেনে তাঁর পোস্ট অ্যাপোক্লিপ্টিক ক্লাসিক 'দ্য রোড' নিয়ে কাজ করছেন। ভদ্রলোকের কাজ সম্পর্কে ভাসাভাসা আইডিয়া ছিল, 'দ্য ব্রডেক রিপোর্ট' বলে একটা গ্রাফিক নভেল বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু দ্য রোডের মতো ভীষণ 'ম্যাকাবরে' দুনিয়াকে কমিক্সে কী করে ধরা যাবে সেই নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল। মাস দুয়েক আগেই শেষমেশ সেই কাজ বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এতদিনে সেটা পড়ার সুযোগ হল। আর পড়ে আমি... বাকরুদ্ধ!
আগে আমার আশঙ্কার কারণটা বলি। ম্যাকার্থির লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা অতি অবশ্যই বুঝতে পারবেন আমি কী নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম! আসলে তিনি তাঁর শক্তিশালী কলমের মাধ্যমে যে দুনিয়াটা রচনা করেন, তা প্লট ভিত্তিক গল্পে বা সিনেমায় নিয়ে আসা ভীষণ চাপের। ম্যাকার্থির ভাষা ছাড়া অন্য কোনও মিডিয়াম--- সে অন্য কারো কলম হোক বা ছবি বা অ্যানিমেশন--- সেই দুনিয়াটা গড়তে পারবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতেও ম্যাকার্থি ভীষণ ডিটেল ওরিয়েন্টেড লেখক, তাঁর গল্পে চরিত্ররা সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এগিয়ে যায়, সেই ট্রাঞ্জিশনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দেশকাল সমাজের বর্ণণা আঁকা হতে থাকে। এমনকি দরকারে ইংরেজির মধ্যে স্প্যানিশ সংলাপ ঢুকে যায়...
'দ্য রোড' দেখতে গেলে খুবই সাধারণ প্লটের গল্প, একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীতে এক বাবা আর তার ছেলে শীত থেকে বাঁচতে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছেন, ঘোরতর শীত, খাবারের অভাব আর ছাইয়ে মোড়া দুনিয়ার পাশাপাশি তাদের ক্যানিবালদের হাত থেকেও রক্ষা পেতে হবে। একটু এদিক ওদিক করলে এই প্লটে অনেক গল্পই ঢুকে যেতে পারে, জম্বি ঢুকিয়ে দিলে 'দ্য লাস্ট অফ আস' হয়ে যাবে, রোবট ঢুকিয়ে দিলে হলিউডের বি গ্রেড সাইফি সিনেমা হয়ে যাবে। কিন্তু ম্যাকার্থি সে সব ন্যাকামি করতেই যাননি। তাঁর লেখায় বাবা আর ছেলে বাদে তেমন কোনও চরিত্র আসেনি, বিশেষ কোনও সাইড প্লট আসেনি, এসেছে শুধু এই অলীক ভয়ংকর দুনিয়ার বর্ণনা! টুকরো টুকরো যথাসামান্য সংলাপ, সেই সমস্ত সংলাপের ধার এতটাই বেশি যে পাঠকের মনে হয় কেউ যেন এক একটা সংলাপের মাধ্যমে তাদের কলজে ছিঁড়ে নিচ্ছে। শুধু ভাষা আর ট্রিটমেন্ট, যথেষ্ট! ওইটুকু দিয়েই বাজিমাত করেছেন, পুলিৎজার প্রাইজও জিতে নিয়েছেন!
এই দুনিয়াটা একটা গ্রাফিক নভেলে কী করে ক্রিয়েট করা যাবে? এই ইউনিক মুডটা কী করে ধরা যাবে ছবিতে, তাও অন্য একজনের ছবিতে? শব্দ আর বাক্য দিয়েই যে অ্যাটমস্ফেয়ার তৈরি হয়েছে, তা প্যানেলের ছবি দিয়ে অনুবাদ হবে কী করে? এই আশঙ্কা ভুল নয়, অন্ততপক্ষে বেশিরভাগ অ্যাডাপ্টেশনের জন্য তো নয়ই।
কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, লার্সেনে অসামান্য কাজ করেছেন। প্রতিটা প্যানেল ভীষণ বাস্তব, ভীষণ বাস্তব, আর ভয়ংকর সুন্দর! ভয়ংকর! এতটাই সুন্দর যে যে কোনও প্যানেল র্যান্ডমলি তুলে ফ্রেম করে ঘরে টাঙিয়ে রাখা চলে। সংলাপ প্রায় নেইই (বইয়ের মতোই), তার জায়গা ভরাট হয়েছে ছবি দিয়েই। সাদাকালো আর মাঝেমধ্যে প্রয়োজন মতো লাল আর খয়েরির শেড, এই গ্রেডেশন এমন চমৎকার ভাবে বইটার মূল ন্যারেটিভকে ফুটিয়ে তুলেছেন যে না পড়লে বিশ্বাস হবে না। কখনও অবিরাম তুষারপাত, কখনও শনশনে হিমেল হাওয়া, কখনও মুষলধার বৃষ্টি...তার পাশাপাশি এসেছে ক্ষয়ে যাওয়া মৃতদেহের ফসিল, ভাগাড় দৃশ্য, জঙ ধরে যাওয়া মেটালিক জাঙ্কয়ার্ড ভিজে আর্দ্র আবহাওয়ায় ধসতে থাকা শহরগুলোর ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠামো... তার মধ্যে দিয়ে চলেছে বাবা আর ছেলে! এবং ভায়োলেন্স! অসামান্য রূপান্তর! এমন এক ডিপ্রেসিং ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে যে পোয়েটিক সৌন্দর্য বের করে আনার যে দক্ষতা ম্যাকার্থির ছিল, তা ছবির মাধ্যমে ভীষণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। প্রায় দু আড়াই বছর ধরে দিন রাত একটা কাজের পিছনে পড়ে থাকলে পার্ফেকশনের লেভেল কী হতে পারে, সেটা দেখার জন্যই এই গ্রাফিক নভেলটা মনে থেকে যাবে। কয়েকটা প্যানেল কমেন্টে দিলাম!
এই কাজটার পর ইচ্ছে রইল ম্যাকার্থির 'ব্লাড মেরিডিয়ান' রিপিট করার! আগেরবার পড়তে গিয়ে মাথা ঘুরছিল, এইবার স্টোরিটেলে এসেছে দেখেছি। বাংলাদেশে সম্ভবত অনুবাদ হওয়ার কথা আছে, তার আগে একটু একটু করে শুনে নেব। ইতিমধ্যে ব্লাড মেরিডিয়ানও গ্রাফিক নভেল হয়ে গেলে ষোলকলা পূর্ণ।
Abrams Comic Art
1936/-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন