The wonderful things in life are the things you do, not the things you have.
শুধু পুরোনো নয়, ওয়েবে প্রকাশিত প্রথম লেখা। ম্যাজিক ল্যাম্প-এ এই লেখাটা দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ, রেইনহোল্ড মেসনারের প্রেমে পড়া। আলপাইন ক্লাইম্বের প্রবাদপ্রতিম ব্যাক্তিত্ব তো বটেই, ধীরে ধীরে মেসনার কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন অল্টিটিউড ক্লাইম্বের জগতে। বেসিক কোর্স করার সময় ওর কিছু দুর্লভ সাক্ষাৎকার দেখার সুযোগ হয়েছিল, সেইগুলো এখনও প্রয়োজনে আমাকে সাহস জোগায়। পুরো লেখাটাই তুলে দিলাম। যদি কেউ আগ্রহী হয়, মেসনারের লেখা 'ক্রিস্টাল হরাইজন' বইটা পড়তে পারেন। জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
পাহাড় যখন ডাকে
পায়ের পাতায় রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এবার রীতিমতো। এক পা ফেলতে গিয়ে মনে হচ্ছে লাংস যেন ছিঁড়ে যাবে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চোখের সামনে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। ক্ষীণ হয়ে আসছে অনুভূতিগুলো। মৃত্যু তার অপেক্ষায় আছে আট বছর ধরে। এখানে সে মরতেই এসেছে…
***
১৯৫৩। রেইনহোল্ড-এর বয়স তখন নয় বছর। খবর এল হারমান বুল নাঙ্গা পর্বত শিখর জয় করেছেন। মুহূর্তের মধ্যে সেলিব্রেশন আরম্ভ হয়ে যায় মেসনার ভাইদের মধ্যে। ইতালিতে থাকা এই পরিবারের সবাই পাহাড় পাগল। মাসে একবার আল্পস-এ না যেতে পারলে এরা অস্থির হয়ে ওঠে। রেইনহোল্ড আর গুন্টুর ইতিমধ্যেই পাকা পর্বতারোহী হয়ে উঠেছে। ইতালির উত্তর-পশ্চিমে ডোলামাইটস রেঞ্জের অনেকগুলো শিখর তারা জয় করেছে দশ বছরে পড়ার আগেই। রেইনহোল্ড এমনিতেও হারমান বুলের অন্ধ ভক্ত। তার হিরোর এই কৃতিত্বে সে সবচেয়ে খুশি। এত বছর ধরে কেউ জয় করতে পারেনি যে নাঙ্গা পর্বত, বুল তা করে দেখালেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব ক্লাইম্বিং টেকনিকের ওপর ভরসা করে। বুল এমনিতেই সেই সময়ের পর্বতারোহী জগতের রেবেল। আলপাইন স্টাইল-এর প্রবল সমর্থক। এক্সপিডিশন স্টাইল বা সিজ স্টাইল-এর ক্লাইম্বিংকে খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন বুল। তার মতে হাজারটা ইকুইপমেন্ট, আর রোপের ওপর ভরসা করে পাহাড়ে যাওয়া পাহাড়কে অপমান করার সামিল। যে সত্যিকারের পর্বতারোহী, সে যাবে ভারমুক্ত হয়ে, নিজের ভরসায়, পাহাড়কে সম্মান করে। না হলে নিজেকে mountaineer বলে পরিচয় দেওয়াই ভুল। ওয়াইনের চুমুক আর সেলিব্রেশনের আড়ালে রেইনহোল্ড ঠিক করে নিল, তার প্রথম হিমালয় এক্সপিডিশন হবে নাঙ্গা পর্বতে। কে জানত, ৩ জুলাই ১৯৫৩-এর সেই সন্ধে জীবন বদলে দেবে রেইনহোল্ড মেসনারের!
***
১৯৭০। নাঙ্গা পর্বত-এর বেস ক্যাম্প-এ বসে হিমালয়ের দিকে চেয়ে আছে রেইনহোল্ড। সঙ্গে আছে তার ছোটভাই গুন্টুর। নয় বছরের রেইনহোল্ড আজ ছাব্বিশ বছরের যুবক। ইতিমধ্যেই সে ভাই গুন্টুরের সঙ্গে জয় করেছে আল্পসের বেশিরভাগ চূড়া। অভিজ্ঞ পর্বতারোহী বলে তাদের স্বীকার করা হয় সারা ইউরোপে। কিন্তু হিমালয় এই প্রথম। রেইনহোল্ড ভোলেনি তার নিজেকে করা প্রমিস। প্রথম হিমালয় এক্সপিডিশন হিসেবে সে বেছে নিয়েছে নাঙ্গা পর্বতকে। আল্পসকে সে হাতের রেখার মতনই চেনে। কিন্তু হিমালয়ের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না। ৮০০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় থাকা প্রতিটি পর্বত শিখর, যাকে popularly eight thousanders বলে ডাকা হয়, প্রত্যেকটা অবস্থিত এই বিশাল হিমালয়ান রেঞ্জে। শুধু একটা পর্বতশৃঙ্খলা নয়, হিমালয় একটা জীবনদর্শন।
২৭ জুন সকালবেলা থেকে ওয়েদার খারাপ হতে শুরু করে। রেইনহোল্ড একা এগিয়ে গেছে রুপাল ফেস দিয়ে পিকের উদ্দেশ্যে তার আগেই। সে এই অবসর হেলায় হারাতে রাজি নয়। গুন্টুরও একটু পরে এগিয়ে যায় তার ভাইকে সঙ্গ দিতে। তারা অভিজ্ঞ মাউন্টেনিয়ার, আর আলপাইন স্টাইল-এ ক্লাইম্ব করলে এমনিতেও সময় কম লাগে। কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়ে নিজের ওপর। গুন্টুর কোনওদিন আগে হিমালয়ে আসেনি, কিন্তু প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে সে দ্রুত এগিয়ে যায় রেইনহোল্ড-এর দিকে। পিকের একটু আগেই তাদের দেখা হয়ে যায়। সাবধানে এগোতে থাকে দু’জনে। একসময়ে পৌছে যায় নাঙ্গা পর্বত পিকে। দারুণ আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তারা। স্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই, তারা আজ জয় করেছে নাঙ্গা পর্বত। মেসনার ভাইরা আকাশের দিকে চোখ তুলে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়।
এবার ফেরার পালা। সবদিক চিন্তা করে তারা নামা শুরু করে দিয়ামির ফেস দিয়ে। এইদিক দিয়ে নামলে সময় বেশি লাগে, কিন্তু কিছু করার নেই। রুপাল ফেসের দিকে ধ্বস নেমেছে। চারদিকে বরফ আর বরফ। তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাঙ্গা পর্বতের চূড়া। হিমালয়ের শীতার্ত হাওয়াকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ। জীবনের দিকে। দু’দিন ধরে নেমে চলেছে তারা অনবরত। এদিকে ওয়েদার ক্রমাগত খারাপ হয়ে চলেছে। শুরু হয়ে গেছে ব্লিজার্ড। এইরকম সময়ে বরফের ক্রিভাসগুলোতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
রেইনহোল্ড আর গুন্টুর নামতে থাকে একটু একটু করে। গুন্টুর-এর শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। হিমালয়ের এত উচ্চতায় আলপাইন স্টাইল-এ বেশিক্ষণ ক্লাইম্ব করলে এরকম হবেই। ব্লিজার্ড-এর জোর বেড়েই চলেছে। আর কোনওমতেই এগোনো যাবে না। বরফের ঝড়ে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তাপমাত্রা চলে গেছে অনেক নিচে। এমন সময় avalanche-এর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। রেইনহোল্ড এগিয়ে গেছিল বেশ খানিকটা। সে চিৎকার করতে থাকে গুন্টুরকে সাবধান করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। হিমবাহ আছড়ে পড়েছে অবসন্ন গুন্টুর-এর ওপর। রেইনহোল্ড-এর চোখের সামনে তার সারাজীবনের পাহাড়ের সঙ্গী, তার ভাই হারিয়ে যায় নাঙ্গা পর্বতের বরফের মধ্যে, চিরতরের জন্যে। বেহুঁশ হওয়ার আগে রেইনহোল্ড শুনতে পায় বুলের একটা কথা, "Mountains have a way of dealing with overconfidence."
ছয়দিন পর রেইনহোল্ড বেস ক্যাম্পে পৌঁছয় মরণাপন্ন অবস্থায়, এক গা জ্বর নিয়ে। গুন্টুর-এর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। রেসকিউ পার্টির লোকেরা একসময় হাল ছেড়ে দেয় গুন্টুর মেসনারের দেহ উদ্ধার করার। অবসন্ন দেহ ও ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে রেইনহোল্ড ফিরে আসে দেশে। ফ্রস্ট বাইট হওয়ার দরুন তার পায়ের ছ’টা আঙুল বাদ দিতে হয়। পায়ের আঙুল না থাকলে রক ক্লাইম্বিং করা অসম্ভব। কিন্তু হায়ার মাউন্টেইনে কোনও সমস্যা হয় না। নিজের অজান্তিতেই রেইনহোল্ড-এর জীবনের দিক ঠিক হয়ে যায়।
হিমালয়।
***
১৯৭১। রেইনহোল্ড আবার ফিরে যায় নাঙ্গা পর্বত, উদ্দেশ্য গুন্টুর-এর দেহটা খুঁজে বের করা। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়ে ওঠে না। পরের বছরে সে আবার ফিরে যায় নাঙ্গা পর্বত জয় করতে। কিন্তু ভাগ্য রেইনহোল্ড-এর ওপর সদয় ছিল না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সে। কিন্তু রেইনহোল্ড-এরও জেদ চেপে গেছে। সে আবার ওই চূড়ায় উঠবেই। ১৯৭২-এ মানালসু আর ১৯৭৫-এ হিডেন পিক জয় করে সে। কিন্তু তার লক্ষ্য নাঙ্গা পর্বত। সে প্রতিবছর ফিরে যায় সেখানে, যদি কোনওভাবে অবসর পাওয়া যায়।
১৯৭৮। রেইনহোল্ড এতদিনে বেশ কয়েকবার হিমালয়ান এক্সপিডিশানে এসেছে। আগের চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ সে। আবার নাঙ্গা পর্বত-এ ফিরে আসে সে। রেইনহোল্ড-এর বিশ্বাস, সে একা না গেলে কোনওদিন উঠতে পারবে না নাঙ্গা পর্বতে। গুন্টুর শুধু তাকেই দেখা দেবে। আলপাইন স্টাইল-এ সোলো ক্লাইম্বিং আরম্ভ করে সে। এবারেও ১৯৭০-এর মতন অবস্থা। ওয়েদার যে কোনও মুহূর্তে খারাপ হতে পারে। কিন্তু আগের বারের মতো রুপাল ফেস দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে না সে। রেইনহোল্ড পথ ধরে দিয়ামির ফেস-এর, যেখান থেকে আগেরবার গুন্টুর আর সে নেমে আসছিল। এই পথ দিয়ে চড়াই করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাকে যেতেই হবে। যদি সে খুঁজে পায় গুন্টুরকে! তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। কে যেন রেইনহোল্ড-এর সমস্ত শক্তি, সমস্ত আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আগেরবারের ঘটনা। ভয়ে শিথিল হয়ে যায় বুকের ভেতরটা। তার পায়ের পাতায় পাথর পড়ে চোট লেগেছে। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে কাটা আঙুলগুলোর পাশ দিয়ে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এবার রীতিমতো।
পায়ের পাতায় রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। এক পা ফেলতে গিয়ে মনে হচ্ছে লাংস যেন ছিঁড়ে যাবে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চোখের সামনে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। ক্ষীণ হয়ে আসছে অনুভূতিগুলো। মৃত্যু তার অপেক্ষায় আছে আট বছর ধরে। এখানে সে মরতেই এসেছে। কিন্তু এর শেষ দেখে যাবে সে। যতক্ষণ শ্বাস চলছে সে হার মানবে না। মৃত্যু যদি হয় হোক। তাকে উঠতেই হবে।
রেইনহোল্ড উঠছে। একা। আরও এক পা। আরও এক পা। সময়ের বোধ হারিয়ে যায় একসময়। একসময় রেইনহোল্ড চমকে ওঠে। গুন্টুর! তার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে তার ভাই। মুখে হাসি। তাকে দেখে বলে ওঠে, “C’mon Rainee! 100 meters more! We will do this.”
গুন্টুর-এর প্রতিমূর্তি হারিয়ে যায়। রেইনহোল্ড দেখে সে চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সে উঠতে থাকে। গুন্টুর আর তার সঙ্গে নেই। কিন্তু তাকে উঠতেই হবে। নিজের জন্যে। সে থামবে না।
রেইনহোল্ড মেসনার কোনওদিন থামেনি এরপর। দিয়ামির ফেস দিয়ে প্রথম সে নাঙ্গা পর্বত জয় করে সোলো ক্লাইম্বিং করে। (পর্বতশৃঙ্গ তো আর জয় করা যায় না, তবে সে সময় ভুল করে এই কথাটাই লিখেছিলাম। যারা পাহাড় জয় করেছি বলে উন্নাসিক নাচানাচি করে, তারা আর যাই হোক, পর্বতারোহী নয়) ১৯৭৮-এই সে এভারেস্ট জয় করে প্রথম supplementary অক্সিজেন না নিয়ে। তার অভিযান কোনওদিন থামেনি। পৃথিবীর ১৪টি উচ্চতম পিকে সে পা রেখেছে একাধিকবার। কেউ তার আগে এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি। সে কোনওদিন supplementary oxygen নিতে রাজি হয়নি। পাহাড়ের সম্মানহানি হতে সে দেবে না। সে পাহাড়কে ভালোবাসে। তারই কথায়, “The wonderful things in life are the things you do, not the things you have.”
২০০৫ সালে নাঙ্গা পর্বতে গুন্টুর মেসনারের দেহ উদ্ধার করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন