শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১

নাহুমের গ্রাম

 একটা বই কী করে লেখা হয়?


একটা পেইন্টিং, একটা কম্পোজিশন, একটা চলচ্চিত্র, একটা ভাস্কর্যের আড়ালে গোটা একটা জীবন থাকতে পারে। একটা জাতির ইতিহাস কোনও জায়গায় গিয়ে মিশে যায় ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে, স্মৃতির সাবকনশিয়াসে সংরক্ষিত শব্দ, গন্ধ, রঙ ও সুর লিখিয়ে নেয় এক একটা বই, রচিত করে সুরমালা, বাধ্য করে শিল্পীকে শিল্পের সামনে আত্মসমর্পণ করতে। শিল্পের আঙ্গিক, উৎপত্তি, বিবর্তনের সমান্তরালে শিল্পীর চেতনা ও অবচেতন নিয়ে আলোচনা ও লেখালিখি কম হয়নি, কিন্তু নন ফিকশনে গূঢ় মনস্ত্বাত্তিক তদন্ত করতে গিয়ে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে খুব বেশি বই পারে না। নাহুমের গ্রামে লেখকের ভাষার মায়া ও চিন্তার গভীরতা চুপ করিয়ে রাখে পাঠককে, ভাবতে বাধ্য করে। এই বইয়ের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু বলা যায় না, কারণ পাঠের এই অনুভব প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নিজস্ব। শিল্পের সার্থকতা ও আবহমান প্রাসঙ্গিকতার এই দীর্ঘ অণুবীক্ষণে বার্গমান, তারকোভস্কি যেমন আছেন সেরকম সমরেশ বসু ও মার্কেসও আছেন। সমসাময়িক শিল্পের কথা যেমন আছে, হারিয়ে যাওয়া শহর ও ইতিহাসের মহামারীর অন্তরালে বদলে যাওয়া মনোজগতের কথাও আছ। আর কিছু না বলে বরং বইয়ের খানিকটা অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম। যদি পড়ে ভালো লাগে, অনুরোধ করব বইটা পড়তে। একাধিক বার পড়তে। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে অনেককেই এই বইটা ফিরে ফিরে পড়তে হবে সারাজীবন।

#পুস্তকাংশ

ক্‌ফারনাউম : গ্রিক শব্দ, হিব্রু ভাষায় উৎপত্তি। আদতে দুটি শব্দ, কেফার ও নাহুম, অর্থাৎ নাহুমের গ্রাম।গ্যালিলি সাগরের উত্তর উপকূলে এক সুপ্রাচীন মাছ-ধরাদের গ্রাম। কোনো এককালে জনসংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু হয়ে এগার শতক পর্যন্ত একটানা মানুষের বসবাস ছিল এখানে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খনন করে উদ্ধার করেছেন দুটি সুপ্রাচীন সিনাগগের ধ্বংসাবশেষ, একটির ঠিক ওপরে আরেকটি। ক্রুসেডের আগে গ্রামটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বিরাট ভুমিকম্প হয়েছিল। ক্‌ফারনাউম, নাহুমের গ্রাম। শব্দবন্ধটি কীভাবে যে হয়ে উঠল এলোমেলো জড়ো হওয়া অবিন্যস্ত অবান্তর জিনিসের স্তূপ, সেসব ভাষাতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়।

সিলিকন আর ইন্ডিয়া রাবার দিয়ে ওকে বানানো হয়েছিল চীনের গুয়াংঝাউ শহরে। এরপর হংকং ঘুরে চলে যায় লিসবনের বাজারে। চীনে তৈরি হলেও চেহারাটা কিন্তু মঙ্গোলয়েড ধাঁচের নয়, বরং অনেকটা যেন ভূমধ্যসাগরীয়দের মতো। ঘন কালো চুল, সবুজ আঙুরের মতো চোখ, পুষ্ট স্তন, চওড়া জঘন ও শ্রোণি; পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি পুতুল। খুব জীবনানুগভাবেই বানানো, এমনকি মুখের গড়নেও নিখুঁত ফুটে আছে লাস্য আর বিষাদ। পোল্যান্ডের দুই নাবিক ভাগাভাগি করে কিনেছিল ওকে। ওরা ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধু, বিভিন্ন বন্দরে একই বেশ্যালয়ে যেত। কখনো কখনো এমনকি একই নারীর কাছে। মাসের পর মাস দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় পুতুলটি হাতবদল হয়ে চলত ক্যাবিন থেকে ক্যাবিনে। ওর একটি নামও দেওয়া হয়, হেলেন। ডান পায়ের গোড়ালির নীচে মার্কার পেন দিয়ে লেখা থেকে জানা যায়। এই নামটি কেন দিয়েছিল, সেটা অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো ওদের চেনা কোনো নারীর নাম, যে ওদের একজনকে, এমনকি হয়তো দুজনকেই, প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেমিকার নাম কখনোই নয়। ‘হেলেন’ নামের নীচে পোলিশ ভাষায় লেখা ছিল দুটি শব্দ -- বেদনার কুয়ো।

বছর দুয়েক পরে ওদের মালবাহী জাহাজটি কিনে নেয় ক্যারিবিয়ানের এক শিপিং কোম্পানি। কর্মী বদল হয়, কিন্তু পুতুলটি কোনোভাবে থেকে যায়। হয়তো ফেলে রেখে গিয়েছিল দুই যুবক। ওরা নাবিকবৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশায় ফেরে। একজন ওয়ারশ-য় রুটির দোকান দেয়, অপরজন গ্রামে খামারবাড়িতে ফিরে গিয়ে চাষবাস শুরু করে, বিয়ে করে সংসার পাতে। হেলেনের শুরু হয় আরেকরকম জীবন।


জাহাজে নতুন কোম্পানির নাবিকদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ল্যাটিনো ও মেস্টিজো। এছাড়া রসুইখানার কাজে চট্টগ্রামের তিন বাঙালিও ছিল। ওদেরই মধ্যে একজনের প্রথম চোখে পড়ে হেলেনকে। অবশ্য ওর নাম বদলে দেওয়া হয়েছিল কী না সেটা আর জানা যায়নি। ওর দেহে আর কিছু লেখা হয়নি কখনো। তবে এই সময়ে সে বিভিন্ন হাতে ঘুরতে থাকে। জাহাজটি একবার উত্তর মেরু অঞ্চলে হিমজমাট সমুদ্রে আটকা পড়েছিল আড়াই মাস (নরওয়ে থেকে হাঙরের তেল আর পাম্পের যন্ত্রাংশ বহন করছিল)। অত্যধিক ব্যবহারে হেলেনের দেহে রাবারের অংশগুলি ক্লান্ত আর শিথিল হয়ে পড়তে থাকে এইসময়, মাথায় ও দেহের অন্যত্র কেশও ঝরতে থাকে। যদিও সিলিকন অটুটই ছিল। এবং এক কুয়াশাঢাকা ভোরে অস্বচ্ছ তেলের মতো প্রশান্ত মহাসাগর পার হবার সময় -- জাহাজটি পানামা থেকে লাওস যাচ্ছিল -- তাকে পোর্টহোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এক বাঙালি রন্ধনকর্মী। মাসাধিককাল এলোমেলো ভেসে বেড়ানোর পর হেলেন আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্যস্রোত পেয়ে যায়, এবং গোলার্ধ পরিক্রমা করে বিষুবরেখা পেরিয়ে চলে আসে বঙ্গোপসাগরে। এক পূর্ণিমার জোয়ারে আন্দামানের একটি অগম্য দ্বীপে এসে ওঠে।

দ্বীপে বাস করত অস্ট্রিক জনজাতির একদল মানুষ। ওরা সভ্যতার কোন ভোরে মূল ভূখন্ড থেকে এসেছিল ভেলায় চেপে। মাছ ধরে, ফলমূল কুড়িয়ে, ছোটোখাটো প্রাণী শিকার করে জীবন নির্বাহ করত। চাষবাস তেমন জানত না। নারকোলপাতা দিয়ে তাদের ঘর বানিয়ে নিত আর পশুর চামড়া ও গাছের বাকল পরত কটিদেশে। এছাড়া উল্কি আঁকার এবং নাক ও কান ছেদন করার প্রথা ছিল। বিশ-পঁচিশ জনের ছোটো ছোটো দলে ওরা থাকত প্রায় আশি বর্গমাইল সিমের বিচির আকারের দ্বীপটায়। একশো কুড়ি থেকে দেড়শোর মধ্যে ওঠানামা করত ওদের জনসংখ্যা। জন্মহার কম এবং শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় এই ভারসাম্যটা বজায় থাকত। সমুদ্রে খাঁড়িতে অঢেল মাছ, অঢেল নারকোল গাছ, বনে ভোজ্য পাতা ও কন্দ অঢেল থাকায়, এবং চাষের প্রয়োজনে জমির ব্যবহার না থাকার কারণে, বিবাদ বিসম্বাদ প্রায় ঘটতই না। সেভাবে কোনো সংগঠিত ধর্মও ছিল না ওদের। কিছু কিছু আদিম ভীতি এবং লোকবিশ্বাস ছিল। যেমন, ওরা মনে করত পিতৃপুরুষেরা মৃত্যুর পর উইপোকা হয়ে যায়। সেজন্য পিঁপড়ের ডিম ও কিছু কিছু পোকার লার্ভা ওদের খাদ্যতালিকায় থাকলেও উইপোকাদের রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মাটি আর নারকোল পাতা দিয়ে বানানো ওদের শঙ্কুর আকারের ঘরগুলোয় ছেয়ে থাকত উইয়ের বাসা। এভাবেই পূর্বপুরুষদের নিবিড় সান্নিধ্যে সহাবস্থান করত ওরা।

এবং এভাবেই রয়ে গিয়েছিল শত শত বছর। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র আন্দামানের আদিবাসী নাগরিকদের জন্য কিছু কিছু জনহিতকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে কমবেশি সাড়াও দিয়েছে কয়েকটি জনজাতি। কোনো কোনো গোষ্ঠী এমনকি পোর্ট ব্লেয়ার ও অন্যান্য শহরে মূলস্রোতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে কেউ কেউ। এই দ্বীপের জনগোষ্ঠীকে অবশ্য বশে আনা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হয়, কিন্তু সাড়া মেলেনি। চিনি, সুতির কাপড়, পলিথিনের শিট ইত্যাদি উপঢৌকন হিসেবে রেখে আসা হয়, কিন্তু সেসব পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় ওরা। এরই মধ্যে একবার এক বেপরোয়া মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ গোপনে একটি নৌকা নিয়ে দ্বীপে চলে আসেন গবেষণার উদ্দেশ্যে। তিনি আর ফিরতে পারেননি। খবরটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে এবং এব্যাপারে কূটনৈতিক স্তরে চাপ তৈরি হলে ভারতের উপকূল রক্ষীবাহিনির বিশাল একটি দল প্রায় দশদিন পরে দ্বীপে গিয়ে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। দেহটি বেলাভূমিতে নারকোল গাছের গায়ে বাঁধা ছিল। কড়া রোদে এবং নোনা হাওয়ায় শুকিয়ে গিয়েছিল, এবং সম্ভবত এক বিশেষ ধরণের গুল্মের রস মাখানো থাকার জন্য পশুপাখিতে কোনো ক্ষতি করেনি। প্রায় অবিকৃতই ছিল।

রবার ও সিলিকনে তৈরি চীনা পুতুল, একদা যার নাম ছিল হেলেন, যখন অর্ধেক পৃথিবী ভেসে দ্বীপের খাঁড়িতে গিয়ে ঢুকল, ওরা তাকে তুলে নিয়ে এসেছিল। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জাহাজডুবির সামগ্রী ও অন্যান্য আবর্জনা ভেসে এসেছে দ্বীপে। ওরা কখনো সেগুলো অনুসন্ধিৎসার বশে কুড়িয়ে নিয়েছে, কখনো নেয়নি। ছেঁড়া জাল, প্লাস্টিকের বোতল ও জেরিক্যান ছাড়া আর প্রায় কোনো কিছুই ওরা কাজে লাগায়নি। কিন্তু এবার এক দুর্জ্ঞেয় কারণে হেলেনকে নিয়ে এসে ওরা তুলল বসতিতে। শুধু তাই নয়, নারকোলপাতা মাটি আর কাঠ দিয়ে ওর জন্য একটি ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিলে কৌম উঠোনের এক কোণে। দিনের পর দিন সাগরের নোনা জলে ভেসে ভেসে হেলেনের সব চুল খসে গিয়েছিল, দেহের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত স্তন এবং যোনিদেশে, ইন্ডিয়া রাবারের অংশগুলো কোনও বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিকট স্ফীত ও বিকৃত হয়ে এসেছিল, এছাড়া জলপাই তেলের মতো চামড়ার রঙ সম্পূর্ণ উঠে বেরিয়ে পড়েছিল সিলিকনের দগদগে সবুজ। ওরা লতাপাতার রস দিয়ে ওদের বিশিষ্ট উল্কি আঁকল, নাক ও কান বিঁধিয়ে দিল, সাজিয়ে দিল মাছের কাঁটার গয়নায়।

এভাবেই শুরু হল। যেভাবে শুরু হয়।

পর পর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেসব অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো যাবেও না কোনোদিন, কারণ এই জনজাতির কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে হেলেনকে কেন্দ্র করে কোনো বিবাদ, হিংসা কিংবা হানাহানির সূত্রপাত ঘটেছিল বলে কোনো প্রমাণ নেই। কিংবা, সাধারণত যেমন ঘটে থাকে, নতুন কোনো ক্ষমতার বিন্যাস গড়ে ওঠেনি। পরিবেশের ওপরেও কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে পুতুলটি উদ্ধার হবার পর ওদের মধ্যে, বিশেষ করে পুরুষ এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, এক অদ্ভুত ধরণের বিষণ্ণতার অসুখ দেখা দেয়। সবচেয়ে উদ্যমী আর কর্মঠরাও যেন জীবনীশক্তি হারায়। খাঁড়িতে মাছ ধরা, জঙ্গলে ঢুকে ফল কন্দ সংগ্রহের কাজে উৎসাহ হারায়। বনে এক ধরণের মাদক ছত্রাক খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। এমনকি নারকোলপাতা জড়ো করে কুঁড়ের চাল ছাইবার উদ্যমও হারায়। একটি গোটা ঋতুতে দ্বীপে কোনো নতুন শিশুর জন্ম হয় না। এবং আরও কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মরা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে এসে উপকূল ছেয়ে যায়, সমুদ্রে ভাসে কালো তেল, নারকোল গাছে অদৃশ্য কীটাণুর প্রকোপে অপুষ্ট ফলগুলো শুকিয়ে ঝরে যেতে থাকে। এই দ্বীপের ত্রিসীমানায় কোনো পণ্যবাহী জাহাজের পথ নেই, কিন্তু রাত্রিবেলা দিকচক্রবালে বিচিত্র আলোর আনাগোনা দেখা যায়। এইসব লক্ষণ গণনা করার পর গোষ্ঠী প্রবীণেরা বলেন, জ্বরে কাঁপছে মেদিনী। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রথমে টের পায় উইপোকারা। উপকূলের লাগোয়া ভিটে ছেড়ে তারা সারি দিয়ে উঠে যেতে থাকে উঁচু জমিতে। তারপর একদিন, কার্ত্তিক পূর্ণিমার তিনদিন পর, দুপুরের পর থেকে সমুদ্র সরতে শুরু হয়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য : মনে হয় যেন মেদিনীর সরা থেকে সব জল এক চুমুকে পান করছে এক দৈত্য। বিস্তীর্ণ তটভূমি উন্মোচিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে আগ্নেয় শিলার ভাস্কর্য, চাটান, গুহা, ধাপকাটা সিঁড়ি, পাথর কুঁদে তোলা দৈত্যাকার পাখি ও বিচিত্র সব প্রাণীর রিলিফ।

দ্বীপবাসীরা অবশ্য সেসব খুঁটিয়ে দেখার জন্য বেলাভূমিতে অপেক্ষা করেনি। তারা উইপোকাদের পথ ধরেছিল। এবং যথারীতি সূর্যটা ডুবে যাবার আগেই ধেয়ে এল বিপুল জলরাশি, নারকোল বীথির মাথায় মাথায়, ওদের বসতিগুলি ভাসিয়ে নিল।

শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল তিন প্রজন্ম আগে। সেবারও তটভূমি উন্মোচিত হয়ে দেখা দিয়েছিল এই আশ্চর্য পাথরের দেশ, বহুবর্ণ প্রবালে ছাওয়া। আগুনের ধারে বসে সেই স্মৃতিকথা শুনে বড়ো হয়েছে এরা। তারও অনেক কাল আগে ওই আগ্নেয় শিলার দেশে, ওইসব গুহা আর চাটানে বাস করত ওদের পূর্বপুরুষ। সেই কাহিনি এতবার বলা ও শোনার ভেতর দিয়ে কল্পনায় এমন সুস্পষ্ট খোদাই হয়েছিল যে মেদিনীর জ্বর সেরে যাবার পর সমুদ্র যখন ফিরে গেল নীচু এলাকা থেকে, জলের নীচে ঠিক কোথায় ওই শিলাপ্রবালের দেশ রয়েছে সেটা নিখুঁত নিরূপণ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওই ডুবে-যাওয়া অঞ্চলটা উপকূল থেকে বাইশ দমের পথ, আট দম গভীর।

এমনিতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে দ্বীপের সকলেই হাঁটতে শুরু করার পরেপরেই সমুদ্রে সাঁতার দিতে শিখে যেত। তিন, চার এমনকি পাঁচ দম গভীরে সাঁতার দিতে পারার ক্ষমতা অনেকেরই ছিল। সাত, আট কিংবা তার বেশি দম নীচে যেতে পারত যারা, তাদের মধ্যে থেকেই কুলপতি নির্বাচন হতো। স্বাভাবিকভাবেই কুলপতির ওপরে ভার পড়ল হেলেনকে জলের নীচে শিলাপ্রবালের দেশে রেখে আসার। তার আগে ওর নাক ও কান থেকে খুলে নেওয়া হলো মাকড়ি, গা থেকে খোলা হলো মাছের কাঁটার অলংকার। এরপর সবজে সিলিকনের গা থেকে ঘসে ঘসে সব উল্কি তুলে ফেলল ওরা। দেহের প্রতিটি ছিদ্রপথে ভরে দিল ডুমুরের বীজ। তারপর সারাদেহ ছাই আর পাতায় মুড়ে ভেলায় চাপিয়ে নিয়ে গেল বাইশ দম, ঠিক যেখানে ঢেউয়ের মাঝে একটি সুস্থির ঘোল চিহ্নিত করেছে শিলাপ্রবালের দেশ। এরপর কুলপতি পাতায় মোড়া পুতুলটিকে পিঠে বেঁধে নিয়ে ডুব দিল।

আর উঠে আসেনি।

জলের নীচে প্রবালগুহায় ছিল অসংখ্য গোলকধাঁধার ফাঁদ, স্বতঃপ্রভ মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের দেশ। সেখানেই ভোররাতের স্বপ্ন, শিশুর দেয়ালা আর না-পাওয়া পুরুষ কিংবা নারীর জন্য গলার কাছে চিনচিনে ব্যথাগুলো সব থরে থরে জমা হয়ে থাকে। বর্ষার রাতে নারকোল ছাউনির ভেতর আগুনের ধারে বসে সেই গোলকধাঁধার গল্প বোনে গোষ্ঠীপ্রবীণারা। হয়তো সেই কাহিনির বুননের ভেতর কোনো একটি বাঁকে রয়ে গিয়েছিল কুলপতি। আর ফিরে আসেনি।

নাহুমের গ্রাম ও অন্যান্য মিউজিয়াম
অবভাস



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন