শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১

আর্ট ফোর্জারির শ্রেষ্ঠ কাহিনি

 


বই পড়ার মতো ডিপ্রেসিং শখ আর হয় না। প্রতিবার এক একটা বই শেষ করার পর কোথায় আনন্দ করব, উল্টে অদ্ভুত এক হতাশা গ্রাস করে। একটা বই পড়া মানে অনেকগুলো বই না পড়া। বুকর্যাকে কত বই না পড়া আছে, কত বই কিনে ফেলে রেখেছি প্লে বুক আর কিন্ডলে। সেগুলোর বেশিরভাগই হয়তো এ জীবনে না পড়া থেকে যাবে। কত কত অভিনব বিষয় আর চমৎকার কাজ নেড়েচেড়ে দেখা হবে না। বুক লিস্টে 'আনরিড' হয়ে থাকবে কত নাম। একসঙ্গে ছ'টা বই পড়ছি, প্রতিটাই অনবদ্য। কিন্তু অমুক অমুক বই এখনও পড়া হল না বলে দীর্ঘশ্বাসও ফেলছি। মাঝেমধ্যেই ভাবি, এর উপর আর নতুন বই লিখে কী লাভ? এক একটা লেখা মানে সেই সাব্জেক্ট নিয়ে আরো পঁচিশ তিরিশটা বই পড়া, পড়তে হয়ই। লিখতে না হলে হয়তো সে সময়ে অন্য কিছু বই পড়ে নেওয়া যেত। এটা ঠিক 'ফোমো' নয়। জীবনের সময় যে কত কম, সেটা উপলব্ধি করা মাত্র। আর এ তো শুধু বইয়ের কথা। একই কথা সিনেমা, সিরিজ, ঘোরা, রান্না... সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই প্রয়োজ্য।

যাকগে। বহুদিন ধরে লিস্টে থাকা একটা বই শুরু করেছি, বেশ তরতর করে এগিয়ে চলেছে। অনেকে আগ্রহী হতে পারে, তাই জানিয়ে রাখলাম।

নন ফিকশন লেখা মানে যে চারটে বা দশটা বই ঘেঁটে লেখা নয়, সেটা এরকম বই পড়লে বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হান ভান মিগারেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার উপর অভিযোগ, সে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাজী দলের নেতা হারমান গোয়েরিংকে জোয়ানেস ভেরমিরের মাস্টারপিস একটা পেইন্টিং বিক্রি করেছে। বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের রাজনীতি তখন বদলে গেছে, নাজীদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিল, প্রত্যেককে জেলে পাঠানো হচ্ছে গ্রেপ্তার করে। মিগারেনের ভাগ্যেও জেলে যাওয়া লেখা ছিল। কিন্তু কেউই জানত না, এই মামলা আর চারটে মামলার মতো নয়।

কয়েকদিনের মধ্যে মিগারেন জেল থেকে বেরিয়ে আসে এবং অভাবনীয় এক কাহিনি জানায়। মিগারেন বলে, গোয়েরিংকে বিক্রি করা তার ছবিটা আসলে ভেরমিরের আঁকা নয়, সেটা তার নিজের আঁকা। আর্ট ফোর্জারির বিদ্যায় অনেক আগেই হাত পাকিয়েছিল সে, আর নাজীদের বোকা বানাতেই সে এই কাজ করেছিল। শুধু এই একবার নয়, নাজীদের সে বার বার বোকা বানিয়েছে নকল ছবি বিক্রি করে। তদন্ত করে দেখা যায় সে ঠিক কথাই বলছে। অনেকে তার কাজের কদর করেনি বলে মিগারেন মনস্থ করেছিল, সবাইকে দেখিয়ে দেবে সে কোন লেভেলের শিল্পী।

এই রহস্যোঘাটনের পর রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন হয়। নাজী বিরোধী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী তো বটেই, শিল্পী হিসেবেও তার নাম ছড়িয়ে যায়। হল্যান্ড তো বটেই, সারা ইউরোপে তাকে হিরো বানিয়ে স্বাগত জানানো হয়। মিগারেন হয়ে যায় আধুনিক ইতিহাসের কিংবদন্তি।

এ তো হল গল্প। এইবার আসি লেখকের কথায়।।জোনাথন লোপেজ ইতিহাস ও শিল্পের অধ্যাপক। মিগারেনের জীবন নিয়ে লিখতে বসে তিনি প্রায় অসাধ্যসাধন করেছেন। পাঁচটা দেশ ঘুরে তিনি মিগারেনের বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের লোকজনকে খুঁজে বার করেন। হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে তাঁর সন্দেহ জাগে। অনেক ঐতিহাসিক সাক্ষীর জবানবন্দি আর তার সংগ্রহ করা রেকর্ড পরস্পর বিরোধী। নথিপত্র আর সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ ব্লু প্রিন্ট তৈরি করতে গিয়ে তো লেখকের চক্ষু চড়কগাছ। ধীরে ধীরে যে সত্য উন্মোচিত হয়, তার সঙ্গে পরিচিত ইতিহাসের কোনও যোগাযোগ নেই।

এই বইয়ে জোনাথন লোপেজ জানিয়েছেন সেই তদন্তের কথা। কীভাবে মিগারেন একটা মিথ্যে কথাকে শ্বাশ্বত সত্য বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। আত্মমর্যাদা আর শিল্পসত্তা সব বাজে কথা, সে ছিল দুনিয়ার সব থেকে বড় আর্ট ফোর্জার। সারা পৃথিবী জুড়ে নকল পেইন্টিংয়ের ব্যবসা করেছে, বোকা বানিয়েছে বহু মানুষকে। আর্ট ফোর্জারির দুনিয়ায় সে প্রায় একটা কার্টেল বানিয়ে ফেলেছিল সে সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছিল নানান দেশে। তার চেয়েও বড় কথা, নাজীবিরোধী তো দূরের কথা, সে ছিল হিটলার আর নাজী আদর্শের সমর্থক। ফ্যাসিবাদী আচরণ আর বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সে পঞ্চাশ বছর ধরে সবাইকে বোকা বানিয়েছে। সবাই তাকে পুজো করে চলেছে। হোয়াট অ্যান আইরনি!

এই অসাধারণ গল্প নিয়েই এই বই-- দ্য ম্যান হু মেড ভেরমির। জোনাথন লোপেজের যেমন রিসার্চ, তেমন স্টোরিটেলিং। নন ফিকশন তো নয়, যেন রোমাঞ্চকর কোনো থ্রিলার। আর্ট নিয়ে আগ্রহ থাকলে এ জিনিস সোনার খনির শামিল। ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারেন।

(বিদেশি নামের উচ্চারণ ভুল হতেই পারে
😊
 কেউ কিছু মনে করবেন না। প্রবঞ্চক যারা পড়েছেন, তারা প্লিজ মিল খুঁজবেন না। দু'টো ভিন্ন বই ভাবাই ভালো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন