"ধুস। পাহাড়ে চলে যাব।"
পনেরো বছর ধরে এই বুলি নিয়ে জীবন কাটানো চলছে, চিরাচরিত ঘুরে বেড়ানো আর ট্রেকিংয়ের ব্যস্ততার বাইরে সত্যি কিছুদিন যে পাহাড়ে গিয়ে কাটাব, সেই স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে। পাহাড়ে এসে আমার আকুলিবিকুলি দেখে ঘড়ির কাঁটা তাই চিরদিন মুচকি হাসে।
মেঘ-কুয়াশা-রোদ্দুর-এর স্বাভাবিক লুকোচুরি দেখে আমাদের শহুরে চোখ অভ্যস্ত নয়, তাই দিনকয়েকের ছুটিতে এসে বড়ই বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি আমরা। এই সূর্যোদয়, এই সূর্যাস্ত, এই ট্রেল, ওই পয়েন্ট...হ্যানাত্যনা! ফলে 'পাহাড়ে চলে যাব' অ্যাটিটিউড হারিয়ে 'পাহাড়ে ঘুরতে এলাম'-টাই প্রধান হয় দাঁড়ায়। কুকুরগুলো বিকেল হলেই চেঁচিয়ে গালি দেয়, পাখিরা কাছে আসে না নিজের মতো, বনফুলের ঝোপ বা দেবদারুর বনের দৃষ্টি বহিরাগতদের প্রতি বড় কঠিন, বড় উদাসীন বলে মনে হয় তখন। আমরা তখন দু দিন তিন দিনে সবকিছু দেখে নিতে চাইছি, শুষে নিতে চাইছি পার্বত্য গ্রামের যাবতীয় অভিজ্ঞতা। আমাদের মতো 'নৌকরিপরস্ত' শখের পথিক আর খেয়ালি বেগানাদের সামনে সে রহস্য বয়ান করতে পাহাড়ের বয়েই গেছে।
কিন্তু এত বছর পর, হঠাৎ করে সত্যিই 'চলে যাব পাহাড়ে'-র বুলি বাস্তব হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চিরদিনের জন্যে পাহাড়ে চলে আসতে হয়তো আরো বহুদিন লাগবে, কিন্তু এই যাত্রায় ফেরতা টিকিট কাটা নেই আমাদের। প্ল্যান নেই, যাত্রাপথের ঠিক নেই, থাকার মেয়াদ কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস যা খুশি হতে পারে! নেই ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা, স্থানীয় রসনার খোঁজে মফস্বলি পাহাড়ি টাউনের ইন্তি ইন্তি চষে ফেলা বা বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে করতে চাওয়া খেজুরে আলাপের ইচ্ছেও নেই এইবার। শুধুই পাহাড়ের সান্নিধ্যে চুপচাপ কিছু সময় কাটিয়ে যাওয়া।
যে গ্রামে আপাতত হপ্তাখানেকের জন্যে আস্তানা, সেটা খুব প্রত্যন্ত জায়গা নয়। মাইল দুয়েক হাঁটলেই রাজ্যের বিদেশি রেস্তোরাঁ আর টুরিস্ট সার্কিটের ফাঁদ ওত পেতে আছে। দিল্লি থেকে অনেকেই আসে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার থেকেও যায় কয়েক মাস। আমাদের ঘরটা একেবারেই বেসিক, সস্তাও বটে। দু' ধারে বড় বড় জানলা, বাইরে চওড়া বালকনিতে চেয়ার পাতলে সারা দিন কেটে যাবে। গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে দেবদারু গাছের ঘন বন, ধৌলাধার রেঞ্জের উঁচু পাহাড়গুলোর পিছন থেকে উঁকি দেয় বরফাচ্ছাদিত পর্বতচূড়া।
ঢালু পাহাড়ের গায়ে প্রায় পাশাপাশি দুটো গ্রাম, অনেকেই এখান থেকে ইন্দ্রহার পাস যাওয়ার জন্যে ডেরা বাঁধে। জল আটকানো যাবে না বলে ধাপে ধাপে ফসল ফলিয়েছে গ্রামের লোক, এরা বলে 'সিড়িদার খেত'। আমাদের বালকনির সামনেই চারটে দেবদারু গাছ উচ্চতায় একে অপরের সঙ্গে রেষারেষি করে দাঁড়িয়ে আছে, গাছে গাছে দেবদারুর ফল স্পষ্ট দেখতে পাই।
এখন, এই মুহুর্তে সূর্য ডুবে গেছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় কুড়ি পঁচিশ ধরনের পাখি ডাকছে। প্রথমে মনে হয় শুধু দু' একটা, তারপর অনেকক্ষণ ধরে মন দিয়ে শুনলে ডাকগুলো আলাদা করে বোঝা যায়। 'কুই কুই কোঁয়াও' আর একটানা 'কুক কুক কুক কুক' এর মাঝে ঢুকে পড়ে 'কুসচুক কুই কুসচুক কুই'! মুখরা আর অন্তরার মাঝে সঞ্চারীর মতো কানে ভেসে আসে চেনা 'কুহু কুহু কুহুউউউ'। পাখির কলকাকলির সঙ্গে সাউন্ড মিক্সিং করতে এগিয়ে এসেছে গ্রামের পশু পাখি মানুষ। এখানকার কুকুরগুলো ভারী সভ্য ভদ্র, গলা মিলিয়ে কচি ভুক ভুক স্বরে ডাকে। আমাদের বাড়ির বিনোদ ভাইয়ার ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলের গল্প করছে ( স্কুল এখনও বন্ধ কিনা!), সামনের বাড়িতে সম্ভবত বাঁশের ঝুড়িতে দেওয়া লঙ্কা ঝাঁকাচ্ছে একটা বউ, এরই মধ্যে কোনও গেস্ট হাউস থেকে ভেসে আসছে জাসলীন রয়ালের নেশা ধরানো গলা...'খো গায়ে হাম কাঁহা, রঙ সারে ইঁহা..."
রঙের প্রাচুর্য আছে ঠিকই কিন্তু এক নজরে তা ধরা পড়ে না। দিন তিনেক থাকার পর আমি দূরে সিড়িদার খেতে দেখতে পাওয়া ধান আর ঘাসের সবুজের পার্থক্য বুঝেছি। পেশাইয়ের জন্যে রাখা গম রাখা থাকে খড়ের বস্তার কাছেই, পাশেই শুকোয় বাদাম। হলুদ আর বাদামির কত কত শেড! আর আকাশ! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সংলাপটার সত্যতা যে আমি কত বার কত ভাবে উপলব্ধি করেছি।
"আকাশ পুরোনো হয় না সন্তু। একজন মানুষ তার জীবনে দু দিন একরকমের আকাশ দেখেনি!"
বিনোদ ভাইয়ার দালানেই একটা মন্দির আছে, সেখানে শিবের পাশাপাশি রামসীতার ছবি, হনুমানও আছে। আবার ছাদে লাগানো আছে কংগ্রেসের পতাকা। অনেকের ছাদেই কংগ্রেসের বা বিজেপির পতাকা দেখেছি, এখানকার ওয়ার্ডে দু একদিনের মধ্যেই ভোট হবে। সেই নিয়ে জোরদার প্রচার চলছে।
এইবার আস্তে আস্তে অন্ধকার হবে। বিনোদ ভাইয়াকে বলে কয়ে ঘরেই খাওয়ার বন্দোবস্ত করে নিয়েছি। দূরের হোটেলগুলো বড্ড দামি, স্থানীয় মানুষরা রান্না করেই খায়। প্রথমে বড্ড সংকোচ করছিল, বাইরে থেকে এসে কেউই হাতে গড়া রুটি আর দাল/সবজি খেতে চায় না, কিন্তু আমরাও নাছোড়বান্দা। অবশেষে কাল কিন্তু কিন্তু করে রুটি ভাত আর ডাল দিয়েছে। গ্রামের দোকান থেকে দই আর শশা পেঁয়াজ নিয়ে এসেছিলাম, নুন লেবু দিয়ে তোহফা স্যালাদ হল। ভাগ্যক্রমে নেট ও চলছিল, সানডে সাসপেন্সে সৈকতদার গল্প শুনতে শুনতে দিব্যি খাওয়া হয়ে গেল। আজও খাবার দিয়ে যাবে বিনোদ ভাইয়া, আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখে সম্ভবত বুঝে গেছে আমরা বাড়িতেও আহামরি কিছু খাই না।
জোর হাওয়া দিচ্ছে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল, ধৌলাধারের রূপোলি চূড়ায় বরফ পড়েছিল রাতে। আজ আকাশ পরিস্কার, মনে হচ্ছে ঠান্ডা পড়বে। এত সবের মাঝে আমার মাথায় কোথা থেকে হুট করে অগ্নি ব্যান্ডের একটা গান চলে এসেছে। সেটাই গুনগুন করে চলেছি। গান কি আর নিয়ম মেনে মাথায় আসবে?
"খোয়া খোয়া সা ইয়ে মেরা জাঁহা
বিন তেরে ম্যায় জাঁউ কাঁহা
তুমপে ফিদা... শামে গজল
মেরে গীতো কি হার ধুন তুম মেহফিল মে
সাভি কো গানে দো,
সাজ হ্যায় তেরী আহ জো
তেরে বিনা...
দিন ইয়ে মেরে রাতে সুনী ইয়ে
কেহ লেনে দো!"
এই। এরকম করে কাটবে। সকাল থেকে সন্ধ্যে। বোঝাই করা বই এনেছি, পড়তে পড়তে দূরে তাকিয়ে থাকব। মাঝে মাঝে বাজারও করতে হবে। পাহাড়ি গেরস্থালি জীবন! খানিকটা উলোঝুলো, খানিকটা আওয়ারা-পাগল-দিওয়ানা...
এমনি করেই কেটে যাবে। যাক! যাক না!
এটা আগে পড়া তবু আবার পড়লেও একই রকম উচাটন হয়।
উত্তরমুছুন-প্রদীপ্ত