#বৃষ্টিযাপন
বাড়ি পালানোর অভিজ্ঞতা বড় একটা কারো থাকে না। আমার জীবনে সেই অভিজ্ঞতা দু' দুবার হয়েছে। একবারের মেয়াদ ছিল কুড়ি মিনিট, তখন আমার বয়স সাত। বাস ধরার আগের মুহুর্তে মামা এসে পাকড়াও না করলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যেতাম সত্যি সত্যি। এই বুকে হাত রেখে বলছি, সেই পুঁচকে বয়সেও এক মুহুর্তের জন্য ভয় করেনি, বরং পালিয়ে ঠিক কী করব সেই ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবসম্মত ভাবে মাথায় ছকে নিয়েছিলাম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। দ্বিতীয় দফার গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলাম ভেবেচিন্তে, মেয়াদও ছিল কয়েক মাসের...কিন্তু সে গল্প আপাতত থাক। মোদ্দা কথা হল সাত হোক অথবা সাতাশ, দেশভ্রমণের সুযোগ পেলে আমি দুনিয়ারাজ্যের কাজকে লাথি মেরে প্রায়োরিটিতে পিছনে করে দিই। চাকরিবাকরি চুলোয় যাক, জাহান্নমে যাক অন্যান্য ডেডলাইন। জীবনের কাছে একমাত্র কমিটমেন্ট, পথের ডাকে সাড়া না দিলে চলবে না। ওই যে আমাদের প্রিয় লাকি আলি বলে গিয়েছেন...
"অপনে হি দিল মে বাসায়ে হুয়ে কুছ ইরাদেঁ হ্যায়
দিল কে কিসি কোণে মে ভি কুছ অ্যায়সে হি ওয়াদেঁ হ্যায়
ইনকো লিয়ে, অব তল চলেঁ, হজারোঁ মে হম ভি মিলেঁ..."
ধান ভানতে শিবের গীত। যারা সত্যিই সময় নষ্ট করে পড়ছে তারা হয়তো ভাবছে, বৃষ্টি কই? খালি ভ্যানতারা করছে! আসলে কী জানেন, বৃষ্টির গল্প আসলে থাকে বৃষ্টির আগে আর পরেই। বৃষ্টি যখন সত্যিই নামে, তখন আর গল্প থাকে না। থাকে কবিতা। সুরও অবশ্য থাকে। ম্যাক্স রিক্টারের কম্পোজিশন অথবা প্রিয় কোনও রবীন্দ্রসংগীত, অথবা চিরকালের প্রিয় রিমঝিম গিরে সাওয়ান আর সাওয়ান কে ঝুলে পড়ে হ্যায়...বৃষ্টিযাপনের সেই মুহুর্তে সহসা হুট করে ঢুকে পড়া কিছু স্মৃতিও থাকে প্রতিবারেই, যাদের প্ররোচনায় আরো কিছু নতুন স্মৃতি ছাপা হতে থাকে অবচেতনের পাতায়।
দিল্লি যাওয়া হয়েছিল কাজেই। কাজ তো লবডঙ্কা, খালি ছোটাছুটি। কিন্তু পোড়া কপাল হলেও ব্যতিক্রম হয়, বেড়ালের ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে। অপ্রত্যাশিত ভাবে কাজ মিটে গেল তাড়াতাড়িই, আর হাতে এক্সট্রা দুয়েকদিন পেয়ে যথারীতি আমার মাথার পোকা নড়ে উঠল। তারপর সেই আদ্যিকালের অভ্যেস ফিরিয়ে আনা ইজ ইজি...হুড়মুড় করে টিকিট বুক, দুমদাম একাধিক ইটিয়ারনারি ঠিক করা, স্যাটাস্যাট ব্যাগ গোছানোও খতম (মানে দু' জোড়া টি শার্ট আর দুটো হাফপ্যান্ট, একটা হাওয়াই চটি), তারপর ট্রেনে চেপে যাত্রা শুরু। প্রায় গোটা একটা দিন কাটিয়ে ভুবনেশ্বরে পৌঁছানো আর বাস ধরে গঞ্জামের উদ্দেশে রওনা দেওয়া, এর মাঝে বলার মতো ঘটনা হল, ট্রেনে দু'টো বই অনেকটা টেনে দিয়েছি। এক নম্বর, পিটার হোপকার্কের Trespassers on the roof of the world, দু' নম্বর তোশিকাজু কাওয়াগুচির সপ্তাহদুয়েক ধরে ফেলে রাখা বই Before the Coffee Gets cold...ফেলে রাখা বই শেষ করার জন্য ট্রেন জার্নির চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।
রম্ভায় যখন পৌঁছলাম, বিকেল হতে খানিকক্ষণ বাকি। গঞ্জামে ঢোকার আগে থেকেই সবুজের আচ্ছাদন বাড়ছিল, গত এক ঘণ্টায় চোখ জুড়িয়ে গেছে। প্রকৃতি তো নয়, সবুজের ক্যানভাস। রাজপথেও বিশেষ গাড়িঘোড়া নেই, রাস্তা খালি পেয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটেছে বাস। দু' দিকে খেত, নদী নালা পুকুর, সবুজ রঙে সজ্জিত ছোটবড় টিলা। দিগন্তপ্রসারী ধানের খেতে কাজ করছে গ্রামের বউরা, তাদের হাতে কাটারি, হাতে বীজের থলে। গরু বা বলদও আছে, তবে খুবই কম। অন্যান্য রাজ্যে হাইওয়ের দু' ধারে গণ্ডায় গণ্ডায় বড় বড় হোটেল আর রেস্তোরাঁ চোখে পড়ে, নিদেনপক্ষে ঝাঁ চকচকে খান দশেক পাঞ্জাবি ঢাবা ( নামেই ঢাবা, দাম শুনলে মনে হয় বলি আমাকেই রোস্ট করে ঝুলিয়ে দে রে ভাই)! এখানে খাওয়ার দোকান বলতে দেখলাম গোনাগুন্তি চপ ফুলুড়ি, বা মফস্বলি ভাতের হোটেল। খালি গায়ে বসে আছে দোকানি, গ্রাহকও নেই। অনেক জায়গায় রাস্তা বানানো চলছে বলে বাসের গতি কিছুটা কমেছে, নাহলে আরো কিছুটা আগেই পৌঁছে যাওয়া যেত।
রম্ভা আসার উদ্দেশ্য চিলকা হ্রদ দর্শন বলাই যেত, কিন্তু ঠিক সেটাই উদ্দেশ্য নয়। বছর দুয়েক ধরে বৃষ্টির মরসুমে এমন কোনও নির্জন মফস্বলে যাওয়া পেন্ডিং হয়ে আছে, যেখানে নিরবিলিতে সবুজকে সঙ্গী করে দিন দুয়েক কাটিয়ে দেওয়া যাবে। সঙ্গে যদি নদী অথবা হ্রদ পাওয়া যায়, তাহলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু এমন জায়গা যদি বা পাওয়া যায়, সাধ্যে কোলায় না। তার উপর কোভিড তো আছেই। তাই প্রিয় দাদা কাম বন্ধুর কাছে রম্ভার খবর পেয়ে বিশেষ দেরি করিনি। করিনি, তার আরেক কারণ কেরল আর উড়িষ্যার উপর আমার কেন জানি একটা গোপন ভরসা আছে। বৃহত্তর রাজ্যের মধ্যে দেখতে গেলে উরিষ্যা সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যের মধ্যেই পড়বে, উন্নয়নের পরিসংখ্যানের দেখিয়ে বারফট্টাই করা এখানকার লোকজনদের ধাতে নেই। কয়েক দশক ধরে বহুজাতিক কোম্পানিরা এখানকার বনজঙ্গল দখল করার জন্য হেন কাজ নেই যা করেনি-- পরিবেশ আইন বদলে দেওয়া থেকে শুরু করে যৌথ সরকারি পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করা--কিন্তু এখানকার হতদরিদ্র মানুষরা কিছুতেই জমি ছাড়েনি। বিপিএলের নীচে বসবাস করেও আপস করেনি অন্যায়ের সঙ্গে, বরং দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য। আরণ্যক ও প্রান্তিক শ্রেণির বহু মানুষের এই বিপ্লব নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা হয় না। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে এই লড়াই চলছে আজও। মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সুবিধা পায় না, রাজ্যের ভাগ্যে উন্নয়নের তকমাও ওঠে না কিন্তু উরিষ্যার এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট চলতে থাকে। ২০১৯-২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বড় রাজ্যের মধ্যে একমাত্র উরিষ্যায় ফরেস্ট কভার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, ডেন্স ফরেস্ট আর ম্যানগ্রোভও বেড়েছে আগের চেয়ে।
গেস্ট হাউসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আর বিকেলের একান্ত প্রয়োজনীয় পথ্য (মানে চা আর কী! সঙ্গে পাহাড়গঞ্জ থেকে আনা নানখাটাই) খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওটিডিসির ঠিক পিছনেই চিলকা হ্রদের জেটি, শান বাঁধানো রাস্তার উপর বেশ সুদৃশ্য কিছু বসার জায়গাও আছে। স্বস্তির কথা হল, লোকজন প্রায় নেইই। স্থানীয় কিছু মানুষ আছে, কয়েকজন বাচ্চা নিজের মনে খেলছে, চুড়ি-পুতুল- ছোলাভাজা- আইস্ক্রিমের কিছু খুচরো স্টল ছাড়া দোকানপাটও নেই, ফলে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে ছেদ পড়েনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম হ্রদের ব্যাপ্তির দিকে। যতদূর চোখ যায় সব্জেটে নীল জল, তার উপর ভাসছে লতানো ঘাস আর জলজ উদ্ভিদ। তীরের কাছে জলে পাটের জাল দিয়ে গোল করে ঘেরা কয়েকটা জায়গা, মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। অনেকগুলো নৌকো নোঙর করা আছে, কিছু মোটরবোটও আছে। ১৯৯০ সালে চিলকায় টাটা আর উড়িষ্যা সরকারের বিশাল এক প্রোজেক্ট শুরু করেছিল চিংড়ি উৎপাদনের জন্য, 'চিলকা বচাও' মুভমেন্ট সফল না হলে হয়তো কমার্শিয়াল ফিশিং ইন্ডাস্ট্রি এসে সমস্ত এলাকা তছনছ করে দিত, যেমনটা দুনিয়ার বহু জায়গায় হয়ে চলেছে। এই মুহুর্তে মাছ ধরার জন্য পারমিট দেওয়া হয় নিয়মমাফিক, আশা করি এই নিয়মটুকু অন্তত মেনে চলা হবে।
ঘণ্টাখানেক বোটে করে গেলেই বেশ কিছু দ্বীপ আছে, শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের মোচ্ছব বসে যায়। এখন অফ সিজন, তাই অতিথিরা বেপাত্তা। আমাদের মতো কিছু বোকা মানুষ আছে অবশ্য, যারা হাঁ করে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীলাভ কালচে মেঘের প্রতিফলন হ্রদের জলে, তার মাঝে ভাসছে দু' একটা দাঁড় টানা নৌকো। যেন কোনও সিনেমার ফ্রেম! কুয়াশা ভেদ করে আসা পুরোনো স্মৃতি, অথবা ভুলে যাওয়া উপন্যাসের কোনও ঘটনা...পা ডুবিয়ে বসে আছি, জলের ছলাত ছলাত শব্দ শুনতে শুনতে ঘোর এসে গেছে! এমন সময় আকাশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত অব্দি বিদ্যুতের রেখা খেলে গেল। বুঝলাম, অবশেষে আসছে! সে আসছে! আহা, তোমায় বড় দেখার সাধ! এই মফস্বলি জলজীবন ধোয়াপাকলা করে দাও একবার, সাধ মিটিয়ে দেখে নিই! তর্জন গর্জন করেই ফিরে যেও না।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। কাঁচা রাস্তার উপর দাঁড় করানো ল্যাম্পপোস্টের আলো জলের উপর।পড়তে শুরু করেছে, সকলের সঙ্গে আমিও পা বাড়িয়েছি ফিরে যাওয়ার জন্য। ইচ্ছে আছে, বাজারের দিকে যাব। কিছুটা হাঁটতেই দেখি, বড় বড় ফোঁটায় জল পড়তে শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝোড়ো বাতাসের রথে চড়ে তিনি হাজির হলেন। গুড়ুম গাড়ুম বিদ্যুৎ, ঝাপুস ঝুপুস বৃষ্টি। একটা দোকানের সামনে শেডের তলায় এক গ্রাম মানুষ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, গুঁজিমুজি করে সেখানেই ঢুকে পড়লাম। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখি বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঠিক কুয়াশার মতো লাগছে, একটা জলজ ধোঁয়া যেন ঝড়ের ঝাপটায় ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছে। শেডের উপরের টিনের চাল থেকে জল পড়তে শুরু করেছে, বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে গায়ে। আমার পিছনে দু'জন মেয়ে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখে একে অপরের সঙ্গে কী যেন কথা বলছে! তাদের মুখে হাসি। অন্যরা অবশ্য অত চুপচাপ নয়, দেশিয় ভাষায় কথা চালাচালি হচ্ছে দিব্যি। একটা বুড়ি মাথার উপর বস্তা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল, বস্তার উপর ধরে আছে একটা ছাতা। সম্ভবত দোকানের খুচরো মালপত্তর, নিজে ভিজলেও বস্তা ভিজতে দেওয়া যাবে না। দোকানের ঠিক সামনে, ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোর দিকে মুখ করে কয়েকটা সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে, তারা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে মহানন্দে। আমার অবধারিত ভাবে মনে পড়ছে একের পর এক গান, ভিড় করে আসছে একগাদা স্মৃতি। বৃষ্টির জলে মাথায় করে সেই কবে গঙ্গায় সাঁতার দিচ্ছিলাম, কোন বর্ষণমুখর দিনে লোডশেডিংয়ের মধ্যে গানের আসর জমিয়েছিল চারটে ছেলে, উডুপীতে বৃষ্টি দেখতে দেখতে সেবার তোহফা খাওয়াদাওয়া হয়েছিল রাস্তার ধারের এক দোকানে, দু'জন ছেলেমেয়ে ক'বে যেন ঝোঁকের মাথায় শিবসমুদ্রম ফলসে গিয়ে বেদম ভিজে গিয়েছিল বৃষ্টিতে, এক্সট্রা জামাকাপড়ও নিয়ে যায়নি তারা...
বাকিটা ওই যে বললাম, গল্প নয়, তাই লেখাও সম্ভব নয়। বলতে পারেন কবিতা। একান্তই ব্যক্তিগত। অথবা গানের কলি। অনুভূতি আর স্মৃতির হাতবদল করা কিছু মুহুর্ত। কিন্তু গল্প...নয়!
পুনশ্চ-- ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে গরম গরম পকোড়া আর চা খেয়েছিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন