গ্রামের নাম পুলনা। চিরতরে হারিয়ে গেছে এই গ্রাম। না, নামটা আছে, গ্রামটাও আছে। কিন্তু বদলে গেছে আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা এক চিলতে গ্রামের সেই পরিচিত দৃশ্য, যেখানে সূর্যের আলো মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ভাঙাত। চা-ওয়ালা রমনকিশোর ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর ট্রেকারদের চা দিতে ভুলে গিয়ে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকত আচমকা জেগে ওঠা রামধনুর দিকে। হেমকুণ্ড সাহিবগামী তীর্থযাত্রীরা চলে যেত এই গ্রামের পাশ দিয়েই কিন্তু ফিরেও চাইত না গ্রামের মোড়ল রামধনীর দিকে। গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান যদি নিয়ম করে নদীর ধারে গিয়ে রঙিন পাথর কুড়োয় তাহলে কে আর পাত্তা দেয়?
শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১
পুলনা- হারিয়ে যাওয়া গ্রাম
গ্রামের নাম পুলনা। চিরতরে হারিয়ে গেছে এই গ্রাম। না, নামটা আছে, গ্রামটাও আছে। কিন্তু বদলে গেছে আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা এক চিলতে গ্রামের সেই পরিচিত দৃশ্য, যেখানে সূর্যের আলো মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ভাঙাত। চা-ওয়ালা রমনকিশোর ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর ট্রেকারদের চা দিতে ভুলে গিয়ে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকত আচমকা জেগে ওঠা রামধনুর দিকে। হেমকুণ্ড সাহিবগামী তীর্থযাত্রীরা চলে যেত এই গ্রামের পাশ দিয়েই কিন্তু ফিরেও চাইত না গ্রামের মোড়ল রামধনীর দিকে। গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান যদি নিয়ম করে নদীর ধারে গিয়ে রঙিন পাথর কুড়োয় তাহলে কে আর পাত্তা দেয়?
ভেনিস ও বৃষ্টির এক বিকেল
ভেনিসে |
সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল ভেনিসে। কালো হয়ে এসেছিল আকাশ, বাতাস বইছিল শন শন। গ্রেট ক্যানালে 'অ্যাকোয়া অল্টা'-র সাইরেন অগ্রাহ্য করে সমুদ্রের ফেনায়িত জলে আকাশ ছোঁয়া ঢেউ খেলছিল, ধুয়ে যাচ্ছিল সান মার্কো চত্বরের পরিপাটি মেজাজ, নিরাবরণ হয়ে উঠছিল অন্য এক জলশহর। আমরা ছাতা মাথায় সেই শহরে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
নাহুমের গ্রাম
একটা বই কী করে লেখা হয়?
একটা পেইন্টিং, একটা কম্পোজিশন, একটা চলচ্চিত্র, একটা ভাস্কর্যের আড়ালে গোটা একটা জীবন থাকতে পারে। একটা জাতির ইতিহাস কোনও জায়গায় গিয়ে মিশে যায় ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে, স্মৃতির সাবকনশিয়াসে সংরক্ষিত শব্দ, গন্ধ, রঙ ও সুর লিখিয়ে নেয় এক একটা বই, রচিত করে সুরমালা, বাধ্য করে শিল্পীকে শিল্পের সামনে আত্মসমর্পণ করতে। শিল্পের আঙ্গিক, উৎপত্তি, বিবর্তনের সমান্তরালে শিল্পীর চেতনা ও অবচেতন নিয়ে আলোচনা ও লেখালিখি কম হয়নি, কিন্তু নন ফিকশনে গূঢ় মনস্ত্বাত্তিক তদন্ত করতে গিয়ে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে খুব বেশি বই পারে না। নাহুমের গ্রামে লেখকের ভাষার মায়া ও চিন্তার গভীরতা চুপ করিয়ে রাখে পাঠককে, ভাবতে বাধ্য করে। এই বইয়ের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু বলা যায় না, কারণ পাঠের এই অনুভব প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নিজস্ব। শিল্পের সার্থকতা ও আবহমান প্রাসঙ্গিকতার এই দীর্ঘ অণুবীক্ষণে বার্গমান, তারকোভস্কি যেমন আছেন সেরকম সমরেশ বসু ও মার্কেসও আছেন। সমসাময়িক শিল্পের কথা যেমন আছে, হারিয়ে যাওয়া শহর ও ইতিহাসের মহামারীর অন্তরালে বদলে যাওয়া মনোজগতের কথাও আছ। আর কিছু না বলে বরং বইয়ের খানিকটা অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম। যদি পড়ে ভালো লাগে, অনুরোধ করব বইটা পড়তে। একাধিক বার পড়তে। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে অনেককেই এই বইটা ফিরে ফিরে পড়তে হবে সারাজীবন।
#পুস্তকাংশ
ক্ফারনাউম : গ্রিক শব্দ, হিব্রু ভাষায় উৎপত্তি। আদতে দুটি শব্দ, কেফার ও নাহুম, অর্থাৎ নাহুমের গ্রাম।গ্যালিলি সাগরের উত্তর উপকূলে এক সুপ্রাচীন মাছ-ধরাদের গ্রাম। কোনো এককালে জনসংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু হয়ে এগার শতক পর্যন্ত একটানা মানুষের বসবাস ছিল এখানে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খনন করে উদ্ধার করেছেন দুটি সুপ্রাচীন সিনাগগের ধ্বংসাবশেষ, একটির ঠিক ওপরে আরেকটি। ক্রুসেডের আগে গ্রামটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বিরাট ভুমিকম্প হয়েছিল। ক্ফারনাউম, নাহুমের গ্রাম। শব্দবন্ধটি কীভাবে যে হয়ে উঠল এলোমেলো জড়ো হওয়া অবিন্যস্ত অবান্তর জিনিসের স্তূপ, সেসব ভাষাতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়।
সিলিকন আর ইন্ডিয়া রাবার দিয়ে ওকে বানানো হয়েছিল চীনের গুয়াংঝাউ শহরে। এরপর হংকং ঘুরে চলে যায় লিসবনের বাজারে। চীনে তৈরি হলেও চেহারাটা কিন্তু মঙ্গোলয়েড ধাঁচের নয়, বরং অনেকটা যেন ভূমধ্যসাগরীয়দের মতো। ঘন কালো চুল, সবুজ আঙুরের মতো চোখ, পুষ্ট স্তন, চওড়া জঘন ও শ্রোণি; পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি পুতুল। খুব জীবনানুগভাবেই বানানো, এমনকি মুখের গড়নেও নিখুঁত ফুটে আছে লাস্য আর বিষাদ। পোল্যান্ডের দুই নাবিক ভাগাভাগি করে কিনেছিল ওকে। ওরা ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধু, বিভিন্ন বন্দরে একই বেশ্যালয়ে যেত। কখনো কখনো এমনকি একই নারীর কাছে। মাসের পর মাস দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় পুতুলটি হাতবদল হয়ে চলত ক্যাবিন থেকে ক্যাবিনে। ওর একটি নামও দেওয়া হয়, হেলেন। ডান পায়ের গোড়ালির নীচে মার্কার পেন দিয়ে লেখা থেকে জানা যায়। এই নামটি কেন দিয়েছিল, সেটা অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো ওদের চেনা কোনো নারীর নাম, যে ওদের একজনকে, এমনকি হয়তো দুজনকেই, প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেমিকার নাম কখনোই নয়। ‘হেলেন’ নামের নীচে পোলিশ ভাষায় লেখা ছিল দুটি শব্দ -- বেদনার কুয়ো।
বছর দুয়েক পরে ওদের মালবাহী জাহাজটি কিনে নেয় ক্যারিবিয়ানের এক শিপিং কোম্পানি। কর্মী বদল হয়, কিন্তু পুতুলটি কোনোভাবে থেকে যায়। হয়তো ফেলে রেখে গিয়েছিল দুই যুবক। ওরা নাবিকবৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশায় ফেরে। একজন ওয়ারশ-য় রুটির দোকান দেয়, অপরজন গ্রামে খামারবাড়িতে ফিরে গিয়ে চাষবাস শুরু করে, বিয়ে করে সংসার পাতে। হেলেনের শুরু হয় আরেকরকম জীবন।
জাহাজে নতুন কোম্পানির নাবিকদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ল্যাটিনো ও মেস্টিজো। এছাড়া রসুইখানার কাজে চট্টগ্রামের তিন বাঙালিও ছিল। ওদেরই মধ্যে একজনের প্রথম চোখে পড়ে হেলেনকে। অবশ্য ওর নাম বদলে দেওয়া হয়েছিল কী না সেটা আর জানা যায়নি। ওর দেহে আর কিছু লেখা হয়নি কখনো। তবে এই সময়ে সে বিভিন্ন হাতে ঘুরতে থাকে। জাহাজটি একবার উত্তর মেরু অঞ্চলে হিমজমাট সমুদ্রে আটকা পড়েছিল আড়াই মাস (নরওয়ে থেকে হাঙরের তেল আর পাম্পের যন্ত্রাংশ বহন করছিল)। অত্যধিক ব্যবহারে হেলেনের দেহে রাবারের অংশগুলি ক্লান্ত আর শিথিল হয়ে পড়তে থাকে এইসময়, মাথায় ও দেহের অন্যত্র কেশও ঝরতে থাকে। যদিও সিলিকন অটুটই ছিল। এবং এক কুয়াশাঢাকা ভোরে অস্বচ্ছ তেলের মতো প্রশান্ত মহাসাগর পার হবার সময় -- জাহাজটি পানামা থেকে লাওস যাচ্ছিল -- তাকে পোর্টহোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এক বাঙালি রন্ধনকর্মী। মাসাধিককাল এলোমেলো ভেসে বেড়ানোর পর হেলেন আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্যস্রোত পেয়ে যায়, এবং গোলার্ধ পরিক্রমা করে বিষুবরেখা পেরিয়ে চলে আসে বঙ্গোপসাগরে। এক পূর্ণিমার জোয়ারে আন্দামানের একটি অগম্য দ্বীপে এসে ওঠে।
দ্বীপে বাস করত অস্ট্রিক জনজাতির একদল মানুষ। ওরা সভ্যতার কোন ভোরে মূল ভূখন্ড থেকে এসেছিল ভেলায় চেপে। মাছ ধরে, ফলমূল কুড়িয়ে, ছোটোখাটো প্রাণী শিকার করে জীবন নির্বাহ করত। চাষবাস তেমন জানত না। নারকোলপাতা দিয়ে তাদের ঘর বানিয়ে নিত আর পশুর চামড়া ও গাছের বাকল পরত কটিদেশে। এছাড়া উল্কি আঁকার এবং নাক ও কান ছেদন করার প্রথা ছিল। বিশ-পঁচিশ জনের ছোটো ছোটো দলে ওরা থাকত প্রায় আশি বর্গমাইল সিমের বিচির আকারের দ্বীপটায়। একশো কুড়ি থেকে দেড়শোর মধ্যে ওঠানামা করত ওদের জনসংখ্যা। জন্মহার কম এবং শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় এই ভারসাম্যটা বজায় থাকত। সমুদ্রে খাঁড়িতে অঢেল মাছ, অঢেল নারকোল গাছ, বনে ভোজ্য পাতা ও কন্দ অঢেল থাকায়, এবং চাষের প্রয়োজনে জমির ব্যবহার না থাকার কারণে, বিবাদ বিসম্বাদ প্রায় ঘটতই না। সেভাবে কোনো সংগঠিত ধর্মও ছিল না ওদের। কিছু কিছু আদিম ভীতি এবং লোকবিশ্বাস ছিল। যেমন, ওরা মনে করত পিতৃপুরুষেরা মৃত্যুর পর উইপোকা হয়ে যায়। সেজন্য পিঁপড়ের ডিম ও কিছু কিছু পোকার লার্ভা ওদের খাদ্যতালিকায় থাকলেও উইপোকাদের রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মাটি আর নারকোল পাতা দিয়ে বানানো ওদের শঙ্কুর আকারের ঘরগুলোয় ছেয়ে থাকত উইয়ের বাসা। এভাবেই পূর্বপুরুষদের নিবিড় সান্নিধ্যে সহাবস্থান করত ওরা।
এবং এভাবেই রয়ে গিয়েছিল শত শত বছর। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র আন্দামানের আদিবাসী নাগরিকদের জন্য কিছু কিছু জনহিতকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে কমবেশি সাড়াও দিয়েছে কয়েকটি জনজাতি। কোনো কোনো গোষ্ঠী এমনকি পোর্ট ব্লেয়ার ও অন্যান্য শহরে মূলস্রোতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে কেউ কেউ। এই দ্বীপের জনগোষ্ঠীকে অবশ্য বশে আনা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হয়, কিন্তু সাড়া মেলেনি। চিনি, সুতির কাপড়, পলিথিনের শিট ইত্যাদি উপঢৌকন হিসেবে রেখে আসা হয়, কিন্তু সেসব পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় ওরা। এরই মধ্যে একবার এক বেপরোয়া মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ গোপনে একটি নৌকা নিয়ে দ্বীপে চলে আসেন গবেষণার উদ্দেশ্যে। তিনি আর ফিরতে পারেননি। খবরটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে এবং এব্যাপারে কূটনৈতিক স্তরে চাপ তৈরি হলে ভারতের উপকূল রক্ষীবাহিনির বিশাল একটি দল প্রায় দশদিন পরে দ্বীপে গিয়ে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। দেহটি বেলাভূমিতে নারকোল গাছের গায়ে বাঁধা ছিল। কড়া রোদে এবং নোনা হাওয়ায় শুকিয়ে গিয়েছিল, এবং সম্ভবত এক বিশেষ ধরণের গুল্মের রস মাখানো থাকার জন্য পশুপাখিতে কোনো ক্ষতি করেনি। প্রায় অবিকৃতই ছিল।
রবার ও সিলিকনে তৈরি চীনা পুতুল, একদা যার নাম ছিল হেলেন, যখন অর্ধেক পৃথিবী ভেসে দ্বীপের খাঁড়িতে গিয়ে ঢুকল, ওরা তাকে তুলে নিয়ে এসেছিল। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জাহাজডুবির সামগ্রী ও অন্যান্য আবর্জনা ভেসে এসেছে দ্বীপে। ওরা কখনো সেগুলো অনুসন্ধিৎসার বশে কুড়িয়ে নিয়েছে, কখনো নেয়নি। ছেঁড়া জাল, প্লাস্টিকের বোতল ও জেরিক্যান ছাড়া আর প্রায় কোনো কিছুই ওরা কাজে লাগায়নি। কিন্তু এবার এক দুর্জ্ঞেয় কারণে হেলেনকে নিয়ে এসে ওরা তুলল বসতিতে। শুধু তাই নয়, নারকোলপাতা মাটি আর কাঠ দিয়ে ওর জন্য একটি ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিলে কৌম উঠোনের এক কোণে। দিনের পর দিন সাগরের নোনা জলে ভেসে ভেসে হেলেনের সব চুল খসে গিয়েছিল, দেহের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত স্তন এবং যোনিদেশে, ইন্ডিয়া রাবারের অংশগুলো কোনও বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিকট স্ফীত ও বিকৃত হয়ে এসেছিল, এছাড়া জলপাই তেলের মতো চামড়ার রঙ সম্পূর্ণ উঠে বেরিয়ে পড়েছিল সিলিকনের দগদগে সবুজ। ওরা লতাপাতার রস দিয়ে ওদের বিশিষ্ট উল্কি আঁকল, নাক ও কান বিঁধিয়ে দিল, সাজিয়ে দিল মাছের কাঁটার গয়নায়।
এভাবেই শুরু হল। যেভাবে শুরু হয়।
পর পর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেসব অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো যাবেও না কোনোদিন, কারণ এই জনজাতির কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে হেলেনকে কেন্দ্র করে কোনো বিবাদ, হিংসা কিংবা হানাহানির সূত্রপাত ঘটেছিল বলে কোনো প্রমাণ নেই। কিংবা, সাধারণত যেমন ঘটে থাকে, নতুন কোনো ক্ষমতার বিন্যাস গড়ে ওঠেনি। পরিবেশের ওপরেও কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে পুতুলটি উদ্ধার হবার পর ওদের মধ্যে, বিশেষ করে পুরুষ এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, এক অদ্ভুত ধরণের বিষণ্ণতার অসুখ দেখা দেয়। সবচেয়ে উদ্যমী আর কর্মঠরাও যেন জীবনীশক্তি হারায়। খাঁড়িতে মাছ ধরা, জঙ্গলে ঢুকে ফল কন্দ সংগ্রহের কাজে উৎসাহ হারায়। বনে এক ধরণের মাদক ছত্রাক খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। এমনকি নারকোলপাতা জড়ো করে কুঁড়ের চাল ছাইবার উদ্যমও হারায়। একটি গোটা ঋতুতে দ্বীপে কোনো নতুন শিশুর জন্ম হয় না। এবং আরও কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মরা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে এসে উপকূল ছেয়ে যায়, সমুদ্রে ভাসে কালো তেল, নারকোল গাছে অদৃশ্য কীটাণুর প্রকোপে অপুষ্ট ফলগুলো শুকিয়ে ঝরে যেতে থাকে। এই দ্বীপের ত্রিসীমানায় কোনো পণ্যবাহী জাহাজের পথ নেই, কিন্তু রাত্রিবেলা দিকচক্রবালে বিচিত্র আলোর আনাগোনা দেখা যায়। এইসব লক্ষণ গণনা করার পর গোষ্ঠী প্রবীণেরা বলেন, জ্বরে কাঁপছে মেদিনী। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রথমে টের পায় উইপোকারা। উপকূলের লাগোয়া ভিটে ছেড়ে তারা সারি দিয়ে উঠে যেতে থাকে উঁচু জমিতে। তারপর একদিন, কার্ত্তিক পূর্ণিমার তিনদিন পর, দুপুরের পর থেকে সমুদ্র সরতে শুরু হয়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য : মনে হয় যেন মেদিনীর সরা থেকে সব জল এক চুমুকে পান করছে এক দৈত্য। বিস্তীর্ণ তটভূমি উন্মোচিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে আগ্নেয় শিলার ভাস্কর্য, চাটান, গুহা, ধাপকাটা সিঁড়ি, পাথর কুঁদে তোলা দৈত্যাকার পাখি ও বিচিত্র সব প্রাণীর রিলিফ।
দ্বীপবাসীরা অবশ্য সেসব খুঁটিয়ে দেখার জন্য বেলাভূমিতে অপেক্ষা করেনি। তারা উইপোকাদের পথ ধরেছিল। এবং যথারীতি সূর্যটা ডুবে যাবার আগেই ধেয়ে এল বিপুল জলরাশি, নারকোল বীথির মাথায় মাথায়, ওদের বসতিগুলি ভাসিয়ে নিল।
শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল তিন প্রজন্ম আগে। সেবারও তটভূমি উন্মোচিত হয়ে দেখা দিয়েছিল এই আশ্চর্য পাথরের দেশ, বহুবর্ণ প্রবালে ছাওয়া। আগুনের ধারে বসে সেই স্মৃতিকথা শুনে বড়ো হয়েছে এরা। তারও অনেক কাল আগে ওই আগ্নেয় শিলার দেশে, ওইসব গুহা আর চাটানে বাস করত ওদের পূর্বপুরুষ। সেই কাহিনি এতবার বলা ও শোনার ভেতর দিয়ে কল্পনায় এমন সুস্পষ্ট খোদাই হয়েছিল যে মেদিনীর জ্বর সেরে যাবার পর সমুদ্র যখন ফিরে গেল নীচু এলাকা থেকে, জলের নীচে ঠিক কোথায় ওই শিলাপ্রবালের দেশ রয়েছে সেটা নিখুঁত নিরূপণ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওই ডুবে-যাওয়া অঞ্চলটা উপকূল থেকে বাইশ দমের পথ, আট দম গভীর।
এমনিতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে দ্বীপের সকলেই হাঁটতে শুরু করার পরেপরেই সমুদ্রে সাঁতার দিতে শিখে যেত। তিন, চার এমনকি পাঁচ দম গভীরে সাঁতার দিতে পারার ক্ষমতা অনেকেরই ছিল। সাত, আট কিংবা তার বেশি দম নীচে যেতে পারত যারা, তাদের মধ্যে থেকেই কুলপতি নির্বাচন হতো। স্বাভাবিকভাবেই কুলপতির ওপরে ভার পড়ল হেলেনকে জলের নীচে শিলাপ্রবালের দেশে রেখে আসার। তার আগে ওর নাক ও কান থেকে খুলে নেওয়া হলো মাকড়ি, গা থেকে খোলা হলো মাছের কাঁটার অলংকার। এরপর সবজে সিলিকনের গা থেকে ঘসে ঘসে সব উল্কি তুলে ফেলল ওরা। দেহের প্রতিটি ছিদ্রপথে ভরে দিল ডুমুরের বীজ। তারপর সারাদেহ ছাই আর পাতায় মুড়ে ভেলায় চাপিয়ে নিয়ে গেল বাইশ দম, ঠিক যেখানে ঢেউয়ের মাঝে একটি সুস্থির ঘোল চিহ্নিত করেছে শিলাপ্রবালের দেশ। এরপর কুলপতি পাতায় মোড়া পুতুলটিকে পিঠে বেঁধে নিয়ে ডুব দিল।
আর উঠে আসেনি।
জলের নীচে প্রবালগুহায় ছিল অসংখ্য গোলকধাঁধার ফাঁদ, স্বতঃপ্রভ মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের দেশ। সেখানেই ভোররাতের স্বপ্ন, শিশুর দেয়ালা আর না-পাওয়া পুরুষ কিংবা নারীর জন্য গলার কাছে চিনচিনে ব্যথাগুলো সব থরে থরে জমা হয়ে থাকে। বর্ষার রাতে নারকোল ছাউনির ভেতর আগুনের ধারে বসে সেই গোলকধাঁধার গল্প বোনে গোষ্ঠীপ্রবীণারা। হয়তো সেই কাহিনির বুননের ভেতর কোনো একটি বাঁকে রয়ে গিয়েছিল কুলপতি। আর ফিরে আসেনি।
নাহুমের গ্রাম ও অন্যান্য মিউজিয়াম
অবভাস
লোকি ও বুড়োবাবার গল্প
আমার মতো যারা মার্ভেলের নতুন সিরিজ 'লোকি' দেখে মুগ্ধ, তাঁরা অনেকে জানেন না ১৯৫২ সালে স্ট্যান লি লোকিকে এনেছিলেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সেই লোকি তখন ভিলেন হয়েও ভুলভাল বকত, মাথায় ছিটও ছিল কম নয়। মাঝেমধ্যেই দরকারি কথা ভুলে যেত। মিস্ট্রি ৮৫ কমিক্স-এ তো লোকির সংলাপ শুনে বিষম লাগে। থর-এর শক্তির কথাও ব্যাটাচ্ছেলে বেমালুম ভুলে গেছে। বলছে, ""Oh...I forgot - the hammer's greatest power - whenever Thor throws it, it returns to him!"
গাছের বই
রিচার্ড পাওয়ার্স মার্কিন সাহিত্য জগতে পরিচিত নাম। তাঁর একাধিক বই ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর খ্যাতিও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি আগে তাঁর কোনও লেখাই পড়িনি। কত বইই তো পড়া হয় না। কী আর করা যাবে!
কোরিয়ার সাহিত্য- জনপ্রিয় একটি বই
কোরিয়ার সাহিত্যিকদের মধ্য চো নাম জু আজকাল তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর লেখা প্রথম দুটো বই বেশ সাড়া ফেলেছে, আর তিন নম্বর বই 'কিম জিয়োয়ুং বর্ন ১৯৮২' তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে মুড়িমুড়কির মতো বিকোচ্ছে। জনপ্রিয়তা এলে সঙ্গে বিতর্কও আসবে, এই বইটা নিয়েও দুনিয়ারাজ্যের ক্রিটিকরা দু' ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। অনেকের মতে 'কিম জিয়োয়ুং বর্ন ১৯৮২' মডার্ন ফেমিনিন লিটারেচারের মাইলস্টোন, আবার অনেকে এটাকে উপন্যাস বলে মানতেও নারাজ। কোরিয়ার থ্রিলার নিয়ে আমরা যতই নাচানাচি করি না কেন, সেখানে আবার সামাজিক অসঙ্গতি আর স্যাটায়ার নিয়ে লেখাই জনপ্রিয় হয় বেশি। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে যে এই বইটা নিয়ে যে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মহৎ সাহিত্য হোক বা না হোক, লেখাটা আক্ষরিক অর্থেই কোরিয়ার আর্থ সামাজিক মহলে বদলের সূচনা করেছে। জেন্ডার ইকোয়ালিটির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় আইনও তৈরি হয়েছে এই বইটা প্রকাশ হওয়ার পর, কিন্তু সে কথা থাক। মোট কথা, বইটা ঠিক কেমন?
পাহাড়যাপন ৬
আতরের দোকান করে যারা, তাদের কাছে দোকানের বাইরের পৃথিবীটা বাসি বলেই মনে হয়। পুষ্পের সৌরভ পেলেও যেন মনে হয় জোলো, ভালো মিষ্টির সুবাসও মনে ধরে না। সব কিছুই বড় অপরিশোধিত। আতরের দোকানটা যেন আরেক জগত, গন্ধের হাট বসেছে সেখানে। কোনওটা পারস্যের ফুলের আতর, কোনটা হিমালয়ের আয়ুর্বেদিক শিকড়ের গন্ধ। প্রতিটি ফুল নিজের ইতিহাস জানায়, বলতে চায় নিজের গল্প।কয়েকজন কারিগর বছরের পর বছরের ধরে এক্সপেরিমেন্ট করে যায় নতুন সুগন্ধের আশায়। দক্ষ হাতে গন্ধ তৈরি করে ওস্তাদ তারা। কিন্তু যে গন্ধ শেষমেশ তৈরি করা যায় না, সেই আতরের কারিগররা হীনমন্যতায় ভোগে। ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। মাথার চুল খামচে ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু...পারে না।
পুরনো দেরাজের ভিতরেও একরকম গন্ধ থাকে। গন্ধটা খুব পরিচিত হলেও কিন্তু ঠাহর করা যায় না। কখনও বা মনে হয় গন্ধটা প্রাচীন আসবাবের, আবার কখনও মনে হয় নতুন বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ।বেশ কয়েক বছর পর যখন দেরাজ খোলে, গন্ধটা ছড়িয়ে থাকে বইয়ে, ছোটবেলার ডায়রিতে, জমানো স্টিকারের কৌটোয়, রঙিন পেনসিলে। একটুক্ষণ বসে থাকলে আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রতিযোগিরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে চেনানোর জন্য। লক্ষীপুজোর গন্ধ, সন্ধ্যেবেলায় হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার গন্ধ, মাদুরে বসে খেতে বসার সময় হারিকেনের সলতের গন্ধ, মরাঘাসের ওপর ভিজে ফুলের অপেক্ষার গন্ধ, আরো কত...
রঙের ও নিজস্ব এক একটা গন্ধ থাকে, যেমন থাকে ইতিহাসের। স্মৃতির গন্ধ অবশ্য লুকিয়ে থাকে নুড়ি নুড়ি গল্পের পিছনে,আড়াল দিয়ে হাসে। কিন্তু বর্তমানের কোনো গন্ধ থাকে না, কারণ বর্তমানের কোনো গল্প থাকে না। গল্প বুনে ওঠে অতীতের তারে। তাই গল্পের গন্ধ তৈরি করা যায় না।
উপরের লাইনগুলো বেশ কয়েক বছর আগে অফিসের টিম মিটিংয়ে বসে লিখেছিলাম। টিম লীড ভ্যাজর ভ্যাজর করে যাচ্ছিল, আমি গম্ভীর মুখে ল্যাপটপে ডেটা দেখার ভান করে নোটপ্যাডে টাইপ করছিলাম। বছরদুয়েক পর ট্রেনে করে ব্যাঙ্গালোরে ফিরছি, আকস্মিকভাবে আলাপ হয়ে গেল সামনের সিটে থাকা এক মাঝবয়সী দম্পতির সঙ্গে। কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোক পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক ও কবি, নাম উজ্জ্বল সিংহ। নিজেও 'ঘোড়সওয়ার' বলে একটা পত্রিকা বের করেন। আমি তখন উজ্জ্বলদাকে চিনতাম না, কবিতা টবিতা নিয়েও আমার ধারণা নেই। দু' একবার ন্যাকাবোকা অন্তমিল দিয়ে কয়েক লাইন লিখতে গিয়েছি, তারপর বকুনি শুনে আর ও পথ মাড়াইনি। ছন্দ বোঝা নাকি আমার কম্ম নয়! যাই হোক, আমিও টুকিটাকি লেখার চেষ্টা করি সেটা যেন কোত্থেকে জেনে ফেললেন, বললেন শুনি কী লিখেছো? এসি কামরা না হলে নির্ঘাত জানলা থেকে ঝাঁপ-টাপ দিতাম। কুকুলকানের সন্ধানে তো আর শোনানো যায় না, বাধ্য হয়েই এই কয়েকটা লাইন পড়লাম। উজ্জ্বলদা এক মুহুর্তও না ভেবে বললেন, "এ তো কবিতা। পাঠিয়ে দিও। আমি ঘোড়সওয়ারে ছাপব।" কথার কথা নয়, লেখাটা সত্যি উনি বইমেলা সংখ্যায় ছেপে দিলেন। ভাবতেও লজ্জা করে।
আজ এত বছর পর এই লেখাটার কথা মনে পড়ে গেল একটাই কারণে। আমারও নিজেকে আজ সেই আতরের দোকানদারির মতোই মনে হচ্ছে। সে মনেপ্রাণে চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনের একটা ছবি গড়ে তোলার-- সে ছবিতে শুধুই পাহাড়, মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর, সবুজের আচ্ছাদন আর বনের পাখি। নগরজীবনের ব্যস্ততা নেই, দায়িত্ব নেই, উচ্চাশা নেই, আছে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি। অঢেল সময়। কিন্তু বাস্তবে সেই ছবি গড়া তার পক্ষে অসম্ভব। আর সম্ভব নয় বলেই আমার অবস্থাও আজ আতরের ব্যর্থ কারিগরদের মতো। হয়তো একদিন হলেও হতে পারে, কিন্তু এই মুহুর্তে নয়। আমার পাহাড়যাপন পর্ব এখানেই শেষ।
গত তিন মাসে আমি পাহাড়কে যেভাবে দেখলাম, সেভাবে আগে দেখিনি। দেখা সম্ভবও ছিল না। হাড় কাঁপানো শীত আর তুষারপাত যেমন দেখা হল, বসন্তের আগমনেরও সাক্ষী হয়ে রইলাম। দেখলাম, ঋতুর সঙ্গে সবুজের রঙ কীভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে পাহাড়িয়া জীবনের রোজনামচা। বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গাওয়া যেমন হল, নতুন বন্ধুদের আনন্দ অনুষ্ঠানের ডাকও পেলাম। গাছগুলো পাতা মেলল, চুড়ার বরফ গলে গেল আস্তে আস্তে। খরস্রোতা পাহাড়ি নদী এখন আরো ক্ষিপ্ত। বাগানের আপেলেও লাল রঙ ধরছে। কালো বলের মতো দেখতে একটা কুকুর ধীরে ধীরে পরিণত আর তাগড়াই হয়ে উঠছে, যার নাম সাইচু। দেখলাম, প্রত্যন্ত এক গ্রামেও দুই মেয়ে টিকটক স্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, বিশাল ছেত্রীর গানের কলি আঁকড়ে তারা ভিডিও করছে রোজ। সুজুকা বলে একরত্তি পুঁচকে মেয়েটা, যার আসল নাম গরিমা, তাকে খুব মিস করব। মিস করব গ্রামের অন্য বাচ্চাদেরও। গীতা, অনু, ঋশু, পরিধি। পরিধির কচি গলায় 'সচিন ভাইয়া' যা শুনে মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড় হত, সেটাও মিস করব। অনুর কাঁদো কাঁদো মুখে বলা 'পালক তো নাহি হ্যায় আজ' কথাটা মনে করে হাসব হয়তো। প্রকৃতির কথা আর কী বলি, আকাশের নীল রং আর সবুজের কথা ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আর টুকরোটাকরা মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে, যার মূল্য আগে বুঝতে পারিনি। সত্যি, গল্প তো বুনে ওঠে অতীতে। বর্তমানের কোনও গল্প হয় না।
রঙের গন্ধ আর পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে আজ আমরা চলে যাব। কিন্তু ফিরে যে আসব, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ততদিনের জন্য, বিদায়। সবাই ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। আর থাকুক সবুজে।
পাহাড়যাপন ৫
বনপাহাড়ের দেশ। সবুজ ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর গাছের শাখা প্রশাখায় একসুরে ডেকে চলেছে দোয়েল, ময়ূর, ম্যাগপাই, আরও কত নাম না জানা পাখি। মাটির রং খয়েরি সবুজ, মনে হয় খানিক আগেই হয়ে গেছে একপশলা বৃষ্টি। কচি সবুজ পাতাগুলো থেকে এখনও জল চুঁইয়ে পড়ছে। টুপ,টুপ,টুপ টুপ...নাকে ভেসে আসছে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। মুক্ত আসমানি শামিয়ানার নিচে একখানা মাত্র বাড়ি, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক গাছ। বাড়ির রোয়াকে বসে কলকেতে টান দিচ্ছে এক বৃদ্ধ, তাকে কোথায় যেন দেখেছি।
মন দিয়ে দেখে চিনে ফেলি। আমারই প্রতিরূপ, তবে ভারি আনমনা। কোত্থেকে আমদানি করা হল একে? তাজ্জব! কেসফাইলের দরকার পড়ে না, সব কিছু আপনা হতেই স্পষ্ট হয়ে আসে আমার কাছে।
বুড়োর বেয়াদব চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কাল মধ্যরাতেও যথারীতি বিছানা ছেড়ে নেমে এসে আকাশের তারার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে সে! বুড়ো কিছুরই তোয়াক্কা করল না সারাজীবন। নগরজীবনের সমঝদাররা কত করে বোঝালো, কিন্তু জীবনকে হিসেবনিকেশ করে দেখার দৃষ্টি যে সে অনেক আগেই খুইয়েছে। স্বেচ্ছায় বর্জন করেছে গৃহপালিত স্টেটমেন্টের নিয়মিত আপডেট আর গাজোয়ারি করে হাতছাড়া করেছে সোহবতি শিক্ষার শংসাপত্র। একফালি আকাশ আর এক পৃথিবী সবুজ নিয়েই সে খুশি। এক চিলতে ঘর আর গুমরে ওঠা মেঘ নিয়ে তার সংসার। হঠাৎ বৃষ্টির চমক আর ঝড়ের সঙ্গে গুলতানি। অদ্ভুত এই গ্রাম! এখানকার নিয়মও অদ্ভুত। মন নিয়ে কাজকারবার, বাজারে পসসা সাজিয়ে বসে না কেউই। বরং সবাই মিলে গল্পের আসর হয়। কেউ গল্প বলে, কেউ শোনে। কল্পনা নয়, স্মৃতির অনুজ্জ্বল কোণে রাখা চকমকি গল্প। ঘটনা, কিসসা, হয়তো বা স্রেফ লাতিফা! এরম করেই কাটে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির মেহফিল শেষ হয়। প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটে, কিন্তু বিদায়বেলায় বিমর্ষতা আর আক্ষেপে হাত ধরাধরি করে আসে না এই গ্রামে। বরং সেতার বা শেহনাইয়ের সুর ভেসে ওঠে পুরোনো আয়না ভেঙে গেলে...
এখনও বাড়িটা চোখের সামনে ভাসে। এই পৃথিবী থেকে সেখানে যাওয়া যায় না। তার অবস্থান ভিন্ন ছায়াপথে। হয়তো বা এই বাড়ির একমাত্র বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হতেও পারত গ্রহান্তরের পথিকের, কিন্তু সে নিজেও যে পাক খেয়ে চলেছে নিরুদ্দেশ জীবনচক্রের গোলকধাঁধায়। তার কোনও ঠিকানা নেই, ভেঙ্গে পড়া কয়েকটি আয়নার স্বীকোরক্তিই তার সম্বল। দেখতে গেলে কোনও কাজও নেই তার, ফসল ফলানো আর রান্না করাটাকে কাজ বলে আমরা স্বীকার করেছিই বা কবে? গাছ আর পাখিদের সঙ্গে গল্পগাছা চলে বাকিটা, আর চলে রোয়াকে বসে কলকে টানা। এখনও সেই একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন চলছে, প্রতিদিনেরই মতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে যাবে, চোখ বুজলে শুনতে পাওয়া যায় ঝিঁঝিঁর শব্দ।
আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি বাড়িটা, বাড়ির লোকটাকে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে দৃশ্যটা।
চোখের পলক বন্ধ হল। বৃষ্টিভেজা বন আর পাহাড়ি গ্রাম উবে গেল মুহুর্তে। সাদা মার্বেলের ঘরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কল্পনাকলের মেশিন থেকে বেরিয়ে এসে চশমা খুললাম, চোখ মুছলাম রুমাল দিয়ে। সার্কিটগুলো বদলাতে হবে। সবুজের ছোঁয়া চোখে লেগে আছে বলেই হয়তো...অভ্যেস ছেড়ে গেছে আজ ৫০০ বছর। ছেলেবেলার নেশা! তখন আমি বাড়ি পালিয়ে বনপাহাড়ের দেশে যেতে পারতাম, একটা বই খোলাই যথেষ্ট ছিল। তখন আমি সবুজ দেখতাম সিঁড়ির কোণায় বা ছাদের পাঁচিলের গায়ে, বুকসেল্ফের তাকে বা আয়নায় কাঁচে। সবুজ দেখার অভ্যেসে ভেজাল ছিল না কোনও।
তখন আমি মানুষ ছিলাম।
পাহাড়যাপন ৪
ঝিমপাহাড় আর সবুজ বনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। দূর থেকে দেখলে 'হ্যামলেট' কথাটাই মনে আসে প্রথমে। গ্রামের এক প্রান্তে অতলস্পর্শী খাদ, সেখানে অতিকায় বৃক্ষরা জড়ামড়ি করে নেমে গেছে অরণ্যের বুকে। অন্যদিকে সবুজের সিড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে বরফাচ্ছাদিত চুড়ার উদ্দেশে।
ইজারায়েলের ব্যাকপ্যাকাররা বছর চল্লিশ আগে খুঁজে বের করেছিল এই রত্ন, চার দশকের শত হাঙ্গামাতেও তার ঔজ্জ্বল্য একফোঁটাও মলিন হয়নি। হয়নি যে, সেটা সত্যি আশ্চর্য! মাত্র ঘন্টা চারেকের দূরত্বে অবস্থিত পার্বতী নদীর ধারে একটা কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে উঠেছে প্রায়। পার্টি ক্রাউডের জ্বালায় গ্রামের মানুষ তো বটেই, বনের পাখিরাও অস্থির। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্যভাবে এই গোপন গ্রামটা বেঁচে গেছে।
ভাগ্যিস! এই অচিনপুরের ডাকে সাড়া না দিলে সত্যি আফসোস থেকে যেত। বৃষ্টির ছাঁট মাথায় নিয়ে হারিয়ে যাওয়া হত না মেঘেদের দেশে, সবুজে গা ডোবানোর অভিজ্ঞতাও রয়ে যেত অধরা। অথচ এখানে যাওয়া প্রায় ছেলেখেলা। ট্রেকিং প্রায় করতে হয় না বললেই চলে, হাইকিং ট্রেলও ঘন্টাখানেকের চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু নির্ভেদ্য অরণ্য এখানে এখনও একইরকম সচল, একইরকম জীবন্ত।
জংলি নালা পিছু ছাড়ে না মুহুর্তের জন্য, কাটাকুটি করে জলের সোঁতা এগিয়ে গিয়েছে বন কেটে। পাখির ডাক আর ভ্রমরের গুঞ্জন শুনতে শুনতে হাঁটা। ক্রমে সবুজের প্রলেপ ঘন হয়ে আসে। এমন সময় আমাদের চমকে দিয়ে উন্মোচিত হয় একটা ঝরনা। আমাকে আর পায় কে? সটান জুতো খুলে পাহাড়ি নদীর জলে পা ডুবিয়ে দিই, তারপর জলপ্রপাতের ধারে পাথরের উপর গা এলিয়ে দিই। ঠান্ডা জলের ছিঁটে মুখে এসে লাগছে, ততক্ষণে আমার মনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা ক্যাওড়া কবি একটা কবিতার বইয়ের নাম ভেবে ফেলেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে'; আমি না হয় লিখব 'জলপ্রপাতের ধারে ঘুমাবো বলে!'
ওঠার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু উঠতেই হয়। দুপুর হতে না হতেই পাহাড়ে আকাশের মুখভার হয়। বৃষ্টি হলে এই হাইকিং রুটে এগোতেই পা পিছলে আলুর দম হতে হবে। ফিরতি মেঘের পানসে মুখ দেখে পাহাড়ে ওঠা শুরু হয়। এইবার একটু চড়াই এসেছে বটে! শুকনো ফুল মাড়িয়ে ঝোপঝাড় ঠেলে এগোচ্ছি, মাঝেমাঝে রাস্তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। সুঁড়িপথগুলো সযত্নে এড়িয়ে মেইন ট্রেলে এগোচ্ছি তখন। বাকিগুলো কাঠুরিয়া আর ঘোড়ার চলার রাস্তা। এই বনে আরো কিছু ছোটছোট গ্রাম আছে, সেখানেও যাওয়া যায় ইচ্ছে হলে। কিন্তু পথ না জানলে হয়রানি হতে পারে।
বিকেলের আগেই গন্তব্যে এসে উপস্থিত হলাম। সবুজের ঘনঘটা থেকে তখন মনের ভিতর লাবডুব লাবডুব শব্দ হচ্ছে। এই সবুজের রঙ লিখে বোঝানো যায় না। এত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি, কিন্তু অন্তত দিন তিনেক পথ না হাঁটলে এমন মারদাঙ্গা সবুজের সঙ্গম তেমন চোখে পড়ে কই! ভাগ্য ভালো হলে বেদেনি বুগিয়াল বা কাশ্মীরের বেতাব ভ্যালিতে কাছাকাছি মশলা পেতে পারেন, না'হলে আল্পস ছাড়া গতি নেই। অবশ্য পাহাড়ের মায়া না থাকলে কেরলের পালক্কড়, সাইলেন্ট ভ্যালি আর মুনরো আইল্যান্ডের সবুজও মগজদখল করতে পারে, কিন্তু তার মেজাজ একদম আলাদা।
যাই হোক, লাফাতে লাফাতে চললাম। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। খাদের ধারে কাঠের বাড়ি, ঢালু জমিতে গমের খেত, সবজি বাগান। হিমাচলি মহিলারা মাথায় কাপড় বেঁধে খেতে কাজ করছে। কিছুটা দূরে ঢেউয়ের মতো ঘাসের মাঠ, সেখানে ঘোড়া চরছে। দু'টো পাহাড়ে ভাগাভাগি করে কয়েকটি বাড়ি, মাঝখানে দিয়ে বয়ে গেছে নালাটা। নালার উপরের কাঠের সাঁকো পেরিয়ে অন্যদিকে চলে এলাম। খুঁজেপেতে একটা হোমস্টে নেওয়া হল। যতটা না বাড়ি, তার চেয়ে বেশি বাগান। রকমারি ফুল ফুটে আছে, তাছাড়া বাঁধাকপি, বেগুন, টম্যাটো, লঙ্কা তো আছেই।
স্থানীয় খাবার খেয়ে চাঙ্গা হয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলাম। একপশলা বৃষ্টি হয়ে সবুজের রঙ আরো গাঢ় হয়েছে, তার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। বাহুল্য নেই, কিন্তু যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
ফুলকাটা বারান্দা, জানলা, রেলিংকাঠ, খড়ের গাদা, গোয়ালের গরুর ঘণ্টি....ছাড়া ছাড়া কয়েকটা হোমস্টে। লাল রোয়াক আর খোলা বারান্দা থেকে ভেসে আসা পুরোনো গানের সুর। রেডিও বাজছে। হঠাৎই এক ভালো লাগা মনখারাপ জড়িয়ে ধরে, দলছুট মন পথ হারিয়ে ছুটে যায় অতীতে। এরকম কোনঠাসা দুপুর অথবা টিউশনি সন্ধ্যের ভিজে মরশুমে রেডিও শোনার অভ্যেস আমার বহুদিনের, সে সব দিন এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। 'ছায়াগীত' আর 'আপকি ফরমাইশ' এর মায়াজাল ছিঁড়ে জোর করে হাঁটা দিই, কানে লেগে থাকে সেই বাগানসুরের মূর্ছনা...
এক চিলতে গ্রাম। গ্রামের পর খেত। খেতের পর পাহাড়। গম থেকে আলু, কপি থেকে সরষে... প্রায় সব কিছুর ফলন হয় এই গ্রামে। দেখতে গেলে একেবারে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট, শহরের উপর কোনও নির্ভরশীলতা নেই। আগে বিদ্যুৎও ছিল না, বছরকয়েক হল এসেছে। মোবাইল কভারেজ নেই, কিন্তু মোবাইল আছে সকলের কাছেই। সেই মোবাইলে আকাশবাণীও বাজে, আবার বাদশাও বাজে। মার্ফির পুরোনো রেডিওর স্মৃতিভেজা অনুষ্ঠান আর সরগম আমাদের নস্টালজিয়ার জগতেই বেঁচে থাক।
সবুজে গা ভিজিয়ে একটা জায়গায় বসলাম। চা খেতে হবে। চা, পাহাড় আর বৃষ্টির সঙ্গম বড় একটা হয় না, তাই আমি যে আহ্লাদে আটখানা সে কথা আলাদা করে বলার নেই। গ্রিন টি না হয়েও চায়ের রঙ সবুজ দেখায় আমার চোখে। সেই ক্লোরোফিল ভাসা চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আলো কমছে, সন্ধ্যের আসর নেমেছে জঙ্গলের বুকে। আড্ডার আড়ালে যে কথোপকথন চলছে, তার নাগাল পাওয়া কঠিন। আমরা শুধু চিন্তাজলের সলতে হাতে অপেক্ষা করে থাকি, ছবিঘর বাঁধি মনে মনে।
রাত নামে। মুর্গির ধোঁয়া ওঠা মাংস আর রুটি নিয়ে ততক্ষণে আমরা পুরোদস্তুর টুরিস্ট। হিমরাত জাগে চিকচিক পাথরে, চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আদিম বনের উপর।
পরদিন ফিরে এসেছিলাম। আমার দলছুট মন অবশ্য প্রতিবারের মতো ফিরে আসতে নারাজ। আজও সে সবুজে গা ডুবিয়ে বসে রেডিও শুনছে।