শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইউরি হেরেরার মেক্সিকো ট্রিলজি

 


পনেরো সেপ্টেম্বর থেকে পনেরো অক্টোবার হিস্প্যানিক হেরিটেজ মান্থ সেলিব্রেট করা হয়। তাই আমিও এই সুযোগে স্প্যানিশ সাহিত্যে একটু সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি, বেশিরভাগই হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছি। 


আপাতত মেক্সিকোতে মুখ তুলেছি। সমকালীন মেক্সিকোর সাহিত্যিকদের মধ্যে ইউরি হেরেরা ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন বললে (অন্তত ইংরেজি অনুবাদে) বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন, পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশায় আছেন, আর মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর সমাজকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন। তাঁর যে তিনটে বই নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে, সেটা আসলে একটা ট্রিলজিই। নেমলেস মেক্সিকো ট্রিলজি বলা যায়। এই তিনটে বই যথাক্রমে কিংডম কনস, দ্য ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ বডিজ আর সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। প্রতিটাই আসলে নভেলার সাইজ, মেরেকেটে একশো পাতা, কিন্তু ইম্প্যাক্ট তাই বলে কম নয়। মজার কথা, ইংরেজিতে আগে তিন নম্বর বইটা এসেছে, তারপর দুই, তারপর এক। পরে অবশ্য তিনটেই একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে, আপাতত আমি দুই আর তিনই পড়েছি।


প্রথমে সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড এর কথা বলা যাক। এই বইটা বেস্ট ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত সেই পুরস্কারটাই উঠে গেছে। কিন্তু এমন একটা বই অনুবাদ করা যে ভীষণ চাপের কাজ সেটা আমি ইংরেজিতে পড়তে গিয়েও বুঝতে পেরেছি। তার প্রধান কারণ, হেরেরা মেক্সিকোর গল্প বলেন মেক্সিকোর নাম না নিয়ে, বরং তিনি 'মেক্সিকো', 'আমেরিকা', 'স্প্যানিশ', 'ইংরেজি' কোনও শব্দই ব্যবহার করেন না, ফলে প্রতিটা বইতেই একটা অ্যাপোক্লিপ্টিক নুয়া গল্পের মেজাজ আছে, অথচ, এই দুনিয়াটা এতটাই বেশি বাস্তব যে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। নাম ব্যবহার না করলেও হেরেরা স্থানবিশেষের ডায়ালেক্ট, স্ল্যাং, কলোকিউয়ালিজম, কালচারাল এমবেডেড রেফারেন্স একদম নিঁখুতভাবে বজায় রাখেন, প্রয়োজনে ডিকশনারিতে না থাকা কিন্তু মুখে মুখে প্রচলিত নতুন শব্দ--- নিওলজিসম?-- ব্যবহার করতেও পিছপা হন না। বোঝাই যাচ্ছে এত কিছু নিয়ে ইংরেজি অনুবাদে সোর্স কন্টেন্টের শৈলী আর উপস্থাপনা বজায় রাখা কঠিন কাজ। এর চেয়েও বড় সমস্যা, হেরেরার গল্পে একটা অ্যাজটেক মাইথলজির চোরা রেফারেন্স থাকে। ঠিকঠাক ভাবে অনুবাদ না হলে সেটা কোনও ক্রিটিকই ধরতে পারবে না।


'সাইন্স...' বইটা মূলত একটা বর্ডার ক্রসিং এর গল্প। মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় একজন মেয়ে (মাকিনা) তার ভাইকে খুঁজতে আসছে বর্ডার ক্রসিং মাফিয়াদের সাহায্য নিয়ে, কারণ ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। (ভাই এসেছিল সেখানে একটা পূর্বপুরুষদের থাকা জমি ক্লেম করতে; মেক্সিকো ইউ এস সীমানায় বহু মানুষ এই জন্য সীমানা ক্রস করে) এইবার এখানে মেক্সিকোও নেই, ইউ এস ও নেই, কিন্তু বেআইনিভাবে সীমানা অতিক্রম করার আগে, করার সময় বা করার পর কী কী হতে পারে তার সবটাই আছে। কিন্তু আসলে গোটাটাই অ্যাজটেক মিথের একটা গল্প, যেখানে Quetzalcoatl পাতালে বা মৃতদের দুনিয়ায় নেমে যায় পূর্বপুরুষদের অস্থি ফেরত দিয়ে মনুষ্যত্বকে রিস্টোর করতে। মাকিনা আসলে এই গল্পে Quetzalcoatl, সে ওই মায়াদের নায়কের মতোই তিনটে ভাষা জানে (মাতৃভাষা, মৃতদের ভাষা, জীবিতদের ভাষা...মানে নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ, স্প্যানিশ আর ইংরেজি) মৃতদের রাজা Mictlantecuhtli তাকে পাতালে আটকে রাখার জন্য একটা ফাঁদ পাতে, যা দেখা যায় মাকিনার ক্ষেত্রেও। পাতালে গিয়ে সে এমন সব জিনিস দেখে, যা আগে সে দেখেনি কিন্তু মৃতদের দুনিয়াত তা সাধারণ ব্যাপার। মাকিনাও ইউএসে এসে তুষারপাত দেখে, আগে সে কখনও বরফ পড়তে দেখেনি।


"...and when it dissolved a few seconds later she wondered how it was that some things in the world -- some countries, some people -- could seem eternal when everything was actually like that miniature ice palace: one-of-a-kind, precious, fragile."


এরকম ছোট ছোট প্রতীকী ব্যাপার বইজুড়ে ছড়ানো আছে, অনুবাদে তার সবটা বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব, যদি মেক্সিকোর লোককথা, সমাহ আর অ্যাজটেক মিথের সঙ্গে পরিচয় না থাকে। ইংরেজিতেই যে ধরনের পোয়েটিক ভাষ্য দেখলাম, স্প্যানিশে পড়লে লোকে মুগ্ধ হত সন্দেহ নেই। প্রেক্ষাপট ভীষণ ভাবে বাস্তব, আর হয়তো সেই কারণেই সবটা না বুঝলেও এই বইটা অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।


দ্বিতীয় বই 'দ্য ট্রান্সাইগ্রেশন অফ বডিজ' নিয়ে তেমন বলা যাবে না, ওটা আরো বেশি আনঅ্যাক্সেসিবল গল্প। কোনও কাব্য ফাব্য নেই, ঘোরতত ডার্ক ন্যারেটিভ। মেক্সিকো শহরে মহামারি শুরু হয়েছে, সেখানে দুই পরস্পরবিরোধী মাফিয়া গ্যাঙ নিজেদের ছেলেমেয়ে হারিয়ে বসে আছে। দুজনেই সন্দেহ করছে অপরপক্ষ তাদের ছেলে বা মেয়েকে কিডন্যাপ করে খুন করেছে, কিন্তু আসলে তা হয়নি। অথচ ছেলেমেয়ে দুটোই মারা পড়েছে, তাদের লাশ শান্তিপূর্ণ ভাবে হাতবদল করার জন্য এক মধ্যস্থকারী ফিক্সারকে নিয়োগ করা হয়েছে, সে নিজের মতো করে তদন্ত করছে সত্যিটা জানার জন্য। তদন্ত শুনেই লাফিয়ে ওঠার কারণ নেই, এই তদন্ত সেই তদন্ত নয়। বলাবাহুল্য, এখানেও কোনও জায়গায় নাম নেই, মিথলজির মেটাফর আর ভাষার কারুকাজ আছে, কিন্তু গল্প ভীষণ ডার্ক, পড়ে সত্যিই মহামারির মধ্যে চলতে থাকা গ্যাঙওয়ারে ফেঁসে গিয়েছি মনে হবে। লিসা ডিলম্যান হেরেরার নিয়মিত অনুবাদিকা, তিনি এই বইটাও অনুবাদ করেছেন, কিন্তু সাইন্স... এর মতো জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে নয় বলেই হয়তো এই বইটা ততোটা জনপ্রিয় হয়নি। তবে ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ডস এর জন্য শর্টলিস্ট হওয়ার সুবাদে সাহিত্যিক মহলে হেরেরার কাজকর্ম নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, ইতিমধ্যেই এই ট্রিলজি ইউরি হেরেরাকে সবাই মেক্সিকোর প্রথম সারির সাহিত্যিকদের মধ্যে নিয়ে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন