শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং

 

বেস্টসেলার সাহিত্য আর বুকার জাতীয় পুরস্কারের বাইরে যারা একটু বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাদের প্রায় অনেকেই একবাক্যে বলছেন, গত পনেরো বছর ধরে আসল কাজ হচ্ছে হিস্প্যানিক সাহিত্যে। লাতিন বুম মার্কা কোনও নাম যে দেওয়া হচ্ছে না, তার বিভিন্ন কারণ আছে।   এখনকার লেখকদেরও আর স্প্যানিশে লেখার জন্য স্পেনে বা লাতিন আমেরিকায় থাকতে হয় না। গ্রান্টা ইমার্জিং হিস্প্যানিক সাহিত্যিকদের একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি জারি করেছিল, তাদের অনেকেই জাপান, আমেরিকা বা ইউরোপে থাকেন। কিন্তু কলম থেমে নেই, আর এদের মধ্যে কয়েকজন এমন ঝড় তুলেছেন যে স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ বহুগুণ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও প্রায় বারো আনা কাজই আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়।

এতসব কথা বলার কারণ, বছর দুয়েক আগে আমি এক লাতিন লেখককে আবিষ্কার করেছিলাম, যার লেখা প্রায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোকের নাম Juan Gabriel Vásquez, থাকেন কোলাম্বিয়ার বোগোতায়, মূলত ঔপন্যাসিক বলেই তাঁর নাম। কোলাম্বিয়ায় তাঁকে নতুন মার্কেজ বলে লাফালাফি হচ্ছে বহুদিন ধরে, কিন্তু ভাস্কেজবাবুর কলম বিলকুল অন্য জাতের। ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, তাঁর বিশেষত্ব হল ট্রাজিক রিয়ালিজম। ভদ্রলোক নিরুত্তাপ স্বরে জানিয়েছেন, "My work is a reaction to the idea of magical realism as the only way to discover Latin America. It's something that still many readers believe. And this is obviously something I strongly oppose. I don't feel Latin America is a magical continent. I feel Latin American history, is if anything, tragedy."

এই জায়গা থেকেই আমি ভাস্কেজকে আবিষ্কার করেছি, কারণ আসল কোলাম্বিয়াকে বোঝার জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য কলমের খোঁজ আমি বহুদিন ধরে চালাচ্ছি। মাকোন্দো নয়, মারিহুয়ানা। আধুনিক কোলাম্বিয়া বলতে যে দেশটার ছবি আমাদের মাথায় ঘোরে, সেখানে কী আছে? এস্কোবার, নারকো ট্রেড, অস্থির রাজনীতি, প্রায় প্রায় গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি, আবার সে সব সামলে আমোদ করার মানসিকতা, ফুটবল আর সাহিত্য প্রীতি, কবিতা নিয়ে উন্মাদনা, পাশাপাশি দুর্নীতি, অপরাধ, অর্গানাইজড ক্রাইম, বোমাবাজি, আমেরিকার সঙ্গে দড়ি টানাটানি... যারা সত্তর আশি নব্বইয়ের দশকে এই দেশে বড় হয়েছেন, তাদের কি কিছু নতুন বলার নেই? এই অস্থিরতা কীভাবে তাদের জীবনকে বদলেছে, সমাজকে বদলেছে, কী করে এই পরিস্থিতি কোলাম্বিয়ার জনমানসকে ভেঙেছে বা গড়েছে? আর শুধু নার্কো ট্রেড কেন, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকের বাস্তব ছবিই বা কতজন জানে? লাতিন দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, উপজাতি বিদ্রোহ, তেল আর গ্যাস নিয়ে রেষারেষি, আমাজনের পরিবেশ বদল ক'টা লেখায় আমরা পড়েছি? অথচ দুনিয়ার লোক মার্কেজকে গুলে খেয়েছে! ভাস্কেজের মতো লেখকদের কলম সেইদিক থেকে দেখতে গেলে কোলাম্বিয়ান সাহিত্যে নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে।

যাই হোক, ভাস্কেজবাবুর বই আজকাল নিয়মিত ইংরেজিতে আসছে। বছরখানেক আগে প্রকাশিত 'রেট্রোস্পেক্টিভ'-ও ভীষণ ভালো রিভিউ পেয়েছে, কিন্তু যে বইটা পড়ে আমি তাঁকে চিনেছি বা দুনিয়া তাঁকে চিনেছে, সেটার নাম 'দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং', এই বইটা আসামাত্র লোকেরা নড়েচড়ে বসেছিল। বইটা ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ড   পাওয়ার আগেও স্প্যানিশে একগাদা পুরস্কার জিতেছে, সে কথা থাক।

এই বইটা কী নিয়ে? এই হল কঠিন প্রশ্ন, কারণ এমন বই আমি আগে পড়িনি। গল্পটা আমি বলেই দিই। আইনের প্রফেসার আন্তোনিও আমাদের প্রোটাগনিস্ট, তার সঙ্গে রিকার্ডো লেভার্ডে বলে এক জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামীর দেখা হয়। তারপর একদিনে রাস্তায় বাইকে সওয়ার দুই আততায়ী এসে তাদের দিকে গুলি ছোঁড়ে, আন্তোনিও বেঁচে গেলেও ভীষণভাবে আহত হয়, রিকার্ডো মারা যান। এদিকে তিন বছর পর যখন আন্তোনিও প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বিয়ে থা করে মেয়ে বউকে নিয়ে সংসার করতে বাধা নেই, তখনও তার মনে সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি ঘুরে বেড়াতে থাকে। কারণ নেই, তবু সে চিন্তা করে যায়। পিটিএসডি বলা যায়, কিন্তু এ আদপে আতংক নয়, বরং কৌতূহল! কেন কেউ রিকার্ডোকে মারল? কী করেছিল সে? জেলে গেছিলই না কেন?

এই অদম্য কৌতূহলের কোনও ব্যাখা নেই, কিন্তু আন্তোনিও সেই খোঁজ চালিয়ে যায়। এই তদন্ত তাঁকে প্রথমে রিকার্ডোর বাড়িওয়ালি, তারপর তার মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। গল্প এমন দিকে ঘোরে, কেউ আন্দাজও করেনি। এক সময় বোঝা যায়, গল্পের মূল চরিত্র বদলে বদলে যাচ্ছে। একটা আপাদমস্তক ক্যারেক্টর ড্রিভেন ন্যারেটিভে কোলাম্বিয়ার তিন দশকের ইতিহাস ঢুকে গেছে। কখনও সে গল্প আন্তোনিওর, কখনও তার মেয়ের, কখনও রিকার্ডো বা তাঁর স্ত্রীর, যখন সত্তরের দশকে তাদের দেখা হয়েছিল। গল্পের সঙ্গে বদলে যায় পারিপার্শ্বিক, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির কথা উঠে আসে গভীরভাবে। দ্রুত গতিতে  বদলে যাওয়া এক দেশ, যেখানকার মানুষের জীবনও বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের চরিত্র, সম্পর্ক, আশা আশঙ্কা। ভাস্কেজের কলম যে দক্ষতায় এই গল্প এগিয়ে নিয়ে গেছে, রিয়ালিজম আর থ্রিলারের আঙ্গিকে গল্প নিয়ে চললেও যেভাবে মাল্টি জেনারেশনাল আইডেন্টিটির জটিলতা তুলে ধরেছেন, তার জবাব নেই। 

দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং... হোয়াট আর দিস থিংস...শুধুমাত্র একটা প্লেন ক্র‍্যাশ নয়, এই পতনের অনুরণন সর্বত্র। একটা রবিনহুডি আপরাধিক সাম্রাজ্যের পতন, একটা প্রজন্মের আশা আকাঙ্খার পতন, সম্পর্ক বা চরিত্রের পতন... এই ভঙ্গুর, ইম্পার্ফেক্ট চরিত্রদের জীবনে সর্বদা একটা 'ফলিং' চলছে। তাদের স্মৃতিতে, তাদের যাপনে, তাদের মননে। কেউ বোঝে না, কেউ যুক্তি খুঁজে পায় না, কিন্তু সব ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে ভিতরে। 

ভাস্কেজবাবুর মেটাফরগুলো এতটাই চমকপ্রদ আর ইমেজারি এতটাই অভিনব যে, ট্রাজিক রিয়ালিজমের মধ্যেও একটা ম্যাজিক চলে আসে। মজার কথা, এক জায়গায় লেখক খোদ হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের প্রথম প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই বইয়ের প্রচ্ছদে একটা মুদ্রণপ্রমাদও রয়ে গিয়েছিল।

একটা গোটা সাইডপ্লট হল ড্রাগ লর্ড এস্কোবারের হুজুগে তৈরি চিড়িয়াখানা নিয়ে, যে চিড়িয়াখানা মেন্টেন করার।লোক নব্বইয়ের দশকে আর নেই। শেষের দিকে একটা দৃশ্যে দেখা যায়, আন্তোনিও আর মায়া (রিকার্ডোর মেয়ে) সেই পরিত্যক্ত চিড়িয়াখানায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা চিতাবাঘ, একটা পাগলা চিম্পাঞ্জি ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। কোথায় সেই গোলাপি ডল্ফিন, ম্যাকাওয়ের ঝাঁক, বাঘ ভাল্লুক! ফিরতি পথে আসার সময় তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটা জলহস্তী, করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। আন্তোনিওর মনে পড়ে যায়, কার্টেল যখন দুর্বল হয়ে এসেছে, ম্যাডালিনের ছাদে ডিইএ পাবলো এস্কোবারকে গুলি করে মেরেছে, তখন একটা জলহস্তী এই চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ তাকে গুলি করা হয়। সেই জলহস্তীই আসলে এই বদলে যাওয়া দেশের বাস্তব। এক মর্মান্তিক ড্রাগ ওয়ারের বিভীষিকার মধ্যেও এই চিড়িয়াখানা ঘিরে কোলাম্বিয়ার ছেলেমেয়েদের যে স্মৃতি, সেই কথার বয়ান পড়তে গেলে মনে হয় আমিও হয়তো বোগোতাতেই ছিলাম।

ইদানীংকালে পড়া বইগুলোর মধ্যে আমি এটা প্রথম সারিতে রেখেছি। মার্কেজের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি কেউ কোলাম্বিয়ার সমকালীন সমাহ আর সাহিত্যকে বুঝতে চান, দিজ ইজ দ্য মাস্ট রিড।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন