পার্সিভাল এভরেট পোড় খাওয়া লেখক, যা ইচ্ছে হয় তাই নিয়েই লেখেন, কাউকেই ডরান না। তাঁর নতুন বই 'জেমস' আসতে না আসতেই খাস্তা কচুরির মতো সেল্ফ থেকে উড়ে যাচ্ছিল, পাঠক সমালোচক সবাই একদম ফ্ল্যাট। একশোটা দশে দশ রিভিউ হলে একটা হয়তো খারাপ রিভিউ পেয়েছে। আপাতত বইটা বুকারের শর্টলিস্টেও ঢুকে পড়েছে আর অনেকেই মনে করছেন, জিতেও যেতে পারে।
এসবের মধ্যে ভাবার কথা একটাই, একটা রিটেলিং নিয়ে এত লাফালাফি কেন? 'জেমস' আসলে 'দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ হাকলবেরি ফিন' উপন্যাস এর রিটেলিং, কিন্তু হাকের জায়গায় এখানে পার্স্পেক্টিভ জিমের। এখন যারা মূল বইটা পড়েননি বা ইংরেজিতে পড়েননি বা পড়লেও আমার মতো ভুলে বসেছিলেন, তাদের খানিকটা রিভিজন দেওয়াই ভালো।
ছোট করে বলতে হলে, হাক বছর দশেকের ছেলে, অ্যাডভেঞ্চার পাগল, তার বন্ধু টম সাওয়ারের সঙ্গে আগেও একাধিক অ্যাডভেঞ্চার করেছে, তার বাবা বেহেড মাতাল আর এই বইয়ে তাকে পুষ্যি নিয়েছিলেন মিসেস ওয়াটসন, যিনি তাকে জোর করে সভ্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলে উঠেপড়ে লেগেছেন, এদিকে হাকের ওইসব ন্যাকাবোকা জীবন মোটেও পছন্দ লয়। সে মারা পড়েছে, এমন একটা নাটক স্টেজ করে পালায়, পথে দেখা জিমের সঙ্গে। জিম, তার বউ আর তার মেয়ে মিস ওয়াটসনের কৃষ্ণাঙ্গ চাকর, মানে কেনা চাকর আর কি, কারণ সে যুগে আমেরিকায় দাসবৃত্তি বেআইনি হয়নি। তাকে আর তার পরিবারকে আলাদা আলাদা জায়গায় বিক্রি করার কথা হচ্ছে দেখে সে পালিয়েছিল, এদিকে হাক মারা পড়েছে ভেবে লোকে ভাবছে জিমই তাকে খুন করেছে। হাক অবশ্য জিমকে বন্ধুই ভাবে। তারপর তারা মিসিসিপি নদী দিয়ে ডিঙি নিয়ে পালায়, পথে একের পর ঘটনা। এই ছিল মোটামুটি গল্প, শেষে হ্যাপি এন্ডিং।
রিভিজন দেওয়ার পর বই শুরু করে দেখি, গল্প হুবহু একইভাবে এগোচ্ছে। মানে , সিন বাই সিন। এভরেট সেই একই সাউথওয়েস্টার্ন ডায়ালেক্ট আর 'মিসৌরি' নিগ্রো ডায়ালেক্ট বজায় রেখেছেন, কিন্তু এইবার গল্পটা জিম প্রথম পুরুষে বলছে বলে স্বাভাবিক ভাবেই একজন কৃষ্ণাঙ্গ পার্স্পেক্টিভ চলে এসেছে, জিমের ভাবনাচিন্তার কথাও খানিক জানা যায়। প্রচুর ইন্টারটেক্সচুয়াল রেফারেন্স আছে, মার্ক টোয়েনের লেখার সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় না থাকলে সে সব সাধারণ পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। যাই হোক , আমরা জানতে পারি সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে শিখেছে, বইপত্র নিয়ে তার আগ্রহ অসম্ভব বেশি, সে ভোল্টায়ারের অন্ধভক্ত, এতই ভক্ত যে স্বপ্ন দেখলেও বইয়ের চরিত্ররা এসে তার সঙ্গে কথা বলে, ফরাসিতে সংলাপ বলতেও ইতস্তত করে না। কিন্তু গল্প তো একই। এভরেট মূল বইয়ের কাঠামো প্রায় একই রেখেছেন, হাক বা অন্যান্য চরিত্রদের স্বভাবও বদলাননি। আমি স্টোরিটেলে শুনেছি বলে ডায়ালেক্ট বুঝতে বেশ সুবিধাই হয়েছে, পড়তে গেলে সেই স্বাদ পাওয়া যেত না। গল্প হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে হাফ বই শেষ। এদিকে আমি ভাবছি, সব ঠিকই আছে, কিন্তু এই একই গল্প লিখে কী করে এই বই এত নাম করল?
ঠিক এমন সময়, আমার গালে বিরাশি সিক্কার চড় মেরে, এভরেট স্যার দিকবদল করেন। হাক আর জিম আলাদা হয়ে যায় (মূল বইতেও যা হয়েছিল কয়েকবার) আর এভরেট কামিং অফ এজ কিশোর গল্পকে চার লাফে ডিঙিয়ে জিমকে স্বতন্ত্র অ্যাডভেঞ্চারে পাঠিয়ে দেন। এই জায়গা থেকে গল্প যেভাবে এগিয়েছে, উনবিংশ শতাব্দীর দাসবৃত্তির যে সমস্ত স্যাটারিকাল বর্ণনা আর মর্মান্তিক ঘটনা এসেছে, তাতে বইটার চেহারাই বদলে গেছে। কামিং অফ এজ গল্প থেকে সোজা ডার্ক রিয়ালিটি; অ্যাডভেঞ্চারের গল্প হয়ে ওঠে হত্যা, দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, অবসাদ আর অনুতাপের গল্প! অতীত আর বর্তমানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জিমের যাত্রা এগিয়ে চলে, তার মনের ভিতর তখন আর একটা জিম উঠে দাঁড়ানোর জন্য ছটপট করছে। বইয়ের শেষে জিম একসময় 'জেমস' হয়ে প্রায় ভিজিলান্টে ফ্যাশনে সুপারহিরোর মতো লোকচক্ষুর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।
এভরেট পাঠককে নিশ্বাস ফেলার কোনও সুযোগই দেননি। সোর্স ম্যাটেরিয়াল এত স্ট্রং, সেটাকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করে তিনি সিভিল ওয়ার আর বদলে যাওয়া সময়ের একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলতে চেয়েছেন, যা এতদিন হাকলবেরি ফিনের গল্প পড়ার সময় কেউ মনে রাখেনি। তাই বলে হাকের গল্পে জিমকে হিরো বানিয়ে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তৃতীয় পর্বে এসে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন লেখক। গল্পে হাকের ভূমিকা শুধুই বাচ্চা ছেলের নয়, জিমের গল্পে তার এক বিশেষ জায়গা আছে। সব মিলিয়ে নালিশ করার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে।
প্রায় আড়াইশো পাতার বই। দু-তিন সিটিং এর বেশি লাগার কথা নয়। হাকলবেরি ফিনের ভক্তদের ভালোই লাগবে আশা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন