সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আনন্দের গল্প? ওয়েল, নট রিয়েলি

 


ইন্দোনেশিয়ার লেখক নর্ম্যান এরিকসন পাসারিবুর 'হ্যাপি স্টোরিজ মোস্টলি' হ্যাপি মনে পড়তে গিয়েছিলাম। হ্যাপি হওয়ার কারণ, পাতলা বই, নামফামও করেছে, হুড়মুড়িয়ে পড়ে আমি গোঁফে তা দিয়ে কেতা দেখাব। কিন্তু প্রথম দুটো গল্প পড়তে গিয়েই হ্যাপিনেস উবে গেল, মাথার মধ্যে সব বনবন করে ঘুরতে লাগল, চোখে পদ্মফুল দেখলাম। সবই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে প্রায়, কিন্তু গল্পগুলোর দোষ নয়, কারণ গল্প ইজ ফাটাফাটি। দোষ আমার, কারণ এই লেখা নিয়ে আমার কোনও আইডিয়াই ছিল না। লেখক কে, তিনি কী বলতে চাইছেন, কী ধরনের লেখালিখি তিনি করেন, সে সব সম্পর্কেও আমার কিছুই জানা নেই।

তাই বই বন্ধ, আগে লেখকের খোঁজ নেওয়া যাক। এখন প্রশ্ন হল, বই পড়তে হলে লেখকের কথা জানতে হবে কেন? কয়েকদিন আগে মডার্ন আর্ট সম্পর্কে কথা ওঠায় আমার এক বন্ধু বলেছে, আর্ট বুঝতে গেলে শিল্পীর সাতকাহন জানতে হবে কেন? তিনি কী ভাবেন, কী ভাবে শিল্পজীবনে এগিয়েছেন, সেসব পড়াশোনা করে একটা ছবি দেখতে বসবে নাকি? কী দরকার? বাত তো ঠিক হ্যায়! দরকার আর কী? কোনও দরকারই নেই। লেখক বা শিল্পীর ব্যাকগ্রাউন্ড বা মনোচিন্তা জেনে নেওয়ার বা বুঝে নেওয়ার তেমন কোনও দরকার নেই, যা বোঝা যায় বা অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় তা পড়লে বা দেখলেই হয়! তবে কিনা মুশকিল হল (ঠিক ভুল আমি বলতে পারব না, সে যোগ্যতা আমার নেই) শিল্প বা সাহিত্যের সমাজ এইভাবে চলে না। লেখকরা পরীক্ষানিরীক্ষা করবে, বাউন্ডারি ভাঙবে, চেনাছকের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আর দর্শন বাক্য আর সংলাপের আড়ালে লুকিয়ে রাখবে, এটাই দস্তুর। সেটা যদি খানিকটা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ইচ্ছে হয়, তাহলে ওইটুকু কাজ করতে হয়। এখন আমি ম্যাঙ্গো রিডার, গম্ভীর সাহিত্য পড়ে আমার পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়নি। তাই আমার পাঠ অভিজ্ঞতাও  যে খুব মসৃণ হবে এসব ক্ষেত্রে তা নয়, তবে কিনা আমার আগ্রহটুকু খাঁটি। আমি সেই রসনাবিলাসীর মতো, আলুর চপ কাবাব পরোটা ফুচকা বিরিয়ানির জগতে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু ক্যাভিয়ার বা ব্লু চিজ পাতে পড়লে যদি প্রথম স্বাদে ভালো নাও লাগে, আমি তবু তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করার চেষ্টা চালিয়ে যাই।

এইসব বাদ দিয়ে জানাই, হোমওয়ার্ক করে জানতে পারলাম নর্মান এরিকসন পাসারিবু আসলে ইন্দোনেশিয়ার  তোবা বাতাক ক্যাথোলিক কৃশ্চান গোষ্ঠীর মানুষ, এবং সমকামী। মূলত কবি, কিন্তু তিনি বাইরে নাম করেছেন ছোটগল্পকার হিসেবেই। কিন্তু আসল কথা হল, পাসারিবু কুইয়ার সাহিত্যের একটা নতুন দিক আবিষ্কার করেছেন আর সেটা এমন চমৎকার ভাবে করেছেন যে স্পেকুলেটিভ কিংবা নন স্পেকুলেটিভ, দুই ঘরানা দিয়েই তার গল্পের ব্যাখা করা চলতে পারে। নর্ম্যানের লেখা সরল রেখায় চলে না, ছত্রে ছত্রে অব্যক্ত কথা আর সমকামী জীবনের যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে (ইন্দোনেশিয়ায় সমকামী সম্পর্কের আইন ধর্ম, সংস্কৃতি আর আধুনিক সমাজের বিবর্তন এর মাঝে আটকে গেছে, হাজার রকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে) চরিত্রদের জীবন কাটাকুটি করে যায় একে অপরের সঙ্গে। নর্ম্যান ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই অদৃশ্য ট্যাপেস্ট্রি, এমন এক বিশাল জাল বুনেছেন তাঁর লেখায়, কারণ তিনি চান তাঁর প্রতিটা লেখাই একাধিকবার পাঠ করা হোক। পাঠকের কাছে এই মনযোগটুকু তিনি প্রত্যাশা করেন।

এইসব পড়ে আমি আবার হ্যাপি স্টোরিজ (ওয়েল, অলমোস্ট)-এ ঝাঁপ মারলাম, আর ধীরে ধীরে এই গল্পগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিয়ে ধরা দিল। ধীরে ধীরে মানে আক্ষরিক অর্থেই ধীরে, কারণ তিন চার মাস ধরে প্রায় প্রতিটা গল্পই আমাকে একাধিক বার পড়তে হয়েছে, কিছু কিছু তো চারপাঁচ পড়েও পুরোপুরি ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবে কিনা নর্ম্যান যে ঝানু লেখক, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকার অবকাশ রইল না। এই পাতলা বইটায় বারোটা গল্প আছে, একশো চল্লিশ পাতা। তবে তাই বলে যদি গল্প প্রতি বারো পাতা ধরে নেওয়া হয়, সেটা ভুল হয়ে যাবে। কারণ, বইটার রেঞ্জ সাধারণ ছোটগল্পের বইয়ের চেয়ে বেশি। প্রথম গল্পটা একটা অণুগল্প মাত্র।

যে কথাটা হ্যাপি স্টোরিজ নিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা হল, এগুলো মোটেও হ্যাপি নয়। ট্রাজিকমিক বলা হয়তো যেতে পারে। টিফানি শাও ইন্ডোনেশিয়ান ভাষার ওয়ার্ড প্লে পুরোপুরি ধরতে পারেননি স্বাভাবিক কারণেই, কিন্তু নর্ম্যান এর ইঙ্গিত শুনে বোঝাই যায়, গল্পগুলো আসলে কাঁটা বিধে থাকা একটা হৃদয় থেকে উঠে এসেছে। 

"Indonesian word “hampir,” means “almost.” As “hampir” is only a letter away from “vampir,” the bloodsucking demon. Tell me, what does it mean to be happy? In a world where we celebrate disneyfied heterosexualities, for queer folks, what is happiness? Often, it becomes the bloodsucking demon, the vampir, the hampir.”

এই বারোটি গল্পের নাম দেখুন:

1) Enkidu Comes Knocking on New Year’s Eve 
2) A Bedtime Story for Your Long Sleep
3) What's your name Sandra?
4) A Young Poet’s Guide to Surviving a Broken Heart
5) The true story of the story of giant
6) Three Love You, Four Despise You
7) Metaxu: Jakarta, 2038
8) Deep Brown, Verging on Black
9) Welcome to the Department of Unanswered Prayers
10) Ad maiorem dei gloriam
11) Our Descendants Will Be as Numerous as the Clouds in the Sky
12) Her Story

কোথাও ডার্ক, কোথাও বিষণ্ণ, কোথাও আবার অভিনব! হেট্রোনর্ম্যাটিভ ফিকশনের আনাচেকানাচে নর্ম্যান আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার জীবনযাত্রাকে যেমন ছুঁয়ে গেছেন, সেখানকার নতুন প্রজন্মের আশা আকাঙ্খা অবসন্নতা ও অসহায়তাকে চিহ্নিত করেছেন, বয়স্কদের জীবনের জটিলটাও তুলে ধরেছেন একটু একটু করে। কোমল হাতে লেখা গল্পগুলো তাদের চরিত্রদের নিয়ে সমব্যাথী, টেন্ডার, কিন্তু এই এম্প্যাথি তাদের জীবনের ঘোরতর বাস্তবকে বদলাতে পারে না। গল্পগুলো মূলত কিউয়ার বটে, যদিও বৈচিত্র্যময়। অ্যাপোক্লিপ্টিক সাই ফাই থেকে চিত্রগুপ্তের দপ্তর, কিছুরই অভাব নেই। 

যতবার পড়ি, নতুন কিছু ধরা পড়ে। প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছি ভাবছি, শেষ গল্পে গিয়ে আমি প্রায় ভূত দেখার মতো করে আবিষ্কার করলাম, আসলে বইটার প্রতিটা গল্পই ইন্টারকানেক্টেড। প্রতিটা মেটাফরের একটা সুদূরপ্রসারী বক্তব্য আছে। প্রতিটা প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ।

মাথায় পোকা নাড়তে আবার গল্পগুলো নাড়াচাড়া শুরু করলাম আর বুঝতে পারলাম, লেখক আমাকে কী বোকাই না বানিয়েছেন! এটা ছোটগল্প সংকলন না উপন্যাস? কালচারাল হিস্ট্রি না ম্যাজিকাল রিয়ালিজম? সাইফাই না সাধাসিধে কুইয়ার সামাজিক গল্প? আরো একটু খোঁজ চালিয়ে বুঝলাম, গল্পের অর্ধেক চরিত্র বাস্তব আর লেখকের আগের বইয়ের সঙ্গেও এই বইয়ের একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে। নর্ম্যান আসলে পাঠকদের সামনে একটা বৃহত্তর গল্পের ইশারা ছেড়ে রেখেছেন, পাঠক সেই ইশারা বুঝে গল্পটা কমপ্লিট করতে পারলে চোখের সামনে একটা অন্য দুনিয়া খুলে যাবে।

চারমাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে আমি ক্ষান্ত দিয়ে লেখকের উদ্দেশে সেলাম ঠুকলাম। যদি বছরে কয়েকশো বই পড়ার টার্গেট না থাকে আর একটা গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারবার পড়তে গেলে আপনার অসুবিধা হয় না, এই বইটা মিস করবেন না।

টিল্টেড অ্যাক্সিস প্রেস
৯৪১/-

মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লাস্ট চিলড্রেন অফ টোকিও

 



জাপানে গত কয়েক বছর ধরে 'স্লাইস অফ লাইফ' বইয়ের বন্যা বয়ে গেছে। এই বেড়াল আর কফিশপ সর্বস্ব ফিলগুড বইগুলো এমন হিট হয়েছে যে বই বেরোনোর আগেই কুড়িটা ভাষায় অনুবাদের সত্ব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর বেরোতে বা বেরোতেই লোকে হামলে পড়ে কিনছে। প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে বেড়ালের ছবি, বইয়ের দোকানে বেড়াল, কফির দোকানে বেড়ালে, সুসি শপে বেড়াল, স্কুলে বেড়াল, অতীত বা ভবিষ্যতে বেড়াল, গোয়েন্দা বেড়াল, লাভগুরু বেড়াল, দার্শনিক বেড়াল, থেরাপিস্ট বেড়াল... বিল্লির দাপটে জাপানিজ সাহিত্য হুড়মুড়িয়ে ক্লাউড নাইনে উঠে গেছে। মাংগা, অ্যানিমে, ক্রাইম, লাভ স্টোরি, কামিং অফ এজ... সব বইই দেখি হিট। তাতে বেড়াল বা স্লাইস অফ লাইফ এলিমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা বই হিট হতেই একদম ফ্র‍্যাঞ্চাইজি খুলে চারটে বই আরো চলে আসে। বিল্লিই এখন দুনিয়ার সবচেয়ে ট্রেন্ডিং প্রাণী, ভরসাযোগ্যও। 

ভুল ভাববেন না, আমি বিল্লি ম্যানিয়ার বিরোধিতা করছি না, স্লাইস অফ লাইফ বই পড়তেও আমার দিব্যি লাগে। খুব শাটল ভাবে সিরিয়াস কথা বলে দেয়, ছিমছাম প্রেম বা বিয়োগের গল্পে লাইফ লেসন দিয়ে দেয়, বেশ কিছু লেখক লেখিকা এই জনরায় এমন হাত পাকিয়ে ফেলেছে যে তাদের আর অগ্রাহ্য করার উপায় নেই৷ পাতলা পাতলা বই, ঝরঝরে অনুবাদ, দু এক সিটিংয়েই শেষ। পড়েও ভালো লাগে। কিন্তু এই স্লাইস অফ লাইফের ঠেলায় জাপানের সমকালীন সিরিয়াস লেখকরা বাজারে এমন কোণঠাসা হয়েছেন যে বলার নয়। অথচ জাপানে চিরকাল সিরিয়াস লেখালিখি হয়েছে, হচ্ছেও। কাওয়াবাতা, সোসেকি, মিশিমোর কথা ছেড়েই দিলাম, য়োকো ওগাওয়া, কেঞ্জাবুরো ওয়ে, ইশিগুরো বা ইয়াশিমোতো তো সমকালীন লেখকদের মধ্যেই পড়বেন। (মুরাকামি প্রভৃতিদের কথা ধরছিই না, স্টার লেখকদের টেনে লাভ নেই)

ইয়োকো তাওয়াদার মতো কিছু কলম আছে, তারা এই রেসের উর্ধ্বে, ব্রকবাস্টার হওয়ার হিড়িকের বাইরে। তাঁর লেখা 'হোয়্যার ইউরোপ বিগিনস' পড়ে আমি লিখেছিলাম, তাওয়াদার লেখায় একটা 'জার্নি' আছে। তিনি বলেছেন, 'দ্যাট লাইজ ইন দ্য ইন বিটউইন'... লেখা বয়ে যায়, চরিত্র বয়ে যায়, সময় বয়ে যায়। কিছুই স্থির নেই। গল্পও স্থির নেই। গল্পের আউটলাইনও স্থির নেই, তাও বয়ে চলেছে। এই ধারাপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে আসলে গল্প কোথায়, অধিকাংশ পাঠক তা খুঁজেই পায় না। তাঁর প্রায় প্রতিটা বইই আলোচিত, কয়েকটা পুরস্কৃতও, কিন্তু গুডরিডসের পাঠকরা বিরক্তি জানান দিতে ইতস্তত করে না। বইয়ের পাহাড় যখন পাঠককে চাপা দিতে চাইছে, তখন থ্রি স্টার রেটিং বই কেন কেউ পড়বে? কূট প্রশ্ন বটে!

কিন্তু, কয়েকজন থাকে, যাদের স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। তাওয়াদাকে নিয়ে আমার একটা ভালো লাগা আছে। এই ছোট্ট বইটা পড়তে গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি ঠিক তাই। গল্প যে কোথায়, গল্পের ক্রাইসিস যে কী, গল্পের প্রেক্ষাপট বা আবহ কী, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! একটা ভবিষ্যতের দুনিয়ার কথা হচ্ছে বটে, তা সেটা ভালো না মন্দ, ডিস্টোপিক বা ইউটোপিক, আমুদে বা বিষণ্ণ, কিছুই 'স্থিরভাবে' বলা যায় না। একবার মনে হয়, কী ডিস্টোপিক ব্যাপার রে ভাই! পরের প্যারায় গিয়ে ভাবি, বাহ, এমনটাই তো হওয়া দরকার, বেশ ফিলগুড ব্যাপার মনে হচ্ছে। 

এই করতে করতে এক বুড়ো থুত্থুড়ে মানুষের একশো পনেরো বছরের জীবনের আগেপিছে ঘুরে বেড়াই, টোকিওর মানুষের জীবন অনুভব করি। চাষবাস, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞানের গলিতে টহল দিই বুড়ো ইয়োশিরোর সঙ্গে! কখনও তার নিজের কথায়, কখনও তার নাতির ছেলের কথায়, কখনও আবার তাদের শিক্ষক বা সহপাঠীর মন বুঝতে চেষ্টা করি। কত কথা উড়ে যায় কত কথা মুছে যায়, কত কথা মন ছুয়ে রিদয়ে হারায় ... কত কথা হল বলা কত কথা তবু বাকি...

...করতে করতে একসময় বই শেষ। ভোম্বলের মতো ভাবি, কী হল? কী ছিল গল্পে? কী পড়লামটা কী? হেঁশোরামের দুনিয়া না কল্পনার উড়ান? হলটা কী? তারপর মন শান্ত হলে বোঝা যায়, গল্প তো তাওয়াদা বলে দিয়েছেন। সবটাই বলেছেন, যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে। চরিত্র, প্রেক্ষাপট, ক্রাইসিস, পরিণাম... সবই তো যথাযথ, পরিমিত! কিন্তু কখন বলেছেন বুঝতে পারিনি! যে লাইনে তিনি গল্পটা বলেছিলেন, সেই লাইনে আমি শুধু সেই লাইনের গল্প নিয়েই মজে ছিলাম, আগেপিছু কিছুই ভাবিনি। এই অবস্থাটা তিষ্ঠোলে একটা সুখানুভূতি হয়। তখন মনে হয়, একটা ভালো কিছু পড়লাম। বেশ আরাম হয়!

এইটুকুই। বাকি গল্প বলার আর দরকার নেই। এই বই পড়তে হলে শুধু পড়ার আনন্দের জন্যই পড়ুন, ভালো বই বা ভালো গল্প পড়ব বলে শুরু করলে হতাশ হতে হবে।


সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য লস্ট স্টেপস

 


ঠিক সময়ের আগে অনেক কিছু হাতে এলে ভালো মতো অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় না, সে আমি নিজের অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। তাতে অধৈর্য হওয়া বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বরং নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সময় দেওয়াই ভালো। আমার এক পরিচিত ব্যাঙ্গালোরিয়ান ভদ্রলোক ভীষণ 'পড়াকু' মানুষ, তিনি প্রায় ষাট বছর বয়সে এসে 'উলিসিস' পড়তে শুরু করেছেন, কষ্ট করে হলেও বইটা শেষ করেছেন এবং আপাতত ফের রি-রিড করার তাল করছেন।

এইসব বেতাল কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, আমি আলেহো কার্পেন্টারের (কার্পেন্তিয়ারই উচ্চারণ বটে, আমার হাতুড়ে জিভে ভুল বলে বলে কার্পেন্টারটাই ছেপে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড ) লেখা যেটুকু পড়েছি, তা বাংলাতেই। লাতিন আমেরিকান উপন্যাস সংগ্রহে দুটো নভেলা পড়ার পর আমার আর কিছু পড়ার ইচ্ছে হয়নি, বা বলা ভালো আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কার্পেন্টার পড়ার সময় আমার হয়নি। এতদিন পর পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিক সিরিজে হিস্প্যানিক ক্লাসিকগুলো নতুন করে অনুবাদ করা হচ্ছে দেখে নড়েচড়ে বসলাম, কিন্তু কার্পেন্টারের দুটো বই নিয়ে আমার উৎসাহ জাগানোর প্রধান কারণ অনুবাদক অ্যাড্রিয়ান নাথান ওয়েস্ট। বেঞ্জামিন লাবাতুতের দুটো অসামান্য বই তিনি যতটা সাবলীল ভাবে, বা বলা যায় 'স্মার্টলি' ইংরেজিতে নিয়ে এসেছেন, তাতে আমার মনে হয়েছিল ইনি অন্য জাতের অনুবাদক। মূল ভাষার মনন ও শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখেও তিনি অন্য ভাষায় মূলানুগ অনুবাদ করতে পারেন, কিন্তু সেই অনুবাদ পড়ে কখনও 'কী হচ্ছেটা কী?' বলে হোঁচট খেতে হয় না। 

তা আলেহো কার্পেন্টারের যে দুটি বই ওয়েস্ট অনুবাদ করেছেন, তা হল 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' আর 'এক্সপ্লোজন ইন আ ক্যাথেড্রাল'। আমি প্রথমটা পড়েছি, আর দ্বিতীয়টা শুরু করেছি। এবার ভাবছি মাঝে কয়েকদিন ব্রেক নিয়ে দু একটা অন্য জিনিস পড়ে ফেলব, তার মাঝে এই পোস্টটা করে রাখলে আবার ধরতে সুবিধা হবে। 

প্রথমে, ওয়েস্টবাবুর অনুবাদের কথাই বলতে হয়। এমন 'ভীষণ' গদ্যের অনুবাদ করতে হলে যে ধরনের সাহস আর দক্ষতা লাগে, তা সকলের থাকে না বলাই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে, আমার বাংলা অনুবাদগুলো ঠিক জমেনি, সে আমার ব্যর্থতা (আমি দ্য চেজ নভেলাটা পড়ে বাংলাটা--মৃগয়া--আবার খানিকটা পড়লাম) দুটো ভাষার সেমান্টিকসে আর রিডিং স্টাইলে স্ট্রাকচারাল ডিফারেন্স আছে। একটা টানা চার পাতার বাক্য বাংলায় একইভাবে না ভেঙে অনুবাদ করে দেওয়াই যায়, এবং শৈলী বজায় রাখাতে সেটা করাই সমীচীন (আজকাল গৃহীতও)। কিন্তু সেই চারপাতা দীর্ঘ বাক্যটা ঠিক কীভাবে অনুবাদ করলে পড়া যাবে বা পড়তে সুবিধা হবে, সেটা ঠিক করা যথেষ্ট চাপের কাজ। একটা এক লাইনের বাক্য চার ভাবে লেখা যায়, সেখানে একটা চার পাতার বাক্য চারশো ভাবে লেখা যেতে পারে। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, এবং সর্বোপরি সাবলীল পাঠ, সব কিছুতেই সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে কিঞ্চিত বদল ঘটাতেই হয় ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্য! 

তারপর কার্পেন্টারের লেখা যাকে বলে 'ডেন্স রেনফরেস্ট, এত 'সঘন' ভাষা, সেই সঘনতার সুবাস বজায় রেখে অনুবাদ করা মুখের কথা নয়। আগে যিনি 'দ্য লস্ট স্টেপ্স' ইংরেজিতে করেছিলেন, তিনি বোধগম্য করতে চেয়ে একটু বেশিই স্বাধীনতা নিয়েছিলেন বলে ভূমিকাতে পড়লাম, 'এক্সপ্লোজান ইন আ ক্যাথেড্রাল' তো মূল স্প্যানিশ থেকে করাই হয়নি, হয়েছিল ফ্রেঞ্চ থেকে। এহেন, বাংলায় এরকম লেখা তুলে আনা যে সহজ নয়, সেটা বোঝাই যায়। তবে এই ক্লাসিকগুলো বাংলায় নিয়ে আসার জন্য যে সদিচ্ছা আর পরিশ্রম করা হয়েছিল, তাতে অসংখ্য পাঠক লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে জেনেছে। সেই সৎ চেষ্টাকে হাই স্যালিউট জানিয়েই বলি, যুগে যুগে ক্লাসিকের নতুন করে অনুবাদ হওয়াটাই দরকার, কাম্যও। 

সেইদিন থেকে দেখতে হলে ওয়েস্টবাবুর অনুবাদ দশে এগারো পাবে। একবারের জন্যও মনে হয়নি, কোথাও একচুলের জন্য অনুবাদকের মনোনিবেশ হারিয়েছেন। আমি পাশাপাশি আগের ইংরেজি অনুবাদ আর নতুন ইংরেজি অনুবাদ রেখে (সঙ্গে স্যাম্পল বাংলা অনুবাদ) দেখেছি, কার্পেন্টার পড়তে হলে সম্ভবত এই নতুন এডিশনটাই বেস্ট।

এইবার বইয়ের কথায়। বিশেষ কিছু বলার নেই, বা বলা উচিত আমার বলার যোগ্যতা নেই। নেই নেই করে বেশ কিছু বইপত্র তো এতদিনে পড়লাম, কার্পেন্টারের মতো 'ভয়ংকর সুন্দর' গদ্য আমি আর দেখিনি। একদম সম্মোহনী নাগপাশের মতো পাঠকের গলা আঁকড়ে ধরে, কিন্তু সেই আলিঙ্গন ছেড়ে বেরোতে আর ইচ্ছে করে না। কার্পেন্টারের এই অ্যালেগরিক কাহিনির স্তরে স্তরে অসংখ্য কাহিনি, কালচারার রেফারেন্স আর দর্শন থইথই করছে। এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রের খোঁজে আমাজনের প্রায় হারিয়ে যাওয়া উপজাতিদের সন্ধান করার এই কাহিনি আসলে হারিয়ে যাওয়া সময়কেও খুঁজে চলে। ঘোর বর্ষায়, বর্ষণসিক্ত বনের অন্ধকারে থাকা উপজাতি জীবনের কোলে বসে গৃহযুদ্ধ আর রাজনীতির ঘটনা বাষ্পের মতো ধোঁয়া হয়ে যেতে থাকে।

I asked myself whether, in bygone days, men had longed for bygone days as I, this summer morning, longed for certain ways of life that man had lost forever.

কার্পেন্টার নিজে দক্ষ মিউজিশিয়ান। তাঁর সব লেখাতেই একটা সঙ্গীতের দর্শন থাকে, কিন্তু তাঁর গদ্যও যেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মিউজিকাল কম্পোজিশন। তবে আমার দৃঢ় ধারণা, স্প্যানিশকে হাতিয়ার করে তিনি তাঁর কলমকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, অন্য ভাষায় সম্ভবত তা হত না। ধরা যাক একটা নৌকো, সেই নৌকার বিভিন্ন অংশের একশো পঞ্চাশটা নাম থাকতে পারে, বৈঠা চালানোর ফলে ক্ষয়ে গিয়ে যে একটা হালকা দাগ পড়ে, তার জন্যও একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে, একটা ফাটলের মধ্যে কাঠের ঘষা লেগে আঁচড় লাগলে তার জন্যও একটা শব্দ লিখে ফেলেছেন, এই সমস্ত শব্দের চোদ্দ আনা শব্দ অন্য ভাষাতে নেইই। (ইংরেজিতে ম্যাক্সিমামই আছে) কার্পেন্টারের লেখার মধ্যে একটা অণুবীক্ষণ আছে, প্রকৃতি আর সমাজের ওপর তাঁর মাইক্রোস্পিক দৃষ্টির পরিণামস্বরূপ যে সমস্ত খুঁটিনাটি গদ্যে উঠে এসেছে, অধিকাংশ ভাষায় সেই ডিটেলিংকে ব্যক্ত করার উপায়ই নেই। 

'এক্সপ্লোজান্স ইন আ ক্যাথেড্রাল' এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক আলেহান্দ্রো চাম্ব্রাস বলেছেন, ছোটবেলায় প্রথম ক্লাসে কার্পেন্টারের একটা ছোটগল্প পড়ানো হয়েছিল, তারপর হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছিল অজানা শব্দের মানে ডিকশিনারি দেখে খুঁজে বার করে আনতে। সেই দশ পনেরোটা শব্দের নমুনাও তিনি দিয়েছেন, পড়ে দেখলাম আমি একটারও মানে জানি না। এমনকি, প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পরেও গুগলে সেই শব্দ টাইপ করলে শুধু ৫০% শব্দেরই মানে আসছে, বাকি গুগল বাবাও হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন। এই তো অবস্থা! 

চাম্ব্রাস আরো বলেছেন, কার্পেন্টার পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে, আপনি একটা অসম্ভব সুরেলা কম্পোজিশন শুনছেন, যা আসলে আপনারই ভাষা, কিন্তু আবার আপনার ভাষা নয়ও। কিন্তু এই গদ্যের সঙ্গীত আর রহস্যে ততোক্ষণে আপনি এমন মজে গেছেন, এমন ভাবে সম্মোহিত হয়েছেন যে আর আসন ছেড়ে উঠতে পারছেন না। এটাই হল আসল কথা, এত সুন্দর আর সহজ ভাবে কার্পেন্টারকে আর কেউ বোঝাতে পারবে বলে মনে হয় না। কার্পেন্টার-এর ভক্ত হলে এই নতুন দুটো অনুবাদ একেবারেই মাস্ট রিড। 

দ্য লস্ট স্টেপ্স
পেঙ্গুইন ক্লাসিকস


শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইউরি হেরেরার মেক্সিকো ট্রিলজি

 


পনেরো সেপ্টেম্বর থেকে পনেরো অক্টোবার হিস্প্যানিক হেরিটেজ মান্থ সেলিব্রেট করা হয়। তাই আমিও এই সুযোগে স্প্যানিশ সাহিত্যে একটু সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি, বেশিরভাগই হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছি। 


আপাতত মেক্সিকোতে মুখ তুলেছি। সমকালীন মেক্সিকোর সাহিত্যিকদের মধ্যে ইউরি হেরেরা ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন বললে (অন্তত ইংরেজি অনুবাদে) বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন, পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশায় আছেন, আর মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর সমাজকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন। তাঁর যে তিনটে বই নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে, সেটা আসলে একটা ট্রিলজিই। নেমলেস মেক্সিকো ট্রিলজি বলা যায়। এই তিনটে বই যথাক্রমে কিংডম কনস, দ্য ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ বডিজ আর সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। প্রতিটাই আসলে নভেলার সাইজ, মেরেকেটে একশো পাতা, কিন্তু ইম্প্যাক্ট তাই বলে কম নয়। মজার কথা, ইংরেজিতে আগে তিন নম্বর বইটা এসেছে, তারপর দুই, তারপর এক। পরে অবশ্য তিনটেই একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে, আপাতত আমি দুই আর তিনই পড়েছি।


প্রথমে সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড এর কথা বলা যাক। এই বইটা বেস্ট ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত সেই পুরস্কারটাই উঠে গেছে। কিন্তু এমন একটা বই অনুবাদ করা যে ভীষণ চাপের কাজ সেটা আমি ইংরেজিতে পড়তে গিয়েও বুঝতে পেরেছি। তার প্রধান কারণ, হেরেরা মেক্সিকোর গল্প বলেন মেক্সিকোর নাম না নিয়ে, বরং তিনি 'মেক্সিকো', 'আমেরিকা', 'স্প্যানিশ', 'ইংরেজি' কোনও শব্দই ব্যবহার করেন না, ফলে প্রতিটা বইতেই একটা অ্যাপোক্লিপ্টিক নুয়া গল্পের মেজাজ আছে, অথচ, এই দুনিয়াটা এতটাই বেশি বাস্তব যে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। নাম ব্যবহার না করলেও হেরেরা স্থানবিশেষের ডায়ালেক্ট, স্ল্যাং, কলোকিউয়ালিজম, কালচারাল এমবেডেড রেফারেন্স একদম নিঁখুতভাবে বজায় রাখেন, প্রয়োজনে ডিকশনারিতে না থাকা কিন্তু মুখে মুখে প্রচলিত নতুন শব্দ--- নিওলজিসম?-- ব্যবহার করতেও পিছপা হন না। বোঝাই যাচ্ছে এত কিছু নিয়ে ইংরেজি অনুবাদে সোর্স কন্টেন্টের শৈলী আর উপস্থাপনা বজায় রাখা কঠিন কাজ। এর চেয়েও বড় সমস্যা, হেরেরার গল্পে একটা অ্যাজটেক মাইথলজির চোরা রেফারেন্স থাকে। ঠিকঠাক ভাবে অনুবাদ না হলে সেটা কোনও ক্রিটিকই ধরতে পারবে না।


'সাইন্স...' বইটা মূলত একটা বর্ডার ক্রসিং এর গল্প। মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় একজন মেয়ে (মাকিনা) তার ভাইকে খুঁজতে আসছে বর্ডার ক্রসিং মাফিয়াদের সাহায্য নিয়ে, কারণ ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। (ভাই এসেছিল সেখানে একটা পূর্বপুরুষদের থাকা জমি ক্লেম করতে; মেক্সিকো ইউ এস সীমানায় বহু মানুষ এই জন্য সীমানা ক্রস করে) এইবার এখানে মেক্সিকোও নেই, ইউ এস ও নেই, কিন্তু বেআইনিভাবে সীমানা অতিক্রম করার আগে, করার সময় বা করার পর কী কী হতে পারে তার সবটাই আছে। কিন্তু আসলে গোটাটাই অ্যাজটেক মিথের একটা গল্প, যেখানে Quetzalcoatl পাতালে বা মৃতদের দুনিয়ায় নেমে যায় পূর্বপুরুষদের অস্থি ফেরত দিয়ে মনুষ্যত্বকে রিস্টোর করতে। মাকিনা আসলে এই গল্পে Quetzalcoatl, সে ওই মায়াদের নায়কের মতোই তিনটে ভাষা জানে (মাতৃভাষা, মৃতদের ভাষা, জীবিতদের ভাষা...মানে নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ, স্প্যানিশ আর ইংরেজি) মৃতদের রাজা Mictlantecuhtli তাকে পাতালে আটকে রাখার জন্য একটা ফাঁদ পাতে, যা দেখা যায় মাকিনার ক্ষেত্রেও। পাতালে গিয়ে সে এমন সব জিনিস দেখে, যা আগে সে দেখেনি কিন্তু মৃতদের দুনিয়াত তা সাধারণ ব্যাপার। মাকিনাও ইউএসে এসে তুষারপাত দেখে, আগে সে কখনও বরফ পড়তে দেখেনি।


"...and when it dissolved a few seconds later she wondered how it was that some things in the world -- some countries, some people -- could seem eternal when everything was actually like that miniature ice palace: one-of-a-kind, precious, fragile."


এরকম ছোট ছোট প্রতীকী ব্যাপার বইজুড়ে ছড়ানো আছে, অনুবাদে তার সবটা বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব, যদি মেক্সিকোর লোককথা, সমাহ আর অ্যাজটেক মিথের সঙ্গে পরিচয় না থাকে। ইংরেজিতেই যে ধরনের পোয়েটিক ভাষ্য দেখলাম, স্প্যানিশে পড়লে লোকে মুগ্ধ হত সন্দেহ নেই। প্রেক্ষাপট ভীষণ ভাবে বাস্তব, আর হয়তো সেই কারণেই সবটা না বুঝলেও এই বইটা অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।


দ্বিতীয় বই 'দ্য ট্রান্সাইগ্রেশন অফ বডিজ' নিয়ে তেমন বলা যাবে না, ওটা আরো বেশি আনঅ্যাক্সেসিবল গল্প। কোনও কাব্য ফাব্য নেই, ঘোরতত ডার্ক ন্যারেটিভ। মেক্সিকো শহরে মহামারি শুরু হয়েছে, সেখানে দুই পরস্পরবিরোধী মাফিয়া গ্যাঙ নিজেদের ছেলেমেয়ে হারিয়ে বসে আছে। দুজনেই সন্দেহ করছে অপরপক্ষ তাদের ছেলে বা মেয়েকে কিডন্যাপ করে খুন করেছে, কিন্তু আসলে তা হয়নি। অথচ ছেলেমেয়ে দুটোই মারা পড়েছে, তাদের লাশ শান্তিপূর্ণ ভাবে হাতবদল করার জন্য এক মধ্যস্থকারী ফিক্সারকে নিয়োগ করা হয়েছে, সে নিজের মতো করে তদন্ত করছে সত্যিটা জানার জন্য। তদন্ত শুনেই লাফিয়ে ওঠার কারণ নেই, এই তদন্ত সেই তদন্ত নয়। বলাবাহুল্য, এখানেও কোনও জায়গায় নাম নেই, মিথলজির মেটাফর আর ভাষার কারুকাজ আছে, কিন্তু গল্প ভীষণ ডার্ক, পড়ে সত্যিই মহামারির মধ্যে চলতে থাকা গ্যাঙওয়ারে ফেঁসে গিয়েছি মনে হবে। লিসা ডিলম্যান হেরেরার নিয়মিত অনুবাদিকা, তিনি এই বইটাও অনুবাদ করেছেন, কিন্তু সাইন্স... এর মতো জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে নয় বলেই হয়তো এই বইটা ততোটা জনপ্রিয় হয়নি। তবে ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ডস এর জন্য শর্টলিস্ট হওয়ার সুবাদে সাহিত্যিক মহলে হেরেরার কাজকর্ম নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, ইতিমধ্যেই এই ট্রিলজি ইউরি হেরেরাকে সবাই মেক্সিকোর প্রথম সারির সাহিত্যিকদের মধ্যে নিয়ে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ইম্পসিবল ক্রিচার্স

 


 আমার বলতে সংকোচ নেই, উনিশ কুড়ি বছর অব্দি আমি নব্বই পার্সেন্ট শিশুকিশোর পাঠ্য বই পড়েই থেকেছি, অন্ততপক্ষে বাংলায়। তাই এখন যখন বেশিরভাগ লেখাই হতাশ করে, সত্যিই মন খারাপ হয়। তারপর আবার শুনি, বয়স বেড়েছে বলেই নাকি ছোটদের লেখা তেমন মন টানছে না। ছোটদের আসলে দিব্যি লাগছে। সেটা হতেই পারে, কিন্তু আমি মাস দুয়েক পর পর 'কালো পর্দার ওদিকে' আর 'টংলিং' তাহলে পড়ছি কেন আর 'ম্যাকেঞ্জি বাংলোয় রাত' বা পেনেটির ভূতের জন্য ইউটিউব খুঁজছি কেন? শুধু পুরোনো অবশ্য নয়, নতুনের মধ্যেও মাঝেমধ্যে দিব্যি লেখা  পাওয়া যায়। আলাদা করে আর নাম নিলাম না। তবে ওই শারদ সংখ্যার প্রকাশের সময় ছাড়া বাকি বছরে কতজন নতুন শিশুকিশোর বই নিয়ে আলোচনা করে আর কতজন সময় নিয়ে একটা ষাট হাজারি ছোটদের উপন্যাস বা নতুন গল্প সংকলন বার করতে চায়, সে কথা আলাদা করে না বললেও চলবে।

একটু ভূমিকা করতেই হল, কারণ এই বইটা ঠিক বড়দের নয়। তবে বড় ছোট মেজো সেজো সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ক্যাথেরিন রুন্ডেলকে লোকে এ যুগের টলকিন বলে ফেলছে। স্টিফেন কিং থেকে নীল গাইমান, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া, দুনিয়া জুড়ে ইম্পসিবল ক্রিচার্সদের নিয়ে মাতামাতি চলছে। এহেন আমি পড়ব না, তা তো চলে না। 

কোনোরকম ঢং না করে বলি, ইম্পসিবল ক্রিচার্স আমার ফাটাফাটি লেগেছে। গল্পে এমন কিছু নতুনত্ব নেই, শিশুসাহিত্যে ম্যাজিকের দুনিয়া দিয়ে দশটার মধ্যে আটটা গল্প লেখা হয় আজকাল। কিন্তু লেখিকা অসম্ভব মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে একটা হাই ভোল্টেজ কোয়েস্ট ড্রামা তৈরি করেছেন, যার সমস্ত সূত্র আসলে লুকিয়ে আছে অসম্ভব মানে ইম্পসিবল সব ক্রিচার্সদের কাছে। তারা কখনও সেন্টুর্স, কখনও গ্রিফিন, কখনও স্ফিংস। যথারীতি চমৎকার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, মজাদার সব চরিত্র, আর স্টেকও বড় কম নয়। নিয়ম মেনেই আন্ডার দ্য লাইন গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে, গল্প মাঝেমধ্যে গম্ভীরও হয়েছে, কিন্তু গতি থমকায়নি একচুল। একদম হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে হয় আর পড়া শেষ হলেও রেশ লেগে থাকে।  কে বলে, বড় হয়ে গেলে ছোটদের বই ভালো লাগে না? (হুঁকোমুখো রাগী বুড়োবুড়িদের ধরছি না, নমস্কার) 

হাইলি রেকামেন্ডেড। বাংলা না জানা অল্পবয়সীদের বই উপহার দিতে হলে এই বইটা পার্ফেক্ট গিফট হতে পারে।

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং

 

বেস্টসেলার সাহিত্য আর বুকার জাতীয় পুরস্কারের বাইরে যারা একটু বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাদের প্রায় অনেকেই একবাক্যে বলছেন, গত পনেরো বছর ধরে আসল কাজ হচ্ছে হিস্প্যানিক সাহিত্যে। লাতিন বুম মার্কা কোনও নাম যে দেওয়া হচ্ছে না, তার বিভিন্ন কারণ আছে।   এখনকার লেখকদেরও আর স্প্যানিশে লেখার জন্য স্পেনে বা লাতিন আমেরিকায় থাকতে হয় না। গ্রান্টা ইমার্জিং হিস্প্যানিক সাহিত্যিকদের একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি জারি করেছিল, তাদের অনেকেই জাপান, আমেরিকা বা ইউরোপে থাকেন। কিন্তু কলম থেমে নেই, আর এদের মধ্যে কয়েকজন এমন ঝড় তুলেছেন যে স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ বহুগুণ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও প্রায় বারো আনা কাজই আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়।

এতসব কথা বলার কারণ, বছর দুয়েক আগে আমি এক লাতিন লেখককে আবিষ্কার করেছিলাম, যার লেখা প্রায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোকের নাম Juan Gabriel Vásquez, থাকেন কোলাম্বিয়ার বোগোতায়, মূলত ঔপন্যাসিক বলেই তাঁর নাম। কোলাম্বিয়ায় তাঁকে নতুন মার্কেজ বলে লাফালাফি হচ্ছে বহুদিন ধরে, কিন্তু ভাস্কেজবাবুর কলম বিলকুল অন্য জাতের। ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, তাঁর বিশেষত্ব হল ট্রাজিক রিয়ালিজম। ভদ্রলোক নিরুত্তাপ স্বরে জানিয়েছেন, "My work is a reaction to the idea of magical realism as the only way to discover Latin America. It's something that still many readers believe. And this is obviously something I strongly oppose. I don't feel Latin America is a magical continent. I feel Latin American history, is if anything, tragedy."

এই জায়গা থেকেই আমি ভাস্কেজকে আবিষ্কার করেছি, কারণ আসল কোলাম্বিয়াকে বোঝার জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য কলমের খোঁজ আমি বহুদিন ধরে চালাচ্ছি। মাকোন্দো নয়, মারিহুয়ানা। আধুনিক কোলাম্বিয়া বলতে যে দেশটার ছবি আমাদের মাথায় ঘোরে, সেখানে কী আছে? এস্কোবার, নারকো ট্রেড, অস্থির রাজনীতি, প্রায় প্রায় গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি, আবার সে সব সামলে আমোদ করার মানসিকতা, ফুটবল আর সাহিত্য প্রীতি, কবিতা নিয়ে উন্মাদনা, পাশাপাশি দুর্নীতি, অপরাধ, অর্গানাইজড ক্রাইম, বোমাবাজি, আমেরিকার সঙ্গে দড়ি টানাটানি... যারা সত্তর আশি নব্বইয়ের দশকে এই দেশে বড় হয়েছেন, তাদের কি কিছু নতুন বলার নেই? এই অস্থিরতা কীভাবে তাদের জীবনকে বদলেছে, সমাজকে বদলেছে, কী করে এই পরিস্থিতি কোলাম্বিয়ার জনমানসকে ভেঙেছে বা গড়েছে? আর শুধু নার্কো ট্রেড কেন, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকের বাস্তব ছবিই বা কতজন জানে? লাতিন দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, উপজাতি বিদ্রোহ, তেল আর গ্যাস নিয়ে রেষারেষি, আমাজনের পরিবেশ বদল ক'টা লেখায় আমরা পড়েছি? অথচ দুনিয়ার লোক মার্কেজকে গুলে খেয়েছে! ভাস্কেজের মতো লেখকদের কলম সেইদিক থেকে দেখতে গেলে কোলাম্বিয়ান সাহিত্যে নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে।

যাই হোক, ভাস্কেজবাবুর বই আজকাল নিয়মিত ইংরেজিতে আসছে। বছরখানেক আগে প্রকাশিত 'রেট্রোস্পেক্টিভ'-ও ভীষণ ভালো রিভিউ পেয়েছে, কিন্তু যে বইটা পড়ে আমি তাঁকে চিনেছি বা দুনিয়া তাঁকে চিনেছে, সেটার নাম 'দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং', এই বইটা আসামাত্র লোকেরা নড়েচড়ে বসেছিল। বইটা ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ড   পাওয়ার আগেও স্প্যানিশে একগাদা পুরস্কার জিতেছে, সে কথা থাক।

এই বইটা কী নিয়ে? এই হল কঠিন প্রশ্ন, কারণ এমন বই আমি আগে পড়িনি। গল্পটা আমি বলেই দিই। আইনের প্রফেসার আন্তোনিও আমাদের প্রোটাগনিস্ট, তার সঙ্গে রিকার্ডো লেভার্ডে বলে এক জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামীর দেখা হয়। তারপর একদিনে রাস্তায় বাইকে সওয়ার দুই আততায়ী এসে তাদের দিকে গুলি ছোঁড়ে, আন্তোনিও বেঁচে গেলেও ভীষণভাবে আহত হয়, রিকার্ডো মারা যান। এদিকে তিন বছর পর যখন আন্তোনিও প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বিয়ে থা করে মেয়ে বউকে নিয়ে সংসার করতে বাধা নেই, তখনও তার মনে সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি ঘুরে বেড়াতে থাকে। কারণ নেই, তবু সে চিন্তা করে যায়। পিটিএসডি বলা যায়, কিন্তু এ আদপে আতংক নয়, বরং কৌতূহল! কেন কেউ রিকার্ডোকে মারল? কী করেছিল সে? জেলে গেছিলই না কেন?

এই অদম্য কৌতূহলের কোনও ব্যাখা নেই, কিন্তু আন্তোনিও সেই খোঁজ চালিয়ে যায়। এই তদন্ত তাঁকে প্রথমে রিকার্ডোর বাড়িওয়ালি, তারপর তার মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। গল্প এমন দিকে ঘোরে, কেউ আন্দাজও করেনি। এক সময় বোঝা যায়, গল্পের মূল চরিত্র বদলে বদলে যাচ্ছে। একটা আপাদমস্তক ক্যারেক্টর ড্রিভেন ন্যারেটিভে কোলাম্বিয়ার তিন দশকের ইতিহাস ঢুকে গেছে। কখনও সে গল্প আন্তোনিওর, কখনও তার মেয়ের, কখনও রিকার্ডো বা তাঁর স্ত্রীর, যখন সত্তরের দশকে তাদের দেখা হয়েছিল। গল্পের সঙ্গে বদলে যায় পারিপার্শ্বিক, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির কথা উঠে আসে গভীরভাবে। দ্রুত গতিতে  বদলে যাওয়া এক দেশ, যেখানকার মানুষের জীবনও বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের চরিত্র, সম্পর্ক, আশা আশঙ্কা। ভাস্কেজের কলম যে দক্ষতায় এই গল্প এগিয়ে নিয়ে গেছে, রিয়ালিজম আর থ্রিলারের আঙ্গিকে গল্প নিয়ে চললেও যেভাবে মাল্টি জেনারেশনাল আইডেন্টিটির জটিলতা তুলে ধরেছেন, তার জবাব নেই। 

দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং... হোয়াট আর দিস থিংস...শুধুমাত্র একটা প্লেন ক্র‍্যাশ নয়, এই পতনের অনুরণন সর্বত্র। একটা রবিনহুডি আপরাধিক সাম্রাজ্যের পতন, একটা প্রজন্মের আশা আকাঙ্খার পতন, সম্পর্ক বা চরিত্রের পতন... এই ভঙ্গুর, ইম্পার্ফেক্ট চরিত্রদের জীবনে সর্বদা একটা 'ফলিং' চলছে। তাদের স্মৃতিতে, তাদের যাপনে, তাদের মননে। কেউ বোঝে না, কেউ যুক্তি খুঁজে পায় না, কিন্তু সব ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে ভিতরে। 

ভাস্কেজবাবুর মেটাফরগুলো এতটাই চমকপ্রদ আর ইমেজারি এতটাই অভিনব যে, ট্রাজিক রিয়ালিজমের মধ্যেও একটা ম্যাজিক চলে আসে। মজার কথা, এক জায়গায় লেখক খোদ হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের প্রথম প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই বইয়ের প্রচ্ছদে একটা মুদ্রণপ্রমাদও রয়ে গিয়েছিল।

একটা গোটা সাইডপ্লট হল ড্রাগ লর্ড এস্কোবারের হুজুগে তৈরি চিড়িয়াখানা নিয়ে, যে চিড়িয়াখানা মেন্টেন করার।লোক নব্বইয়ের দশকে আর নেই। শেষের দিকে একটা দৃশ্যে দেখা যায়, আন্তোনিও আর মায়া (রিকার্ডোর মেয়ে) সেই পরিত্যক্ত চিড়িয়াখানায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা চিতাবাঘ, একটা পাগলা চিম্পাঞ্জি ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। কোথায় সেই গোলাপি ডল্ফিন, ম্যাকাওয়ের ঝাঁক, বাঘ ভাল্লুক! ফিরতি পথে আসার সময় তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটা জলহস্তী, করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। আন্তোনিওর মনে পড়ে যায়, কার্টেল যখন দুর্বল হয়ে এসেছে, ম্যাডালিনের ছাদে ডিইএ পাবলো এস্কোবারকে গুলি করে মেরেছে, তখন একটা জলহস্তী এই চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ তাকে গুলি করা হয়। সেই জলহস্তীই আসলে এই বদলে যাওয়া দেশের বাস্তব। এক মর্মান্তিক ড্রাগ ওয়ারের বিভীষিকার মধ্যেও এই চিড়িয়াখানা ঘিরে কোলাম্বিয়ার ছেলেমেয়েদের যে স্মৃতি, সেই কথার বয়ান পড়তে গেলে মনে হয় আমিও হয়তো বোগোতাতেই ছিলাম।

ইদানীংকালে পড়া বইগুলোর মধ্যে আমি এটা প্রথম সারিতে রেখেছি। মার্কেজের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি কেউ কোলাম্বিয়ার সমকালীন সমাহ আর সাহিত্যকে বুঝতে চান, দিজ ইজ দ্য মাস্ট রিড।

দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ 'জেমস' অ্যান্ড হাকলবেরি ফিন

 


পার্সিভাল এভরেট পোড় খাওয়া লেখক, যা ইচ্ছে হয় তাই নিয়েই লেখেন, কাউকেই ডরান না। তাঁর নতুন বই 'জেমস' আসতে না আসতেই খাস্তা কচুরির মতো সেল্ফ থেকে উড়ে যাচ্ছিল, পাঠক সমালোচক সবাই একদম ফ্ল্যাট। একশোটা দশে দশ রিভিউ হলে একটা হয়তো খারাপ রিভিউ পেয়েছে। আপাতত বইটা বুকারের শর্টলিস্টেও ঢুকে পড়েছে আর অনেকেই মনে করছেন, জিতেও যেতে পারে। 

এসবের মধ্যে ভাবার কথা একটাই, একটা রিটেলিং নিয়ে এত লাফালাফি কেন? 'জেমস' আসলে 'দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ হাকলবেরি ফিন' উপন্যাস এর রিটেলিং, কিন্তু হাকের জায়গায় এখানে পার্স্পেক্টিভ জিমের। এখন যারা মূল বইটা পড়েননি বা ইংরেজিতে পড়েননি বা পড়লেও আমার মতো ভুলে বসেছিলেন, তাদের খানিকটা রিভিজন দেওয়াই ভালো। 

ছোট করে বলতে হলে, হাক বছর দশেকের ছেলে, অ্যাডভেঞ্চার পাগল, তার বন্ধু টম সাওয়ারের সঙ্গে আগেও একাধিক অ্যাডভেঞ্চার করেছে, তার বাবা বেহেড মাতাল আর এই বইয়ে তাকে পুষ্যি নিয়েছিলেন মিসেস ওয়াটসন, যিনি তাকে জোর করে সভ্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলে উঠেপড়ে লেগেছেন, এদিকে হাকের ওইসব ন্যাকাবোকা জীবন মোটেও পছন্দ লয়। সে মারা পড়েছে, এমন একটা নাটক স্টেজ করে পালায়, পথে দেখা জিমের সঙ্গে। জিম, তার বউ আর তার মেয়ে মিস ওয়াটসনের কৃষ্ণাঙ্গ চাকর, মানে কেনা চাকর আর কি, কারণ সে যুগে আমেরিকায় দাসবৃত্তি বেআইনি হয়নি। তাকে আর তার পরিবারকে আলাদা আলাদা জায়গায় বিক্রি করার কথা হচ্ছে দেখে সে পালিয়েছিল, এদিকে হাক মারা পড়েছে ভেবে লোকে ভাবছে জিমই তাকে খুন করেছে। হাক অবশ্য জিমকে বন্ধুই ভাবে। তারপর তারা মিসিসিপি নদী দিয়ে ডিঙি নিয়ে পালায়, পথে একের পর ঘটনা। এই ছিল মোটামুটি গল্প, শেষে হ্যাপি এন্ডিং।

রিভিজন দেওয়ার পর বই শুরু করে দেখি, গল্প হুবহু একইভাবে এগোচ্ছে।  মানে , সিন বাই সিন। এভরেট সেই একই সাউথওয়েস্টার্ন ডায়ালেক্ট আর 'মিসৌরি' নিগ্রো ডায়ালেক্ট বজায় রেখেছেন, কিন্তু এইবার গল্পটা জিম প্রথম পুরুষে বলছে বলে স্বাভাবিক ভাবেই একজন কৃষ্ণাঙ্গ পার্স্পেক্টিভ চলে এসেছে, জিমের ভাবনাচিন্তার কথাও খানিক জানা যায়। প্রচুর ইন্টারটেক্সচুয়াল রেফারেন্স আছে, মার্ক টোয়েনের লেখার সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় না থাকলে সে সব সাধারণ পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। যাই হোক , আমরা জানতে পারি সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে শিখেছে, বইপত্র নিয়ে তার আগ্রহ অসম্ভব বেশি, সে ভোল্টায়ারের অন্ধভক্ত, এতই ভক্ত যে স্বপ্ন দেখলেও বইয়ের চরিত্ররা এসে তার সঙ্গে কথা বলে, ফরাসিতে সংলাপ বলতেও ইতস্তত করে না। কিন্তু গল্প তো একই। এভরেট মূল বইয়ের কাঠামো প্রায় একই রেখেছেন, হাক বা অন্যান্য চরিত্রদের স্বভাবও বদলাননি। আমি স্টোরিটেলে শুনেছি বলে ডায়ালেক্ট বুঝতে বেশ সুবিধাই হয়েছে, পড়তে গেলে সেই স্বাদ পাওয়া যেত না। গল্প হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে হাফ বই শেষ। এদিকে আমি ভাবছি, সব ঠিকই আছে, কিন্তু এই একই গল্প লিখে কী করে এই বই এত নাম করল? 

ঠিক এমন সময়, আমার গালে বিরাশি সিক্কার চড় মেরে, এভরেট স্যার দিকবদল করেন। হাক আর জিম আলাদা হয়ে যায় (মূল বইতেও যা হয়েছিল কয়েকবার) আর এভরেট কামিং অফ এজ কিশোর গল্পকে চার লাফে ডিঙিয়ে জিমকে স্বতন্ত্র অ্যাডভেঞ্চারে পাঠিয়ে দেন। এই জায়গা থেকে গল্প যেভাবে এগিয়েছে, উনবিংশ শতাব্দীর দাসবৃত্তির যে সমস্ত স্যাটারিকাল বর্ণনা আর মর্মান্তিক ঘটনা এসেছে, তাতে বইটার চেহারাই বদলে গেছে। কামিং অফ এজ গল্প থেকে সোজা ডার্ক রিয়ালিটি; অ্যাডভেঞ্চারের গল্প হয়ে ওঠে হত্যা, দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, অবসাদ আর অনুতাপের গল্প! অতীত আর বর্তমানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জিমের যাত্রা এগিয়ে চলে, তার মনের ভিতর তখন আর একটা জিম উঠে দাঁড়ানোর জন্য ছটপট করছে। বইয়ের শেষে জিম একসময় 'জেমস' হয়ে প্রায় ভিজিলান্টে ফ্যাশনে সুপারহিরোর মতো লোকচক্ষুর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।

এভরেট পাঠককে নিশ্বাস ফেলার কোনও সুযোগই দেননি। সোর্স ম্যাটেরিয়াল এত স্ট্রং, সেটাকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করে তিনি সিভিল ওয়ার আর বদলে যাওয়া সময়ের একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলতে চেয়েছেন, যা এতদিন হাকলবেরি ফিনের গল্প পড়ার সময় কেউ মনে রাখেনি। তাই বলে হাকের গল্পে জিমকে হিরো বানিয়ে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তৃতীয় পর্বে এসে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন লেখক। গল্পে হাকের ভূমিকা শুধুই বাচ্চা ছেলের নয়, জিমের গল্পে তার এক বিশেষ জায়গা আছে। সব মিলিয়ে নালিশ করার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। 

প্রায় আড়াইশো পাতার বই। দু-তিন সিটিং এর বেশি লাগার কথা নয়। হাকলবেরি ফিনের ভক্তদের ভালোই লাগবে আশা করি।

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

তুরস্কের মেলাঙ্কলিয়া

 


সাবাহতিন আলির 'ম্যাডোনা ইন আ ফার কোট' টার্কিশ সাহিত্যের ক্লাসিক বলে গণ্য হয়েছে গত তিরিশ বছর আগে। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই বিশেষ বইটা নিয়ে পাঠক আর সমালোচকদের মধ্যে একটা দ্বিধাভাব আছে। কেউ কেউ বলে, একমাত্র দস্তয়ভস্কির 'হোয়াইট নাইটস' ছাড়া কোনও কিছুই এই অসামান্য গল্পের কাছাকাছি যেতে পারে না। বাকিদের মত, এমন মেলোড্রামাটিক কাঁদুনে প্রেম কাহিনিকে ক্লাসিক দূরস্থান, ভালো বই বলাই চলে না। এই দুই দল সত্তর বছর ধরে কুস্তি করছে, পেঙ্গুইন বইটাকে মডার্ন ক্লাসিক হিসেবে প্রকাশ করার পর এই কুস্তোকুস্তি আরো বেড়েছে।

সে যাই হোক, লেখা নিয়ে সংশয় থাকলেও লেখককে নিয়ে প্রায় কারো মনেই সংশয় নেই। এলিফ শাফাক বা ওরহান পামুকের অনেক আগেই যে গুটিকয়েক লেখক টার্কিশ সাহিত্যের মাস্টার স্টোরিটেলার্সের মধ্যে শামিল হয়েছেন, সাবাহতিন আলি তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু শুধু লেখক না, মানুষ হিসেবেও তাঁর জীবন কম রোমাঞ্চকর নয়। অটোমান রাজ্যের শেষ সময়ে বুলগারিয়া তাঁর জন্মস্থান হলেও আধুনিল টার্কি তাঁর কর্মভূমি, রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, দেশ থেকে বেরোনোর জন্য পাসপোর্ট পাননি বলে বেআইনিভাবে পালাতে গিয়ে একজন লোককে নিয়োগ করেন, সেই তাঁকে খুন করে, সে ১৯৪৭ সালের কথা। এমন একজন ঘোর বাস্তববাদী মানুষ 'ম্যাডোনা ইন আ ফার কোট' এর মতো আপাত রোমান্টিক বিষাদে মোড়া প্রেম ও বিরহের গল্প কী করে লিখতে পেরেছেন কেউ বুঝতে পারেনি।

গল্প জটিক কিছুই নয়। বলা যায় গল্পের মধ্যে গল্প। আড়াইজন প্রধান চরিত্র, অনেকটা প্রেম আর আকর্ষণ, বাকিটা একটা দীর্ঘ বিরহ। বিষাদ আর বিরহের দীর্ঘশ্বাস। এই বই পড়তে গেলে প্রথমে মনে হয়, ওই তো একটা লাভ স্টোরি। তারপর মেলানকলিক শীতের মায়াজড়ানো গল্প পড়তে গেলে কখন যে সাদামাঠা প্লটটা নেশায় ফেলে দেয়, বার্লিন আর আঙ্কারার শীতকাল চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কুয়াশা আর তুষারপাত শুরু হয় ঘরের ভিতর বসে, বোঝা যায় না। একসময় পাঠক আবিষ্কার করে, 'তুমি পথ হারাইয়েছ'...তার আর হুঁশ নেই।

যারা এখনও বোকার মতো সত্যিকারের প্রেম ফেম নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, পড়ে ফেলুন।


প্রাবদা ইউনের আশ্চর্য দুনিয়া

 



গত পঁচিশ বছরে যদি কেউ থাইল্যান্ডে থেকে মোটামুটি বইপত্রের ওপর নজর রেখে থাকে, তাহলে প্রাবদা ইউনকে চিনতে না পারা প্রায় অসম্ভব। ২০০০ সালের কাছাকাছি এই তরুণ লেখক থাই সাহিত্যে প্রায় ঝড় তুলে দিয়েছিলেন।

উদ্ভট বিষয়, অসামান্য ওয়ার্ডপ্লে আর ক্রমাগত বদলে যাওয়া ব্যাঙ্ককের শহুরে জীবন নিয়ে প্রাবদা ইউন একের পর এক গল্প লিখেছেন, তার অনেকগুলো থাই পাঠকদের কাছে প্রায় রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে গেছে। মুশকিল হল, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির বাইরের ভাষায় সাহিত্য রচনা হলে সে সব তেমন অনুবাদ হয় না, বা হলেও অনেকসময় সেই অনুবাদে মূল সাহিত্যের ম্যাজিক ধরা পড়ে না। একটা ভাষার সঙ্গে সেই ভাষার সাহিত্যের যে বোঝাপড়া, সেটা অন্য ভাষায় নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। তবুও, বেশ কিছু প্রকাশক অনুবাদক আছেন, তাঁরা চেষ্টা করেন, আর করেন বলেই প্রায় পনেরো বছর পর টিল্টেড অ্যাক্সিস প্রেসে ডেবোরা স্মিথের সম্পাদনায় প্রাবদা ইউনের এই অনবদ্য গল্প সংকলনটা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০০ সালে 'খোয়াম না জা পেন' নামে প্রকাশিত বইটার প্রকাশক ছিল আমারিন পাবলিশার্স, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল বইটাকে যোগ্য স্পেস দেওয়ার, অনুবাদক মুই পুপুকসাকুলের বক্তব্য শুনে তা বোঝাও যায়। থাই ওয়ার্ডপ্লের জাদু ইংরেজিতে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়, কিন্তু মুই পুপুকসাকুল চেষ্টা করেছেন।

এইবার, গল্পের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, প্রাবদা ইউন ঠিক গতানুগতিক গল্পকার নন। তাঁর গল্প নিটোল গল্প নয়, বরং এক একটা গল্প পড়লে তো মনে হয়, আদৌ আমি কী পড়লাম। ভালো, মন্দ না অদ্ভূত, সে সব বুঝতে সময় লাগে! কিছু কিছু গল্প অবশ্য প্রথম পাঠেই ছিটকে দেয়, বইয়ের প্রথম গল্প 'পেন ইন প্যারেন্থেসিস' যেমন। কয়েকটা আবার ঠাঁটিয়ে চড় বা মাথায় গাঁট্টা মারে। আগে গল্পের নামগুলো দেওয়া যাক।

১) পেন ইন প্যারেন্থেসিস
২) এই প্লোয়াং
৩) আ স্কুলগার্লস ডায়েরি
৪) মিস স্পেস
৫) সামথিং ইন দ্য এয়ার
৬) দ্য ডিসঅ্যাপিয়েরেন্স অফ দ্য সি ভ্যাম্পায়ার ইন ব্যাঙ্কক
৭) শ্যালো/ডিপ, থিক/থিন
৮) দ্য শার্প স্লিপার
৯) স্নো ফর মাদার
১০) মারুত বাই দ্য সি
১১) দ্য ক্রাইং পার্টিজ
১২) ফাউন্ড

নামেই বোঝা যাচ্ছে, এসব ঠিক কমন গল্প নয়। 'মিস স্পেস' গল্পটা শুনে মহাকাশ বা স্পেকুলেটিভ মনে হতে পারে, কিন্তু এই গল্পের বিষয়বস্তু হল থাই শব্দের মধ্যে স্পেস দেওয়ার সঙ্গে জীবনযাপনের দর্শনের কী সম্পর্ক! প্রসঙ্গত, থাই ভাষায় শব্দের মাঝে স্পেস ব্যবহার এর চলন নেই, তাতে শব্দ বাক্য বা দুইয়েরই অর্থ বদলে যেতে পারে। 'মারুত বাই দ্য সি' গল্পে মারুত বলছে, "আমি মারুত ফারুত নই আর সি এর ধারে বসার ইচ্ছেও আমার নেই। এ সেই প্রাবদা ব্যাটার কাণ্ড!" বলে লেখকের জীবন আর দর্শকের কন্ট্রাডিকশন নিয়ে পাঠককে জানিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে মারুত।

Don’t waste your precious time with his nonsense. Granted, he might say or do things to amaze you. He might write words that tug on your heart strings. You might find his unusual perspective charming. He might lead you to believe that he has something important to say. But believe me, every single thing that you think you learn from him in fact comes from you yourself. As the Thai expression says, grandma’s treats bought with grandma’s money.

'স্নো ফর মাদার' আরেকটা চমকে দেওয়া গল্প, প্রথম বাক্য শুনেই অবধারিত ভাবে মার্কেজের উপন্যাসের প্রথম লাইনের কথা মনে পড়ে...

Nuan harboured a belief that she had never shared with anyone, not even with Aim, her regular hairdresser with whom she was so close they were practically family, But more than twenty years ago, her only son, Pon, had stormed into her mosquito net, his eight-year-old fists full of grass he had scraped up from the roadside. “Mommy, I brought you snow,” he had announced to her in his little voice and from that day on, Nuan became convinced that if only her beloved son could come into contact with snow, real snow, he might be cured.

'দ্য ক্রাইং পার্টিজ' গল্পে এক দল ছেলেমেয়ে মুঠো মুঠো লঙ্কা চিবিয়ে কান্নাকাটি করার জন্য হাউজ পার্টি করছে, কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় আসলে এই পার্টিতে কেঁদে তারা দুঃখলাঘব করছে, এন্টারটেন হচ্ছে। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই আবার বোঝা যায়, ব্যাপারটা আসলে তা নয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাবদা ইউন নিজের একটা জগত তৈরি করেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সমসাময়িক থাই সাহিত্যের সঙ্গে হাতেখড়ি করতে হলে এই বইটা স্টেপিং স্টোন হিসেবে কাজ করতে পারে। ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারেন।

দ্য প্লেইন্স : গোলকধাঁধার নাম হাইওয়ে

 


জেরাল্ডবাবু জিন্দেগিতে প্লেনে চড়েননি। অস্ট্রেলিয়ার এই লেখক ভিক্টোরিয়া আর মেলবর্ন করেই জীবন কাটিয়ে দিলেন, কিন্তু তাঁর লেখা সাত সমুদ্দুর তেরো নদী ঘুরে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্য নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা হয় না মেনস্ট্রিমে, ইংরেজি লেখক মাত্রেই আমেরিকা আর ইউকের লেখকরা জাঁকিয়ে বসেছেন। এই দূর দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেমন সাহিত্যচর্চা চলছে, পঞ্চাশ বছর আগেও সে খবর বিশেষ কেউ জানত না, এখনও জানে না। মাঝেমধ্যে দু একটা ঢেউ আসে, ওইটুকুই। আমি অন্তত অস্ট্রেলিয়ার লেখকদের লেখা দু চারটের বেশি পড়েছি বলে দাবী করতে পারব না।
এমন সময় দ্য প্লেন্স টাইপ এক একটা বইয়ের খবর আসে, যারা খবর রাখেন তাদের কাছ থেকেই। একশো পাতার বই, চল্লিশ বছর আগে বেরিয়েছিল, ৩০০০০ শব্দেই শেষ। স্যাম্পল পড়ে বুঝলাম বেশ সহজ ইংরেজি বলেই মনে হচ্ছে, দুদিনেই মেরে দেব।
ঘাট হয়েছে জেরাল্ড সাহেব, মাপ করে দাও।
দ্য প্লেন্স এমন একটা ভয়ংকর বই, অস্ট্রেলিয়ার প্লেন্সের মতোই তার চরিত্র। দেখে মনে হয় সবটাই 'প্লেন' কিন্তু আসলে সেখানে যে কত বৈচিত্র্য লুকিয়ে আছে, বোঝা দুষ্কর।
গল্প এক লাইনের। এক ফিল্মমেকার তার স্ক্রিপ্টের রিসার্চ এর জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্লেনস মানে ইনটেরিয়র ল্যান্ডে গেছে, যেখানে হাজার হাজার মাইল প্রায় কিছুই নেই, কারণ অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ জনসংখ্যা থাকে কূলবর্তী শহরগুলোতে। অস্ট্রেলিয়ান প্লেন্স এমন এক অদ্ভুত জায়গা যেখানকার সংস্কৃতি খোদ অস্ট্রেলিয়ার লোকজনও, মায় প্লেন্সের লোকও বুঝতে পারে না। এ এক এমন স্বতন্ত্র জগত, যা বেশি বোঝার চেষ্টা করলে মানুষ খোদ সেই প্লেন্স এর অংশ হয়ে ঘুরে মরে, কিন্তু বোঝা আর শেষ হয় না।
Not a soul in this district knows who I am or what I mean to do here...not one has seen the view of the plains that I am soon to disclose.
বোঝাই যায়, পুরো লেখাটাই অ্যালাগরিকাল। বছরের পর বছর ধরে সেই ফিল্মমেকার প্লেন্স নিয়ে গবেষণা করছে, সেখানকার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে পাতার পর পাতা ভরাচ্ছে, কিন্তু এক দশক পরও তার সিনেমা হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। প্লেন্স নিজেই সেই সমস্ত শিল্প আর জীবনের ল্যান্ডস্কেপ, যা বোঝার কোনো উপায় নেই, কারণ বোঝার জন্য যে ভ্যান্টেজ পয়েন্টে আমাদের যেতে হবে, সেখানে যাওয়ার সাহস আমরা কোনোদিনই অর্জন করতে পারব না। এক জায়গায় লেখক লিখেছেন...
the man who would never take even the one road that led away from his isolated farmhouse for fear that he would not recognise the place if he saw it from the distant vantage that others used.
লেখা সহজ, কিন্তু প্লটফট নেই বলে মাঝেমধ্যে একটু জিরোতে হয়। ল্যান্ডস্কেপের বর্ণনা পড়ে চমৎকার লাগে, তারপর বোঝা যায়, আরে, আসলে লেখক আলাদাই গল্প বলছেন। কয়েক স্তরে গল্প, মানে গল্পহীন গল্প, কে কোনখান থেকে কানেক্ট করবে বলা মুশকিল।
তবে বইটা দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে গিয়ে এমন জটিল আর ডিপ্রেসিং হয়ে উঠেছে যে মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিতে হয়। নিশ্বাস ফেলতে হয়। তিরিশ হাজার শব্দের এই বইটা অনেকে তিরিশ চল্লিশ বার পড়েছে, প্রতিবারই নতুন কিছু অর্থ ধরা পড়েছে। অত সময় আর ধৈর্য দেওয়া আমার কাজ নয়, কিন্তু প্লেন্স যে আসলে মোটেও প্লেন নয়, সেটা বোঝার জন্য বিশেষ বুদ্ধি লাগে না। তবে এটুকু বোঝা গেল, অন্তত দু তিন বার না পড়লে বইটার মর্ম উদ্ধার করা মুশকিল। যারা বিদেশি সাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, পড়ে ফেলুন।

আন্তোনিও লুবো আন্তুনেস: পর্তুগিজ মাস্টার

 

আন্তোনিও লুবো আন্তুনেস এই মুহুর্তে বা বলা যায় গত কুড়ি বছর আগে থেকেই সমসাময়িক পর্তুগিজ লেখকদের মধ্যে লেজেন্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁকে নোবেল দেওয়ার কথাও প্রতি বছরই উঠে থাকে। কিন্তু প্রায় সকলেই একবাক্য বলেন, আন্তুনেসকে অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, একে তো তিনি অন্য কোনও লেখকদের মতোই লেখেন না, হোসে সারামাগো বা ফের্নান্দো পেসোয়ার গদ্যের চেয়ে তাঁর গদ্যের চলন সম্পূর্ণ আলাদা, তার ওপর আন্তুনেসের লেখায় একটা আনঅ্যাপোলজেটিক 'নগ্নতা' আছে। সেই নগ্নতা সাহিত্য এর বেশ ধরে গদ্যকে আবৃত করে রাখে, পর্তুগিজ পাঠক বুঁদ হয়ে এই গদ্যের জাদুতে পড়ে চলে। এক একটা বাক্য চলছে তো চলছেই, এক পাতা দু পাতা চার পাতা, মাঝে মাঝে ছয় সাত পাতা ধরে একটাই বাক্য, কিন্তু ঝানু পাঠক বাদেও আম জনতা নেশায় পড়ে সেই লেখা পড়ছে, কেউ মাঝখান থেকে ছেড়ে দেয় না। ও জিনিস ইংরেজিতে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব, কারণ ভাষার একটা সীমাবদ্ধতা তো থাকেই।
আমার আপাতত অনুবাদ ক্লাসিক পড়ার ফেজ চলছে, তাই আন্তুনেসের এই বইটা আবার নতুন করে অনুবাদ হয়েছে বলে পড়ার ইচ্ছে হল। আরেকটা কারণ, মার্গারেট জুলি কোস্তা ভীষণ ভালো অনুবাদ করেন, সেটা 'দ্য বুক অদ ডিসকোয়াইট' পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম। আগের অনুবাদের সঙ্গে এই অনুবাদের কিছু পার্থক্য তো থাকবেই, মূল লেখার স্বাদও অনেকটা বেশি থাকবে বলেই আন্দাজ করেছিলাম। পড়ে বুঝলাম, আন্দাজটা ঠিকই ছিল।
আন্তুনেসের এই বইটা কোনো উপন্যাস নয়। ভদ্রলোক আর্মিতে ডাক্টার ছিলেন, পর্তুগিজ যখন সত্তরের প্রথম দিকে সালাজারের স্বৈরাচারী শাসনের শেষ পর্যায়ে, আফ্রিকার কলোনিগুলোতে মারামারি চলছে। দেশে বিধ্বস্ত অবস্থা, এদিকে আঙ্গোলার মতো জায়গায় লোকাল রিভোল্ট দমানোর জন্য ছেলেছোকরাদের জুতে দেওয়া হয়েছে, যুদ্ধ শিবিরে পাঠানো হয়েছে আন্তুনেসকেও। সেই দু আড়াই বছরের স্মৃতিচারণাই এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু। বলা যায়, এক দীর্ঘ বিটার, মেলানকলিক মোনোলগ। সমসাময়িক পর্তুগাল আর আঙ্গোলার খুঁটিনাটি জানা যায়, সৈনিকদের মনোস্থিতি ধরা পড়ে, কিন্তু লেখার আসল জায়গা হলে সেই অসামান্য গদ্য, আন্তুনেসের সিগনেচার 'নিউড প্রোজ'। একেবারে মোহগ্রস্ত করে ফেলার ক্ষমতা আছে লেখকের। পুরো লেখাটাই 'তোমাকে' উদ্দেশ্য করা লেখা, সেই শ্রোতার পরিচয় পেতে পেতেই বই শেষ, এবং তার পরিচয়ের বিশেষ কোনও প্রয়োজনও ছিল না। গোটা বই জুড়ে রাগ, বিরক্তি, নস্টালজিয়া আর যুদ্ধের অসহায়তা... ফিলগুড মোমেন্ট একটাও আছে বলে মনে পড়ছে না। আন্তুনেস পরবর্তীতে একের পর এক ক্লাসিক লিখেছেন, সে সবও আশা করি নতুন করে অনুবাদ হবে। কিন্তু তাঁর গদ্যের ম্যাজিক ইংরেজিতে ধরার জন্য জুলি কোস্তা যে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন তাতে কোনও সন্দেহই নেই। প্লটবিহীন লিটারারি মেমোয়ার পড়ার ইচ্ছে হলে চমৎকার বই।