সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আনন্দের গল্প? ওয়েল, নট রিয়েলি
মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দ্য লাস্ট চিলড্রেন অফ টোকিও
...করতে করতে একসময় বই শেষ। ভোম্বলের মতো ভাবি, কী হল? কী ছিল গল্পে? কী পড়লামটা কী? হেঁশোরামের দুনিয়া না কল্পনার উড়ান? হলটা কী? তারপর মন শান্ত হলে বোঝা যায়, গল্প তো তাওয়াদা বলে দিয়েছেন। সবটাই বলেছেন, যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে। চরিত্র, প্রেক্ষাপট, ক্রাইসিস, পরিণাম... সবই তো যথাযথ, পরিমিত! কিন্তু কখন বলেছেন বুঝতে পারিনি! যে লাইনে তিনি গল্পটা বলেছিলেন, সেই লাইনে আমি শুধু সেই লাইনের গল্প নিয়েই মজে ছিলাম, আগেপিছু কিছুই ভাবিনি। এই অবস্থাটা তিষ্ঠোলে একটা সুখানুভূতি হয়। তখন মনে হয়, একটা ভালো কিছু পড়লাম। বেশ আরাম হয়!
সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দ্য লস্ট স্টেপস
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ইউরি হেরেরার মেক্সিকো ট্রিলজি
পনেরো সেপ্টেম্বর থেকে পনেরো অক্টোবার হিস্প্যানিক হেরিটেজ মান্থ সেলিব্রেট করা হয়। তাই আমিও এই সুযোগে স্প্যানিশ সাহিত্যে একটু সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি, বেশিরভাগই হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছি।
আপাতত মেক্সিকোতে মুখ তুলেছি। সমকালীন মেক্সিকোর সাহিত্যিকদের মধ্যে ইউরি হেরেরা ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন বললে (অন্তত ইংরেজি অনুবাদে) বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন, পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশায় আছেন, আর মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর সমাজকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন। তাঁর যে তিনটে বই নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে, সেটা আসলে একটা ট্রিলজিই। নেমলেস মেক্সিকো ট্রিলজি বলা যায়। এই তিনটে বই যথাক্রমে কিংডম কনস, দ্য ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ বডিজ আর সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। প্রতিটাই আসলে নভেলার সাইজ, মেরেকেটে একশো পাতা, কিন্তু ইম্প্যাক্ট তাই বলে কম নয়। মজার কথা, ইংরেজিতে আগে তিন নম্বর বইটা এসেছে, তারপর দুই, তারপর এক। পরে অবশ্য তিনটেই একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে, আপাতত আমি দুই আর তিনই পড়েছি।
প্রথমে সাইন্স প্রিসিডিং দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড এর কথা বলা যাক। এই বইটা বেস্ট ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত সেই পুরস্কারটাই উঠে গেছে। কিন্তু এমন একটা বই অনুবাদ করা যে ভীষণ চাপের কাজ সেটা আমি ইংরেজিতে পড়তে গিয়েও বুঝতে পেরেছি। তার প্রধান কারণ, হেরেরা মেক্সিকোর গল্প বলেন মেক্সিকোর নাম না নিয়ে, বরং তিনি 'মেক্সিকো', 'আমেরিকা', 'স্প্যানিশ', 'ইংরেজি' কোনও শব্দই ব্যবহার করেন না, ফলে প্রতিটা বইতেই একটা অ্যাপোক্লিপ্টিক নুয়া গল্পের মেজাজ আছে, অথচ, এই দুনিয়াটা এতটাই বেশি বাস্তব যে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। নাম ব্যবহার না করলেও হেরেরা স্থানবিশেষের ডায়ালেক্ট, স্ল্যাং, কলোকিউয়ালিজম, কালচারাল এমবেডেড রেফারেন্স একদম নিঁখুতভাবে বজায় রাখেন, প্রয়োজনে ডিকশনারিতে না থাকা কিন্তু মুখে মুখে প্রচলিত নতুন শব্দ--- নিওলজিসম?-- ব্যবহার করতেও পিছপা হন না। বোঝাই যাচ্ছে এত কিছু নিয়ে ইংরেজি অনুবাদে সোর্স কন্টেন্টের শৈলী আর উপস্থাপনা বজায় রাখা কঠিন কাজ। এর চেয়েও বড় সমস্যা, হেরেরার গল্পে একটা অ্যাজটেক মাইথলজির চোরা রেফারেন্স থাকে। ঠিকঠাক ভাবে অনুবাদ না হলে সেটা কোনও ক্রিটিকই ধরতে পারবে না।
'সাইন্স...' বইটা মূলত একটা বর্ডার ক্রসিং এর গল্প। মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় একজন মেয়ে (মাকিনা) তার ভাইকে খুঁজতে আসছে বর্ডার ক্রসিং মাফিয়াদের সাহায্য নিয়ে, কারণ ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। (ভাই এসেছিল সেখানে একটা পূর্বপুরুষদের থাকা জমি ক্লেম করতে; মেক্সিকো ইউ এস সীমানায় বহু মানুষ এই জন্য সীমানা ক্রস করে) এইবার এখানে মেক্সিকোও নেই, ইউ এস ও নেই, কিন্তু বেআইনিভাবে সীমানা অতিক্রম করার আগে, করার সময় বা করার পর কী কী হতে পারে তার সবটাই আছে। কিন্তু আসলে গোটাটাই অ্যাজটেক মিথের একটা গল্প, যেখানে Quetzalcoatl পাতালে বা মৃতদের দুনিয়ায় নেমে যায় পূর্বপুরুষদের অস্থি ফেরত দিয়ে মনুষ্যত্বকে রিস্টোর করতে। মাকিনা আসলে এই গল্পে Quetzalcoatl, সে ওই মায়াদের নায়কের মতোই তিনটে ভাষা জানে (মাতৃভাষা, মৃতদের ভাষা, জীবিতদের ভাষা...মানে নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ, স্প্যানিশ আর ইংরেজি) মৃতদের রাজা Mictlantecuhtli তাকে পাতালে আটকে রাখার জন্য একটা ফাঁদ পাতে, যা দেখা যায় মাকিনার ক্ষেত্রেও। পাতালে গিয়ে সে এমন সব জিনিস দেখে, যা আগে সে দেখেনি কিন্তু মৃতদের দুনিয়াত তা সাধারণ ব্যাপার। মাকিনাও ইউএসে এসে তুষারপাত দেখে, আগে সে কখনও বরফ পড়তে দেখেনি।
"...and when it dissolved a few seconds later she wondered how it was that some things in the world -- some countries, some people -- could seem eternal when everything was actually like that miniature ice palace: one-of-a-kind, precious, fragile."
এরকম ছোট ছোট প্রতীকী ব্যাপার বইজুড়ে ছড়ানো আছে, অনুবাদে তার সবটা বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব, যদি মেক্সিকোর লোককথা, সমাহ আর অ্যাজটেক মিথের সঙ্গে পরিচয় না থাকে। ইংরেজিতেই যে ধরনের পোয়েটিক ভাষ্য দেখলাম, স্প্যানিশে পড়লে লোকে মুগ্ধ হত সন্দেহ নেই। প্রেক্ষাপট ভীষণ ভাবে বাস্তব, আর হয়তো সেই কারণেই সবটা না বুঝলেও এই বইটা অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় বই 'দ্য ট্রান্সাইগ্রেশন অফ বডিজ' নিয়ে তেমন বলা যাবে না, ওটা আরো বেশি আনঅ্যাক্সেসিবল গল্প। কোনও কাব্য ফাব্য নেই, ঘোরতত ডার্ক ন্যারেটিভ। মেক্সিকো শহরে মহামারি শুরু হয়েছে, সেখানে দুই পরস্পরবিরোধী মাফিয়া গ্যাঙ নিজেদের ছেলেমেয়ে হারিয়ে বসে আছে। দুজনেই সন্দেহ করছে অপরপক্ষ তাদের ছেলে বা মেয়েকে কিডন্যাপ করে খুন করেছে, কিন্তু আসলে তা হয়নি। অথচ ছেলেমেয়ে দুটোই মারা পড়েছে, তাদের লাশ শান্তিপূর্ণ ভাবে হাতবদল করার জন্য এক মধ্যস্থকারী ফিক্সারকে নিয়োগ করা হয়েছে, সে নিজের মতো করে তদন্ত করছে সত্যিটা জানার জন্য। তদন্ত শুনেই লাফিয়ে ওঠার কারণ নেই, এই তদন্ত সেই তদন্ত নয়। বলাবাহুল্য, এখানেও কোনও জায়গায় নাম নেই, মিথলজির মেটাফর আর ভাষার কারুকাজ আছে, কিন্তু গল্প ভীষণ ডার্ক, পড়ে সত্যিই মহামারির মধ্যে চলতে থাকা গ্যাঙওয়ারে ফেঁসে গিয়েছি মনে হবে। লিসা ডিলম্যান হেরেরার নিয়মিত অনুবাদিকা, তিনি এই বইটাও অনুবাদ করেছেন, কিন্তু সাইন্স... এর মতো জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে নয় বলেই হয়তো এই বইটা ততোটা জনপ্রিয় হয়নি। তবে ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ডস এর জন্য শর্টলিস্ট হওয়ার সুবাদে সাহিত্যিক মহলে হেরেরার কাজকর্ম নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, ইতিমধ্যেই এই ট্রিলজি ইউরি হেরেরাকে সবাই মেক্সিকোর প্রথম সারির সাহিত্যিকদের মধ্যে নিয়ে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ইম্পসিবল ক্রিচার্স
আমার বলতে সংকোচ নেই, উনিশ কুড়ি বছর অব্দি আমি নব্বই পার্সেন্ট শিশুকিশোর পাঠ্য বই পড়েই থেকেছি, অন্ততপক্ষে বাংলায়। তাই এখন যখন বেশিরভাগ লেখাই হতাশ করে, সত্যিই মন খারাপ হয়। তারপর আবার শুনি, বয়স বেড়েছে বলেই নাকি ছোটদের লেখা তেমন মন টানছে না। ছোটদের আসলে দিব্যি লাগছে। সেটা হতেই পারে, কিন্তু আমি মাস দুয়েক পর পর 'কালো পর্দার ওদিকে' আর 'টংলিং' তাহলে পড়ছি কেন আর 'ম্যাকেঞ্জি বাংলোয় রাত' বা পেনেটির ভূতের জন্য ইউটিউব খুঁজছি কেন? শুধু পুরোনো অবশ্য নয়, নতুনের মধ্যেও মাঝেমধ্যে দিব্যি লেখা পাওয়া যায়। আলাদা করে আর নাম নিলাম না। তবে ওই শারদ সংখ্যার প্রকাশের সময় ছাড়া বাকি বছরে কতজন নতুন শিশুকিশোর বই নিয়ে আলোচনা করে আর কতজন সময় নিয়ে একটা ষাট হাজারি ছোটদের উপন্যাস বা নতুন গল্প সংকলন বার করতে চায়, সে কথা আলাদা করে না বললেও চলবে।
একটু ভূমিকা করতেই হল, কারণ এই বইটা ঠিক বড়দের নয়। তবে বড় ছোট মেজো সেজো সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ক্যাথেরিন রুন্ডেলকে লোকে এ যুগের টলকিন বলে ফেলছে। স্টিফেন কিং থেকে নীল গাইমান, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া, দুনিয়া জুড়ে ইম্পসিবল ক্রিচার্সদের নিয়ে মাতামাতি চলছে। এহেন আমি পড়ব না, তা তো চলে না।
কোনোরকম ঢং না করে বলি, ইম্পসিবল ক্রিচার্স আমার ফাটাফাটি লেগেছে। গল্পে এমন কিছু নতুনত্ব নেই, শিশুসাহিত্যে ম্যাজিকের দুনিয়া দিয়ে দশটার মধ্যে আটটা গল্প লেখা হয় আজকাল। কিন্তু লেখিকা অসম্ভব মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে একটা হাই ভোল্টেজ কোয়েস্ট ড্রামা তৈরি করেছেন, যার সমস্ত সূত্র আসলে লুকিয়ে আছে অসম্ভব মানে ইম্পসিবল সব ক্রিচার্সদের কাছে। তারা কখনও সেন্টুর্স, কখনও গ্রিফিন, কখনও স্ফিংস। যথারীতি চমৎকার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, মজাদার সব চরিত্র, আর স্টেকও বড় কম নয়। নিয়ম মেনেই আন্ডার দ্য লাইন গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে, গল্প মাঝেমধ্যে গম্ভীরও হয়েছে, কিন্তু গতি থমকায়নি একচুল। একদম হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে হয় আর পড়া শেষ হলেও রেশ লেগে থাকে। কে বলে, বড় হয়ে গেলে ছোটদের বই ভালো লাগে না? (হুঁকোমুখো রাগী বুড়োবুড়িদের ধরছি না, নমস্কার)
হাইলি রেকামেন্ডেড। বাংলা না জানা অল্পবয়সীদের বই উপহার দিতে হলে এই বইটা পার্ফেক্ট গিফট হতে পারে।
শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং
বেস্টসেলার সাহিত্য আর বুকার জাতীয় পুরস্কারের বাইরে যারা একটু বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাদের প্রায় অনেকেই একবাক্যে বলছেন, গত পনেরো বছর ধরে আসল কাজ হচ্ছে হিস্প্যানিক সাহিত্যে। লাতিন বুম মার্কা কোনও নাম যে দেওয়া হচ্ছে না, তার বিভিন্ন কারণ আছে। এখনকার লেখকদেরও আর স্প্যানিশে লেখার জন্য স্পেনে বা লাতিন আমেরিকায় থাকতে হয় না। গ্রান্টা ইমার্জিং হিস্প্যানিক সাহিত্যিকদের একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি জারি করেছিল, তাদের অনেকেই জাপান, আমেরিকা বা ইউরোপে থাকেন। কিন্তু কলম থেমে নেই, আর এদের মধ্যে কয়েকজন এমন ঝড় তুলেছেন যে স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ বহুগুণ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও প্রায় বারো আনা কাজই আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়।
এতসব কথা বলার কারণ, বছর দুয়েক আগে আমি এক লাতিন লেখককে আবিষ্কার করেছিলাম, যার লেখা প্রায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোকের নাম Juan Gabriel Vásquez, থাকেন কোলাম্বিয়ার বোগোতায়, মূলত ঔপন্যাসিক বলেই তাঁর নাম। কোলাম্বিয়ায় তাঁকে নতুন মার্কেজ বলে লাফালাফি হচ্ছে বহুদিন ধরে, কিন্তু ভাস্কেজবাবুর কলম বিলকুল অন্য জাতের। ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, তাঁর বিশেষত্ব হল ট্রাজিক রিয়ালিজম। ভদ্রলোক নিরুত্তাপ স্বরে জানিয়েছেন, "My work is a reaction to the idea of magical realism as the only way to discover Latin America. It's something that still many readers believe. And this is obviously something I strongly oppose. I don't feel Latin America is a magical continent. I feel Latin American history, is if anything, tragedy."
এই জায়গা থেকেই আমি ভাস্কেজকে আবিষ্কার করেছি, কারণ আসল কোলাম্বিয়াকে বোঝার জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য কলমের খোঁজ আমি বহুদিন ধরে চালাচ্ছি। মাকোন্দো নয়, মারিহুয়ানা। আধুনিক কোলাম্বিয়া বলতে যে দেশটার ছবি আমাদের মাথায় ঘোরে, সেখানে কী আছে? এস্কোবার, নারকো ট্রেড, অস্থির রাজনীতি, প্রায় প্রায় গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি, আবার সে সব সামলে আমোদ করার মানসিকতা, ফুটবল আর সাহিত্য প্রীতি, কবিতা নিয়ে উন্মাদনা, পাশাপাশি দুর্নীতি, অপরাধ, অর্গানাইজড ক্রাইম, বোমাবাজি, আমেরিকার সঙ্গে দড়ি টানাটানি... যারা সত্তর আশি নব্বইয়ের দশকে এই দেশে বড় হয়েছেন, তাদের কি কিছু নতুন বলার নেই? এই অস্থিরতা কীভাবে তাদের জীবনকে বদলেছে, সমাজকে বদলেছে, কী করে এই পরিস্থিতি কোলাম্বিয়ার জনমানসকে ভেঙেছে বা গড়েছে? আর শুধু নার্কো ট্রেড কেন, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকের বাস্তব ছবিই বা কতজন জানে? লাতিন দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, উপজাতি বিদ্রোহ, তেল আর গ্যাস নিয়ে রেষারেষি, আমাজনের পরিবেশ বদল ক'টা লেখায় আমরা পড়েছি? অথচ দুনিয়ার লোক মার্কেজকে গুলে খেয়েছে! ভাস্কেজের মতো লেখকদের কলম সেইদিক থেকে দেখতে গেলে কোলাম্বিয়ান সাহিত্যে নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে।
যাই হোক, ভাস্কেজবাবুর বই আজকাল নিয়মিত ইংরেজিতে আসছে। বছরখানেক আগে প্রকাশিত 'রেট্রোস্পেক্টিভ'-ও ভীষণ ভালো রিভিউ পেয়েছে, কিন্তু যে বইটা পড়ে আমি তাঁকে চিনেছি বা দুনিয়া তাঁকে চিনেছে, সেটার নাম 'দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং', এই বইটা আসামাত্র লোকেরা নড়েচড়ে বসেছিল। বইটা ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার আগেও স্প্যানিশে একগাদা পুরস্কার জিতেছে, সে কথা থাক।
এই বইটা কী নিয়ে? এই হল কঠিন প্রশ্ন, কারণ এমন বই আমি আগে পড়িনি। গল্পটা আমি বলেই দিই। আইনের প্রফেসার আন্তোনিও আমাদের প্রোটাগনিস্ট, তার সঙ্গে রিকার্ডো লেভার্ডে বলে এক জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামীর দেখা হয়। তারপর একদিনে রাস্তায় বাইকে সওয়ার দুই আততায়ী এসে তাদের দিকে গুলি ছোঁড়ে, আন্তোনিও বেঁচে গেলেও ভীষণভাবে আহত হয়, রিকার্ডো মারা যান। এদিকে তিন বছর পর যখন আন্তোনিও প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বিয়ে থা করে মেয়ে বউকে নিয়ে সংসার করতে বাধা নেই, তখনও তার মনে সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি ঘুরে বেড়াতে থাকে। কারণ নেই, তবু সে চিন্তা করে যায়। পিটিএসডি বলা যায়, কিন্তু এ আদপে আতংক নয়, বরং কৌতূহল! কেন কেউ রিকার্ডোকে মারল? কী করেছিল সে? জেলে গেছিলই না কেন?
এই অদম্য কৌতূহলের কোনও ব্যাখা নেই, কিন্তু আন্তোনিও সেই খোঁজ চালিয়ে যায়। এই তদন্ত তাঁকে প্রথমে রিকার্ডোর বাড়িওয়ালি, তারপর তার মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। গল্প এমন দিকে ঘোরে, কেউ আন্দাজও করেনি। এক সময় বোঝা যায়, গল্পের মূল চরিত্র বদলে বদলে যাচ্ছে। একটা আপাদমস্তক ক্যারেক্টর ড্রিভেন ন্যারেটিভে কোলাম্বিয়ার তিন দশকের ইতিহাস ঢুকে গেছে। কখনও সে গল্প আন্তোনিওর, কখনও তার মেয়ের, কখনও রিকার্ডো বা তাঁর স্ত্রীর, যখন সত্তরের দশকে তাদের দেখা হয়েছিল। গল্পের সঙ্গে বদলে যায় পারিপার্শ্বিক, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির কথা উঠে আসে গভীরভাবে। দ্রুত গতিতে বদলে যাওয়া এক দেশ, যেখানকার মানুষের জীবনও বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের চরিত্র, সম্পর্ক, আশা আশঙ্কা। ভাস্কেজের কলম যে দক্ষতায় এই গল্প এগিয়ে নিয়ে গেছে, রিয়ালিজম আর থ্রিলারের আঙ্গিকে গল্প নিয়ে চললেও যেভাবে মাল্টি জেনারেশনাল আইডেন্টিটির জটিলতা তুলে ধরেছেন, তার জবাব নেই।
দ্য সাউন্ডস অফ থিংস ফলিং... হোয়াট আর দিস থিংস...শুধুমাত্র একটা প্লেন ক্র্যাশ নয়, এই পতনের অনুরণন সর্বত্র। একটা রবিনহুডি আপরাধিক সাম্রাজ্যের পতন, একটা প্রজন্মের আশা আকাঙ্খার পতন, সম্পর্ক বা চরিত্রের পতন... এই ভঙ্গুর, ইম্পার্ফেক্ট চরিত্রদের জীবনে সর্বদা একটা 'ফলিং' চলছে। তাদের স্মৃতিতে, তাদের যাপনে, তাদের মননে। কেউ বোঝে না, কেউ যুক্তি খুঁজে পায় না, কিন্তু সব ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে ভিতরে।
ভাস্কেজবাবুর মেটাফরগুলো এতটাই চমকপ্রদ আর ইমেজারি এতটাই অভিনব যে, ট্রাজিক রিয়ালিজমের মধ্যেও একটা ম্যাজিক চলে আসে। মজার কথা, এক জায়গায় লেখক খোদ হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের প্রথম প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই বইয়ের প্রচ্ছদে একটা মুদ্রণপ্রমাদও রয়ে গিয়েছিল।
একটা গোটা সাইডপ্লট হল ড্রাগ লর্ড এস্কোবারের হুজুগে তৈরি চিড়িয়াখানা নিয়ে, যে চিড়িয়াখানা মেন্টেন করার।লোক নব্বইয়ের দশকে আর নেই। শেষের দিকে একটা দৃশ্যে দেখা যায়, আন্তোনিও আর মায়া (রিকার্ডোর মেয়ে) সেই পরিত্যক্ত চিড়িয়াখানায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা চিতাবাঘ, একটা পাগলা চিম্পাঞ্জি ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। কোথায় সেই গোলাপি ডল্ফিন, ম্যাকাওয়ের ঝাঁক, বাঘ ভাল্লুক! ফিরতি পথে আসার সময় তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটা জলহস্তী, করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। আন্তোনিওর মনে পড়ে যায়, কার্টেল যখন দুর্বল হয়ে এসেছে, ম্যাডালিনের ছাদে ডিইএ পাবলো এস্কোবারকে গুলি করে মেরেছে, তখন একটা জলহস্তী এই চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ তাকে গুলি করা হয়। সেই জলহস্তীই আসলে এই বদলে যাওয়া দেশের বাস্তব। এক মর্মান্তিক ড্রাগ ওয়ারের বিভীষিকার মধ্যেও এই চিড়িয়াখানা ঘিরে কোলাম্বিয়ার ছেলেমেয়েদের যে স্মৃতি, সেই কথার বয়ান পড়তে গেলে মনে হয় আমিও হয়তো বোগোতাতেই ছিলাম।
ইদানীংকালে পড়া বইগুলোর মধ্যে আমি এটা প্রথম সারিতে রেখেছি। মার্কেজের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি কেউ কোলাম্বিয়ার সমকালীন সমাহ আর সাহিত্যকে বুঝতে চান, দিজ ইজ দ্য মাস্ট রিড।
দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ 'জেমস' অ্যান্ড হাকলবেরি ফিন
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
তুরস্কের মেলাঙ্কলিয়া
প্রাবদা ইউনের আশ্চর্য দুনিয়া
দ্য প্লেইন্স : গোলকধাঁধার নাম হাইওয়ে