শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫

সেলুরিয়ান সি-এর দ্বীপের সেই বাড়িটা

 


জি কে চেস্টারটন বলেছিলেন, সাহিত্য পড়া আসলে লাক্সারি, গল্প পড়া হল প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে এক একটা বই কথাটা মনে করিয়ে দেয়। এই অসম্ভব, অসম্ভব মিষ্টি বইটার কথা লিখে রাখলাম, কেউ পড়লে তাদের দু চারটে দিন অনেক বেশি মিষ্টি হয়ে উঠবে। ডায়াবিটিস থাকলেও সমস্যা নেই। একদম সুগারক্যান্ডি বই, যদিও মাঝেমধ্যে টকমিষ্টি লজেন্সের স্বাদও পাবেন। আর যদি স্টোরিটেল বা অন্য কোথাও অডিও স্টোরি শোনেন, তাহলে তো পোয়াবারো। এমন মালপো হালুয়া জিলিপি মার্কা রস গড়ানো বইকে সাহিত্য বলে গণ্য করে না অনেকেই, তারা ওইসব মোটামোটা জটিল বই নিয়ে বসে থাকুক গে! আমরা বরং ছোট করে সেলুরিয়ান ক্রনিকালসের প্রথম বইয়ের গল্পটা জেনে নিই।

লিনাস বেকার ডিপার্টমেন্ট অফ চার্জ ফর ম্যাজিকাল ইউথের জন্য কাজ করেন। কেরানি গোছের কাজ, তাঁর প্রধান দায়িত্ব হল ম্যাজিকাল চাইল্ডদের জন্য বরাদ্দ অনাথআশ্রমে গিয়ে দেখে আসা বাচ্চাগুলো যত্নে আছে কিনা! ঝামেলা থাকলে রিপোর্ট দেওয়া, সেই অরফেনেজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এই কাজ করতে করতে তিনি চল্লিশের গোড়ায় পৌঁছেছেন, অন্য সবাই পদোন্নতি পেয়ে তাঁকে টপকে গেছে। লিনাস বেকার থেকে গেছেন। তিনি ভুঁড়ি থলথলে গোবেচারা মানুষ, একা থাকেন, সঙ্গী বলতে একজন বেড়াল মাত্র। গান শোনা ছাড়া তেমন কোনও শখ নেই। দজ্জাল বসের কাছে বকা খান, বাড়িওয়ালা রোজ টিটকিরি দেয়, তিনি বাস থেকে নেমে বৃষ্টিপ্রবণ শহরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের কথা ভাবেন, কিন্তু সমুদ্র দেখতে আর যাওয়া হয় না। তিনি নিজেও জানেন, আমার কিছু হওয়ার নয়।

এমন সময় একটা হাই ভোল্টেজ অ্যাসাইনমেন্ট এসে পড়ে তাঁর কাছে৷ হাইয়ার ম্যানেজমেন্ট তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ার আর রিপোর্ট দেখে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে একটা গোপন মিশনে পাঠাবেন তাঁকে। কী সেই গোপন মিশন? একটা দ্বীপে অবস্থিত অনাথ আশ্রমে ছয়জন বিপজ্জনক বাচ্চা থাকে। নামে বাচ্চা হলেও তারা এক একটা জিনিস। বেকারকে গিয়ে একমাস থেকে রিপোর্ট করতে হবে, এই জায়গাটা থাকবে না বন্ধ করে দেওয়াই বেটার?

বেড়াল নিয়ে বেকার শেষমেশ ট্রেনে উঠে বসেন। তখনও তিনি জানেন না যে এই যাত্রায় তিনি প্রথম সমুদ্র দেখবেন, লোনা হাওয়া আর রোদের সঙ্গে তার মোলাকাত হবে জীবনে এই প্রথম। তিনি এও জানেন না যে ছয়জন বাচ্চার কথা তাকে বলা হয়নি, শুধু ফাইল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে পৌঁছে গিয়ে দেখতে হবে জানিয়ে, তাদের মধ্যে একজন খোদ শয়তানের ছেলে মানে অ্যান্টিক্রাইস্ট। অবশেষে, তিনি এও জানতেন না যে এই এক মাস তাঁর জীবন বদলে দেবে।

বেকার দ্বীপে গিয়ে পৌঁছান বটে, কিন্তু নিজে পৌঁছানোর সাধ্য ছিল না তাঁর। তাঁকে সেই অঞ্চলের বনদেবী (ইংরেজি নামটা থাক!) সেখানে নিয়ে আসেন৷ দেখা হয় অনাথ আশ্রমের প্রধান সঞ্চালক আর্থারের সঙ্গে। ছয়জন ছেলেমেয়ের সঙ্গেও, যাদের ভয়ে ডিপার্টমেন্টর লোক থরথর করে কাঁপছে।

এই এক মাস ধরে একের পর এক রহস্যোদঘাটন হয়। বেকার ভয় পান, তর্কাতর্কি করেন, অনেক কিছু বোঝেন, অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে চলি। একের পর এক চমৎকার ঘটনা, দমফাটা হাসির সিকোয়েন্স, আশ্চর্য রহস্য, চোখ ভিজিয়ে দেওয়া দৃশ্য। গল্পের সঙ্গে আমরাও তখন সেলুরিয়ান সি এর দ্বীপে থাকা সেই বাড়িটায় গিয়ে পৌঁছেছি।

টি জে ক্লুন সাহিত্য করতে পেরেছেন কিনা, ভাষা আর ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাজিমাত করেছেন কিনা, সে সব বলা এখানে বেকার! কারণ, এখানে গল্পটাই সব। এমন একটা মন্ত্রমুগ্ধ করা গল্প, যা পড়ে মনে হয় গরম রসগোল্লা খেলাম। নতুন বন্ধু পাতানো যায়, পিকনিকে যাওয়া যায় তাদের সঙ্গে, স্বপ্ন দেখা যায়, গান গাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি সাহিত্য আর কী হতে পারে?

কিছু কিছু বই নিজের জন্য পড়ে নিতে হয়। পড়ুন, ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝিদের উপহার দিন, রাত্রে স্টোরিটেলে একসঙ্গে বসে শুনুন। যদি ভালো না লাগে, মুখমিষ্টি না হয়, মন না ভরে, তাহলে মনের ডাক্টারের কাছে যাওয়ার ফিজটা আমিই দেব না হয়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন