গত সপ্তাহে আফ্রিকায় কতরকম আবিষ্কার হচ্ছে, সেই নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। তার আগে মিশর নিয়েও একটা আপডেট দিয়েছি। অনেকের হয়তো ধারণা হতে পারে, আবিষ্কার- ফাবিষ্কার বুঝি দেশের বাইরেই সব হচ্ছে। পোস্ট ট্রুথ ইন্ডিয়ান সোসাইটিতে গবেষণা-ফবেষণা সব গোল্লায় গেছে, সবাই ফালতু বকতেই ব্যস্ত, তাঁদের মিষ্টি হাসি হেসে বলতে হয়, একশো চল্লিশ কোটির দেশে ও কথা ভাবাও পাপ। ভারতবর্ষে আজও এমন মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, যারা একের পর এক কামাল করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে সেই সব কথা পৌঁছতে পারে না, তাঁদের নিয়ে কেউ ব্রেকিং স্টোরি করে না, এইটুকুই যা দুঃখের। যাকগে, অন্তত পাঁচটা বিষয় নিয়ে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক আর আবিষ্কারকরা কী কী চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারছেন, সেই নিয়ে কয়েক লাইন করে লিখে দিলাম। বড় লেখা কেউ পড়েও না। কেউ আগ্রহী হলে বিস্তারিত পড়তেই পারেন খুঁজে।
১) প্রথমেই পুরাতত্ত্ববিদদের কাণ্ডকারখানা দেখা যাক। আমাদের দেশে আর্কিওলজিস্টদের নানা রকম ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইতিহাস খুঁড়ে বের করা ঢের ঝক্কির কাজ, টাকাফাকাও লাগে, খোদ সরকারেরও ওতে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সামান্য বাধানিষেধ পেলেই বড় বড় প্রজেক্ট তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে, এক্সক্যাভেশন সাইটে খাটিয়ে রাখা ত্রেপল নিজেই ফসিল হয়ে যায় আর কি! তবু ভারতীয় আর্কিওলজিস্টরা হাল ছাড়তে রাজি নয়। গত কয়েক বছরে তারা এমন সব রোমাঞ্চকর তথ্য জানতে পেরেছেন যে দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেছে।
প্রথমেই বলতে হয় কিলাদি এক্সপিডিশনের কথা। তামিলনাডুর কিলাদি আর কাছাকাছি অবস্থিত অন্যান্য এক্সক্যাভেশন সাইট থেকে পাওয়া তথ্য এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে যে ইতিহাসবিদরা দাড়ি চুলকে পোকা বার করে ফেলছেন প্রায়। ব্যাপারটা ইতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে৷ কিলাদিতে বহুদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্রাফিতি-চিহ্নিত মৃৎপাত্রের টুকরো, খোদাই করা চাকা, সোনার অলংকার, হাতির দাঁতের পাশা, জীবজন্তুদের মূর্তি তো আছেই, কিন্তু আসল ঝামেলা বেধেছে সেখানে পাওয়া সঙ্গম টেক্সট নিয়ে। কিলাদি থেকে প্রচুর পরিমাণে পটারি আর অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে, তার ওপর তামিল ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা খোদাই করা আছে। পড়ে সকলের ঘুম উড়ে গেছে। এ যে সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে।
এখন সঙ্গম সাহিত্য আবার কী জিনিস? খুব ভাসাভাসা বলতে হলে বলতে হয় তামিল সাহিত্যে সঙ্গম সাহিত্যের টেক্সট প্রায় একটা লিজেন্ড। সঙ্গম সাহিত্য আসলে ব্যাকরণ গ্রন্থ কাব্যসংকলন (তোল্কাপ্পিয়াম) আর তা বাদেও আটটা গ্রেটার টেক্সট নিয়ে একটা প্রাচীন সাহিত্য জনরা, সেগুলো আবার দু ভাগে শ্রেণীভক্ত করা হয়েছে। অত ঝামেলায় না গেলে বলি, উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে আকানানুরু (৪০০ প্রেমের কবিতা), পুরানানুরু (৪০০টা বীরত্বপূর্ণ কবিতা), কুরুন্থোগাই (ছোট প্রেমের কবিতা) এবং নাত্রিনাই (পাঁচটা সিনসিনারি নিয়ে কবিতা) ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হল, সঙ্গম লিটারেচর দাবী করে তামিল সভ্যতা ৬০০ বিসিই-তেও, এমনকি তার আগেও যথেষ্ট উন্নত ছিল। সেখানে স্থাপত্যশিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভীষণ ভাবে এগিয়ে ছিল। এতদিন ভাবা হত উত্তর ভারতে জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে প্রথমে, দক্ষিণ ভারতে নয়। সঙ্গম সাহিত্যে যে বলা হয়েছিল তামিল সভ্যতা আরিয়ান আর বৈদিক সভ্যতার চেয়ে ভিন্ন আর তামিলরা প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্র সভ্যতা বিকশিত করেছে, সেটা সত্যি। কোন্ডাগাই বিউরিয়াল সাইট থেকে পাওয়া আর্টেফ্যাক্টগুলোর লিপি পড়ে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।পাশাপাশি এনসিয়েন্ট তামিলরা যে এজুকেশন, ক্রাফটসম্যানশিপ আর ট্রেডিংয়ে ভীষণভাবে উন্নত ছিল বলে লেখা হয়েছিল, তা শুধুই কষ্টকল্পনা নয় বলেও প্রমাণ হয়েছে।
এসব জানার পর রাজনীতি গরম। তামিলনাডুর সিএম বলছেন সেন্টার থেকে ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিডিয়াতেও যেন এই নিয়ে বিশেষ কথা না হয়, সেইজন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে চারিদিক থেকে। তাঁদের ভয়, তামিলনাডুর ইতিহাস নিয়ে এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার রাজনীতিতেও পালাবদল ঘটাতে পারে। সে-সব সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে কিলাদি অভিযান আর নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে সারা দুনিয়ার ইতিহাসকাররা উদগ্রীব হয়ে আছে।
২) তামিলনাড়ুর গাঙ্গাইকোন্ডাচোলাপুরমেও খননকার্য চালিয়ে চোল বংশের ইতিহাস, শিল্পকর্ম আর ঐতিহ্য নিয়ে অজানা সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করছেন যে আয়ুধালাম আর কোল্লানকুঝিতে এক্সপিডিশন চালিয়ে গেলে আরো অনেক তথ্য জানা যেতে পারে, কিন্তু আপাতত বাজেট নেই সেই কাজটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পট্টরাইপেরেম্বুদুরেও টেরাকোটা শিল্প আর মৃত্তিকামূর্তি মিলিয়ে প্রায় দশহাজার আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া গিয়েছে।
৩) হরিয়াণার রাখিগরিতে একটা প্রাচীন জলাশয় বা রেজর্ভয়ের সিস্টেম পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পান যুগে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য জানা গেছে। হাইড্রোলজিস্ট আর ত্রিমাত্রিক মডেল ডিজাইনারদের কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হবে, এমন উদ্ভাবনী ওয়াটার সিস্টেম সম্পর্কে এখনও আমরা বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি।
৪) ওদিকে ইসরো যে একের পর এক ধামাকা করছে সে তো সবাই জানে। চাঁদের সাউথ পোলে চন্দ্রযান নামানোর কথা বেশ আলোরণ ফেলেছে, সূর্যের করোনা আর সোলার উইন্ড নিয়ে স্টাডি করার জন্য যে আদিত্য-এল১ বলে সোলার অবজারভেটারি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তার চেয়েও বেশি লাফালাফি হচ্ছে একটা ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার নিয়ে। এক বিরল বিস্ফোরণের সময় সুইফট জে১৭২৭. ৮-১৬১৩ ব্ল্যাকহোল থেকে যে হাই এনার্জি এক্স রে পাওয়া গেছে, তাতে কিছু আনইউজুয়াল বিহেভিয়ার লক্ষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই অস্বাভাবিক আচরণের নাম 'অ্যাপিরিওডিক মড্যুলেশন'। এই আচরণের ফলে এক্স-রেতে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্যাটার্ন দেখা যায় যা কোয়াসি-পিরিওডিক অসিলেশন (QPO) নামে পরিচিত। ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত জোর গবেষণা চলছে।
৫) ওদিকে বনেজঙ্গলেও ধুমধাড়াক্কা চলছে। ২০২৩ সালেই জীববৈচিত্র্যে একের পর এক নতুন নাম যোগ হয়েছে, ভারতে ৬৪১টি নতুন প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গিয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯৯টি প্রথমবার ভারতে পাওয়া গিয়েছে। প্রচুর প্রাণী এই প্রথম পাওয়া গেছে পৃথিবীর বুকে। নতুন আবিষ্কারের বেশিরভাগই ছিল অমেরুদণ্ডী প্রাণী (৫৬৪টি প্রজাতি), বিশেষ করে পোকামাকড় (৩৬৯টি প্রজাতি), যেখানে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে (৭৭টি প্রজাতি), মাছ (৪৭টি প্রজাতি) প্রাধান্য পেয়েছে, তারপরে সরীসৃপ, উভচর, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি রয়েছে। হিমালয়ে 'হিমালয়ান আইবেক্স' বলে একটা নতুন প্রজাতির আইবেক্স বা পাহাড়ি ছাগল পাওয়া গেছে, কর্নাটকের কুর্গে Miniopterus srinii বলে বাঁকানো ডানার চামচিকে মিলেছে, কেরালায় পাওয়া গেছে অ্যান্ট মিমিকিং স্পাইডার, ময়ুরভঞ্জে নতুন প্রজাতির গিরগিটির নাম খাতায় উঠেছে। সবচেয়ে বেশি প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে ওয়েস্টার্ন ঘাটে, বলাই বাহুল্য। তবে নর্থ ইস্টে হাজার রকম গাছড়া পাওয়া গেছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে।
এছাড়াও দেশজুড়ে আবিষ্কার চলছে। জাদুবিদ্যা নিয়ে, উপজাতির ইতিহাস আর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে, সামুদ্রিক জীবন ও পরিবেশ নিয়ে, জিওসায়েন্স নিয়ে, এমনকি ভূত প্রেত রাক্ষস নিয়েও নৃতত্ত্ববিদরা ডেঞ্জারাস সব কাজ করছেন। পড়তে গেলে রোমাঞ্চে গায়ের কাঁটা দাঁড়িয়ে যায়। মুশকিল হল, অধিকাংশ জনতা শুধু আলতু ফালতু নিউজ চ্যানেল আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে আছেন, বাকিরা রিল নিয়ে লাফাচ্ছেন। অনেকে তো ভেবেই নিয়েছেন এ দেশে কিছুই হয় না, কারণ এসবের বিশেষ প্রচার নেই। আসল কথা হল, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও কাজ হচ্ছে, আস্তে আস্তে করে হলেও নতুন আবিষ্কার চলছে। আমি নিশ্চিত, আমার বন্ধুবৃত্তেই এমন মানুষ আছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যদি তাঁরা মাঝেমধ্যে সে নিয়ে কিছু কিছু কথা জানান, আমার মতো আগ্রহী পাঠকরা উপকৃত হই আর কি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন