বইমেলায় গেলে আমি পারতপক্ষে কল্পবিশ্বের স্টলে ঢুকি না। স্পেকফিক বইগুলো দেখে হাত পা নিশপিশ করবে কিন্তু বাড়িতে বই রাখার জায়গা নেই, আজকাল পাইরেসির জ্বালায় ইবুকও হয় না, তাই অনেক বইই ইচ্ছে থাকলেও পড়া হয় না বা পড়তে বছর গড়িয়ে যায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকেই। সত্যি বলতে, এই সময় বাংলায় কল্পবিজ্ঞান বা সার্বিক ভাবে স্পেকুলেটিভ ফিকশনের ভক্ত হলে সোহম গুহ, সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়, রনিন বা শ্রীজিত সরকারের মতো প্রতিভাবান কলমদের এড়িয়ে না যাওয়াই বেটার। সিনিয়ারদের কথা না হয় নাই বললাম। এত সব কথা বলার কারণ, বেশ কয়েকদিন পর একটা বই পড়ে মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে।
গত মাসেই মেলায় সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়ের চারুদত্ত ফ্যান্টাসি সিরিজের প্রথম বই 'বিষনিদ্রা' প্রকাশিত হয়েছে, ইতিমধ্যেই পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে। আরবান ফ্যান্টাসি কাম গোয়েন্দা গল্প ঘরানার কাহিনি, বিশ্বসাহিত্যে এমন গল্পের অভাব না থাকলেও বাংলায় অতি প্রয়োজনীয় সংয়োজন। রিভার্স অফ লন্ডন, অ্যালেক্স ভেরাস সিরিজ বা জেমস লাভগ্রভের শার্লকিয়ান মিস্ট্রির ভক্ত হলে এই বই আপনারই জন্য, আবার ফ্যান্টাসি বাদ দিয়ে সাধারণ গোয়েন্দা গল্প/রহস্য কাহিনির অনুরাগী হলেও বইটা আপনাকে হতাশ করবেন না।
অতি সংক্ষিপ্ত সামারি। চারুহাসিনী দত্ত পেশায় দিব্যেন্দ্রিয়, অদ্ভুতাঙ্গ প্রাণী আর অতিলৌকিক (পড়ুন রাক্ষস, খোক্ষস, মৃতদেহ জাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি) নিয়েই তাঁর কারবার। এমন সময় এক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর স্ত্রী রহস্যজনক ভাবে অদ্ভুতাঙ্গ এক প্রাণীর আক্রমণে প্রাণ হারান আর সেই কেসের তদন্ত করতে গিয়ে চারু এক বড় রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। একের পর এক ঝামেলা, রহস্যের ওপর রহস্য, তদন্ত এবং সমাধান। ক্লিন অ্যান্ড সিম্পল। কোনও নাটক নয়।
সৌম্যবাবুর লেখা সাবলীল, ভাষা স্মার্ট, তাঁর রেঞ্জও কাবিলে তারিফ। নানান জায়গায় তাঁর লেখা গল্প পড়ে আমি জানি তিনি গল্পের চরিত্র বুঝে ভাষা ব্যবহার করেন, অযথা জ্ঞান ফলাতে যান না। এখানেও তাঁর কলম ধারালো ছুরির মতো এগিয়েছে। ঝকঝকে ন্যারেটিভ, তকতকে সংলাপ, ইন্টারেস্টিং প্লট এবং টানটান ট্রিটমেন্ট। খুব শাটল ভাবে এই দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়েছেন, পাশাপাশি কোরাপ্ট রাজনীতি আর সিস্টেমের পাওয়ার ডায়নামিক্সও বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরই মাঝে অসম্ভব দক্ষতায় জাস্টিস আর মোরাল কম্পাস নিয়ে কমেন্ট্রিও করেছেন, সেসব কতজন খেয়াল করবেন জানি না। কিন্তু এসব কিছুই মূল কাহিনির গতিকে থমকে দেয়নি। লেখককে সাধুবাদ দিতেই হয় তাঁর পরিমিতিবোধের জন্য। তিনি আসলে একই রহস্য কাহিনি লিখছেন, আর রহস্য কাহিনিতে রহস্যটাই আসল, এটা কোথাও তিনি ভুলে যাননি। ফলে গোটা বইটাই মুচমুচে, ক্রিস্প। কুড়মুড়ে ফিশফ্রাইয়ের মতোই।
ফ্যান্টাসি হওয়া সত্ত্বেও শক্তিনগর বলে যে পশ্চিম বঙ্গের যে শহরটাকে সৌম্যবাবু তুলে ধরেছেন, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। এখানে সম্পর্কের জটিলতা আছে, কেরিয়ারের ঝামেলা আছে, ড্রাগ ব্যবসা আছে, দিব্যেন্দ্রিয় ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের ছুঁড়ে মারা টীকাটিপ্পনী আছে। সত্যি বলতে এসব চেনা জিনিস এতটাই বেশি আছে যে মাঝেমধ্যে আমার মনে হচ্ছিল ফ্যান্টাসির চেয়ে রিয়ালিজমের দিকে কাঁটা বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে। আরেকটু ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং করলে, অদ্ভুতাঙ্গ বা এই অতিবাস্তব দুনিয়ার গোড়ার কথা একটু খোলসা করে বললে হয়তো আরো জমে যেত। কিন্তু যেহেতু এটা সিরিজ হতেই চলেছে, আশা করি পরের বইগুলোয় আরো ডিটেলে সব জানা যাবে। কিন্ত সব মিলিয়ে 'বিষনিদ্রা' বাংলা স্পেকুলেটিভ ঘরানায় একটা অসম্ভব ভালো অ্যাডিশন। রিডিং ব্লক হলে তা কাটাতে এই বইটা তুলে নিতেই পারেন। বোর হওয়ার কোনও জায়গা নেই।
বিষনিদ্রা
কল্পবিশ্ব প্রকাশনী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন