শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

ওলাউদার আশ্চর্য জীবন

 


ধরুন আপনার বয়স দশ। স্কুলের ছুটি, আদর আহ্লাদে দিন কাটছে। সকালে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনে, দুপুরে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে, এক ঘুম দিয়ে বিকেলে উঠে পাউডার মেখে চুল আঁচড়ে আপনি চার বছরের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পার্কে ক্রিকেট খেলতে গেলেন এবং দুর্বৃত্তদের হাতে কিডন্যাপ হলেন। হলেন তো হলেন, আর আপনার বাড়ি ফেরা হল না। সারাজীবনের জন্য। ছোট ভাইকেও আর কোনোদিন দেখতে পেলেন না। এইবার ইম্যাজিন করুন, আপনার জীবন কেমন হবে?

যতক্ষণ আপনি ইম্যাজিন করছেন, ততোক্ষণে আমি একটা ছোট্ট গল্প বলে নিই। এমন একজন ছেলের গল্প যাকে এই সব কল্পনা কর‍তে হয়নি, তার জীবনে সত্যিই এমন ঘটেছিল। কিন্তু সেই জীবন এমনই ঘটনাবহুল হয়ে উঠল, যে ইতিহাসেও তার সঠিক বিবরণ মেলে না। সবটা জানা যায় না। ভাসা ভাসা তথ্যই আছে। তাই সই।

ছেলেটা আফ্রিকার যে নামহীন জায়গায় জন্মেছিল, সেটা আজকাল নাইজিরিয়ায় পড়ে। অষ্টদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, তখন আফ্রিকা সম্পর্কে সাদা চামড়ার মানুষের কী ধারণা ছিল সে সবাই জানে। সে যাই হোক, ছেলেটার নাম হল ওলাউদা। তার বাবা ছিলেন গ্রামের প্রধান, খুব একটা অভাব ছিল না। গ্রামের মানুষ একে অপরকে ভালোবাসত, সাহায্য করত, বিকেলে আগুনের চারিদিকে বসে সবাই গল্পের আসর জমাত। কমিউনিটির ব্যাপারটা খুব প্রবল ছিল। এই পরিবেশে বড় হয়ে উঠছিল ওলাউদা। বালক বয়সে সবাই যে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন তারও ছিল। কিন্তু এগারো বছর বয়সে তার সেই সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

বোনের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল ওলাউদা। এমন সময় ঘোড়সওয়াররা চড়াও হল গ্রামে। চারিদিকে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। ওলাউদা কিছু বোঝার আগেই দুজন মানুষ তাকে আর তার বোনকে তুলে একটা অন্ধকার গাড়ির ভিতর ছুঁড়ে দিল, সেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে। বাইরে থেকে তখন চেঁচামেচি, আর্তনাদের শব্দ ভেসে উঠছে। ওলাউদা চোট পেয়ে বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। সে জানত না বহুদিন আর সে এই অন্ধকার থেকে বেরোতে পারবে না, সূর্যের আলো দেখতে পারবে না। জীবনে আর কোনওদিন বোনের মুখও দেখা হবে না। যখন সে ঘুম ভেঙে উঠবে, তখন অলরেডি সে ক্রীতদাস হিসেবে একজনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।

এখান থেকে ওলাউদার জীবন এমন একটা রোলার কোস্টার হয়ে উঠল যে সে বুঝেই উঠতে পারল না কী হচ্ছে! কয়েক মাস ধরে ঘুপচি অন্ধকারে এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে ছুঁড়ে ফেলা হল তাকে, প্রায় অর্ধভুক্ত অবস্থায় সে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে ততদিনে। বাতি জ্বালালে চোখ জ্বালা করে। এর মধ্যে কতবার তার মালিক বদল হয়েছে সে জানেও না। কিন্তু কাজ করতে হয় ঠিকই। মাঝেমধ্যেই চাবুক এসে পড়ে পিঠে, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গা। এই করে কতদিন কাটল, কী কাজ সে করছে, কে তার মালিক, কিছুই তার আর মনে নেই। সবসময় একটা ঘোর লেগে আছে, যেন কেউ ড্রাগ দিয়ে রেখেছে। আসলে নিকষ অন্ধকারে থেকে, ভিটামিন আর পুষ্টি কমে যাওয়ায় তার মাথা কাজ করছিল না। যখন তার বোধশক্তি ফিরল, তখন সে দেখল সে একটা ক্যারেবিয়ানগামী ক্রীতদাস জাহাজের খোলে অন্যদের সঙ্গে বন্দী।

ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক স্লেভ ট্রেড এর কথা আমরা সকলেই জানি। জানি, কিন্তু অনুভব করার ক্ষমতা আমাদের নেই। মিডল প্যাসেজ, যেখানে আফ্রিকার ক্রীতদাসকে শুঁটকি মাছের মতো চেপেচুপে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, সেখানকার অবস্থা কার্গোর চেয়েও বেশি খারাপ। অভুক্ত অবস্থায় লোকজন সি সিকনেসে ধুঁকছে, মলমূত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে, লোকে রক্তবমি করছে। জল নেই,  ওষুধ নেই, আলোর ব্যবস্থা নেই, নামমাত্র খাবার আর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আছে। একের পর এক মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় একটা এগারো বছরের ছেলের মনে কী ধরনের ভাবনা আসে? বিশেষ করে যখন তাকে কয়েক মাস আগে বাবা মা ভাই বোনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে?

ওলাউদা যে মরল না, সেটাই আশ্চর্য। সেই অন্ধকার খোলের মধ্যেই হয়তো ছেলেটা সার্ভাইভালের শিক্ষা রপ্ত করেছিল। কেউ তাকে শেখায়নি, কেউ উৎসাহ দেয়নি, কেউ সান্ত্বনা দেয়নি, কিন্তু কোনও এক মুহুর্তে বাচ্চা ছেলেটা ঠিক করে নিয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি সে মরবে না। কিছুতেই মরবে না। 

ওলাউদা মরেনি, ক্যারেবিয়ানে এসে পৌঁছেছিল সে। ডাঙায় পা রাখা মাত্র তাকে আবার বিক্রি করে দেওয়া হয়। তার নতুন মালিক ব্রিটিশ নেভাল অফিসার মাইকেল পাস্কাল। বন্দী ক্রীতদাসদের অবস্থা তখন কহতব্য নয়, কিন্তু ওলাউদার মধ্যে একটা বেপোরোয়া ভাব জন্মেছে। সে অত পরোয়া করে না, কাজ করে মন দিয়ে। কয়েকদিনের মধ্যেই পাস্কাল খেয়াল করলেন, তার নতুন চাকরটা যেন একটু অন্যরকম। ছেলেটার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, কাজেকর্মে চটপটে, মুখে মুখে জবাব দিতেও ভয় পায় না। একে খানিকটা শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে নৌবাহিনীর জাহাজের কাজে লাগানো যায়! 

পাস্কাল ওলাউদাকে পড়াশোনা শেখাতে শুরু করলেন, হাতেখড়ি দিলেন জাহাজ চালানোরও। দেখলেন, কালো ছেলেটা একেবারে যাকে বলে কুইক লার্নার, দু'বার তাকে কিছু বলতে হয় না। এদিকে ওলাউদা তখন ভেবে নিয়েছে, জীবন যুদ্ধে সে পরাজয় স্বীকার করবে না। প্রতিদিন নতুন করে শুরু করবে। নতুন জিনিস শিখবে, নতুন কথা জানার চেষ্টা করবে। পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করবে না। অন্যান্য ক্রীতদাসরা পড়াশোনার সুযোগ পায় না। সে পেয়েছে যখন, সেই সুযোগ হেলায় হারাবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই সে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি রপ্ত করে নিল। রোজ তার শেখার উৎসাহ বাড়ছে।

বছর কয়েক পর দেখা গেল, কিশোর ছেলেটা ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজে করে সারা দুনিয়া চক্কর দিচ্ছে। তখন সে আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে ইংরেজি বলে, তার নেভিগেশন স্কিল রীতিমতো ভালো, ঝড়ঝঞ্ঝায় ডরায় না। কেবিন বয় থেকে ভ্যালে বা ইঞ্জিন রুমের সহকারী, রাতপাহারা থেকে লাইফ সেভিং গার্ড, সব কাজেই সে সমান করিৎকর্মা।

বছরের পর বছর ধরে ওলাউদা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে চলল। কানাডা থেকে আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর, ক্যারেবিয়ান থেকে ইউরোপ... কত জাহাজে কতরকম কাজ কর‍ল তার ঠিকঠিকানা নেই। এই গোটা সময়টা ধরে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব জরিপ করল, অবজার্ভ করল, বইপত্র পড়ে নিজের জ্ঞান বাড়াল, লোকজনের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করে কানেকশন তৈরি করল আর পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটে গেল। মাঝে বেশ কয়েকবার মালিক বদল হয়েছে, তাকে মুক্তি দেওয়ার কথাও হয়েছে৷ মালিকরা কথা দিয়েছে, কিন্তু কেউই কথা রাখেনি। একটা কালা মানুষকে দেওয়া কথার কী দাম? ওলাউদা বুঝেছিল, মুক্তি চাইলে হয় পালাতে হবে, নয় নগদ দিয়ে কিনে নিতে হবে? আর মুক্তি পেলেও সে করবে কী? দিনমজুর হবে? না, আর নয়! তাকে ব্যবসা করতে হবে, নয় অন্য কোনোও কাজ করতে হবে। কিন্তু তা সহজে হবে না। বড় জায়গায় কানেকশন দরকার। আর একজন ব্ল্যাক নেটিভের জন্য সেই কানেকশন তৈরি করা সহজ নয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে সে এই কাজ করে গেছে। অবশেষে ১৭৬৬ সালে, বহু বছর ধরে দাসবৃত্তির পর সে চল্লিশ পাউন্ড দিয়ে তার স্বাধীনতা কিনতে পারল। তখন চল্লিশ পাউন্ডে একটা ঘোড়া পাওয়া যেত। এত বছরের পরিশ্রমের দাম চল্লিশ পাউন্ড। সেই টাকা দিয়ে তোমাকে নিজের মুক্তি কিনতে হবে। চমৎকার না!

তা মুক্তি পেয়ে ওলাউদা কী করল? তখনও সে যুবক, যে কোনও কাজেই সে যোগ দিতে পারত। বর্ণবৈষম্যের দুনিয়ায় সে যে বড় কিছু করতে পারবে না, সে তো জানাই কথা! কিন্তু ব্ল্যাক টাউনে একটা ছোট্ট দোকান, একটা সেলাই শপ, একটা কসাইয়ের দোকান দেওয়া হয়তো অসম্ভব ছিল না। এতদিন পর কিছুটা শান্তি কে চায়? 

কিন্তু, ওলাউদা অন্য ধাতুতে গড়া। সে কাউকে না জানিয়ে এতদিন ধরে নিজের জন্য নীরবে একটা অন্য জীবনের পরিকল্পনা করেছে, সেটা বাস্তবায়িত করতে সে বদ্ধপরিকর। বহু কষ্টে সে ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছাল। তারপর কাজ নিল অন্য একটা জাহাজে। সিম্যানশিপ তার রক্তে ঢুকে গেছে, ফ্রান্স, লুইসবার্গ, লাগোসের যুদ্ধে সে যোগ দিয়েছে, দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতা দিয়েই তাকে উপার্জনের পথ বের করতে হবে। সে একের পর এক জাহাজে, বিশেষ করে এক্সপিডিশন শিপে কাজ করতে লাগল। তার কাজ দেখে খুশি হয়ে ১৭৭৩ সালে ডক্টর চার্লস ইরভিং তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তিনি সমুদ্রের জল পরিশোধিত করার গবেষণা করছেন, এইচএমএস রেসহর্স বলে একটা জাহাজ নর্থ পোল অভিযানে যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি ওলাউদাকে নিতে চান। ওলাউদা এই অভিযানে যোগ দিল এবং ক্রমে ডক্টর ইরভিংয়ের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠল। নর্থ পোল থেকে ফেরার পর ইরভিং এর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সে সেন্ট্রাল আমেরিকার মসকিউটো কোস্টে গিয়ে আফ্রিকার ক্রীতদাসদের সুপারভাইজ করার কাজ নিল, পাশাপাশি তাদের পরিস্থিতি নিয়ে জার্নাল লেখাও শুরু করে দিল। তার জীবনে যত অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে, না লিখলে আমরা জানতেও পারতাম না।

১৭৭৮ সালে লন্ডনে ফিরে গিয়ে ওলাউদা আস্তে আস্তে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করল। এতদিনে তার কিছু সঞ্চয় হয়েছে, অনেকে তাকে চেনে, এই অবস্থান থাকা সত্ত্বেও সেটাকে ব্যবহার না করা বোকামি। আজীবন সে এই কাজটাই করতে চেয়েছে। ১৭৮০ সালে সে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করার জন্য অ্যাবোলিসানিস্ট মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করল। কয়েক বছরের মধ্যেই সে এই আন্দোলনের মুখপাত্র আর অন্যতম নেতা হয়ে উঠল। কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক করা, আইনি আর্জি দেওয়া, প্রস্তাবিত বিল নিয়ে আলোচনা করা, বিরোধ মিছিল গোটা ইংল্যান্ডে স্লেভ অ্যাট্রসিটি সম্পর্কে বিবৃতি দেওয়া শুধু নয়, আসলে ওলাউদা গ্রাসরুট লেভেল গিয়ে এই আন্দোলনের জমি তৈরি করেছে। দাসপ্রথা উন্মূলনের জন্য সে কী কী করেছে, সেটা নিয়ে বিস্তারে বলতে গেলে একটা বইই হয়ে যাবে। 

১৭৮৮ সালে ওলাউদার আত্মজীবনী প্রকাশিত হল, নাম 'The Interesting Narrative of the Life of Olaudah Equiano'. এর আগে ব্রিটেনের মানুষ কোনও কালো মানুষের জবানবন্দিতে ক্রীতদাস জীবনের কথা শোনেনি। ওলাউদার বইটা বাজারে ঝড় তুলে ফেলল। তার জীবনকালেই আট দশটা ভাষায় অনুবাদ হল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস থেকে লম্বা লম্বা চিঠি আসতে লাগল। সবাই তার জীবনের কথা পড়ে শকড। ক্রীতদাসদের জীবন ঠিক কীরকম হতে পারে সে নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। এই বইয়ের পর ইউরোপে জোর আলোচনা শুরু হল, দাসপ্রথা তুলে দেওয়ার জন্য চাপ পড়তে লাগল। ওলাউদা তখন আয়ারল্যান্ডে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। পরবর্তীতে আমেরিকান রেভোলিউশনারি ওয়ারের সময়ও গরিব আফ্রিকান আমেরিকানদের পক্ষ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, ঘুরে ঘুরে দুঃস্থ মানুষের সাহায্য করেছেন, রেডিকাল মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলে অপবাদ কুড়িয়েছেন, কিন্তু কাজ থামাননি। শেষ দিন অব্দি ক্রীতদাসদের মঙ্গলের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।

মাত্র বাহান্ন বছর বেঁচেছিলেন ওলাউদা ইকুয়ানো৷ এগারো বছর বয়সে তার বাড়িঘর পরিবার পরিচিত জীবন ছেড়ে এমন এক অনিশ্চিত জীবনে ঢুকে পড়তে হয়েছিল, যা সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না বাচ্চা ছেলেটার। অতীতের সমস্ত কথা, এমনকি নিজের আসল নামটাও বার বার ভুলে থাকার জন্য তাকে জোর দেওয়া হয়েছে। সেই ছেলেই যে একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করবে, তাদের প্রণেতা হয়ে উঠবে। 

জীবনে সব কিছুই সম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন