বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

ঘিবলিকে একা থাকতে দিন

 


কাজুও ওগা বলে কারো কথা লিখতে গেলে কতজন তাঁকে চিনতে পারবেন বলা মুশকিল। কিন্তু যদি বলি তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি স্টডিও ঘিবলির (অথবা জিবলির, উচ্চারণে কিছু আসে যায় না) মনকাড়া সিনেমার মায়াবী ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো এঁকেছেন, মিয়াজাকির প্রিয়পাত্র এবং ঘিবলি স্টুডিওজের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর, তাহলে অনেকেই নড়েচড়ে উঠবেন। ভদ্রলোক সম্পর্কে দু চার কথা লিখতে ইচ্ছে হল। কেন হল, সে কথা পরে লিখছি।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা যায়, কাজুও ওগা, স্টুডিও ঘিবলির একজন কিংবদন্তী তো বটেই, অ্যানিমেশন জগতে তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য। ওগা শুধু ছবি আঁকেন না, তিনি তাঁর তুলির আঁচড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রাণ সৃষ্টি করেন। তাঁর কাজের গভীরতা, রঙের ব্যবহার এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি ফ্রেমে স্পষ্ট বোঝা যায়।

কাৎসুহিরো ওতোমো একবার বলেছিলেন, চরিত্র মানে ক্যারক্টার অ্যানিমেশনের চেয়েও পটভূমি মানে ব্যাকগ্রাউন্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা বড় বিল্ডিং নির্মাণ করতে গেলে তার ভিত শক্ত হওয়া ভীষণ দরকার। ওগা সেই ভিত স্থাপন করেন, গল্পের ফাউন্ডেশন সৃজন করেন। মিয়াজাকির সিনেমায় আমরা যে জগৎ দেখি, দেখে মুগ্ধ হই, তার পেছনের কারিগর হলেন কাজুও ওগা। হ্যাঁ, মাই নেবার তোতোরো অথবা কিকিস ডেলিভারি সার্ভিস কিংবা হালের দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন, সমস্ত সিনেমার ক্যানভাস তিনি ভেবেছেন, এঁকেছেন। ভারতে না হলেও জাপানে সবাই তাঁকে একবাক্য চেনেন। ওগা ব্যাকগ্রাউন্ডকে কেবল কোনও স্থান হিসেবে দেখেন না, বরং ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইমোশনটাকে বুঝতে চান। গল্পের সঙ্গে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড যাবে, তা মানানসই কিনা, সেখানে রঙ বা এলিমেন্ট কী হবে, সেসব তো আছেই, কিন্তু এই প্রতিটা ব্যাকগ্রাউন্ড প্যানেল যেখানে চরিত্ররা ঘুরেফিরে বেড়াবে, তাদের জীবন ও ভাবনার সঙ্গে সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমোশনাল কানেক্ট হচ্ছে কী না, সেটা বোঝা, খোঁজা, আঁকা, পরীক্ষা করা আর ফুটিয়ে তোলাই তাঁর প্রধান কাজ। অবশেষে, প্রতিবার ওগা অসামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড উপহার দেন, এমন এক অনুভূতি তৈরি করেন, যা দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে বহুদিন বাদেও।

নাওয়া তানাকা (Naoya Tanaka) বলেছেন, ওগা প্রকৃতির স্বাভাবিক দৃশ্য ভাবেন না, বরং সেই দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্টগুলোর মূল ভাবনা বা সার এক্সট্র‍্যাক্ট করেন এবং সেগুলোকে এমনভাবে অগামেন্ট করেন, যাতে পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ দেখেও déjà vu-এর মতো মনে হয়। তাঁর কাজের বিশেষত্ব, তিনি খুব সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করেন। এমনিতেও পেশাদার কাজে যে পোস্টার কালার ব্যবহার করতেন, তা সাধারণত স্কুলের বাচ্চারা ব্যবহার করে। বাচ্চাদের রোজকার রঙ ব্যবহার করে জাপানের অন্যতম শিল্পী এমন সব চমকপ্রদ ল্যান্ডস্কেপ এঁকে সারা দুনিয়ায় লোককে মুগ্ধ কর রেখেছেন, সে কথা জেনে অনেকে অবাক হয়, বাচ্চারা সেই কথা জেনে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়। জাপানের ব্যাকগ্রাউন্ড শিল্পীদের জন্য এরপর পোস্টার কালারই ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়। স্টুডিও ঘিবলি Nicker Poster Color ব্যবহার করত, যা অনেকটা ওপেক ওয়াটার কালারের মতোই।

ভাবলে অবাক হতে হয়, এত এত কাজ, এই সমস্তই ওগা করেছেন মাত্র একুশটা রঙ ব্যবহার করে। রঙ নয়, এলিমেন্টের সঙ্গে মানানসই অনুভূতি ফুটিয়ে তোলাই ছিল প্রধান কাজ, ছোট ছোট জিনিসের ওপর ফোকাস করতেন, তারপর কম্বিনেশন ব্যবহার করে পছন্দসই লুক আনার চেষ্টা করা হত। রঙের গ্রেডেশন আর কম্বিনেশন নিয়ে খেলতেন, অল্প অল্প রঙ ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে নানারকম শেড আঁকতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পছন্দ না হলে আবার আঁকা হত। এক একটা সময় একটা ল্যান্ডস্কেপ একশো থেকে দুশবার আঁকা হয়েছে, বছর ঘুরে গেছে। কিন্তু যতক্ষণ না সেই আবেগটা ফুটে উঠছে, ওগা থামেননি, হতাশও হননি। রঙ বাদে কী থাকত তাঁর টেবিলে? কাগজ, জাপানি ফ্ল্যাট ব্রাশ TMK poster paper, fine-pointed Sakuyo ব্রাশ...ব্যস!

কিন্তু শুধুই কি দক্ষতা? না, পরেরদিকে লে আউট আর স্টোরিবোর্ড এর জন্য টিম থাকত, ওগার কাজ ছিল ফ্রিমিক্সিং এর ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো কংক্রিটে করা। কিন্তু টেবিলে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই রিসার্চ শুরু হত, দিনের পর দিন তিনি শহরতলি আর গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন, প্রকৃতিকে দেখতেন, মেঘ ছায়া রোদ্দুর দেখে রাফ স্কেচ করতেন, এই অবজার্ভেশন থেকেই কল্পনা উঠে আসত। পমপোকোর ঋতুবদলের সিন আঁকার জন্য তিনি তামাতে গিয়ে থাকতেন, সেখানকার ফলিয়েজ আর সিনারি মনে তুলে নিতেন, কাজের প্রতি নিষ্ঠার কোনও অভাব ছিল না। সে যতই পরিশ্রম হোক না কেন, যত দিনই লাগুক না কেন!

ওগা একা নয়, স্টুডিও ঘিবলির প্রতিটা কর্মী তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে এই নিষ্ঠা দেখিয়েছে। যতগুলো সিনেমা আপনি দেখেছেন, তার একটাও কম্পিউটারাইজড অ্যানিমেশন নয়, প্রতিটা হাতে আঁকা। এক একটা মুভমেন্ট অনেক সময় বছর কাবার করে দিয়েছে। একটা ভিড়ের সিন দেখানোর জন্য কুড়িজন শিল্পী মিলে ছয়মাস ধরে হাজার হাজার স্টোরিবোর্ড এঁকেছেন। একটা সিনের জন্য। সিনেমাগুলো শুধু শুধুই হয়নি।

ইদানীং দেখছি, এআইতে ঘিবলি মুভিজের অনুকরণে একের পর এক ছবি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে দেখলাম, হিন্দি বাংলা ছবির স্টিলের অনুকরণে গাদা গাদা ছবি জেনারেট হয়েছে, মুহুর্তের মধ্যে সেগুলো ক্রিয়েট করা যায়। কেউ ইমোশন নিয়ে ভাবে না, কেউ অবজার্ভ করে না, কেউ দিনের পর দিন পিঠ বেঁকিয়ে আঁকে না, কিন্তু ছবি হচ্ছে। কয়েকদিন আগে মিয়াজাকিতে এই নিয়ে প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, তিনি যারাপনাই ডিসগাস্টেড। এ শুধু শিল্পীদের নয়, মানুষের জীবনেরই অপমান। ইটস অ্যান ইনসাল্ট টু লাইফ ইটসেল্ফ।

সময় বদলাবে। প্রযুক্তি আসবেই। সব কিছু নর্মালাইজ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুটা সম্মান কি না থাকলেই নয়? এআইকে দিয়ে ঘিবলি স্টাইলে ছবি করার চেয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাবনার ছবিই তো হতে পারে! কিন্তু জানি, এই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। হয়তো কয়েক বছর পর এআই মিয়াজাকির স্টাইলে একটা গোটা সিনেমাই বানিয়ে দেবে। সেখানে কাজুও ওগা রঙয়ের কম্পোজিশন নিয়ে ভাববেন না, গাছপালা পাখিদের দেখে সময় নষ্ট হবে না, হাজার হাজার শিল্পীকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনের পর দিন আঁকতে হবে না। কিন্তু সিনেমা হিট হবে, ট্রেন্ড করবে, আমরা পোস্ট করব, পুরস্কারও পাবে সেই সিনেমা। মানুষের হাতে না তৈরি হলেও এআই আর্ট ক্রমে হিউম্যান আর্ট হয়ে যাবে, হিউম্যান ক্রমে ইনহিউম্যান হয়ে যাবে মানুষ থেকেও। তাই সইই।

কিন্তু, আমি চিরকাল মানুষের বানানো সিনেমাই প্রেফার করব। এইটুকু সেকেলে হয়ে থাকাই আমার প্রতিরোধ। আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি, মানুষ হয়েই মরব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন