একটা গান আপনার জীবন বদলাতে পারে? কয়েকজন হ্যাঁ বললেও অনেকেই হয়তো না বলবেন। সত্যি কথা বলতে, একটা বই, একটা পেন্টিং, একটা কবিতা, একটা সিনেমা বা একটা গান যে আদৌ জীবনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে, সে কথা সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ মানুষই বিশ্বাস করেন না। তর্ক না করে বরং একটা গানের চার লাইন শোনানো যাক, তারপর একটা গল্প হোক।
না, গানটার মূল লাইন এটা নয়। এই অংশটা আসলে কোরাসের পার্ট। গান শুরু হচ্ছে এভাবে...
Nelly Bly! Nelly Bly!
Bring de broom along,
We’ll sweep de kitchen clean, my dear,
And hab a little song.
কিন্তু, একটা মেয়ের কাছে কোরাসে গাওয়া ওই লাইনগুলো কীভাবে জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠল, সে এক অসামান্য কাহিনি। ১৮৫০ স্টিফেন ফস্টার এই গানটা কম্পোজ করেছিলেন এক দরিদ্র মেয়ে নেলি ব্লাইকে কল্পনা করে, যে শত দুঃখ কষ্টেও কোনোদিন ভেঙে পড়ে না, কোনোদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। তিনি জানতেন না, চোদ্দ বছর পর পেনিসেলভেনিয়াতে এলিজাবেথ বলে এক মেয়ে জন্মাবে, আর মায়ের পাশে রান্নাঘরে বসে তাঁর এই গান শুনতে শুনতে তাঁর জীবনে এক অদৃশ্য বদলের সূচনা হবে।
এলিজাবেথ জন্মেছিল আর্মস্ট্রং কাউন্টির কোচরান মিলসে। বাবার নাম ছিল মাইকেল কোচরান। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন দিন আনি দিন খাই মজুর হিসেবে, কিন্তু কর্মজীবনে নানা ঘাটের জল খেয়ে নানা কাজ করতে হয়েছে তাঁকে৷ কখনও পোস্টমাস্টার, কখনও মিল ওয়ার্কার, অবশেষে তিনি কোচরান মিলস কিনে ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যস্ত কর্মজীবনের মধ্যে তিনি দু'বার বিয়ে করেছেন, পনেরোটি সন্তানের বাবা হয়েছেন, কিন্তু প্রায় কাউকেই সময় দিতে পারেননি। অবশেষে যখন তিনি মারা যান, ব্যবসা পড়তির দিকে, দেনাপাওনা ভালোই বেড়েছে, তখন এলিজাবেথের বয়স মাত্র ছয়।
পনেরোজন সন্তানের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি বাঁটোয়ারা হওয়ার পর দেখা গেল, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে এলিজাবেথের মা আবার বিয়ে করলেন, এই ভেবে যে নতুন স্বামী দায়িত্ব নিলে অন্ততপক্ষে পাঁচ সন্তানের পড়াশোনা খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু সে বিয়ে টিকল না। প্রায় প্রতিদিন স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে, শুতে বসতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খোঁটা শুনতে শুনতে দিন কাটানো দুস্কর হয়ে পড়ল তাঁর জন্য। বরের হাত মার খাওয়ার সময় মেয়েকে রান্নাঘরে বসিয়ে যান, ফোনোগ্রাফ আবিষ্কার হয়েছে কয়েক বছর হল। এলিজাবেথ বসে বসে নেলি ব্লাইয়ের গান শোনে, পাশের ঘর থেকে মায়ের আর্তনাদ শোনা যায়। শোনা যায় অমানুষিক সব শব্দ। এলিজাবেথ মনপ্রাণ দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করে, এক একটা শব্দ তাঁর মাথার মধ্যে গেঁথে যায়।
এমন করে বেশিদিন চলতে পারে না। এলিজাবেথের মা ম্যারি বিবাহবিচ্ছেদ করে পিটসবার্গে চলে আসেন, তখন সে জায়গার নাম অ্যালেগেনি সিটি। সম্বল বলতে তেমন কিছুই নেই, পেট চালানোর জন্য একটা বোর্ডিং হাউস চালাতে শুরু করেন ম্যারি। ততদিনে এলিজাবেথ কিশোরী হয়েছে। পাঁচ ছেলেমেয়ে বোর্ডিং হাউসের কাজ করে হাঁফিয়ে পড়ে, দিনান্তে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম এলিজাবেথ। সে ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই পড়ে। ম্যারি এই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না, কিন্তু ম্যারি জেদ ধরে রইল, সে পড়া চালিয়ে যাবে। জেদ করে সে জোর করে ইন্ডিয়ানা নর্মাল স্কুলে নাম লিখিয়ে ফেলল, প্রায় চারশো মাইল দূরের কলেজ, কিন্তু টাকাপয়সা ছিল বা বলে এক সেমেস্টার পরেই তাকে বের করে দেওয়া হল। বোর্ডিং স্কুলে ফিরে আসা ছাড়া আর উপায় রইল না।কিন্তু মেয়ের জেদ কম নয়। সে পড়বেই। কিছুতেই সে পরিস্থিতির কথা বলে কান্নাকাটি করবে না, হার স্বীকার করবে না। নেলি ব্লাইয়ের মতোই সে লড়াই চালিয়ে যাবে।
এরকম করেই ছয় বছর কেটে গেল। ১৮৮৫ সালে পিটসবার্গ ডিসপ্যাচ কাগজে "What Girls Are Good For" বলে একটা কলাম ছাপা হল। সেখানে জানানো হয়েছে ভালো মেয়েদের জায়গা ঘরের ভিতর, তাদের কাজ শুধু পুরুষদের কাজে সাহায্য করা। সেই কলাম পড়ে এলিজাবেথের গা পিত্তি জ্বলে গেল। রেগেমেগে সে সম্পাদককে একটা চিঠি লিখে পাঠাল। নিজের নামের জায়গায় লিখল... লোনলি অরফ্যান গার্ল।
১৮৮৫ সালের কথা। জর্জ ম্যাডন তখন পিটসবার্গ ডিসপ্যাচের সম্পাদক। তিনি এই চিঠির ভাষা ও শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে সেটা কাগজে তো ছাপলেনই, সঙ্গে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন পাঠিকা যেন তার আসল পরিচয় জানিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। এলিজাবেথের কোনও সংশয় ছিল না। সে বিশ্বাসী ভঙ্গিতে কাগজের দপ্তরে গিয়ে জর্জ ম্যাডনের সঙ্গে দেখা করল। তার সঙ্গে কথা বলে ম্যাডন আবারও মুগ্ধ হলেন, এলিজাবেথকে নিয়মিত কলাম লেখার চাকরি দেওয়া হল। কিন্তু কয়েকদিন লেখার পরই সে মেয়ে একটা বেয়াড়া অনুরোধ করে বসল। এলিজাবেথ নয়, সে লিখতে চায় নেলি ব্লাই নামে। এই ছদ্মনামই তার কলমের পরিচয় হবে। ম্যাডন সব শুনলেন, বুঝলেন না ভালো, কিন্তু আপত্তি করলেন না৷
কিন্তু, কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যাডন বুঝতে পারলেন এই মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া। টেবল ওয়ার্ক করলে ওর মন ভরবে না। এলিজাবেথ থুড়ি 'ব্রেভ নেলি ব্লাই' কে ছদ্মবেশে স্থানীয় কারখানায় পাঠানো হল সেখানকার মহিলা কর্মচারীদের প্রতি চলতে থাকা অন্যায় অবিচারের ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। কোনও মেয়ের জন্য এই ধরনের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের কাজ সে যুগে ভাবাই যেত না। নেলি অবশ্য নিঁখুত পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে সেই ফ্যাক্টরির অন্তরীণ দুর্নীতি আর মেয়েদের জোর জুলুম করে খাটিয়ে নেওয়ার বিরোধে একের পর এক কলাম লিখে চলল। ফলে ফ্যাক্টরির মালিকরা গেলেন মহা চটে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে আবার ডেস্কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। কিন্তু ফ্যাশন আর ঘরোয়া বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার প্রতি নেলির বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, ব্রেভ নেলি নামটা যখন সে নিয়েছে, তখন পুতু পুতু করে জীবন সে কাটাবে না। পিটসবার্গ ডিসপ্যাচের ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে মেক্সিকোতে একটা জায়গা খালি ছিল। তখন সেখানে স্বৈরাচারী পোরফিরিও ডিয়াজের শাসন চলছে, কেউ ভয়ে যেতে চায় না৷ নেলি প্রায় জোর করে ছয় মাসের জন্য মেক্সিকো চলে গেল। সেখানে সরকারের নিষ্ঠুরতা আর প্রেস ফ্রিডমের সেন্সরশিপ নিয়ে সে এমন সব জ্বলন্ত ভাষায় কলাম লিখতে লাগল, মেক্সিকোর সরকারের বড়কর্তাদের কালঘাম ছুটে গেল৷ একজন লোকাল জার্নালিস্টকে বেআইনি ভাবে গ্রেপ্তার করা হলে নেলি ভীষণ কড়া ভাষায় পোরফিরিও ডিয়াজের আলোচনা করল। এরপর সে ক্রমাগত হুমকি পেতে শুরু করল। লোকাল গুণ্ডা থেকে পুলিশ, কেউ খুন করার ভয় দেখায় তো কেউ বলে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হবে। নেলি অবিচল। সে একা থাকলে নেলি ব্লাইয়ের ছোটবেলায় শোনা গান গুনগুন করে। সে কিছুতেই ভেঙে পড়বে না, কিছুতেই দুর্বল হবে না। শেষমেশ কেউ তাকে গ্রেপ্তার করেনি, পিটসবার্গ ডিসপ্যাচই ভয় পেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনে। নেলি এতে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে নিউইয়র্কে চলে আসে, কয়েকদিন ঘোরাফেরা করে 'নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে' চাকরি পেয়ে গেল সে।
এইবারের কাজটা আরো চ্যালেঞ্জিং। সত্যিকারের (এবং কোনও মেয়ের জন্য প্রথম) ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের কাজ, মাঝেমধ্যেই নানান ঝুঁকি নিতে নয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টটা এল যখন নিউয়র্কের মেন্টাল অ্যাসাইলাম মানে পাগলখানার পরিস্থিতি বিচারের জন্য একজনকে কাজ দেওয়ার কথা উঠল। নেলি প্রায় লাফিয়ে উঠে এই দায়িত্ব নিল। সে বদ্ধ উন্মাদ সেজে দশ দিন সেই অ্যাসাইলামে কাটিয়ে দিল, সব কিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর করল। এসে সে অ্যাসাইলামের অব্যবস্থা আর দুর্নীতি নিয়ে এইসা ভয়ানক ডিটেলস সহ রিপোর্ট লিখল যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি বসানো হল অ্যাসাইলামের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার জন্য, বাজেটও বাড়িয়ে দেওয়া হল কয়েক গুণ। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে নেলি পরে 'টেন ডেজ ইন দ্য ম্যাডহাউস' বলে একটা বই লিখবে, যে বই একশো বছর পরেও পাঠকপ্রিয়তা হারাবে না।
পরবর্তী দশ বছর ধরে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হিসেবে নেলি ব্লাই যে কত সামাজিক অবিচার আর দুর্নীতির কথা লিখেছে, কত শক্তিশালী মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। বহুবার হুমকি পেয়েছে, মাফিয়ারা ভয় দেখিয়েছে, নেতারা চোখ রাঙিয়েছে, কিন্তু নেলি পরোয়া করেনি। শুধু মনে মনে গুনগুন করে গেছে ছোটবেলায় শোনা সেই গান।
শুধু পেশার জন্য তদন্ত করেই অবশ্য সে থামেনি। অ্যাডভেঞ্চার তার ধমনীতে বইত। 'অ্যারাইন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' থেকে অনুপ্রানিত হয়ে সে একবার ৭২ দিনে দুনিয়া ঘুরে ফেলেছিল। সে এক ভ্রমণ বটে। চল্লিশ হাজার মাইলের এই রোমাঞ্চকর সফর করা হয়েছিল ঘোড়াগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার, নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি করে। এই গোটা সফরের বিবরণ ধরা আছে 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৭২ ডেজ' বইতে। কত প্রকাশক বেআইনি ভাবে ইংরেজি বই অনুবাদ করছেন, এই পাবলিক ডোমেনে থাকা চমৎকার বইগুলো তাঁদের চোখে পড়ে না কেন কে জানে?
এই বই লেখার পর নেলি সেলেব্রিটি হয়ে গেলেন। মেয়েরা সবাই নেলির উদাহরণ টেনে কথা বলতে শুরু করলেন। ষোল বছরের পারিবারিক জীবনের নানান ওঠানামার পর নেলি কিছুদিনের জন্য সাংবাদিকতা থেকে ব্রেক নিয়েছিলেন, ১৯১১ সালে তিনি 'নিউইয়র্ক ইভিনিং জার্নাল'- এর জন্য আবার কাজ করতে শুরু করেন। বারবার লেখালিখির মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন মেয়েরা কোনও অংশেই, কোনও ক্ষেত্রেই ছেলেদের চেয়ে কম নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইউরোপের ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে ট্রেঞ্চের ভিতরে থেকে রিপোর্ট করেছেন, এরম কোনও নজির তখন ছিল না। বাইরে যখন বোমা ফেলা হচ্ছে, নেলির বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে, তখনও সে মনে মনে ছোটবেলার গান গুনগুন করছে।
নেলি ব্লাই নেলি ব্লাই
নেভার নেভার সাই
নেভার ব্রিং দ্য টিয়ারড্রপ
টু দ্য কর্নার অফ ইওর আই
আট্টান্ন বছরের স্বল্প আয়ুতে যে সংবেদনশীল জীবন নেলি কাটিয়েছেন, যে সাহস দেখিয়েছেন, পুরুষপ্রধান সমাজে বহু মেয়েকে, এমনকি বহু ছেলেকেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। স্টিফেন ফস্টার শুধু জানতে পারলেন না, নেলির জন্য লেখা একটি গান আসলে সত্যি সত্যিই এক নেলিকে জন্ম দেবে, যার জীবনের সঙ্গে গানের এই লাইনগুলো একেবারে খাপে খাপ।
নেলি ব্লাই হ্যাভ আ হার্ট
ওয়ার্ম অ্যাজ আ কাপ অফ টি
অ্যান্ড বিগার দ্যান দ্য সুইট পট্যাটো
ডাউন ইজ টেনেসি
হ্যাঁ। একটা গানও আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন