মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

ব্ল্যাকহোলের ভিতর পিকনিক

 


মাঝে মাঝে এমন এক একটা কথা জানা যায় ভেবে মাথা একেবারে ভোম্বল হয়ে যায়। তার মধ্যেও লেভেল অফ ভোম্বলনেস সীমা ছাড়িয়ে যায় এমন খবর পেলে।
সাম্প্রতিকতম ঘটনার কথাই বলছি। নাসার বিজ্ঞানীরা আভাস দিয়েছেন আমাদের পৃথিবী, ইনফ্যাক্ট গোটা মহাবিশ্ব একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে বসে থাকতে পারে। আশংকা করা হচ্ছে মহাবিশ্বের জন্মই হয়েছিল একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। সিসিন লিউয়ের গল্প? আজ্ঞে না। একবর্ণও বানিয়ে বলছি না। বরং রিপোর্টটা ছোট করে জানিয়ে দিচ্ছি।
সন্দেহ নেই, JWST মানে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। মহাবিশ্বকে দেখার আর বোঝার পদ্ধতিতে বিপ্লব এসেছে বলা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিকতম ফাইন্ডিং দেখে বৈজ্ঞানিকদের ঘিলু নড়ে গেছে।
দশ বিলিয়ন ডলারের এই টেলিস্কোপ ২০২২ সাল থেকে কসমস অবজার্ভ করা শুরু করেছিল৷ এতদিন ধরে ডিপ স্পেস আর গ্যালাক্সিদের অবজার্ভেশন করে যে রিডিং পাওয়া গিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, ডিপ স্পেস আর আর্লি গ্যালাক্সির অধিকাংশই একদিকে রোটেট করছে। বারো আনা গ্যালাক্সি ঘুরছে ক্লকওয়াইজ, বাকিরা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরছে।
একটা র্যান্ডম মহাবিশ্বের ধারণা যদি করা হয়, ফিজিক্সের নিয়ম মেনে বৈজ্ঞানিকরা প্রত্যাশা করেন যে ৫০% ক্লকওয়াইজ ঘুরবে, বাকি ৫০% অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গ্যালাক্টিক রোটেশনেরও একটা প্রেফারড ডিরেকশন আছে, পছন্দ অপছন্দ আছে। যে ২৬৩টা গ্যালাক্সি অবজার্ভ করে এই কসমিক ডান্সের নির্ভুল ফাইন্ডিং পাওয়া গিয়েছে, তা JADES মানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ অ্যাডভান্সড ডিপ এক্সট্রাগ্যালাক্টিক সার্ভের একটা উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট। বহু সায়েন্টিস্ট রাতদিন কাজ করে রিডিংগুলো বারবার ভেরিফাই করেছেন, তাই ভুল হওয়ার চান্স প্রায় নেইই।
এখন এই অদ্ভুত অ্যানামলির পিছনের কারণ কী, সেই ভেবে সবাই মাথার চুল ছিঁড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কারণ যা হতে পারে, তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েই দিয়েছেন প্রজেক্টের টিম লিডার লিওর শামির। তিনি বলেছেন, "আমরা ঠিক নিশ্চিত নই কেন এমন হচ্ছে? কিন্তু একটা কারণ হতে পারে যে ইউনিভার্স ওয়াজ বর্ন রোটেটিং। (ল্যাও ঠেলা) ব্ল্যাক হোল কসমোজলিও এই ধারণাকে সাপোর্ট করে।"
এখন ব্ল্যাকহোল কসমোলজি কী? Schwarzschild cosmology বলেও অনেকে, এই ধারণার জনক রাজ কুমার রাজ কুমার পাথরিয়া আর আই জে গুড। তারা বলেছিলেন, Schwarzchild radius বা ইভেন্ট হরাইজন বলে যা প্রচলিত, যেখান থেকে আলোও ফিরতে পারে না, সেটাও আসলে ভিসিবল ইউনিভার্সের একটা দিগন্ত।
এককালে 'সাইলেন্টিয়াম' বলে একখান বই লিখেছিলাম বলে খানিকটা মাথা ঘামাতে হয়েছিল এসব নিয়ে, তাই মনে আছে, ইনফ্যাক্ট গল্পে এর ভূমিকাও ছিল। সত্যি বলতে ব্যাপারটা জটিল। সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় এই ধারণা বলছে (১) একটা ব্ল্যাকহোল যত এনার্জি আর ম্যাটারকে গিলে খাচ্ছে তা ব্ল্যাকহোলের অন্যপ্রান্তে নির্মিত হোয়াইট হোল দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু অন্য দিকে যে ইউনিভার্সটা হবে, সেটা হবে ভিন্ন। সেক্ষেত্রে এই ব্ল্যাকহোল আইস্টাইন রোসেন ব্রিজ বা ওয়ার্মহোল হিসেবে কাজ করবে। (২) যখন একটি মৃত নক্ষত্র কোলাপ্স হওয়ার ফলে একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, তখন একই সময়ে ওয়ার্মহোলের অপর প্রান্তে অবস্থিত হোয়াইট হোল থেকে একটা অন্য ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের জন্ম হয়। (৩) তার মানে দাঁড়াল, একটা ইউনিভার্সে একটা ব্ল্যাকহোল আছে আর সেই ব্ল্যাকহোলের ভিতরে আরেকটা ইউনিভার্স তৈরি হচ্ছে। আমাদের ইউনিভার্সও আসলে সেইভাবে একটা ব্ল্যাকহোলের ভিতরে অবস্থিত থাকতে পারে। (৪) নেস্টেড ইউনিভার্সের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল এই বলে যে সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র কোলাপ্স করলে যে ব্ল্যাকহোল হবে তাতে তার দৈর্ঘ্য হবে দু মাইলের মতো, তার ভিতর এত বড় ইউনিভার্স তৈরি হবে কী করে? তাতে অঙ্ক কষে বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে থিওরিটিকাল ফিজিসিস্ট নিকোদাম পাপোলাস্কি বলেছিলেন, বাইরে থেকে ছোট মনে হলেও ব্ল্যাকহোলের ভিতরে দূরত্ব আর সময় অন্য ভাবে কাজ করে, অর্থাৎ একটা পুঁচকে ব্ল্যাকহোলের ভিতর গোটা ব্রহ্মাণ্ড থাকতে পারে, মাখন চুরি করে খাওয়া কৃষ্ণের মুখের মতোই।
এই কন্সেপ্ট পুরোপুরি গৃহীত হয়নি, যদিও ফান্ডামেন্টালি সব ঠিকই আছে। কিন্তু এতদিনের সায়েন্টিফিক কন্ডিশানিং থেকে অত সহজে কেউ বেরোতে পারে না। এখন এই জেডস এর বৈপ্লবিক ফাইন্ডিংসের পর সবাই নড়েচড়ে বসেছে। লিওর শামির বলেছেন, "যদি সত্যিই তাই হয় যে আমাদের ইউনিভার্স জন্মেছিলই রোটেটিং অবস্থায়, আর আমরা সত্যিই এক ব্ল্যাকহোলের ভিতরে বসে আছি, তাহলে কসমসের সমস্ত নিয়ম নতুন করে ভাবতে হবে।"
এখন এর মধ্যে স্পেসটাইম টরশন আর পাস্ট ফিউচার সিমেট্রির অনেক জটিলতা আছে, ব্ল্যাক হোল কসমোলজি হলে গ্যালাক্সির প্রেফারড রোটেশন কীভাবে বদলায়, সেসব জটিল অঙ্ক আছে, সেই সব আর লিখলাম না। নাসা বা স্পেসের সাইটে ডিটেলস পাওয়া যাবে। আপাতত আক্কেল গুড়ুম করার জন্য খবরটাই যথেষ্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন