বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫
ফ্যামিলি স্টাইল: স্টাইল সে জিনে কা
বুধবার, ৭ মে, ২০২৫
মাই টেন্ডর ম্যাটাডোর
চিলিতে 'মাই টেন্ডর ম্যাটাডোর' বইটির একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। আধুনিক যুগের কুইয়ার ক্লাসিক তো বটেই, পেদ্রো লেমেবেলের এই উপন্যাস ১৯৮৭ সালের যে সময়টা তুলে ধরেছে, যখন চিলিতে বুগিউগি চলছে। ইউনিভার্সিটি চত্বরে ছাত্ররা একাধিক রেবেল গ্রুপ বানিয়ে প্রটস্ট করছে, কমিউনিস্ট গেরিলাবাহিনী পিনোচেকে খুন করে 'ডেমোক্রেসি' আনবে বলে হুঙ্কার দিচ্ছে, ওদিকে সরকার একের পর এক নতুন আইন বানাচ্ছে আর স্টেট স্পন্সর্ড মিডিয়া দেশের সাধারণ মানুষের ব্রেনওয়াশ করে ফেলেছে প্রায়। এমন সময় এই উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়। মূল স্প্যানিশে উপন্যাসের নাম হল Tengo miedo, torero যা আসলে সারা মন্টিয়েলের একটা বিখ্যাত গানের লাইন। এখন এই লাইনের সঙ্গে নানান ইমোশনাল অ্যাস্পেক্ট, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর নস্টালজিয়ার গল্প জড়িয়ে আছে, সে বলাই বাহুল্য। হিস্প্যানিক সাহিত্যে জনপ্রিয় প্রবাদ বা গানের কথা ব্যবহার করে উপন্যাসের নাম রাখা খুব কমন ব্যাপার, কিন্তু সে নিয়ে আপাতত আর কথা খরচ করলাম না।
আসল কথা হল, পেদ্রো লেমেবেলের এই উপন্যাস ২০০১ সালে প্রকাশিত, এই নিয়ে আগেও অনেক সিনেমা নাটক হয়েছে, এখনও হচ্ছে। নতুন যুগে পাঠকদের আগ্রহ দেখে পুশকিন প্রেস বইটা নতুন করে প্রকাশিত করেছে ২০২৫ সালে। বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, শেষ করতে বেশ সময়ই লাগল। কেন?
কারণ, উপন্যাসটা ঠিক গতানুগতিক উপন্যাসের মতো লেখা হয়নি। চ্যাপ্টার ফ্যাপ্টারের বালাই নেই। মূল চরিত্র কুইন অফ দ্য কর্নার বলে একজন 'ট্রাভেস্টি' বা মাঝবয়সী সমকামী, তাঁকে মাঝেমধ্যে হি, আবার মাঝেমধ্যে সি লেখা হয়েছে। লাতিন আমেরিকায় ট্রাভেস্টি মানে সম্ভবত পুরুষ যিনি মহিলাদের মতো ক্রস ড্রেস করেন, কিন্তু চরিত্রটির মনের ভাব বা সিদ্ধান্তগুলো বুঝতে আমার বেশ সময় লেগেছে।
এখন এই কুইন একজন তরুণ ছাত্রের প্রেমে পড়েছেন, সেই ছাত্রটির নাম কার্লোস। সে কুইনের বাড়িতে নানান সন্দেহজনক জিনিসপত্র রেখে যাচ্ছে, অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে এসে গোপনীয় আলোচনা করছে, কিন্তু কুইনকে কিছু জানাচ্ছে না। আর প্রেমে অন্ধ হয়ে কুইনও জিজ্ঞেস করছেন না। আমি দিব্যি বুঝতে পারছি, কার্লোস প্যাট্রিওটিক ফ্রন্টের গেরিলাবাহিনীর সৈনিক, সে আসলে অস্ত্রশস্ত্র গোপনে রাখার জন্য কুইনের বাড়িটা ব্যবহার করছে। কিন্তু কুইন বুঝছেন না কেন? না তিনি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না? এটা কি ও-ই 'একতরফা পেয়ার' এর পাগলামি? কার্লোসের মনে কি তাঁর জন্য কোনও ইমোশন আছে, নাকি সবটাই তাঁর ভালো ব্যবহার শুধুই তার কাজ বের করার ফন্দি? এইসব ঝামেলা না হয় হল, কিন্তু এরমধ্যে খোদ পিনোচে আর তাঁর স্ত্রী লুসিয়াও এসে পড়েছেন। পিনোচের স্বৈরাচারী শাসনের সিদ্ধান্ত, ডিপ্লোম্যাসি, এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার চলছে, আবার তাঁদের পারিবারিক জীবনের ঝামেলাও এসে পড়ছে।
এখন বইটায় না অধ্যায় আছে, না ঘটনার ভাগাভাগি আছে, না ডাবল কোট ইত্যাদির ব্যবহার আছে। সংলাপগুলো সব ন্যারেটিভে চলে এসেছে আর চারটে বাক্যের মতো। কুইনের সঙ্গে কার্লোসের কথা চলতে চলতেই লুসিয়া আর পিনোচের কথা শুরু হয়ে যাচ্ছে, কুইনের বেদনাদায়ক অতীতের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে লুসিয়ার অতীত। আর তার সঙ্গে চলছে চিলিতে চলতে থাকা অভ্যুত্থানের লড়াই। ছাত্ররা প্রটেস্ট করছে, সেনাবাহিনী কার্ফিউ জারি করে লোকজনের ঘরেঢুকে পড়ছে, গেরিলাবাহিনী আক্রমণ করছে, ওদিকে কুইন অফ দ্য কর্নার তাঁর ওয়ানসাইডে লাভ লাইফ নিয়ে উৎকণ্ঠায় মরে যাচ্ছেন, নিজের বিপদ ডেকে এনে কার্লোসদের সাহায্য করছেন। এই কাহিনির চলন ধরতেই আমার অনেকটা সময় লেগে গেল।
আসল কথা হল, পেদ্রো নিজে সমকামী আর চল্লিশ বছর আগে সান্তিয়াগোর একজন সমকামী মানুষ, যে রেডিও আর সেলাইবোনাই নিয়েই বেঁচে আছে, সে প্রেমকে কীভাবে এক্সপ্রেস করবে, আমরা প্রথমে তা বুঝতে পারি না। তাঁর এক্সপ্রেশন, তাঁর শৈলী, তাঁর কবিতা, তাঁর বিষাদ, সবই আমাদের অচেনা। তাই অনেকেই একসময় এই বইটা পড়ে বিরক্ত হয়েছিলেন, বোলান্যো নাকি বলেছিলেন, এমন corny প্রেমের উপন্যাস আমার চাই না। কিন্তু আসলে এই প্রেম কর্নি নয়, প্রাচীনপন্থী নয়, ন্যাকা নয়, সময় ও চরিত্রের নিরিখে, এইটাই বাস্তব।
“So, like a buzzing bumblebee, he came and went through the house, feathered in his stole of: Yes, Carlos. No, Carlos. Maybe, Carlos. Perhaps, Carlos. As if the repetition of the name embroidered its letters in the air, lulled by the echo of his nearness. As if the pedal of that snarling tongue insisted on naming him, calling him, licking him, savoring those syllables, chewing that name, filling itself entirely with that Carlos so deep, that name so broad, that it remained all sigh, wrapped between the C and the A of that C-arlos that illuminated the entire house with its presence.”
একবার ব্যাপারটা ধরে নেওয়ার পর আমার আর অসুবিধা হয়নি। পেদ্রো লেমেবেল আসলে নিজেই কুইন, তিনি কুইয়ার লেখক হিসেবেই বিখ্যাত, সারাজীবন ক্রসড্রেস করেছেন, মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় গল্পটা অনেকটাই আত্মজৈবনিক, অটোফিকশন। কিন্তু তাই বলে দেশের তৎকালীন অবস্থা পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। সান্তিয়াগোর যানবাহন থেকে স্টুডেন্ট লাইফ, সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তা, রাজনৈতিক পপরিস্থিতি সবই চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন, কিন্তু এসবের ঊর্ধ্বে গিয়েও বারবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, এটা আসলে আদতে একটা প্রেমের গল্প। এখন সেই প্রেম কতজন বুঝছে বা কতজন বুঝছে না, সেটা ভাবার দায় তাঁর নয়।
ছোট বই। কিন্তু এটা ইবুক রেকামেন্ড করব না। ভাষা আর শৈলীর কারুকাজ আছে, হার্ডকপি পড়লেই সুবিধা হবে মনে হয়।
পুশকিন প্রেস
রবিবার, ৪ মে, ২০২৫
অপ্রাগৈতিহাসিক
কল্পবিশ্বের হাত ধরে যে প্রতিভাবান স্পেকফিক লেখকদের একটা ব্যাচ উঠে এসেছে, তাতে সোহম গুহ-এর নাম আলাদা করে বলতেই হয়। ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সোহমের কয়েকটা গল্প পড়েই আমি তাঁর ছকভাঙা লেখার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিষয়বস্তু ও চিন্তাভাবনার দিক থেকে অভিনব তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা, সোহমের কলম যে কল্পবিজ্ঞান লেখে, তাতে 'বাঙালি পাঠক ও জিনিস বুঝবে কি না! একটু সহজ করে লিখব নাকি?' জাতীয় মেন্টাল ব্লকেজ থাকে না।
যা থাকে, তা হল এই ভাবনাটা। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে কল্পবিজ্ঞান লিখতে বসেছি যখন, এই যুগের সেরা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সঙ্গেই পাল্লা দিতে হবে, তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে, স্ট্রেট অ্যান্ড সিম্পল। এখন, এই অ্যাস্পিরেশন হয়তো অনেকেরই থাকে, কিন্তু সত্যি কথা হল, অ্যাস্পিরেশন থাকলেই তো হয় না, একটা বিশেষ ঘরানায় নিজের লেখাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে, আন্তর্জাতিক করে তুলতে হলে, বহুস্তরীয় করে তুলতে হলে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়। আমি সেরা কল্পবিজ্ঞান লিখতে চাই, আবার সেরা ঐতিহাসিক গল্পও লিখব, অসামান্য সামাজিক কাহিনি লিখব, মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথাও লিখে দেব ঝটপট... ওসব শুনতেই ভালো লাগে। বাস্তবে, জিনিয়াস বাদে অমন কেউ করতে পারে না। আমার যতদূর ধারণা, সোহম জানেন, তিনি স্রেফ কল্পবিজ্ঞান লিখবেন এবং মন দিয়ে লিখবেন। সেই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছেন, হোমওয়ার্ক করেছেন, করছেন, বইপত্রের পাশাপাশি আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের চলন ও দর্শন তিনি একদম গুলে খেয়েছেন। না খেয়ে থাকলে 'অপ্রাগৈতিহাসিক' এর মতো লেখা বেরোতে পারে না।
বইটা পড়েছি বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু আপাতত বইটা সঙ্গে নেই বলে বিস্তারিত আলোচনা লেখা একটু মুশকিল। কিন্তু এমন একটা উচ্চাকাঙ্খী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে যে পরিশ্রম লেগেছে, সে নিয়ে স্পেকফিক আগ্রহী পাঠক হিসেবে দু চার লাইন লিখে রাখলে অন্যায় হবে না।
প্রথমেই, অতি সংক্ষিপ্ত সামারি।
'অপ্রাগৈতিহাসিক' আসলে কী নিয়ে? প্রথমেই জেনে রাখা ভালো, টেকনিক্যালি বইটির নাম 'অপ্রাগৈতিহাসিক: প্রথম পর্ব (ঈশ্বরের বাগান)' এবং এ-ই বইটি একটা ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। তেলেঙ্গানার বেআইনি খনিতে কয়েক কোটি বছর পুরোনো একটা ফসিলে মানুষের জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে, সেই কথা চাউর হতে একাধিক দেশের বিজ্ঞানী ও সরকার নড়েচড়ে বসেছেন। এবং সেই সূত্রে একটা অভিযানের সূচনা হয়, যা এই বইটির মূল বিষয়বস্তু। এটুকুতে আশা করি প্লটের কোনও স্পয়লার দেওয়া হল না।
বাট ওয়েট, ডিড আই সে প্লট? বাট ওয়েট, প্লট ইজ নট দ্য অনলি কি থিং হিয়ার! প্লট আছে, কিন্তু শুধুই প্লট থাকলে এই বইয়ের কথা লিখতে হত না। হুম, এখানে দু এক কথা আরো বলে রাখি! বইটা পড়ে আমার অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে যা মনে হয়েছিল সেইটুকুই, কারণ লেখক বা অন্যান্য পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতা বা ইন্টারপ্রিটেশন আমার চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে।
'অপ্রাগৈতিহাসিক' ভীষণ একটা চনমনে সাস্পেন্স থ্রিলারের ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে। একের পর এক রহস্য, অজানা তথ্য, প্রাগৈতিহাসিক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যুগের স্টেট অফ দ্য আর্ট টেকনোলজির তাকলাগানো তথ্য, এবং মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া জটিল সব প্রশ্ন একে অপরের সঙ্গে মিশে একটা স্পাইডারনেট তৈরি করেছে। অনেক পাঠক হয়তো ভাবছেন বইটা একদম টেকনো থ্রিলারের ভঙ্গিতে শেষ লাইন অব্দি আপনাকে এজ অফ দ্য সিটে বসিয়ে রাখবে। মারকাটারি অ্যাডভেঞ্চার হবে ক্রিকটনের বইয়ের মতো। আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু না, বইটার মাঝামাঝি গিয়ে আমার মনে হয়েছে, 'ওই বইটা' লেখক লিখতে চাননি। এখানে রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটছে পরপর, সার্ভাইভালের জন্য দাঁত চাপা লড়াই আছে, গায়ের রোম দাঁড় করানো ঘটনা আছে, অ্যাড্রেনালিন রাশ আছে, গতিও আছে, কিন্তু সেই সব ছাপিয়ে কেন এই বইটা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে তার কারণ হল, বইটা আসলে একটা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটা বিশেষ দর্শনকে অবলম্বন করে এগিয়েছে, যার নাম পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম।
এখন ওপর ওপর দেখলে মনে হয় পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এমন আর কী নতুন জিনিস? ট্রাডিশনালি একরকম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি লেখা হত, তাতে অনুমান করা হত বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে হতে এমন একটা সময় আসবে যখন এই সমস্ত চমৎকার জিনিস থাকবে কিংবা তার ফলে কিছু কিছু ক্রাইসিস তৈরি হবে। কিন্তু পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এই বিশ্বাসটাকেই চ্যালেঞ্জ করে। এখন technological determinism কে চ্যালেঞ্জ করে বলা যে এআই এলে এই সমস্যা হবে বা রোবটরা বেশি শক্তিশালী হলে মানুষকে দাস হয়ে থাকতে হবে খুবই প্রাথমিক লেভেলের কল্পনা, সে নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে। কিন্তু সমকালীন post-paradigm shift আরো অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন তুলছে, সেখানে আসলে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব চেতনা আর মরালিটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা দুর্ঘটনা কীভাবে সমগ্র মানবজাতিকে একটা নৈতিক দ্বন্দের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই পিসিপি ঘরানার প্রধান অস্ত্র।
সেখানে কিছুই নিশ্চিত নেই, সবই ধোঁয়াশা! যদি বিজ্ঞানের অগ্রগতির পূর্বপরিকল্পিত ভাবনাটাই মিথ্যা বলে জানা যায়? মানুষ বা মহাকাশ বা সময়ের যে প্রমাণিত কন্সেপ্ট আছে, তাই যদি বদলে যায়? সত্যি বলতে, বাস্তবেও scientific dogmatism এর দিন চলে গেছে। দিন দিন নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে, তার ফলে বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুই রিভিজন করতে হচ্ছে। এর বিকল্প নেই, কারণ 'নতুন' বিজ্ঞান বলছে 'পুরোনো' বিজ্ঞান ভুল, আবার 'ভবিষ্যতের বিজ্ঞান' ও 'বর্তমানের বিজ্ঞান' কে ভুল বলবে বলে অনেকের বিশ্বাস। কে জানে? এই বাস্তবতাবোধ, এই এপিস্টেমিক হিউমিলিটির ফলে মানবজাতির সত্তা ও অস্তিত্বের ধারণাই এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে কোনও কিছুর নিশ্চয়তা নেই।
পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম শিফটে এ-র সঙ্গে ঢুকে গেছে পোস্টমর্ডানিজম আর সিউডোসায়েন্সের নানান ধারণা। নতুন প্রযুক্তির ভুল এবং ইনএফিসিয়েন্সির ফলে নানারকমের পারশেপশন তৈরি হচ্ছে। এই যেমন, যে অ্যাপে টাইপ করছিলাম, সেখানে ইংরেজি শব্দ Dogmatism টাইপ করতেই বাংলায় 'কুকুরজাতীয়' লিখে দিল, Paradigm কে প্যারাডাইম না লিখে প্যারাডিগম লিখে ফেলল, epistemic কে 'জ্ঞানমূলক' করে দিল। অটোকারেক্টের তো যা তা অবস্থা! এখন আমি ভাবছি প্রযুক্তিটা ইনএফিসিয়েন্ট, কিন্তু তবু আমরা গুগল টাইপিং আর ট্রান্সলেট ব্যবহার করছি। এখানেই একটা গোটা জাতির দ্বন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বেলাইনে চলে এসেছি। এ নিয়ে বিশদে বলা এখানে অসম্ভব। কিন্তু বটমলাইন হল, আধুনিক কালে এই দর্শনকে অবলম্বন করে লেখা কল্পবিজ্ঞানে মূলত সময়, ইতিহাস, প্রযুক্তি এবং মানুষের অস্তিত্বচেতনার জটিল প্রশ্নগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই বইগুলো শুধুই বিজ্ঞাননির্ভর অনুসন্ধানের গল্প বলে না, বরং মানবচেতনার দার্শনিক দিকগুলো নিয়ে একটা কাহিনি বুনে তোলে। 'অপ্রাগৈতিহাসিক' ও তার ব্যাতিক্রম নয়।
আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের যে আরেকটি বিশেষত্ব এই উপন্যাসে পুরোদমে আছে, তা হল কল্পকাহিনির মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ার কথা তুলে ধরে। সহজ হিসেব হল, কল্পবিজ্ঞান আসলে আগামীর গল্প নয়, সার্থক কল্পবিজ্ঞান চিরকাল বর্তমানের কাহিনি বলতে চেয়েছে। মোড়ক যা ইচ্ছে হতে পারে, রূপক যা ইচ্ছে ব্যবহার করা যেতে পারে, মহাকাশ থেকে জলের নিচে, হাজার বছর পরের দুনিয়া বা হাজার বছর আগের দুনিয়ায় কাহিনি থাকলেও, আসলে তা আজকের গল্প। লেখায় বর্তমানের প্রতিফলন না থাকলে, সোশিওলজিকাল কন্টেক্সট না থাকলে, এই সময়ে অনুভব করা অসহায়তাগুলো লেখায় ফুটিয়ে না ওঠাতে পারলে সেই কল্পবিজ্ঞান কোনও কাজের নয়। এখন যদি কোনও পাঠক সায়েন্স ফিকশনে শুধু উদ্ভট গ্যাজেট খুঁজছে, এলিয়েন খুঁজছে আর রাজনীতি আর সোশ্যাল রিয়ালিটির আলোচনা/সংলাপ পেলেই হাই তুলছে, তাহলে তা পাঠকদের সমস্যা, সায়েন্স ফিকশন বা তার লেখকদের নয়। না না, আমি বলছি না, বিদ্বজনেরা বলছেন।
সেই জায়গা থেকে সোহমের উপন্যাস টপনোচ। প্রথম বইতেই তিনি যথাসম্ভব সোশ্যাল রিয়ালিটি দেখিয়েছেন, ক্রাইসিসটাকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বুনেছেন, পাঠকদের অনাদি-অনন্ত বিস্তৃত জটিল সায়েন্টিফিক-এথনিক ডিলেমার মাঝে ফেলেছেন, এবং যতটা সম্ভব রোমাঞ্চ আর গতি বজায় রেখেছেন। তার ভাষাটাও ঠিক চিরাচরিত বাংলা নয়, একদম ঝরঝরে স্বতঃস্ফূর্ত বাংলা বলতে যা বোঝায় তা নয়, ইংরেজি স্পেকফিকে যে ধরনের ভাষা বা বাক্যগঠন থাকে, অনেকটা সেই ধাঁচের। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি, পাঠসুখে ব্যাঘাত ঘটেনি, বরং ব্যাপারটা লেখকের ক্রিয়েটিভ চয়েজ বলেই মনে হল। মেলভিল বা ম্যারি ডোরিয়া রাসেলের মতো অনেকেই গতানুগতিক ইংরেজি বর্জনকে একটা নিজস্ব ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন, খানিকটা সেরকমই। আরো খোলতাই ভাষা হলে পড়তে বেশি ভালো লাগত না লাগত না, সেটা আপাতত বোঝার উপায় নেই।
যাই হোক, বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জগতে এই বইটি এবং সিরিজটি অতি প্রয়োজনীয় সংয়োজন হতে চলেছে, সেটুকু স্বীকার না করে উপায় নেই। যাঁরা সিরিয়াস সাই ফাই নিয়ে ইন্টারেস্টেড, এই বইটা মিস না করাই ভালো। আপাতত দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায়।
অপ্রাগৈতিহাসিক
সোহম গুহ
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
Mythopoeic শৈলীর গ্রাফিক নভেল
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫
শাউন ট্যানের ওয়ার্ডলেস ক্লাসিক
এক যুগ পর শাউন ট্যানের ওয়ার্ডলেস ক্লাসিক কাজটা পড়া হল। মন্ত্রমুগ্ধ বললে কম বলা হয়। মাথা খারাপ করে দেওয়া ভাবনা। গ্রাফিক নভেলের যাবতীয় নিয়ম ভেঙে ফিল্মমেকিং প্রসেস অনুসরণ করে কাজটা করেছেন ট্যান, প্রতিটা সিকোয়েন্সের স্টোরিবোর্ড এঁকেছেন, সত্যিকারের মানুষদের মডেল করে চরিত্রগুলো এঁকেছেন।
কী নিয়ে এই গ্রাফিক নভেল?
খাতায় কলমে এক ইমিগ্র্যান্টের গল্প। সে এক কাল্পনিক দুনিয়ায় গিয়ে পড়েছে। সেখানে নিয়মকানুন আলাদা, ভাষা আলাদা। বাস্তবে একজন ইমিগ্র্যান্ট নতুন জায়গায় গিয়ে যেসব ঝামেলায় পড়ে, ফ্যামিলিকে নিয়ে আসার আগে কাজকর্ম জোগাড় করতে হবে, পরিচিতি বাড়াতে হবে, একাকীত্ব কাটিয়ে রোজ চেষ্টা করতে হবে ইন্টিগ্রেট করার।
আর্টওয়ার্ক নিয়ে কথা বলার আস্পর্ধা আমার নেই। গোটাটাই সিপিয়া টোনে পুরোনো ফোটোগ্রাফ স্টাইলে আঁকা, মাঝেমধ্যে পাতা জুড়ে একটাই ছবি। এবং, একটাও সংলাপ নেই।
আশ্চর্য কথা, এই গ্রাফিক নভেলটা আসলে ছোটদের জন্য লেখা। কিন্তু বড়দের জন্যও এই লেভেলের ক'টা কাজ হয়েছে, সেটা খুঁজে দেখতে হবে।
Arthur A. Levine Books
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫
টোকিও আজকাল
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
রহস্য বাকি আছে (ভারতবর্ষ)
গত সপ্তাহে আফ্রিকায় কতরকম আবিষ্কার হচ্ছে, সেই নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। তার আগে মিশর নিয়েও একটা আপডেট দিয়েছি। অনেকের হয়তো ধারণা হতে পারে, আবিষ্কার- ফাবিষ্কার বুঝি দেশের বাইরেই সব হচ্ছে। পোস্ট ট্রুথ ইন্ডিয়ান সোসাইটিতে গবেষণা-ফবেষণা সব গোল্লায় গেছে, সবাই ফালতু বকতেই ব্যস্ত, তাঁদের মিষ্টি হাসি হেসে বলতে হয়, একশো চল্লিশ কোটির দেশে ও কথা ভাবাও পাপ। ভারতবর্ষে আজও এমন মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, যারা একের পর এক কামাল করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে সেই সব কথা পৌঁছতে পারে না, তাঁদের নিয়ে কেউ ব্রেকিং স্টোরি করে না, এইটুকুই যা দুঃখের। যাকগে, অন্তত পাঁচটা বিষয় নিয়ে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক আর আবিষ্কারকরা কী কী চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারছেন, সেই নিয়ে কয়েক লাইন করে লিখে দিলাম। বড় লেখা কেউ পড়েও না। কেউ আগ্রহী হলে বিস্তারিত পড়তেই পারেন খুঁজে।
১) প্রথমেই পুরাতত্ত্ববিদদের কাণ্ডকারখানা দেখা যাক। আমাদের দেশে আর্কিওলজিস্টদের নানা রকম ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইতিহাস খুঁড়ে বের করা ঢের ঝক্কির কাজ, টাকাফাকাও লাগে, খোদ সরকারেরও ওতে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সামান্য বাধানিষেধ পেলেই বড় বড় প্রজেক্ট তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে, এক্সক্যাভেশন সাইটে খাটিয়ে রাখা ত্রেপল নিজেই ফসিল হয়ে যায় আর কি! তবু ভারতীয় আর্কিওলজিস্টরা হাল ছাড়তে রাজি নয়। গত কয়েক বছরে তারা এমন সব রোমাঞ্চকর তথ্য জানতে পেরেছেন যে দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেছে।
প্রথমেই বলতে হয় কিলাদি এক্সপিডিশনের কথা। তামিলনাডুর কিলাদি আর কাছাকাছি অবস্থিত অন্যান্য এক্সক্যাভেশন সাইট থেকে পাওয়া তথ্য এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে যে ইতিহাসবিদরা দাড়ি চুলকে পোকা বার করে ফেলছেন প্রায়। ব্যাপারটা ইতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে৷ কিলাদিতে বহুদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্রাফিতি-চিহ্নিত মৃৎপাত্রের টুকরো, খোদাই করা চাকা, সোনার অলংকার, হাতির দাঁতের পাশা, জীবজন্তুদের মূর্তি তো আছেই, কিন্তু আসল ঝামেলা বেধেছে সেখানে পাওয়া সঙ্গম টেক্সট নিয়ে। কিলাদি থেকে প্রচুর পরিমাণে পটারি আর অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে, তার ওপর তামিল ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা খোদাই করা আছে। পড়ে সকলের ঘুম উড়ে গেছে। এ যে সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে।
এখন সঙ্গম সাহিত্য আবার কী জিনিস? খুব ভাসাভাসা বলতে হলে বলতে হয় তামিল সাহিত্যে সঙ্গম সাহিত্যের টেক্সট প্রায় একটা লিজেন্ড। সঙ্গম সাহিত্য আসলে ব্যাকরণ গ্রন্থ কাব্যসংকলন (তোল্কাপ্পিয়াম) আর তা বাদেও আটটা গ্রেটার টেক্সট নিয়ে একটা প্রাচীন সাহিত্য জনরা, সেগুলো আবার দু ভাগে শ্রেণীভক্ত করা হয়েছে। অত ঝামেলায় না গেলে বলি, উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে আকানানুরু (৪০০ প্রেমের কবিতা), পুরানানুরু (৪০০টা বীরত্বপূর্ণ কবিতা), কুরুন্থোগাই (ছোট প্রেমের কবিতা) এবং নাত্রিনাই (পাঁচটা সিনসিনারি নিয়ে কবিতা) ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হল, সঙ্গম লিটারেচর দাবী করে তামিল সভ্যতা ৬০০ বিসিই-তেও, এমনকি তার আগেও যথেষ্ট উন্নত ছিল। সেখানে স্থাপত্যশিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভীষণ ভাবে এগিয়ে ছিল। এতদিন ভাবা হত উত্তর ভারতে জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে প্রথমে, দক্ষিণ ভারতে নয়। সঙ্গম সাহিত্যে যে বলা হয়েছিল তামিল সভ্যতা আরিয়ান আর বৈদিক সভ্যতার চেয়ে ভিন্ন আর তামিলরা প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্র সভ্যতা বিকশিত করেছে, সেটা সত্যি। কোন্ডাগাই বিউরিয়াল সাইট থেকে পাওয়া আর্টেফ্যাক্টগুলোর লিপি পড়ে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।পাশাপাশি এনসিয়েন্ট তামিলরা যে এজুকেশন, ক্রাফটসম্যানশিপ আর ট্রেডিংয়ে ভীষণভাবে উন্নত ছিল বলে লেখা হয়েছিল, তা শুধুই কষ্টকল্পনা নয় বলেও প্রমাণ হয়েছে।
এসব জানার পর রাজনীতি গরম। তামিলনাডুর সিএম বলছেন সেন্টার থেকে ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিডিয়াতেও যেন এই নিয়ে বিশেষ কথা না হয়, সেইজন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে চারিদিক থেকে। তাঁদের ভয়, তামিলনাডুর ইতিহাস নিয়ে এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার রাজনীতিতেও পালাবদল ঘটাতে পারে। সে-সব সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে কিলাদি অভিযান আর নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে সারা দুনিয়ার ইতিহাসকাররা উদগ্রীব হয়ে আছে।
২) তামিলনাড়ুর গাঙ্গাইকোন্ডাচোলাপুরমেও খননকার্য চালিয়ে চোল বংশের ইতিহাস, শিল্পকর্ম আর ঐতিহ্য নিয়ে অজানা সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করছেন যে আয়ুধালাম আর কোল্লানকুঝিতে এক্সপিডিশন চালিয়ে গেলে আরো অনেক তথ্য জানা যেতে পারে, কিন্তু আপাতত বাজেট নেই সেই কাজটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পট্টরাইপেরেম্বুদুরেও টেরাকোটা শিল্প আর মৃত্তিকামূর্তি মিলিয়ে প্রায় দশহাজার আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া গিয়েছে।
৩) হরিয়াণার রাখিগরিতে একটা প্রাচীন জলাশয় বা রেজর্ভয়ের সিস্টেম পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পান যুগে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য জানা গেছে। হাইড্রোলজিস্ট আর ত্রিমাত্রিক মডেল ডিজাইনারদের কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হবে, এমন উদ্ভাবনী ওয়াটার সিস্টেম সম্পর্কে এখনও আমরা বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি।
৪) ওদিকে ইসরো যে একের পর এক ধামাকা করছে সে তো সবাই জানে। চাঁদের সাউথ পোলে চন্দ্রযান নামানোর কথা বেশ আলোরণ ফেলেছে, সূর্যের করোনা আর সোলার উইন্ড নিয়ে স্টাডি করার জন্য যে আদিত্য-এল১ বলে সোলার অবজারভেটারি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তার চেয়েও বেশি লাফালাফি হচ্ছে একটা ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার নিয়ে। এক বিরল বিস্ফোরণের সময় সুইফট জে১৭২৭. ৮-১৬১৩ ব্ল্যাকহোল থেকে যে হাই এনার্জি এক্স রে পাওয়া গেছে, তাতে কিছু আনইউজুয়াল বিহেভিয়ার লক্ষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই অস্বাভাবিক আচরণের নাম 'অ্যাপিরিওডিক মড্যুলেশন'। এই আচরণের ফলে এক্স-রেতে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্যাটার্ন দেখা যায় যা কোয়াসি-পিরিওডিক অসিলেশন (QPO) নামে পরিচিত। ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত জোর গবেষণা চলছে।
৫) ওদিকে বনেজঙ্গলেও ধুমধাড়াক্কা চলছে। ২০২৩ সালেই জীববৈচিত্র্যে একের পর এক নতুন নাম যোগ হয়েছে, ভারতে ৬৪১টি নতুন প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গিয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯৯টি প্রথমবার ভারতে পাওয়া গিয়েছে। প্রচুর প্রাণী এই প্রথম পাওয়া গেছে পৃথিবীর বুকে। নতুন আবিষ্কারের বেশিরভাগই ছিল অমেরুদণ্ডী প্রাণী (৫৬৪টি প্রজাতি), বিশেষ করে পোকামাকড় (৩৬৯টি প্রজাতি), যেখানে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে (৭৭টি প্রজাতি), মাছ (৪৭টি প্রজাতি) প্রাধান্য পেয়েছে, তারপরে সরীসৃপ, উভচর, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি রয়েছে। হিমালয়ে 'হিমালয়ান আইবেক্স' বলে একটা নতুন প্রজাতির আইবেক্স বা পাহাড়ি ছাগল পাওয়া গেছে, কর্নাটকের কুর্গে Miniopterus srinii বলে বাঁকানো ডানার চামচিকে মিলেছে, কেরালায় পাওয়া গেছে অ্যান্ট মিমিকিং স্পাইডার, ময়ুরভঞ্জে নতুন প্রজাতির গিরগিটির নাম খাতায় উঠেছে। সবচেয়ে বেশি প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে ওয়েস্টার্ন ঘাটে, বলাই বাহুল্য। তবে নর্থ ইস্টে হাজার রকম গাছড়া পাওয়া গেছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে।
এছাড়াও দেশজুড়ে আবিষ্কার চলছে। জাদুবিদ্যা নিয়ে, উপজাতির ইতিহাস আর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে, সামুদ্রিক জীবন ও পরিবেশ নিয়ে, জিওসায়েন্স নিয়ে, এমনকি ভূত প্রেত রাক্ষস নিয়েও নৃতত্ত্ববিদরা ডেঞ্জারাস সব কাজ করছেন। পড়তে গেলে রোমাঞ্চে গায়ের কাঁটা দাঁড়িয়ে যায়। মুশকিল হল, অধিকাংশ জনতা শুধু আলতু ফালতু নিউজ চ্যানেল আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে আছেন, বাকিরা রিল নিয়ে লাফাচ্ছেন। অনেকে তো ভেবেই নিয়েছেন এ দেশে কিছুই হয় না, কারণ এসবের বিশেষ প্রচার নেই। আসল কথা হল, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও কাজ হচ্ছে, আস্তে আস্তে করে হলেও নতুন আবিষ্কার চলছে। আমি নিশ্চিত, আমার বন্ধুবৃত্তেই এমন মানুষ আছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যদি তাঁরা মাঝেমধ্যে সে নিয়ে কিছু কিছু কথা জানান, আমার মতো আগ্রহী পাঠকরা উপকৃত হই আর কি!
সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
বাংলার স্টেশন কথা
একটা বই কী করে হয়?
একটা বই করে কী হয়?
দুটো প্রশ্নের উত্তরই কেস স্পেসিফিক। একটা বই করে আসলে কিছুই হয় না হয়তো; শুধু শুধু মানসিক চাপ নেওয়া, ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা হওয়া, কিংবা চোখের বারোটা বাজানো। আবার হয়তো, একটা বই করে একজন ভীষণ আনন্দ পায়। গোটা প্রসেসটার সময় তো বটেই, তার পরেও সেই বইটা তাঁর জীবনে ভ্যালু অ্যাড করে। ওদিকে, একটা বই তৈরি হওয়াও নানারকম। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই রবিবার পান্ডুলিপি শুরু হয়ে পরের শনিবার জমা হলে আসছে সোমবার বই ছাপাইতে চলে যায়। আজকাল অ্যাসেম্বলি লাইনে ফেলে বই করা কোনও ব্যাপারই নয়। ওদিকে এমনও ঘটে, যে ভীষণ নাকমুখ কুঁচকে একটা বই নিয়ে বছর কাবার করে দেন লেখক/প্রকাশক, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান, অথচ বই হাতে নেওয়ার পর সেই যত্ন চোখে বা মনে ধরা পড়ে না।
কথাগুলো মনে পড়ল, এই বইটার কথা উঠতে। ট্রেন নিয়ে আমার বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ আছে বটে, কিন্তু বাংলার স্টেশন নিয়ে আমি ওই দু একটা বই পড়ে ভাসাভাসা যা জানা যায়, তার চেয়ে বেশি কিছু জানি না। তবু কেন জানি সম্পাদক জুটি আমাকে প্ল্যানিং টিমে রেখেছিলেন কে জানে? হয়তো ট্রেনের প্রতি আগ্রহের কথা জেনে গিয়েছিলেন বলেই! ফালতু বকা ছাড়া আমার কন্ট্রিবিউশান শুন্য। মাইনাসও বলা যায়। কিন্তু এই গোটা সময় ধরে আমি দেখলাম, একটা 'নট সো কমন' বিষয়বস্তুর বইটাকে একটা 'নট সো কমন' বই বানানোর জন্য দুজন মানুষ কী খাটুনিই না খাটলেন!
ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে যখন আমাকে গ্রুপে ঢোকানো হয়, তার সম্ভবত বছর খানেক আগে থেকেই বইয়ের খসড়া করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানে, বিষয়বস্তু সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করা, অন্যান্য বই গুলে খাওয়া, কে বা কারা লিখতে পারেন, কী নিয়ে লিখতে পারেন, তার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ম্যানুস্ক্রিপ্টের যেমন ড্রাফট ১ থেকে ২০ হতে পারে, প্রাথমিক পরিকল্পনাও ফাইনাল হতে গিয়ে পঞ্চাশবার অদলবদল হয়।
একপর্ণিকা ছোট প্রকাশনী। ত্রিপুরা থেকে বই করে, প্রকাশক কলকাতায় আসেন না। মানে, আসেনই না। মুখ দেখাতেও না। জয়ঢাক প্রকাশন তাদের পরিবেশক, বই তাই সহজলভ্য। কিন্তু মূল প্রকাশকের বই করে কতটা প্রফিট হয়, কতজন পড়েন আমার জানা নেই। আন্দাজ করছি, সঙ্খ্যাটা মারাত্মক কিছু নয়! তবু, একটা বই নিয়ে এই লং টার্ম এফর্ট দেওয়া, এই আন্তরিক যত্ন আর নিজের দিক থেকে পরিশ্রমের ত্রুটি না রাখার প্রসেসটা আমি বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি।
তা সত্ত্বেও কি সব সময় বই একদম পারফেক্ট হয়? সব বইই কি বিষয়বস্তু, প্রোডাকশন বা প্রচ্ছদের দিক থেকে আমার চোখে দারুণ কিছু বলে মনে হয়?
না। হয় না।
এটাই সত্যি কথা। বানানের ভুল থাকতে পারে, প্রচ্ছদ আমার পছন্দ না হতে পারে, মেকিং বা প্রুফের ত্রুটিও কিছু থাকতে পারে মাঝেমধ্যে। থাকেও।
কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হল একজন মানুষের প্রতিবার নাছোড়বান্দা পারফেকশন পাওয়ার জন্য করা এই চেষ্টাটা। প্রকাশনী বলতে তো একজন মাত্র মানুষ। বাজেটও নেই। লোকবলও নেই। শুধু ভালো বই করার জেদ আছে, ইচ্ছে আছে। আমি জানি, এমন প্রকাশনী আরো আছেন। অনেকেই আছেন, শূন্য লাভ নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন। একবার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাংলা প্রকাশনা জগতে কী ভালো লাগে? আমি বলেছিলাম, হাজার অপেশাদারিত্ব আর বিতিকিচ্ছিরি রকম পলিটিক্স আর স্ট্রাকচারহীন জগতে থেকেও কয়েকজন মানুষ সব প্রফিট লসের হিসেব ভুলে ভালো বই করার জন্য খাটছে, বুদ্ধিসুদ্ধি শিকেয় তুলে প্যাশন নিয়ে বাঁচছে। ওইটুকুই ভালো লাগা। ওইটুকুই।
এইবার আমি একটা বই বানাতে দেখলাম, যেটার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবেও হয়তো জড়িয়েও নেই। না আমার লেখা আছে, না আমি সম্পাদক, না বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেইজন্যই বুঝি আরো মন দিয়ে দেখতে পেলাম, অনুভব করতে পারলাম, এই বইটা ঠিক কতটা যত্ন নিয়ে তৈরি করা হল?
বাংলায় স্থানীয় স্টেশন নিয়ে একাধিক কাজকর্ম হয়েছে। কিন্তু সাবজেক্টটা এতটাই বড় যে প্রতিটা অঞ্চলের স্টেশন নিয়ে এক একটা সিরিজই হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, তুলনামূলক ভাবে অজানা বিষয় নিয়ে লেখা সংগ্রহ করার জন্য সম্পাদকরা কী কী করেছেন? বইটাকে ভালো করার জন্যই বা তাঁরা কী করেছেন? আমি বরং কয়েকটা পয়েন্ট লিখে দিই।
১) আই আর এফ সি এ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাব ফোরামের যাবতীয় লেখালিখি পড়ে দেখেছেন, দরকারে সেই লেখা নিয়ে অন্যান্য বইপত্র/লেখালিখি ঘেঁটে দেখেছেন। এই আমি বললাম হয়তো পার্থপ্রতিম বাবু ট্রৈনিকে রেল নিয়ে চমৎকার কাজ করছেন না ভারতীয় রেল হেরিটেজ নিয়ে দীপক রায়চৌধুরী বহুদিন ব্লগ লিখেছেন, রাজীববাবু ছুটলেন খবর নিতে। হয়তো বললাম আমার বন্ধু কাম দাদা Saugata Sengupta পুরো রেলপাগলা লোক, রাজীবদা ঝাঁপ মারলেন। আমি বলেই খালাস। যেখানে দেখো ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, সম্পাদক-জোড় কিছুই করতে বাকি রাখেননি।
২) বইয়ের স্ট্রাকচার নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। কী নিয়ে লেখা থাকবে আর কী নিয়ে থাকবে না, কোন বিষয়টা নিয়ে বইটা গড়ে উঠলে পাঠকটা নতুন কিছু পাবেন না পূর্ববর্তী বইগুলোর কোন লেখাগুলো নিয়ে কচলানোর দরকার নেই, সেই নিয়ে এমন গভীর, উত্তপ্ত, যুক্তিগ্রাহ্য আর দীর্ঘ আলোচনা চলেছে যে আমি মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেছি।
৩) বইতে কন্ট্রিবিউটার হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য কাকে কাকে অনুরোধ করা হবে, সেই নিয়েও প্রচুর মেল/মেসেজ চালাচালি হতে দেখেছি, ফোনও হয়েছে। বিষয়বস্তু নিয়ে অগাধ জ্ঞান কিন্তু লেখা তুলনায় শুষ্ক, আবার লেখার শৈলী অনবদ্য কিন্তু বিষয়বস্তুর নিরিখে সেই লেখা বিশেষ কোনও ভ্যালু অ্যাডিশন করছে না... এক্ষেত্রে কী করা যায়? এই ব্যাপারটা শুনতে যত সহজ মনে হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া ততোটাই কঠিন। বাংলা লেখালিখির জগতে কোনও কাজের মূল্য নির্ধারণ করা নেই, সবসময় ভালো লেখা পাওয়াও যায় না। আমি খুশি, অবশেষে একটা চমৎকার ব্যালেন্স করে নেওয়া যায় ভালো সম্পাদক পাওয়া গেলে। এখানেও দিব্যি কাজ হয়েছে।
৪) সম্পাদনার ক্ষেত্রে এমন সমস্ত ছোটখাটো সমস্যা দেখা যায়, সাধারণত যে সব নিয়ে কেউ মাথাই ঘামায়নি। এই ধরুন, একটা স্টেশনের নাম। বাংলায় একরকম, স্থানীয় ভাষায় একরকম, হিন্দিতে একরকম। কোনটা রাখা হবে? আপনি হয়তো ভাবছেন বাংলা বইয়ে বাংলা নাম, সিম্পল! কিন্তু ব্যাপারটা অমন নয়। একটা নামের ইতিহাস বা কালচারাল সিগ্নিফিকেন্স এক একটা লেখার এমন ভাবে ঢুকে থাকে, তখন সেটাকে বদলে দেওয়া মোটেও সহজ হয় না। সেই নামের ব্যাঞ্জনার সঙ্গে লেখা ও বিষয়ের যে সামঞ্জস্য আছে, সেটা ব্রেক করলে সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। এমন হাজারও জিনিস, স্ট্রাকচারিং থেকে প্লেসমেন্ট, সূচিপত্রের অদলবদল, ভূমিকা ও ব্লার্ব, এক একটা শব্দের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা হতে দেখেছি। এক একটা সময় এমন হয়েছে, কাজ পনেরো আনা শেষ হয়ে আবার শুরু করতে হয়েছে, কারণ সামান্য একটা ভুল 'হয়তো' হলেও হতে পারে। এই অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য না সম্পাদক না প্রকাশক একবারের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
৫) বইয়ের সঙ্গে যে জরুরি ছবি, নথি, অলংকরণ ইত্যাদি যাবে, সেই নিয়েও তুমুল আলোচনা আর মাঝেমধ্যে মতান্তর হয়েছে। কিন্তু অবশেষে দেখা গেছে, বইয়ের জন্য যা জরুরি, সেটাকেই প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে। কেউই ইগোবশত নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। পাশাপাশি আবার 'বই কে ওয়াস্তে সব মঞ্জুর' বলে কপিরাইটেড ছবি বা অন্য বইয়ের/শিল্পীর অলংকরণ/ফোটোগ্রাফ কিছুই ব্যবহার করেননি। এই বিশেষ কাজটা করার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে টুপি খুললাম।
৬) প্রচ্ছদ যে ঠিক কতবার বানানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একইভাবে কাজ হয়েছে ভিতরের ছবি নিয়েও। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ক্যালিগ্রাফি, স্টাইল থেকে রঙের ব্যবহার, দিনের পর দিন ধরে কাজ চলছে তো চলছেই। বইমেলা চলে এল, বই হল না। নববর্ষ দোরগোড়ায়, তবু দুজনে ঘাড় গুঁজে কাজ করছে। ইভেন্ট চলে গেলে বই আদৌ বিকোবে কিনা, সে নিয়ে কারো হেলদোল নেই। দুজনের সিদ্ধান্ত, বই পারফেক্ট না হলে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। মিথ্যে বলব না, মাঝেমধ্যে দু এক মুহুর্তের জন্য তো আমিই ভেবেছি, ওরে বাবা! এত বাড়াবাড়ি করে কী লাভ? কতজন আর পড়বে? তারপর দুই সম্পাদকের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছে। অবশেষে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
সেই বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশ হল কাল। আন্তরিক যত্ন আর পরিশ্রমে করা একখান বই। হয়তো পারফেক্ট, হয়তো পারফেক্ট (পার্ফেক্ট বলে কিছু হয়ও না) নয়, কিন্তু পারফেক্ট করার ইনটেনশনটা, ইচ্ছেটা, পরিশ্রমটা ...সেটা অবশ্যই পারফেক্ট।
আমি বইটার সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নই। তবু মেকিং সম্পর্কে দু একটা কথা বললাম, সাধারণত 'বিহাইন্ড দ্য বুক' নিয়ে কথা হয়, অথচ সিনেমায় 'বিহাইন্ড দ্য সিনস' নিয়ে এক একটা ডকুমেন্টারি হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ট্রেন নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের কাছে অনুরোধ, বইটা উল্টেপাল্টে দেখবেন। দেখে জানাবেন, যত্নটুকু চোখে আর মনে ধরা পড়ছে কিনা! যদি পড়ে, সম্পাদক জুটির সব কষ্ট সার্থক।
বাংলার স্টেশন কথা
একপর্ণিকা প্রকাশনী
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫
রহস্য বাকি আছে (আফ্রিকা)
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য আর রহস্য নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমে কমতে দেখছি। ছোটবেলায় একটা নতুন প্রাণী বা প্রাকৃতিক বিস্ময়ের কথা জেনে গেলে আমি দিনরাত সেই চিন্তাই করতাম। আফ্রিকা, আমাজন বা তিব্বত আমাদের মনোজগতে এক রহস্যময় জায়গা হয়ে বেঁচেছিল। আমি ততোটাও বুড়ো হাবড়া নই, সেই যুগেও প্ৰযুক্তির যথেষ্ট অনুপ্ৰপবেশ ঘটেছে মানবজীবনে, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ আর রাজনৈতিক বিপর্যয় লেগেই থাকত গোটা দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা অবাক হওয়া ছিল, চমকে ওঠা ছিল, নতুন একটা তথ্য জেনে বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দে ডগমগ হওয়া ছিল। ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের যুগে তথ্য পাওয়া সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু 'বিস্ময়' জিনিসটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছে মানুষের মন থেকে। এখন আর আমরা কেউই অবাক হই না। অনেকের আবার ধারণা, পৃথিবীর সব রহস্যই আসলে আবিষ্কার করা হয়ে গেছে। অবাক হওয়ার মতো কিছুই আর বাকি নেই। অথচ সত্যি কথা হল, এখনও, এই যুগেও একের পর তাক লাগানো আবিষ্কার হচ্ছে। শুধু আফ্রিকার কথাই যদি ধরি, গত কুড়ি বছরে এমন সমস্ত প্রাণীদের খোঁজ পাওয়া গেছে, এমন সব প্রাকৃতিক ফেনোমেনার কথা জানা গেছে যে বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেছেন, বারবার। কয়েকটা বলা যাক।
গত এক দশকে চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার হল রুয়ান্ডার গোল্ডেন মাঙ্কিদের নিয়ে। তাদের সোনালি পশমের মতো লোম রোদ্দুরে ঝকঝক করে, দেখা গেছে তাদের এই লোমে আসলে ফিওমেলানিন পিগমেন্ট আছে বলেই এমনটা হয়। এই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতিকে রাখা হয়েছে cercopithecid গ্রূপে, অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতির সঙ্গে এদের যথেষ্ট ফারাক আছে। একদিকে গোল্ডেন মাঙ্কিদের নিয়ে উন্মাদনার ফলে রুয়ান্ডার পর্যটন ইন্ডাস্ট্রি বেশ অর্থলাভ করছে, অন্যদিকে কনজারভেশন বায়োলোজিস্টরা এদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। একের পর এক অভিযান হচ্ছে। গত বছর রুয়ান্ডায় সবচেয়ে বড় গোল্ডেন মাঙ্কিদের দলকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
তানজানিয়া চিরকাল গেম রিজার্ভ বলে খ্যাতিলাভ করেছে, সেরিংগেটিতে শ্বাপদরা হরিণ আর ওয়াইল্ড বিস্টদের ছুটিয়ে শিকার করছে, তানজানিয়া বললেই এই ছবি মাথায় আসে। কিন্তু এখানে বৈচিত্র্যেরও অভাব নেই। কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা সেখানে এমন এক প্রজাতির বায়োলুমিনিসেন্ট উদ্ভিদ খুঁজে বের করেছিলেন, যার পাতা থেকে নীল রঙের আলো বিচ্ছুরিত হয়। রিসেন্টলি Tessmannia princeps বলে এক নতুন প্রজাতির গাছ পাওয়া গেছে, সে প্রায় ৩০০০ বছর প্রাচীন। Udzungwa এলাকার Mngeta Valley নাকি অজানা গাছপালা খুঁজে পাওয়ার জন্য সেরা জায়গা। কিন্তু এখনও সেখানে অত অভিযান করা হয়ে ওঠেনি।
ইথিওপিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে এথনোবোটানিস্টরা এমন একটা উদ্ভিদ আবিষ্কার করেছেন যার পাতায় শক্তিশালী anti-inflammatory গুণ রয়েছে। স্থানীয় উপজাতির মানুষ নাকি যুগ যুগ ধরে এই গাছের পাতা ব্যবহার করে আসছে চোটজখম হলে। প্রিলিমিনারি ক্লিনিক্যাল স্ট্যাডিতে জানা গেছে অন্য anti-inflammatory উদ্ভিদের মতো এই গাছের পাতা সেবন করলে কোনও সাইড এফেক্টও হয় না।
ওদিকে ম্যাডাগাস্কারে ব্যাঙ পেয়ে জুলোজিস্টরা নাচ শুরু করেছেন। একের পর এক ব্যাঙ পাওয়া যাচ্ছে, সবাই নিজগুণে অনন্য। একটার নাম দেওয়া হয়েছে চাঁদের আলোর ব্যাঙ। সূর্যের আলো পড়লে ব্যাঙটার চামড়া স্বচ্ছ ট্রান্সপ্যারেন্ট হয়ে যায়, চাঁদের আলো পড়লে মনে হয় ব্যাঙের দেহের ভিতর একটা বেগুনি আলো জ্বলছে। ব্যাঙ বাবাজি এর ফলে দিনের বেলাও নিরাপদে থাকে, রাতের নিশাচর প্রাণীরাও কিছু করতে পারে না। সার্ভাইভালের জন্য এমন এভোলিউশনারি ইনোভেশন খুব কমই দেখা গেছে। এছাড়াও আছে এলিয়েন ব্যাঙ, মানে এই ব্যাঙগুলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করলে মনে হয় স্টার ট্রেকের স্পেশাল সাউন্ড এফেক্ট চলছে। মাঝেমধ্যেই ডক্টর Mark Scherz লাইভ বা রেকর্ডেড অনুষ্ঠান করেন, সেখানে আরো বিশদে জানা যাবে।
এখানেই শেষ নয়, গোটা আফ্রিকা জুড়ে নেত্য চলছে আসলে। কঙ্গো ও পশ্চিম অঞ্চলের দুর্গম অরণ্যে গবেষকরা এমন একটা ফল আবিষ্কার করেছেন যা চিনির চেয়ে বহু গুণ বেশি মিষ্টি, কিন্তু কোনও ক্যালোরি নেই। এই ফলকে স্থানীয়রা 'মিষ্টি সাগরের তারা' বলে ডাকে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করছেন যে যে এই ফল থেকে একটি ন্যাচারাল সুইটনার তৈরি করা যেতে পারে যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হবে। এখন শুনছি এরকম আরো কিছু শিকড়বাকড় আর ফলের সন্ধান নাকি পাওয়া গেছে।
নামিবিয়ার মরুভূমিতে এমন একটা বিটল পোকা পাওয়া গেছে যা বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করতে পারে। এই অদ্ভুত কীটের পিঠে বিশেষ একরকমের কাঁটা রয়েছে যা কুয়াশা থেকে জল নিয়ে ধরে রাখে, এবং তারপর সেই জল সরাসরি তার শরীরে অ্যাবসর্ব করে নেয়। আর এদিকে আমরা এতদিন সব ক্রেডিট ব্যাটাছেলে উটদের দিয়ে আসছি শুধু।
জিওকেমিস্টরাও কম যান না। তারা মালি ও অন্যান্য জায়গায় রিভারসাইড ডিপোজিট পরীক্ষা করে বিশেষ ধরনের মাটি বা montmorillonite clay পেয়েছেন, হেভি মেটাল আর বিষাক্ত টক্সিন শুষে নিতে এই মাটির জবাব নেই। স্থানীয় মহিলারা বারবার বলেছিলেন যে এই মাটি দিয়ে তাদের হাত ধোয়ার পর ত্বকের সমস্যা সেরে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা ঠিকই বলেছিলেন। বলাবলি চলছে, কসমেটিক্স আর ফার্মা ইন্ডাস্ট্রিতে এই মাটি বিপ্লব আনতে পারে।
কঙ্গো বেসিনের অরণ্যে গত বারো বছরে প্রায় সাড়ে সাতশোরও বেশি নতুন প্রজাতির জীব পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে কুমির থেকে ইলেকট্রিক মাছ, পেঁচা থেকে অর্কিড সবই আছে। হুড়োহুড়ি পড়েছে De Winton's golden mole এর প্রত্যাবর্তনে, যে ব্যাটা বালিতে সাঁতার দেয়। Leaf-Mimic Frog এর কথাও বলতে হবে, এই ছোট ব্যাঙের ত্বকের টেক্সচার এবং রঙ জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা পচা পাতাকে প্রায় পুরোপুরি অনুকরণ করে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছে যে এই প্রজাতি সম্পর্কে আগে কিছুই জানা ছিল না। এদের ত্বকে এক বিশেষ কোষ রয়েছে যা তার তাৎক্ষণিক পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় টেক্সচার এবং বর্ণকে সূক্ষ্মভাবে বদলে দিয়ে লুকিয়ে পড়তে পারে। আমার ফেভারিট হল লেসুলা মাংকি, যারা একেবারে মানুষের মতো মুখভঙ্গি করে। দলে বসে থাকলে দেখে মনে হয়, সংসদের অধিবেশন… থাউক সে কথা!
ওদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালানোর সময় ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডেটিং কৌশল ব্যবহার করে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত মেগাফৌনা প্রজাতির গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ছবিগুলোতে অত্যাধুনিক পিগমেন্ট প্রিপারেশন দেখা যায়, রঙ চটে না যায় এইজন্য সেগুলো পশুর চর্বির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই গুহাচিত্রে যে সব প্রাণী দেখা যাচ্ছে তাদের সঙ্গে মানুষদের কোনওদিন মোলাকাত হয়েছে বলে জানা ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, লেট প্লাইস্টোসিন এবং আর্লি হোমো-সেপিয়েন্সের মধ্যে কিছু ইন্টারেকশন হয়েও থাকতে পারে? কারণ প্লাইস্টোসিন যুগের ম্যামথের ছবিতে এই ধরনের কালারিং টেক পাওয়া যায়নি, মানে সেই যুগের শিল্পীদের মগজে তখনও ওঁৎ বুদ্ধি আসেনি। না এসেছিল? নাকি ম্যামথ জাতীয় জীবদের সঙ্গে হোমো সেপিয়েন্সদের সাক্ষাৎও হয়েছে? হেহে, ইটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল! যাই হোক, নানান প্রশ্ন আছে, আপাতত প্যালিও এনভায়োলেন্টমেট কন্ডিশন নিয়ে জোর গবেষণা চলছে সাউথ আফ্রিকায়। এছাড়াও নতুন হিউমিনয়েড প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে সাউথ আফ্রিকার আরেক গুহায়।
এখন, এই সব আবিষ্কারগুলোই হয়েছে গত এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে। কোনওটা চার বছর আগে, কোনওটা দশ বছর আগে। কিন্তু এই গবেষণা এখনও কন্টিনিউ হচ্ছে। এখন অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, মাত্র এই? এ আর এমন কি! বেশ, তাহলে আরো কয়েকটা লিস্টি করে দিলাম।
২০২৩ সালের শেষের দিকে তানজানিয়ার জাঞ্জিবারের উপকূলে একটা দুর্দান্ত আবিষ্কার হয়েছে। ম্যারিন বায়োলোজিস্টরা সেখানে একটি কোরাল রিফ সিস্টেম অর্থাৎ প্রবাল প্রাচীর ব্যবস্থা আবিষ্কার করেন যা উষ্ণ সমুদ্রের তাপমাত্রার প্রতি অস্বাভাবিক রেসিলিয়েন্সের পরিচয় দিতে পারে। সবাই জানে, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে কোরাল রিফের তাপ বাড়ছে, তারা কঙ্কালে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু এই প্রবাল প্রাচীন সেখানে অবস্থিত হিট রেজিস্টেন্ট অ্যালগির প্রকারের সঙ্গে চমৎকার একটা সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ ডেভেলাপ করেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে যে জলের তাপ বাড়লেই শৈবালগুলো এসে একটা প্রটেক্টেড লেয়ার তৈরি করে ফেলে। এই আবিষ্কারটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই গবেষণার ওপর নির্ভর করে গোটা দুনিয়াযা কোরাল রিফ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা যায়, ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিকরা এই ধরনের শৈবাল ট্র্যাক করে দুনিয়ায় অন্যান্য কিছু জায়গাতেও এইধরনের তাপরোধকারী কোরাল রিফ খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা খুব বেশি মুখ খুলছেন না, কারণ ঘটনাটার একটা আর্থিক রাজনৈতিক দিকও আছে। তাই ঘটনাটা কতটা বাস্তব বোঝা এই মুহূর্তে মুশকিল। তবে হিট রেজিস্টেন্ট কোরাল রিফ সম্পর্কিত বড়সড় কিছু একটা যে পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
২০২৪ সালের শুরুতে ইথিওপিয়ার হাইল্যান্ডে বিজ্ঞানীরা একটা ভূগর্ভস্থ ছত্রাক নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করেন। আগেও পাওয়া গিয়েছিল কাছাকাছি একটা কলোনি, কিন্তু এইবার তারা আগের ডেটা বিশ্লেষণ করে আরো ব্যাপক ভাবে গবেষণা চালিয়েছে। এই ব্যাপক মাইসেলিয়াল ফাঙ্গাই সিস্টেম বিভিন্ন পরিবারের একাধিক বৃক্ষ প্রজাতিকে সংযুক্ত করে, পুষ্টি বিনিময়ের সুবিধা দেয়। আইসোটোপ ট্রেসিং কৌশল ব্যবহার করে দেখা গেছে যে ফাঙ্গাই নেটওয়ার্কটা স্ট্রেস কন্ডিশনে গাছেদের কাছে নিউট্রিশন পৌঁছে দেয়। এই প্ল্যান্ট-ফাঙ্গাই কমিউনিকেশন মেকানিজম ঠিক হলে উপস্থিত ইকলজি মডেলগুলো নিয়ে আবার করে ভাবতে হবে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি নামিবিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে কাজ করা উদ্ভিদবিদরা এক succulent প্রজাতির উদ্ভিদ খুঁজে বার করেছেন। এই উদ্ভিদ সোলার রেডিয়েশনের তীব্রতা অনুযায়ী ফোটোসিন্থেসিস পাথওয়েকে বদলে দিতে পারে। জটিল বিজ্ঞানে না ঢুকে বলি, ব্যাপারটা কাজে লাগালে সাহারাতেও সুন্দরবন হতে পারে, মানে খরা অঞ্চলে কৃষি করা বা গাছপালা বসানো অনেক সহজ হয়ে যাবে। একইভাবে কেনিয়ার হাইল্যান্ডসেও একটা উদ্ভিদ পাওয়া গেছে যাদের পাতায় বিশেষ ট্রাইকোম বিকশিত হয়েছে যেগুলো বায়বীয় আর্দ্রতা গ্রহণ করে সোজা হাইস্পিড ট্রেনে করে সেই জল শিকড়ের কাছে পৌঁছে দেয়। এমনকি আর্দ্রতা কম হলে, এই ট্রাইকোম উদ্ভিদকে বাঁচাতে বাতাস থেকে পর্যাপ্ত জলও বের করতে পারে। বায়োমিমিক্রি ইঞ্জিনিয়াররা এই নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। বলুন, এই ধরনের যুগান্তকারী একটা সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের নিউজ চ্যানেলরা দু এক কথা বলতেও তো পারে!
যাই হোক, ওদিকে মাদাগাস্কারেও গত বছর একটা পিঁপড়ে পাওয়া গেছে যে ব্যাটাচ্ছেলে তাদের কোষের মধ্যে ব্যাকটিরিয়া চাষ করছে, এই ব্যাকটিরিয়াগুলো কাজে লাগাতে পারলে ছত্রাকদের থেকে হওয়া সংক্রমণকে একেবারের জন্য নির্মূল করে দেওয়া যেতে পারে। এই খবরটা ইউটিউবে কোথাও দেখেছিলাম বলে সত্যতা প্রমাণিত করতে পারব না, তবে ম্যাডাগাস্কারে যে দুরন্ত সব আবিষ্কার আর গবেষণা চলছে তা সায়েন্স ডট ওআরজি সাইটে গিয়ে পড়লেই জানতে পারবেন।
২০২৩ সালের একদম শেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্পিলিওলজিস্টরা একটা ফাটাফাটি আবিষ্কার করেছেন। মাটির এক কিলোমিটার নিচে এমন একটা প্রকাণ্ড গুহার নেটওয়ার্ক পাওয়া গেছে যেখানে আগে যাওয়া সম্ভবই ছিল না। কিন্তু আসল কথা হল এই অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, যেখানে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন প্রাণ বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই, সেখানে তারা মাইক্রোঅর্গ্যানিজমের একটা আইসোলেটেড ইকোসিস্টেম খুঁজে পেয়েছে। এই প্রবল অম্লীয় পরিস্থিতিতে কোনও অণুজীব থাকতে পারে তা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু এই পুঁচকে অণুজীবগুলো কোন একটা উপায়ে যেন মিনারেল মেটাবলাইজ করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এদের শরীরের কেমিক্যাল পাথওয়ে আর গঠন জানা গেলে মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাঁচিয়ে রাখার দিকে একটা নতুন পথ খুলে যাবে, স্পেস ট্রাভেল রেডিয়েশনের ঝুঁকিও অনেক কমে যাবে।
২০২৪ সালে, আরো কিছু জরুরি কাজ হয়েছে, সেগুলো সেই অর্থে আবিষ্কার নয়। প্রথমেই বলতে হয় Operation SAMA এর কথা, অবৈধ চোরাশিকার আর পোচিং আটকে ওয়াইল্ডলাইফ সমৃদ্ধ করার এই প্রজেক্ট উনিশটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আর উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। সিয়েরা লিওন আর লাইবেরিয়াতে রিফরেস্টেশন প্রোগ্রাম ভালো ফল দিয়েছে, শকুন আর অন্যান্য মাংসাশী পাখিদের সংখ্যা বেড়েছে। পোচিং কমেছে হাতি আর প্যাংগলিনের। জাম্বিয়াতে লেপার্ডের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে কমে গিয়েছিল, এখন তাদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কোপা ভের্দেতে সাস্টেনেবল ফিশিং শুরু হয়েছে, আশার কথা। হাজার হাজার হতাশাজনক খবরের মধ্যেও দেখে ভালো লাগে এখনও অনেকে প্রকৃতি নিয়ে ভাবে। এখনও আমাদের পৃথিবীতে প্রচুর অজানা রহস্য রয়ে গেছে।
শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫
সেলুরিয়ান সি-এর দ্বীপের সেই বাড়িটা
জি কে চেস্টারটন বলেছিলেন, সাহিত্য পড়া আসলে লাক্সারি, গল্প পড়া হল প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে এক একটা বই কথাটা মনে করিয়ে দেয়। এই অসম্ভব, অসম্ভব মিষ্টি বইটার কথা লিখে রাখলাম, কেউ পড়লে তাদের দু চারটে দিন অনেক বেশি মিষ্টি হয়ে উঠবে। ডায়াবিটিস থাকলেও সমস্যা নেই। একদম সুগারক্যান্ডি বই, যদিও মাঝেমধ্যে টকমিষ্টি লজেন্সের স্বাদও পাবেন। আর যদি স্টোরিটেল বা অন্য কোথাও অডিও স্টোরি শোনেন, তাহলে তো পোয়াবারো। এমন মালপো হালুয়া জিলিপি মার্কা রস গড়ানো বইকে সাহিত্য বলে গণ্য করে না অনেকেই, তারা ওইসব মোটামোটা জটিল বই নিয়ে বসে থাকুক গে! আমরা বরং ছোট করে সেলুরিয়ান ক্রনিকালসের প্রথম বইয়ের গল্পটা জেনে নিই।
লিনাস বেকার ডিপার্টমেন্ট অফ চার্জ ফর ম্যাজিকাল ইউথের জন্য কাজ করেন। কেরানি গোছের কাজ, তাঁর প্রধান দায়িত্ব হল ম্যাজিকাল চাইল্ডদের জন্য বরাদ্দ অনাথআশ্রমে গিয়ে দেখে আসা বাচ্চাগুলো যত্নে আছে কিনা! ঝামেলা থাকলে রিপোর্ট দেওয়া, সেই অরফেনেজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এই কাজ করতে করতে তিনি চল্লিশের গোড়ায় পৌঁছেছেন, অন্য সবাই পদোন্নতি পেয়ে তাঁকে টপকে গেছে। লিনাস বেকার থেকে গেছেন। তিনি ভুঁড়ি থলথলে গোবেচারা মানুষ, একা থাকেন, সঙ্গী বলতে একজন বেড়াল মাত্র। গান শোনা ছাড়া তেমন কোনও শখ নেই। দজ্জাল বসের কাছে বকা খান, বাড়িওয়ালা রোজ টিটকিরি দেয়, তিনি বাস থেকে নেমে বৃষ্টিপ্রবণ শহরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের কথা ভাবেন, কিন্তু সমুদ্র দেখতে আর যাওয়া হয় না। তিনি নিজেও জানেন, আমার কিছু হওয়ার নয়।
এমন সময় একটা হাই ভোল্টেজ অ্যাসাইনমেন্ট এসে পড়ে তাঁর কাছে৷ হাইয়ার ম্যানেজমেন্ট তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ার আর রিপোর্ট দেখে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে একটা গোপন মিশনে পাঠাবেন তাঁকে। কী সেই গোপন মিশন? একটা দ্বীপে অবস্থিত অনাথ আশ্রমে ছয়জন বিপজ্জনক বাচ্চা থাকে। নামে বাচ্চা হলেও তারা এক একটা জিনিস। বেকারকে গিয়ে একমাস থেকে রিপোর্ট করতে হবে, এই জায়গাটা থাকবে না বন্ধ করে দেওয়াই বেটার?
বেড়াল নিয়ে বেকার শেষমেশ ট্রেনে উঠে বসেন। তখনও তিনি জানেন না যে এই যাত্রায় তিনি প্রথম সমুদ্র দেখবেন, লোনা হাওয়া আর রোদের সঙ্গে তার মোলাকাত হবে জীবনে এই প্রথম। তিনি এও জানেন না যে ছয়জন বাচ্চার কথা তাকে বলা হয়নি, শুধু ফাইল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে পৌঁছে গিয়ে দেখতে হবে জানিয়ে, তাদের মধ্যে একজন খোদ শয়তানের ছেলে মানে অ্যান্টিক্রাইস্ট। অবশেষে, তিনি এও জানতেন না যে এই এক মাস তাঁর জীবন বদলে দেবে।
বেকার দ্বীপে গিয়ে পৌঁছান বটে, কিন্তু নিজে পৌঁছানোর সাধ্য ছিল না তাঁর। তাঁকে সেই অঞ্চলের বনদেবী (ইংরেজি নামটা থাক!) সেখানে নিয়ে আসেন৷ দেখা হয় অনাথ আশ্রমের প্রধান সঞ্চালক আর্থারের সঙ্গে। ছয়জন ছেলেমেয়ের সঙ্গেও, যাদের ভয়ে ডিপার্টমেন্টর লোক থরথর করে কাঁপছে।
এই এক মাস ধরে একের পর এক রহস্যোদঘাটন হয়। বেকার ভয় পান, তর্কাতর্কি করেন, অনেক কিছু বোঝেন, অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে চলি। একের পর এক চমৎকার ঘটনা, দমফাটা হাসির সিকোয়েন্স, আশ্চর্য রহস্য, চোখ ভিজিয়ে দেওয়া দৃশ্য। গল্পের সঙ্গে আমরাও তখন সেলুরিয়ান সি এর দ্বীপে থাকা সেই বাড়িটায় গিয়ে পৌঁছেছি।
টি জে ক্লুন সাহিত্য করতে পেরেছেন কিনা, ভাষা আর ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাজিমাত করেছেন কিনা, সে সব বলা এখানে বেকার! কারণ, এখানে গল্পটাই সব। এমন একটা মন্ত্রমুগ্ধ করা গল্প, যা পড়ে মনে হয় গরম রসগোল্লা খেলাম। নতুন বন্ধু পাতানো যায়, পিকনিকে যাওয়া যায় তাদের সঙ্গে, স্বপ্ন দেখা যায়, গান গাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি সাহিত্য আর কী হতে পারে?
কিছু কিছু বই নিজের জন্য পড়ে নিতে হয়। পড়ুন, ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝিদের উপহার দিন, রাত্রে স্টোরিটেলে একসঙ্গে বসে শুনুন। যদি ভালো না লাগে, মুখমিষ্টি না হয়, মন না ভরে, তাহলে মনের ডাক্টারের কাছে যাওয়ার ফিজটা আমিই দেব না হয়!
ছোট নৌকা আর একটা টেলিফোন
২০২১ সালে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় কার্দিশ রিফিউজিদের একটা নৌকা মানে ওই স্মল বোট ডুবতে শুরু করে। উপায় না দেখে তারা ব্রিটিশ হেল্পলাইনে ফোন করে। তারা বলে, মনে হয় তোমরা ফ্রেঞ্চ ওয়াটারে আছো, অমুক নম্বরে ফোন করো। ততক্ষণে জল ঢুকতে শুরু করেছে, উনত্রিশজন যাত্রীর মধ্যে নারীপুরুষ তো আছেই, একটা বাচ্চা মেয়েও আছে। মাঝ সমুদ্রে নেটওয়ার্ক পাওয়া চাপ। তবু একজন ফোন করে। ফ্রেঞ্চ হেল্পলাইন থেকে একজন বউ তুলে বলে, তোমরা মনে হয় ব্রিটিশ ওয়াটারে আছো। ওদের জানিয়ে দিচ্ছি! লোকেশন ভেজো! লোকেশন পাঠানোও মুশকিল। ওদিকে জল কোমর অব্দি এসে গেল প্রায়। ঠান্ডা হাওয়া, জলে ভিজে সবাই কাঁপছে। যাই হোক, হেল্পলাইন থেকে বলে, শান্ত থাকুন। দেখছি কী ব্যাপার। দেখতে দেখতে বোট প্রায় ডুবে যায় আর কি! অনেকে জলে পড়ে গেছে। বেগতিক দেখে বারবার তারা ফোন করতে চেষ্টা করছে, দু দশ মিনিট পর আর কিছু করার থাকবে না। বার বার ফোন আসায় মহিলা বলেন, ধৈর্য ধরুন, দেখছি তো! কিন্তু দেখছে আর কে? ব্রিটিশ রেস্কিউ বোট অনেক দূরে, ফরাসি বোট অন্য মিশনে ব্যস্ত। একদম জলে পড়ে যাওয়ার আগে নিরুপায় হয়ে আবার ফোন করে লোকটা। মহিলা বলেন, জ্বালিয়ে মারলি মাইরি! ইউ উইল নট বি সেভড, বোঝলা?
সাতাশজন মারা যায়। সকলের লাশ ভাসতে পাওয়া যায় সমুদ্রে। প্রতি বছর ওইটুকু সামুদ্রিক পথ, যা নব্বই মিনিটে ক্রস করে দেয় ফাস্ট বোট, সেখানে লোক মরছে। এদেশে হলে অবশ্য পাত্তা দিত না। জায়গাটা ইউরোপ বলেই সাড়া পড়ে, তদন্ত হয়। রেস্কিউ হেল্পলাইনের মহিলাকে ডেকে আনা হয় জেরা করার জন্য। তিনি বলেন, "আমি কী করব? আমি তো প্রোটোকল ফলো করেছি।"
প্রশ্ন ওঠে, আপনি সিচুয়েশন এর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি? ওরা রিফিউজি, মরে যাচ্ছিল, একটু সেন্সিটিভ হতে পারছিলেন না? উত্তর আসে, রিফিউজি না হলে মিলেনিয়ার হলে বুঝি বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না? আমি কেন দুজন মানুষের মধ্যে তফাত করব? আমার চোখে সবাই ভিক্টিম।
“I didn’t ask you to leave, I said. It was your idea, and if you didn’t want to get your feet wet, love, you shouldn’t have embarked. I didn’t push you into the water, I didn’t fetch you from your village or field or ruin of a suburb and put you in your wretched leaky boat, and now the water’s up to your ankles, I get it that you’re frightened, and you want me to save you and you’re impatient. You’re counting on me. But I didn’t ask you for any of that. So you’ll just have to grin and bear it and let me get on with my job. And apparently these thoughts were so strong that I actually spoke them out loud.”
আপনার ওপিনিয়ন কী রিফিউজি সমস্যা নিয়ে? পুলিশ জিগোয়। উত্তর আসে, আমার কোনোও ওপিনিয়ন নেই। ওপিনিয়ন দিয়ে রেস্কিউ চলে না। সাতাশজন মারা গেছে, সারা কেরিয়ারে আমি কত রিফিউজিকে বাঁচিয়েছি সেটা কে বলবে?
দুজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। তাদের পরিচয় জানা কি তাদের রক্ষা করার জন্য জরুরি? হতে পারে একজন কোটিপতি, শখ করে নিজস্ব ইয়াটে করে মাছ ধরতে এসে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছেন, অন্যজন সিরিয়া বা ইরাক থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের ঘরবাড়ি বোমায় উড়ে গেছে, তারা যা হোক কিছু করে আইনি বা বেআইনি ভাবে নৌকা করে ইংল্যান্ডে যেতে গিয়ে নৌকাডুবির শিকার হয়েছেন। দুজনে একসঙ্গে ডুবছে? আমি একজনকে বাঁচাতে পারব। কাকে বাঁচাব? তাদের অতীত বা সিদ্ধান্ত বা গুডলাক/ব্যাডলাক জানার প্রয়োজন আমার আছে কি? একজন পেশাদার রেসকিউ অফিসারের কাছে কি দুজনেই সমান ভিকটিম নন? না সেখানেও আপনার সো কল্ড হিউম্যানিটির ভূমিকা থাকতে হবে? থাকা কি আদৌ উচিত? কে জানে? আমি তো বলতে পারছি না।
এই লেখক যে দার্শনিক বলে পরিচিত, সেটা বোঝাই যায়। তাই, স্মল বোটও ঠিক ফিকশন নয়, এটা একটা ফিলোসফিকাল প্রশ্নকে তুলে ধরেছে। সে প্রশ্ন কালেক্টিভ ডিসেন্সিটিজেশনের। উচিত অনুচিতের। মনুষ্যত্ব আর দায়িত্ববোধের মাঝে থাকা সূক্ষ্ম লাইনের। এই বই সাহিত্য হিসেবে পড়তে কেমন লাগবে জানি না, কিন্তু এই সময় আর এখনকার মানুষকে বুঝতে হলে বইটা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
একটা জায়গা পড়ে সত্যি একটু নড়ে গেছিলাম।
There is no shipwreck without spectators. Even when there’s no one, when it’s far out at sea, at night, without witnesses, when there’s no living soul in sights for thousands of nautical miles, only waves and the viscous night, covering everything, swallowing everything; when there are no more eyes to see than there are arms to reach out, there are still spectators and the shore from which they are watching is never far away, even if, at the same time, it is infinitely distant.
কিন্তু সতর্ক করে দিচ্ছি, ইটস নট অ্যান ইজি রিড। ভালো লাগবে, তা জরুরি নয়।
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫
পিটার অ্যান্ড লিজা
কমিকসের দুনিয়ায় মার্ভেল আর ডিসি এখনও বেস্টসেলার তালিকায় সবচেয়ে ওপরে থাকে। তাদের সঙ্গে এসে জুড়েছে জাপানিজ মাংগা, নিউ ওয়ার্ল্ড হরার, ফিলগুড কলেজ রোমান্স বা বুদ্ধিদীপ্ত সাইফি ফ্যান্টাসি। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ফ্যান্টাগ্রাফিক্স, ড্রন অ্যান্ড কোয়ার্টারলি, জোনাথন কেপ বা ফেবারের মতো বহু প্রকাশনা নিয়মিত লিটারারি গ্রাফিক নভেল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। সেখানে সারা দুনিয়ার শিল্পীরা কাজ করেন, ভিন্ন ভিন্ন আর্ট স্টাইল আর মানসিকতার মেলবন্ধন হয়। এই কাজগুলো সাধারণত বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলে অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এই বইটা আবিষ্কার করেছিলাম।
সত্যি বলতে, 'পিটার অ্যান্ড লিজা' তেমন এক্সক্লুসিভ কোনও কাহিনি বলতে চায়নি। শিল্পী ভূমিকাতে জানিয়েছেন, এখানে গল্প টল্প বিশেষ নেই। জীবনে যা হয়, তাই আছে। বিষণ্ণ অবস্থাতেও একটা শহরের বিষন্নতা কত সুন্দর হয়ে চোখে ধরা দিতে পারে, সেই কথা আছে। সাধারণ স্বার্থপর মানুষরাও সময় বিশেষে কত ভালো মুহূর্ত উপহার দেয়, আছে সে কথাও। বয়ে যাওয়া সময় আছে। বন্ধু বিচ্ছেদ, সম্পর্কের ভাঙাগড়া আছে, বোহেমিয়ান লাইফ আর অবসাদগ্ৰস্ততার মাঝে বেঁচে থাকা আছে। শীত আছে। পর্ণমোচী গাছের অপূর্ব সুন্দর সব নকশা আছে। বসন্ত আছে। বসন্তের ফুল আছে। ঋতুবদল আছে। প্রেম আছে। আর আছে জীবন।
পিটার কম্পালসারি আর্মি সার্ভিস শেষে শহরে ফিরেছে। কিন্তু এরপর সে কী করবে জানে না। তার সেনাবাহিনীর বন্ধুরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, কিন্তু পিটার কনফিউজড। এই কনফিউশনের একটা বড় কারণ, সে কবিতা লেখে। হৃদয়বিদারক সে কবিতা। যুদ্ধে ক্ষয়ে পড়া তার শহর নিয়ে, শহরের মানুষ নিয়ে। অন্যদের চেয়ে সে বেশি সংবেদনশীল, বেশি ভাবে, আবার ভাবেও না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে যে যুদ্ধ বিপর্যস্ত শহরে ভেসে যায় পিটার।
লড়াই থেমে গেছে অনেকদিন, কিন্তু শহরের স্বাভাবিক চরিত্র ফিরে আসেনি। ভাড়াবাড়ির অবস্থা খারাপ, লোকজনের হাতে পয়সা কম। তবু বোহেমিয়ান পাড়ায় রোজ পার্টি হয়, হইহল্লা চলে, নাচানাচি হুল্লোড় চলে। উদ্দাম জীবনের এই ব্যাকরণ মেনে পিটারও বন্ধুদের সঙ্গে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে ঘুরছে, কিন্তু শত মানুষের ভিড়েও তাঁর চোখ অন্যমনস্ক, সেখানে বিষাদের ছোঁয়া। এমন সময় লিজার সঙ্গে তার আলাপ। সে একজন ব্যালে ডান্সার। দুজনের সাক্ষাৎ হয়, সম্পর্ক গড়ায় লিভ ইনে। লিজার সঙ্গ পেয়ে পিটারের জীবন রঙিন হতে শুরু করে। তার ফ্যাকাসে জীবনের মরুভূমিতে সে একটা মরুদ্যান খুঁজে পেয়েছে। সময় কাটে, বছর গড়ায়। পিটার লিখতে চায়। কিন্তু কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। খুচরো কাজ করতে করতে, ফ্ল্যাটে হাউসপার্টি করতে করতে, ভাড়াবাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে আর লিজার সঙ্গে একইভাবে প্রেম করতে করতে দেখা যায়, পিটারের সেই অবসাদ আবার ফিরে আসছে। ক্রমে সেই বিষাদ বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের সম্পর্ককে শেষ করে দেয়। কিন্তু ...জীবন থেমে থাকে না কারোরই। সময় কাটতে থাকে। দুজনেরই বয়স বাড়ছে। বহু বছর পর তাদের আবার দেখা হয়। ততদিনে তারা আলাদা মানুষ, কিন্তু কোথাও না কোথাও পিটার এখনও সেই পিটার, লিজা এখনও সেই লিজা।
ন্যারেটিভ এগিয়েছে একবার পিটার, একবার লিজার বয়ানে। তাড়াহুড়ো নেই। গল্প বলার চেষ্টা নেই। খালি ফ্ল্যাট আছে, সেখানে উড়ন্ত পর্দা আছে, বাইরে পত্রহীন গাছের সারি আছে। বেড়াল আছে, কুকুর আছে। মদের বোতলের গড়াগড়ি, সিংকে জমানো এঁটো বাসনের ডাঁই আছে। বিকল গাড়ির গোদাম আছে। মানুষও আছে তাদের হরেকরকম জীবন নিয়ে, জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা তাদের নীরব অলিখিত কবিতা নিয়ে। লিখিত কবিতাও আছে, সর্বত্র।
মিরোস্লাভ সেকুলিক-স্ট্রুজা প্রাণবন্ত ভাবে চরিত্রদের আর তাদের সময়টা ধরেছেন। gouache আর watercolor, দুই ঘরানার আঁকাকেই একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হল, যদিও আর্ট নিয়ে আমার জ্ঞান খুবই ভাসাভাসা। রঙের ছয়লাপ, কিন্তু মেজাজটা বিষন্ন, এমন বহু জায়গা আছে। আবার ফিকে প্যানেলে পর পর আঁকা, কিন্তু বেশ একটা হ্যাপি মোমেন্ট ধরা পড়ছে, এমন জায়গাও আছে। বোহেমিয়ান পাড়া, ডাইভ বার, ঘরের পিছনের ঘর এবং জনাকীর্ণ নগরীর দৃশ্যের বোহেমিয়ান পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলেছে তাঁর আঁকা। গোটা ন্যারেটিভটাই 'ব্লিক', সেখানে মাঝেমধ্যে আশার আলো দেখা যায়।
সব নিয়ে মন্ত্রমুদ্ধ করে দেওয়া বই। গল্পের বদলে জীবন পড়ার/দেখার ইচ্ছে হলে এই কাজটা পড়তে পারেন।
পিটার অ্যান্ড লিজা
ফ্যান্টাগ্রাফিক্স