শনিবার, ১০ মে, ২০২৫

বাংলার লুপ্তপ্রায় কেবিন সংস্কৃতি

 


৯ঋকাল বুকস পরপর মচৎকার সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে। দু একটা কেনা হয়, আবার কিছু কিছু আনালেও পড়া হয় না, বা পড়তে পড়তে বছর ফুরিয়ে আসে। যাই হোক, এই বছরের দু একটা টার্গেটেড বইয়ের মধ্যে এটা অন্যতম ছিল, অনেকেই প্রচ্ছদ দেখে আগ্রহী হয়েছিলেন যতদূর মনে পড়ছে। তারপর খুব বেশি পোস্ট ফোস্ট দেখিনি, তাই একটা ছোটকু পোস্ট। বড় পোস্ট দিয়েও লাভ নেই। আজকাল বাজারে এসব চলছে না। ফেসবুক হয়তো ভ্যানিশই করে দিল, যেমন করে অর্ধেক কেবিন রেস্তোরাঁ ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে...

যাই হোক, গ্রন্থভাবনা থেকে স্ট্রাকচারিং, সব বিষয়েই যথারীতি লিরিকালিয় যত্নের ছাপ বিদ্যমান। সে অবশ্য প্রকাশনার সব বইতেই থাকে, আলাদা করে বলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

এখানে ঘটনা হল, লেখক তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে, সংকলনটা বানাতে কতটা খাটাখাটুনি করতে হয়েছে। খুঁজে খুঁজে এক একটা লেখা সংগ্রহ করা অত সহজ লয়!

কে নেই? অরণি বসু থেকে দামু মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় থেকে সুনেত্রা সাধু, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে যশোধরা রায়চৌধুরী...আছেন রঞ্জন রায়, সুনীল কুমার পাল, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত প্রভৃতি। তাবড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন লেখকও আছেন, যিনি এই প্রথম একটা লেখা ছাপালেন।

বইটি ভাগ করা হয়েছে এই পাঁচটি বিভাগে।


এক কেবিনের মধ্যে আরেকটা কেবিন

কিসসা কেবিন কা

কলকাতার কেবিন কড়চা

জেলায় জেলায় দুজনে কূজনে

হারিয়ে যাওয়া কেবিনের দিন

চেনা অচেনা কেবিননামা


প্রতিটা বিভাগেই চার পাঁচটা করে লেখা আছে। এছাড়া অতিরিক্ত সংয়োজন, টীকা ইত্যাদি অতিরিক্ত বিভাগও আছেই, যেমন থাকে। লেখায় যে সমস্ত কেবিনের উল্লেখ আছে, সেই কেবিনের ঠিকানা আর বর্তমানে বন্ধ আছে না খোলা আছে সেসবও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রসনাপ্রেমিকদের কথা ভেবে।

সংকলনের কিছু কিছু লেখা স্বাভাবিকভাবেই পরে খুঁজে যোগ করা হয়েছে, তাতে অতীতের রোমান্স আর নস্টালজিয়া থাকলেও 'কেবিন' সেই অর্থে নেই, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কেবিন নিয়ে এক্সক্লুসিভ লেখা হলেও অনেকেই হয়তো বসন্ত কেবিন/দিলকুশা/সাঙ্গুভ্যালি ইত্যাদি জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি শুধু নামেই, কারণ সকলের চোখ আর মন নিজের, সেই জায়গাটা সম্পর্কে স্মৃতি আর আবেগ প্রত্যেকের আলাদা।

এমনিতেও এই সংলকনে, কেবিন নিয়ে লেখা মানে শুধু কেবিন চরিত নয়, পাশাপাশি কলকাতা ও বাংলার ইতিহাসের নানান খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। সমাজ, পরিবার, মূল্যবোধ, সাহিত্য, রাজনীতি, রন্ধনশিল্প, সংস্কৃতি, সিনেমার কথা সাবলীলভাবে জড়িয়ে গেছে আলেখের সঙ্গে। কোন কেবিন রেস্তোরাঁয় কোন সাহিত্যিক আসতেন, কোন অভিনেতা কেবিন রেস্তোরাঁ থেকে মোগলাই প্যাক করে নিয়ে যেতেন... এসব যেমন আছে, ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশও ঘটেছে ইতিউতি।

গৌতম বসু মল্লিকের কলমে 'আড্ডা, প্রেম ও কেবিনকথা' ওপেনিং কলম হিসেবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য, তথ্যবহুল লেখা। কিন্তু আমার মন ছুঁয়ে গেছে দেবদত্ত গুপ্তের 'চপলেট কাটলেট রমাকান্তর কেবিন'। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনেকে হাহুতাশ করেছেন সে যুগে কেবিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রেম করা হল না বলে, অনেকে আবার কেবিনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া স্টুডেন্ট লাইফের নোলার কাহিনিই লিখেছেন ঘি গরমমশলা দিয়ে। কেউ কেউ বদলে যাওয়া সমাজ নিয়ে কমেন্ট্রি করেছেন, কেউ আবার অনুসন্ধান করেছেন স্পেসিফিক কেবিন রেস্তোরাঁর রসুই রহস্য।

এত এত কেবিন সর্বস্ব লেখাতেও দামুবাবু যথারীতি নিজস্বতা বজায় রেখে আউট অফ দ্য স্টেডিয়াম ছয় আঁকড়েছেন। যাঁরা রহস্য গল্প লিখবেন বলে হাত পাকাচ্ছেন, অ্যাটমস্ফিয়ার ক্রিয়েট করার বিদ্যাটা তাঁর লেখা পড়ে আয়ত্ত করে ফেলুন। 'পাহাড়ের কেবিনগাথা' অমনভাবে আর কেউই লিখতে পারত না। কুমারপ্রসাদের লেখায় আলিসাহেবের একাধিক ঘটনা পড়ে যারাপরনাই প্রীত হলাম। দারুণ লেগেছে সুনেত্রা সাধুর 'আড়াল আর আগুন স্মৃতি'।

সব নিয়ে ফাটাফাটি সংকলন। যাঁরা জীবনে ডেটিং সাইট বা কেবিন লাইট কিছুই পাননি আমার মতো, বই পড়েই পাপখণ্ডন করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন