রবিবার, ৪ মে, ২০২৫

অপ্রাগৈতিহাসিক

 


কল্পবিশ্বের হাত ধরে যে প্রতিভাবান স্পেকফিক লেখকদের একটা ব্যাচ উঠে এসেছে, তাতে সোহম গুহ-এর নাম আলাদা করে বলতেই হয়। ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সোহমের কয়েকটা গল্প পড়েই আমি তাঁর ছকভাঙা লেখার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিষয়বস্তু ও চিন্তাভাবনার দিক থেকে অভিনব তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা, সোহমের কলম যে কল্পবিজ্ঞান লেখে, তাতে 'বাঙালি পাঠক ও জিনিস বুঝবে কি না! একটু সহজ করে লিখব নাকি?' জাতীয় মেন্টাল ব্লকেজ থাকে না।

যা থাকে, তা হল এই ভাবনাটা। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে কল্পবিজ্ঞান লিখতে বসেছি যখন, এই যুগের সেরা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সঙ্গেই পাল্লা দিতে হবে, তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে, স্ট্রেট অ্যান্ড সিম্পল। এখন, এই অ্যাস্পিরেশন হয়তো অনেকেরই থাকে, কিন্তু সত্যি কথা হল, অ্যাস্পিরেশন থাকলেই তো হয় না, একটা বিশেষ ঘরানায় নিজের লেখাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে, আন্তর্জাতিক করে তুলতে হলে, বহুস্তরীয় করে তুলতে হলে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়। আমি সেরা কল্পবিজ্ঞান লিখতে চাই, আবার সেরা ঐতিহাসিক গল্পও লিখব, অসামান্য সামাজিক কাহিনি লিখব, মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথাও লিখে দেব ঝটপট... ওসব শুনতেই ভালো লাগে। বাস্তবে, জিনিয়াস বাদে অমন কেউ করতে পারে না। আমার যতদূর ধারণা, সোহম জানেন, তিনি স্রেফ কল্পবিজ্ঞান লিখবেন এবং মন দিয়ে লিখবেন। সেই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছেন, হোমওয়ার্ক করেছেন, করছেন, বইপত্রের পাশাপাশি আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের চলন ও দর্শন তিনি একদম গুলে খেয়েছেন। না খেয়ে থাকলে 'অপ্রাগৈতিহাসিক' এর মতো লেখা বেরোতে পারে না।

বইটা পড়েছি বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু আপাতত বইটা সঙ্গে নেই বলে বিস্তারিত আলোচনা লেখা একটু মুশকিল। কিন্তু এমন একটা উচ্চাকাঙ্খী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে যে পরিশ্রম লেগেছে, সে নিয়ে স্পেকফিক আগ্রহী পাঠক হিসেবে দু চার লাইন লিখে রাখলে অন্যায় হবে না।

প্রথমেই, অতি সংক্ষিপ্ত সামারি।

'অপ্রাগৈতিহাসিক' আসলে কী নিয়ে? প্রথমেই জেনে রাখা ভালো, টেকনিক্যালি বইটির নাম 'অপ্রাগৈতিহাসিক: প্রথম পর্ব (ঈশ্বরের বাগান)' এবং এ-ই বইটি একটা ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। তেলেঙ্গানার বেআইনি খনিতে কয়েক কোটি বছর পুরোনো একটা ফসিলে মানুষের জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে, সেই কথা চাউর হতে একাধিক দেশের বিজ্ঞানী ও সরকার নড়েচড়ে বসেছেন। এবং সেই সূত্রে একটা অভিযানের সূচনা হয়, যা এই বইটির মূল বিষয়বস্তু। এটুকুতে আশা করি প্লটের কোনও স্পয়লার দেওয়া হল না।

বাট ওয়েট, ডিড আই সে প্লট? বাট ওয়েট, প্লট ইজ নট দ্য অনলি কি থিং হিয়ার! প্লট আছে, কিন্তু শুধুই প্লট থাকলে এই বইয়ের কথা লিখতে হত না। হুম, এখানে দু এক কথা আরো বলে রাখি! বইটা পড়ে আমার অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে যা মনে হয়েছিল সেইটুকুই, কারণ লেখক বা অন্যান্য পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতা বা ইন্টারপ্রিটেশন আমার চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে।

'অপ্রাগৈতিহাসিক' ভীষণ একটা চনমনে সাস্পেন্স থ্রিলারের ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে। একের পর এক রহস্য, অজানা তথ্য, প্রাগৈতিহাসিক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যুগের স্টেট অফ দ্য আর্ট টেকনোলজির তাকলাগানো তথ্য, এবং মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া জটিল সব প্রশ্ন একে অপরের সঙ্গে মিশে একটা স্পাইডারনেট তৈরি করেছে। অনেক পাঠক হয়তো ভাবছেন বইটা একদম টেকনো থ্রিলারের ভঙ্গিতে শেষ লাইন অব্দি আপনাকে এজ অফ দ্য সিটে বসিয়ে রাখবে। মারকাটারি অ্যাডভেঞ্চার হবে ক্রিকটনের বইয়ের মতো। আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু না, বইটার মাঝামাঝি গিয়ে আমার মনে হয়েছে, 'ওই বইটা' লেখক লিখতে চাননি। এখানে রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটছে পরপর, সার্ভাইভালের জন্য দাঁত চাপা লড়াই আছে, গায়ের রোম দাঁড় করানো ঘটনা আছে, অ্যাড্রেনালিন রাশ আছে, গতিও আছে, কিন্তু সেই সব ছাপিয়ে কেন এই বইটা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে তার কারণ হল, বইটা আসলে একটা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটা বিশেষ দর্শনকে অবলম্বন করে এগিয়েছে, যার নাম পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম।

এখন ওপর ওপর দেখলে মনে হয় পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এমন আর কী নতুন জিনিস? ট্রাডিশনালি একরকম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি লেখা হত, তাতে অনুমান করা হত বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে হতে এমন একটা সময় আসবে যখন এই সমস্ত চমৎকার জিনিস থাকবে কিংবা তার ফলে কিছু কিছু ক্রাইসিস তৈরি হবে। কিন্তু পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এই বিশ্বাসটাকেই চ্যালেঞ্জ করে। এখন technological determinism কে চ্যালেঞ্জ করে বলা যে এআই এলে এই সমস্যা হবে বা রোবটরা বেশি শক্তিশালী হলে মানুষকে দাস হয়ে থাকতে হবে খুবই প্রাথমিক লেভেলের কল্পনা, সে নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে। কিন্তু সমকালীন post-paradigm shift আরো অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন তুলছে, সেখানে আসলে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব চেতনা আর মরালিটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা দুর্ঘটনা কীভাবে সমগ্র মানবজাতিকে একটা নৈতিক দ্বন্দের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই পিসিপি ঘরানার প্রধান অস্ত্র।

সেখানে কিছুই নিশ্চিত নেই, সবই ধোঁয়াশা! যদি বিজ্ঞানের অগ্রগতির পূর্বপরিকল্পিত ভাবনাটাই মিথ্যা বলে জানা যায়? মানুষ বা মহাকাশ বা সময়ের যে প্রমাণিত কন্সেপ্ট আছে, তাই যদি বদলে যায়? সত্যি বলতে, বাস্তবেও scientific dogmatism এর দিন চলে গেছে। দিন দিন নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে, তার ফলে বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুই রিভিজন করতে হচ্ছে। এর বিকল্প নেই, কারণ 'নতুন' বিজ্ঞান বলছে 'পুরোনো' বিজ্ঞান ভুল, আবার 'ভবিষ্যতের বিজ্ঞান' ও 'বর্তমানের বিজ্ঞান' কে ভুল বলবে বলে অনেকের বিশ্বাস। কে জানে? এই বাস্তবতাবোধ, এই এপিস্টেমিক হিউমিলিটির ফলে মানবজাতির সত্তা ও অস্তিত্বের ধারণাই এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে কোনও কিছুর নিশ্চয়তা নেই।

পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম শিফটে এ-র সঙ্গে ঢুকে গেছে পোস্টমর্ডানিজম আর সিউডোসায়েন্সের নানান ধারণা। নতুন প্রযুক্তির ভুল এবং ইনএফিসিয়েন্সির ফলে নানারকমের পারশেপশন তৈরি হচ্ছে। এই যেমন, যে অ্যাপে টাইপ করছিলাম, সেখানে ইংরেজি শব্দ Dogmatism টাইপ করতেই বাংলায় 'কুকুরজাতীয়' লিখে দিল, Paradigm কে প্যারাডাইম না লিখে প্যারাডিগম লিখে ফেলল, epistemic কে 'জ্ঞানমূলক' করে দিল। অটোকারেক্টের তো যা তা অবস্থা! এখন আমি ভাবছি প্রযুক্তিটা ইনএফিসিয়েন্ট, কিন্তু তবু আমরা গুগল টাইপিং আর ট্রান্সলেট ব্যবহার করছি। এখানেই একটা গোটা জাতির দ্বন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বেলাইনে চলে এসেছি। এ নিয়ে বিশদে বলা এখানে অসম্ভব। কিন্তু বটমলাইন হল, আধুনিক কালে এই দর্শনকে অবলম্বন করে লেখা কল্পবিজ্ঞানে মূলত সময়, ইতিহাস, প্রযুক্তি এবং মানুষের অস্তিত্বচেতনার জটিল প্রশ্নগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই বইগুলো শুধুই বিজ্ঞাননির্ভর অনুসন্ধানের গল্প বলে না, বরং মানবচেতনার দার্শনিক দিকগুলো নিয়ে একটা কাহিনি বুনে তোলে। 'অপ্রাগৈতিহাসিক' ও তার ব্যাতিক্রম নয়।

আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের যে আরেকটি বিশেষত্ব এই উপন্যাসে পুরোদমে আছে, তা হল কল্পকাহিনির মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ার কথা তুলে ধরে। সহজ হিসেব হল, কল্পবিজ্ঞান আসলে আগামীর গল্প নয়, সার্থক কল্পবিজ্ঞান চিরকাল বর্তমানের কাহিনি বলতে চেয়েছে। মোড়ক যা ইচ্ছে হতে পারে, রূপক যা ইচ্ছে ব্যবহার করা যেতে পারে, মহাকাশ থেকে জলের নিচে, হাজার বছর পরের দুনিয়া বা হাজার বছর আগের দুনিয়ায় কাহিনি থাকলেও, আসলে তা আজকের গল্প। লেখায় বর্তমানের প্রতিফলন না থাকলে, সোশিওলজিকাল কন্টেক্সট না থাকলে, এই সময়ে অনুভব করা অসহায়তাগুলো লেখায় ফুটিয়ে না ওঠাতে পারলে সেই কল্পবিজ্ঞান কোনও কাজের নয়। এখন যদি কোনও পাঠক সায়েন্স ফিকশনে শুধু উদ্ভট গ্যাজেট খুঁজছে, এলিয়েন খুঁজছে আর রাজনীতি আর সোশ্যাল রিয়ালিটির আলোচনা/সংলাপ পেলেই হাই তুলছে, তাহলে তা পাঠকদের সমস্যা, সায়েন্স ফিকশন বা তার লেখকদের নয়। না না, আমি বলছি না, বিদ্বজনেরা বলছেন।

সেই জায়গা থেকে সোহমের উপন্যাস টপনোচ। প্রথম বইতেই তিনি যথাসম্ভব সোশ্যাল রিয়ালিটি দেখিয়েছেন, ক্রাইসিসটাকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বুনেছেন, পাঠকদের অনাদি-অনন্ত বিস্তৃত জটিল সায়েন্টিফিক-এথনিক ডিলেমার মাঝে ফেলেছেন, এবং যতটা সম্ভব রোমাঞ্চ আর গতি বজায় রেখেছেন। তার ভাষাটাও ঠিক চিরাচরিত বাংলা নয়, একদম ঝরঝরে স্বতঃস্ফূর্ত বাংলা বলতে যা বোঝায় তা নয়, ইংরেজি স্পেকফিকে যে ধরনের ভাষা বা বাক্যগঠন থাকে, অনেকটা সেই ধাঁচের। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি, পাঠসুখে ব্যাঘাত ঘটেনি, বরং ব্যাপারটা লেখকের ক্রিয়েটিভ চয়েজ বলেই মনে হল। মেলভিল বা ম্যারি ডোরিয়া রাসেলের মতো অনেকেই গতানুগতিক ইংরেজি বর্জনকে একটা নিজস্ব ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন, খানিকটা সেরকমই। আরো খোলতাই ভাষা হলে পড়তে বেশি ভালো লাগত না লাগত না, সেটা আপাতত বোঝার উপায় নেই।

যাই হোক, বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জগতে এই বইটি এবং সিরিজটি অতি প্রয়োজনীয় সংয়োজন হতে চলেছে, সেটুকু স্বীকার না করে উপায় নেই। যাঁরা সিরিয়াস সাই ফাই নিয়ে ইন্টারেস্টেড, এই বইটা মিস না করাই ভালো। আপাতত দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায়।

অপ্রাগৈতিহাসিক
সোহম গুহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন